নিরপেক্ষতার দাবি ও তারুণ্যের অঙ্গীকার by ডা. ওয়াহিদ নবি
ইদানীংকালের আধুনিক লংমার্চ ও জনসভায় চারদলীয় জোটের অনেক দাবিদাওয়া ও বক্তব্য শোনা গেছে। এর মধ্যে মুখ্য দাবি বলে যা মনে হয়েছে, তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান। মুখ্য অঙ্গীকার বলে মনে হয়েছে তরুণ প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। অবশ্যই অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছে, কিন্তু আজ আমরা বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের মুখ্য দাবি ও অঙ্গীকার এবং প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে দু-একটি কথা বলতে চাই।
খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে বলেছেন যে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। তাঁদের কথায় এর কারণ পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। তিনি এবং তাঁর জোট মনে করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। এখানে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি নিয়ে বা এই পদ্ধতির পটভূমি নিয়ে একটু আলোচনা করে নিলে মন্দ হয় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছিল ১৯৯৬ সালে। এর কারণ ছিল সাধারণ নির্বাচনের, বিশেষ করে মাগুরার উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগের দাবির কারণ ছিল নিরপেক্ষতার প্রত্যাশা। তখন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, 'শুধু শিশু ও উন্মাদরা নিরপেক্ষ।' এখন পাশা উল্টে গেছে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় আর আওয়ামী লীগ চায় না। এর মধ্যে দেড় দশক সময় পেরিয়ে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে কথা হয়েছিল তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার। আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে যে গত দেড় দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ও অন্যান্য বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা কেমন? এই অভিজ্ঞতা আমাদের মানসিকতার ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করেছে কি? দেড় দশকে আমরা মনন প্রক্রিয়ায় কিছু উন্নত হয়েছি কি?
গত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দুটি প্রধান বিষয় চোখে পড়ে। একটি হচ্ছে, বিএনপি জোটের বিশাল পরাজয়। আর অপরটি হচ্ছে ২০০১ সালের নির্বাচনের তুলনায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা এক কোটি ২২ লাখ কম। নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে খালেদা জিয়া ও চারদলীয় জোট নেতারা যা বলেছেন তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। অর্থাৎ চারদলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের তুলনায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে এক কোটি ২২ লাখ ভোটার কম হওয়ার কারণ এই হতে পারে যে ২০০১ সালে ভোটার সংখ্যা ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়ানো হয়েছিল, কারণ ভুলের জন্য বা অনুপযুক্ততার জন্য এত বড় ভুল হতে পারে না। নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য আওয়ামী লীগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতায় সন্দেহ প্রকাশ করেছে অতীতে। তাহলে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা কোনো সময়ই উভয় জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অংশ হলেও তারা এক ও অভিন্ন, এটা ধরে নেওয়া হয়তো ঠিক হবে না। দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান নির্বাচন কমিশন উপযুক্ততার সঙ্গে কাজ করেছে। তারা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ভোটার তালিকার আধুনিকীকরণ করেছে। যুক্তি-প্রমাণসহ তাদের বিরুদ্ধে কেউ অনুপযুক্ততার অভিযোগ আনেনি। ২০০১ সালে নির্বাচনের বিজয়ীরা ২০০৮ সালের ভোটার সংখ্যা কমতিকে মেনে নেয়নি। অর্থাৎ ২০০৮ সালের নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ভোটার তালিকাকে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অর্থটা এই দাঁড়াল যে নির্বাচন কমিশনগুলোর উপযুক্ততার ব্যাপারেও উভয় জোট একমত নয়। অবশ্য নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে উপযুক্ততা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সংবিধানের ৫৮ ধারার গ(১) উপধারা অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির অগ্রাধিকার প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার। তিনি রাজি না হলে তারপর পর পর বেশ কয়েকটি বিকল্পের সুযোগ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন। তাঁর আগে যাঁরা প্রধান উপদেষ্টা হতে পারতেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। কাজেই তিনি বা তাঁর দলের লোকরা তাঁকে সহজেই প্রধান উপদেষ্টা বানাতে পারেন। অনেকে মনে করে যে ইয়াজউদ্দিন সাহেব এভাবেই প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কাল সম্বন্ধেও সংবিধানে স্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। ১২৩ ধারা অনুযায়ী গণপরিষদ ভেঙে দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। ৫৮ ধারার ১২ উপধারা