৩৪টি বাণিজ্যিক ট্রলারের লাইসেন্স বরাদ্দঃ মাছ ধরবেন নেতারা! by মামুন আবদুল্লাহ
সরকার সমুদ্রে মাছ ধরতে ৩৪টি বাণিজ্যিক ট্রলারের লাইসেন্স দিয়েছে। লাইসেন্সগুলোর বেশির ভাগই পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা ও ঘনিষ্ঠজনেরা। তাঁদের মধ্যে একজন প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী, একাধিক সাংসদ ও শীর্ষপর্যায়ের নেতৃত্বের আত্মীয়স্বজনও রয়েছেন। লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশই মাছের ব্যবসা করে না। কিন্তু বরাদ্দপত্রের শর্ত অনুযায়ী তাঁদের এখন মাছ ধরার কথা। এর আগে ২০০৪ সালে একইভাবে তৎকালীন বিএনপি সরকারের নেতারাও লাইসেন্স পেয়েছিলেন।
সেসব ট্রলার এখন ব্যবসায়ীদের নামে চালু রয়েছে। নেতারা কেউ মাছ ধরার ব্যবসা করছেন না। ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, নতুন পাওয়া লাইসেন্স বিক্রির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। একটি লাইসেন্স এক থেকে দেড় কোটি টাকায় বিক্রির আলোচনা হচ্ছে। একটি নতুন ট্রলার আমদানি করতে ব্যয় হবে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। পাশাপাশি মাসে আরও এক থেকে দেড় কোটি টাকা ট্রলার পরিচালনার জন্য খরচ করতে হবে। এত সব ঝামেলায় না গিয়ে ট্রলারের লাইসেন্স বিক্রি করে দেওয়াকেই অর্থ আয়ের সহজ রাস্তা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশ।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশি সমুদ্রসীমায় বর্তমানে প্রায় আড়াই শ বাণিজ্যিক ট্রলার মাছ ধরছে। ব্যাপক পরিমাণে মাছ ধরার কারণে সাগরে মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন জরিপ ও গবেষকদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। বঙ্গোপসাগরে মাছের মজুদের বিস্তারিত জরিপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে কোনো ট্রলারের লাইসেন্স না দেওয়ার সুপারিশ রয়েছে দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটির। তা সত্ত্বেও দেওয়া হলো ট্রলারের আরও লাইসেন্স।
যাঁরা ট্রলার বরাদ্দ পেয়েছেন: নতুন ট্রলার বরাদ্দের প্রথম নাম হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর ছোট ছেলে। এর আগে তিনি এই সরকারের আমলেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি তেল পরিবহনের দুটি ট্যাংকারের (তেলবাহী জাহাজ) লাইসেন্স পান। ওই দুই ট্যাংকার দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
হেলাল উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ পরিবারের লোকজন এবার ট্রলার পেয়েছে। এ জন্য কাউকে এক টাকাও ঘুষ দিতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নিজে এসব ট্রলার বরাদ্দ দিয়েছেন। অথচ বিএনপি আমলে লাইসেন্সপ্রতি ২৫ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়ে ৫০টি নতুন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল।
হেলাল উদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, এবার যাঁরা বরাদ্দ পেয়েছেন তাঁরা সবাই আওয়ামী পরিবারের বঞ্চিত নেতা-কর্মী। রাজনৈতিক বিবেচনায় এই ট্রলার দেওয়া হয়েছে। এই সরকারের আমলে তাঁর নামে বরাদ্দ পাওয়া দুটি ট্যাংকার মেঘনা গ্রুপে ভাড়ায় খাটছে বলে তিনি জানান।
মেঘনা গ্রুপের একটি সূত্র জানায়, ভাড়ায় নয়, তাঁরা ট্যাংকার দুটি কিনে নিয়েছেন।
বরাদ্দ পাওয়ার তালিকায় এরপরই রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামানের ছেলে, সোনালী ব্যাংকের পরিচালক কে এম জামান ওরফে রোমেলের নাম। খন্দকার আসাদুজ্জামান সংস্থাপন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। প্রথম আলোকে কে এম জামান বলেন, ‘আগে আমাদের আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা ছিল। এটা এখন বহুমুখী করার চেষ্টা করছি।’