অনুযায়ী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা আছে সংবিধানে। কিন্তু নানা কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া আর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া একই সময়ে না-ও হতে পারে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমাতায় ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। সরকারের দৈনন্দিন কাজ করা তাদের আর একটি দায়িত্ব। কিন্তু গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী করেনি? খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন তিনি তরুণ প্রজন্মের হাতে নেতৃত্ব হস্তান্তর করতে চান। অবশ্যই আমাদের সবাইকে একদিন বলতে হবে, 'আমার দিন ফুরাল সন্ধ্যা হলো।' সন্ধ্যার ম্রিয়মাণ আলোকে ক্ষীয়মাণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি আমাদের সবাইকে নিতে হবে। আর তারুণ্যের প্রতি আমাদের একটা আকর্ষণ তো রয়েছেই। কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। তারুণ্য বলতে আমরা কী বুঝি? সোজা বাংলায় কত বছর বয়সে তারুণ্যের শুরু আর কত বয়সে শেষ? সব পরিস্থিতিতেই কী তারুণ্যের একই সূচনা ও সমাপ্তি? একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের তারুণ্যের যেখানে সমাপ্তি, একজন রাজনীতিবিদের তারুণ্যের সেখানে সমাপ্তি দূরের কথা সূচনা হয় কি? রাজনীতিবিদ হিসেবে কাকে তরুণ বলা হবে? আগামী নির্বাচনের সময় যে রাজনীতিবিদদের বয়স ৫০ হবে তাদের তরুণ বলা যাবে কি? এই প্রশ্নটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে তা সবাই বুঝবে। আর একটা হচ্ছে এই যে যদি তিনি তরুণ কোনো একজনের হাতে ক্ষমতা দিতে চান, তবে তা নির্বাচনের আগেই করতে হবে এবং এখনই তার প্রকৃষ্ট সময়। নতুন নেতা নির্বাচিত হবেন_এটা সবাই চাইবে। আগামী নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে তিনি তাঁর নেতৃত্বের উপযুক্ততা প্রমাণ করবেন_এটাই হবে জনগণের প্রত্যাশা। এসব করতে গেলে ভবিষ্যৎ নেতার কিছু সময়ের প্রয়োজন। আর নেতা নির্বাচন করতে গেলে সে জন্যও কিছু সময়ের প্রয়োজন। এসব কথা চিন্তা করলে দেখা যায় যে দলের ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করার এটাই সময়। আর তিনি যদি তা না করেন, তবে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেবে। হয়তো তারা ভাববে রাজনীতিবিদদের আর একটা প্রতিজ্ঞা। দুর্ভাগ্যবশত রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে মানুষের আস্থা কম। কিংবা মানুষ হয়তো ভাববে খালেদা জিয়া ক্ষমতা হাতে পেলে সন্তানদের দেশে ফেরত আনবেন। তাদের মামলা প্রত্যাহার করবেন। দণ্ড পেলে সেসব মওকুফ করবেন। একটা উপনির্বাচনে জিতিয়ে এনে তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এমনটা হলে জনগণ খুশি হবে না।
আমরা দেখলাম যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়োগ পদ্ধতি নিখুঁত নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কাল অস্পষ্ট। ক্ষমতা হাতে পেলে যদি তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তবে তাদের বিরত করার কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থা নেই। সময়কাল স্পষ্ট না হওয়ায় তারা যত দিন ইচ্ছা ক্ষমতায় থাকতে পারে। কাজেই নিরপেক্ষতার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যুক্তিসম্পন্ন নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই এবং কোনোকালে ছিল না। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বাড়াতে হবে যদি আমরা গণতন্ত্র চাই, যদি নতুন প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তবে তার প্রক্রিয়া এখনই শুরু করতে হবে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কলামিস্ট
গত নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দুটি প্রধান বিষয় চোখে পড়ে। একটি হচ্ছে, বিএনপি জোটের বিশাল পরাজয়। আর অপরটি হচ্ছে ২০০১ সালের নির্বাচনের তুলনায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা এক কোটি ২২ লাখ কম। নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে খালেদা জিয়া ও চারদলীয় জোট নেতারা যা বলেছেন তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। অর্থাৎ চারদলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের তুলনায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে এক কোটি ২২ লাখ ভোটার কম হওয়ার কারণ এই হতে পারে যে ২০০১ সালে ভোটার সংখ্যা ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়ানো হয়েছিল, কারণ ভুলের জন্য বা অনুপযুক্ততার জন্য এত বড় ভুল হতে পারে না। নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য আওয়ামী লীগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতায় সন্দেহ প্রকাশ করেছে অতীতে। তাহলে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা কোনো সময়ই উভয় জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অংশ হলেও তারা এক ও অভিন্ন, এটা ধরে নেওয়া হয়তো ঠিক হবে না। দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান নির্বাচন কমিশন উপযুক্ততার সঙ্গে কাজ করেছে। তারা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ভোটার