চট্টগ্রামের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত এম এ হান্নানের কানাডাপ্রবাসী ছেলে এস এম ফারুকও একটি ট্রলারের লাইসেন্স বরাদ্দ পেয়েছেন। বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদের স্ত্রী নূরান ফাতেমার নামও রয়েছে। প্রতিমন্ত্রীর গৃহিণী স্ত্রীকে বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিস নামে সদ্য গঠিত একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া আরও বরাদ্দ পেয়েছেন ঢাকার মিরপুরের সাংসদ আসলামুল হক (মাহিম ট্রেড লিংক), সাংসদ মীর্জা আজম (স্বর্ণালী ইন্টারন্যাশনাল), বরিশালের আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, খুলনার সাংসদ শেখ হেলালের আপন দুই ভাই শেখ সালাউদ্দিন ওরফে শেখ জুয়েল (মেসার্স ফারদিন ফিশ) ও শেখ জালাল উদ্দিন ওরফে শেখ রুবেল (মেসার্স জালাল করপোরেশন), আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নূরুল কাউয়ুম খান (এম এন ফিশিং), তাঁর স্ত্রী নাসরিন খান (প্রগ্রেসিভ ফিশিং লিমিটেড), চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আজম নাছির উদ্দিন (এমিউস ফিশিং লিমিটেড) এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্তের ভাই স্বপন চন্দ্র দত্ত (আপন ইমপোর্ট সেন্টার)।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর মৎস্য লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম ওরফে বাবুল সরকারও তাঁর প্রতিষ্ঠান মেসার্স সরকার ফিশ ট্রেডিংয়ের নামে একটি ট্রলারের লাইসেন্স পান। গত সংসদ নির্বাচনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সংসদীয় আসনে তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের এই ট্রলার আমি ব্যবসায়ী হিসেবে পেয়েছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী চাঁদপুরের যে আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন, সেখানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিল। কারণ সেখানে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে আমার শক্ত অবস্থান রয়েছে।’
ব্যবসায়ীদের মধ্যে মুছা মিয়া (কুলিয়ারচর গ্রুপ), মোস্তফা কামাল (মেঘনা গ্রুপ), চট্টগ্রামের বি দোজা অ্যান্ড কোম্পানির চেয়ারম্যানের স্ত্রী হামিদা দোজা, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতির ভাই রাশেদ মুরাদ ইব্রাহিম, ঢাকায় বসবাসরত চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম খান (এম এম ফিশিং) ও তাঁর স্ত্রী মিসেস মনোয়ারা বেগম (এম আর ফিশিং) একটি করে ট্রলারের লাইসেন্স পেয়েছেন।
সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীদের নামে বরাদ্দ দেওয়া ছয়টি লাইসেন্সও আওয়ামী লীগের নেতাদের নামে ছিল। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নামে বরাদ্দ করিয়ে নিয়েছেন।
জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারটা পেয়েছি সেটা বলব না, তবে কারও কারও নামে বরাদ্দের ট্রলার যে পেয়েছি এটা সত্য।’
যেভাবে বরাদ্দ: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে মৎস্য অধিদপ্তর আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ট্রলারের কিছুসংখ্যক ফিশিং লাইসেন্স দেওয়ার জন্য দরখাস্ত আহ্বান করে। আবেদনের জন্য ১০টি শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করার মতো আর্থিক সংগতি থাকতে হবে। মন্ত্রণালয় এ নিয়ে একটি যাচাই-বাছাই কমিটি করে। কমিটি যোগ্য বিবেচিত ৩৩০টি আবেদনপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায়। সেখান থেকেই ৩৪টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। শর্ত অনুযায়ী আগামী