তালিকার আধুনিকীকরণ করেছে। যুক্তি-প্রমাণসহ তাদের বিরুদ্ধে কেউ অনুপযুক্ততার অভিযোগ আনেনি। ২০০১ সালে নির্বাচনের বিজয়ীরা ২০০৮ সালের ভোটার সংখ্যা কমতিকে মেনে নেয়নি। অর্থাৎ ২০০৮ সালের নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ভোটার তালিকাকে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অর্থটা এই দাঁড়াল যে নির্বাচন কমিশনগুলোর উপযুক্ততার ব্যাপারেও উভয় জোট একমত নয়। অবশ্য নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে উপযুক্ততা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সংবিধানের ৫৮ ধারার গ(১) উপধারা অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির অগ্রাধিকার প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার। তিনি রাজি না হলে তারপর পর পর বেশ কয়েকটি বিকল্পের সুযোগ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন। তাঁর আগে যাঁরা প্রধান উপদেষ্টা হতে পারতেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। কাজেই তিনি বা তাঁর দলের লোকরা তাঁকে সহজেই প্রধান উপদেষ্টা বানাতে পারেন। অনেকে মনে করে যে ইয়াজউদ্দিন সাহেব এভাবেই প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কাল সম্বন্ধেও সংবিধানে স্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। ১২৩ ধারা অনুযায়ী গণপরিষদ ভেঙে দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। ৫৮ ধারার ১২ উপধারা অনুযায়ী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা আছে সংবিধানে। কিন্তু নানা কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া আর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া একই সময়ে না-ও হতে পারে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমাতায় ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। সরকারের দৈনন্দিন কাজ করা তাদের আর একটি দায়িত্ব। কিন্তু গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী করেনি? খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন তিনি তরুণ প্রজন্মের হাতে নেতৃত্ব হস্তান্তর করতে চান। অবশ্যই আমাদের সবাইকে একদিন বলতে হবে, 'আমার দিন ফুরাল সন্ধ্যা হলো।' সন্ধ্যার ম্রিয়মাণ আলোকে ক্ষীয়মাণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি আমাদের সবাইকে নিতে হবে। আর তারুণ্যের প্রতি আমাদের একটা আকর্ষণ তো রয়েছেই। কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। তারুণ্য বলতে আমরা কী বুঝি? সোজা বাংলায় কত বছর বয়সে তারুণ্যের শুরু আর কত বয়সে শেষ? সব পরিস্থিতিতেই কী তারুণ্যের একই সূচনা ও সমাপ্তি? একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের তারুণ্যের যেখানে সমাপ্তি, একজন রাজনীতিবিদের তারুণ্যের সেখানে সমাপ্তি দূরের কথা সূচনা হয় কি? রাজনীতিবিদ হিসেবে কাকে তরুণ বলা হবে? আগামী নির্বাচনের সময় যে রাজনীতিবিদদের বয়স ৫০ হবে তাদের তরুণ বলা যাবে কি? এই প্রশ্নটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে তা সবাই বুঝবে। আর একটা হচ্ছে এই যে যদি তিনি তরুণ কোনো একজনের হাতে ক্ষমতা দিতে চান, তবে তা নির্বাচনের আগেই করতে হবে এবং এখনই তার প্রকৃষ্ট সময়। নতুন নেতা নির্বাচিত হবেন_এটা সবাই চাইবে। আগামী নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে তিনি তাঁর নেতৃত্বের উপযুক্ততা প্রমাণ করবেন_এটাই হবে জনগণের প্রত্যাশা। এসব করতে গেলে ভবিষ্যৎ নেতার কিছু সময়ের প্রয়োজন। আর নেতা নির্বাচন করতে গেলে সে জন্যও কিছু সময়ের প্রয়োজন। এসব কথা চিন্তা করলে দেখা যায় যে দলের ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করার এটাই সময়। আর তিনি যদি তা না করেন, তবে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেবে। হয়তো তারা ভাববে রাজনীতিবিদদের আর একটা প্রতিজ্ঞা। দুর্ভাগ্যবশত রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে মানুষের আস্থা কম। কিংবা মানুষ হয়তো ভাববে খালেদা জিয়া ক্ষমতা হাতে পেলে সন্তানদের দেশে ফেরত আনবেন। তাদের মামলা প্রত্যাহার করবেন। দণ্ড পেলে সেসব মওকুফ করবেন। একটা উপনির্বাচনে জিতিয়ে এনে তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এমনটা হলে জনগণ খুশি হবে না।
আমরা দেখলাম যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়োগ পদ্ধতি নিখুঁত নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কাল অস্পষ্ট। ক্ষমতা হাতে পেলে যদি তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তবে তাদের বিরত করার কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থা নেই। সময়কাল স্পষ্ট না হওয়ায় তারা যত দিন ইচ্ছা ক্ষমতায় থাকতে পারে। কাজেই নিরপেক্ষতার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যুক্তিসম্পন্ন নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই এবং কোনোকালে ছিল না। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বাড়াতে হবে যদি আমরা গণতন্ত্র চাই, যদি নতুন প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তবে তার প্রক্রিয়া এখনই শুরু করতে হবে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কলামিস্ট
No comments