দুই বছরের মধ্যে এসব ট্রলার আমদানি করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ: বাণিজ্যিক ট্রলারের সাহায্যে সাগরে অপরিকল্পিতভাবে মাছ ধরা বন্ধ করতে সরকার ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম মাহাবুবুজ্জমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিল। কমিটি সাগরে মাছের মজুদের ওপর বিস্তারিত জরিপ না করা পর্যন্ত ঢালাওভাবে ট্রলারের লাইসেন্স না দেওয়ার সুপারিশ করে। ১৯৯৭ সালে মৎস্য অধিদপ্তরের চিংড়ি বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল করিমকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিও ট্রলার সংখ্যা ৭৮টিতে সীমিত রাখার প্রস্তাব দেয়।
এই সুপারিশমালার ভিত্তিতে সরকার ২০০০ সালে নতুন কোনো ট্রলার অনুমোদন না দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে। তার পরও বিগত সরকারের সময় লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, এবারও দেওয়া হলো। এবার প্রথমে ৩০টি লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে ৩৪টিতে উন্নীত করা হয়।
বাণিজ্যিক ট্রলার পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজালাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকেও আমরা বলেছিলাম সমুদ্রে মাছের মজুদ পরিস্থিতির ওপর বিস্তারিত জরিপ চালিয়ে তারপর ট্রলারের সংখ্যা নির্ধারণ করা হোক। কিন্তু সরকার তা না করে রাজনৈতিক কারণে ইচ্ছেমতো ট্রলারের লাইসেন্স অনুমোদন দিচ্ছে। এতে সামুদ্রিক মাছের আহরণ খাত বিপন্ন হয়ে পড়েছে।’
বিএনপি নেতাদের ৫০ লাইসেন্স ব্যবসায়ীদের হাতে: বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে ৫০টি নতুন ট্রলারের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। লাইসেন্সগুলো পান হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও বিএনপির নেতারা। এর মধ্যে ছিলেন মোরশেদ খান, লুৎফুজ্জামান বাবর, মির্জা আব্বাস, আলী আজগার লবী, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন, সরোয়ার জামাল, হাফিজ ইব্রাহিম, ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মুফতি ইজহারুল হক, ব্যবসায়ী বাবুল কাজী, সলিমুল হক প্রমুখ। এসব লাইসেন্স প্রতিটি ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকায় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশি সমুদ্রসীমায় বর্তমানে প্রায় আড়াই শ বাণিজ্যিক ট্রলার মাছ ধরছে। ব্যাপক পরিমাণে মাছ ধরার কারণে সাগরে মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন জরিপ ও গবেষকদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। বঙ্গোপসাগরে মাছের মজুদের বিস্তারিত জরিপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে কোনো ট্রলারের লাইসেন্স না দেওয়ার সুপারিশ রয়েছে দুটি বিশেষজ্ঞ কমিটির। তা সত্ত্বেও দেওয়া হলো ট্রলারের আরও লাইসেন্স।
যাঁরা ট্রলার বরাদ্দ পেয়েছেন: নতুন ট্রলার বরাদ্দের প্রথম নাম হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর ছোট ছেলে। এর আগে তিনি এই সরকারের আমলেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি তেল পরিবহনের দুটি ট্যাংকারের (তেলবাহী জাহাজ) লাইসেন্স পান। ওই দুই ট্যাংকার দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
হেলাল উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ পরিবারের লোকজন এবার ট্রলার পেয়েছে। এ জন্য কাউকে এক টাকাও ঘুষ দিতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নিজে এসব ট্রলার বরাদ্দ দিয়েছেন। অথচ বিএনপি আমলে লাইসেন্সপ্রতি ২৫ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়ে ৫০টি নতুন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল।
হেলাল উদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, এবার যাঁরা বরাদ্দ পেয়েছেন তাঁরা সবাই আওয়ামী পরিবারের বঞ্চিত নেতা-কর্মী। রাজনৈতিক বিবেচনায় এই ট্রলার দেওয়া হয়েছে। এই সরকারের আমলে তাঁর নামে বরাদ্দ পাওয়া দুটি ট্যাংকার মেঘনা গ্রুপে ভাড়ায় খাটছে বলে তিনি জানান।
মেঘনা গ্রুপের একটি সূত্র জানায়, ভাড়ায় নয়, তাঁরা ট্যাংকার দুটি কিনে নিয়েছেন।
বরাদ্দ পাওয়ার তালিকায় এরপরই রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামানের ছেলে, সোনালী ব্যাংকের পরিচালক কে এম জামান ওরফে রোমেলের নাম। খন্দকার আসাদুজ্জামান সংস্থাপন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। প্রথম আলোকে কে এম জামান বলেন, ‘আগে আমাদের আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা ছিল। এটা এখন বহুমুখী করার চেষ্টা করছি।’
চট্টগ্রামের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত এম এ হান্নানের কানাডাপ্রবাসী ছেলে এস এম ফারুকও একটি ট্রলারের লাইসেন্স বরাদ্দ পেয়েছেন। বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদের স্ত্রী নূরান ফাতেমার নামও রয়েছে। প্রতিমন্ত্রীর গৃহিণী স্ত্রীকে বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিস নামে সদ্য গঠিত একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া আরও বরাদ্দ পেয়েছেন ঢাকার মিরপুরের সাংসদ আসলামুল হক (মাহিম ট্রেড লিংক), সাংসদ মীর্জা আজম (স্বর্ণালী ইন্টারন্যাশনাল), বরিশালের আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, খুলনার সাংসদ শেখ হেলালের আপন দুই ভাই শেখ সালাউদ্দিন ওরফে শেখ জুয়েল (মেসার্স ফারদিন ফিশ) ও শেখ জালাল উদ্দিন ওরফে শেখ রুবেল (মেসার্স জালাল করপোরেশন), আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নূরুল কাউয়ুম খান (এম এন ফিশিং), তাঁর স্ত্রী নাসরিন খান (প্রগ্রেসিভ ফিশিং লিমিটেড), চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আজম নাছির উদ্দিন (এমিউস ফিশিং লিমিটেড) এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্তের ভাই স্বপন চন্দ্র দত্ত (আপন ইমপোর্ট সেন্টার)।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর মৎস্য লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম ওরফে বাবুল সরকারও তাঁর প্রতিষ্ঠান মেসার্স সরকার ফিশ ট্রেডিংয়ের নামে একটি ট্রলারের লাইসেন্স পান। গত সংসদ নির্বাচনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সংসদীয় আসনে তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের এই ট্রলার আমি ব্যবসায়ী হিসেবে পেয়েছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী চাঁদপুরের যে আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন, সেখানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ছিল। কারণ সেখানে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে আমার শক্ত অবস্থান রয়েছে।’
ব্যবসায়ীদের মধ্যে মুছা মিয়া (কুলিয়ারচর গ্রুপ), মোস্তফা কামাল (মেঘনা গ্রুপ), চট্টগ্রামের বি দোজা অ্যান্ড কোম্পানির চেয়ারম্যানের স্ত্রী হামিদা দোজা, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতির ভাই রাশেদ মুরাদ ইব্রাহিম, ঢাকায় বসবাসরত চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম খান (এম এম ফিশিং) ও তাঁর স্ত্রী মিসেস মনোয়ারা বেগম (এম আর ফিশিং) একটি করে ট্রলারের লাইসেন্স পেয়েছেন।
সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীদের নামে বরাদ্দ দেওয়া ছয়টি লাইসেন্সও আওয়ামী লীগের নেতাদের নামে ছিল। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নামে বরাদ্দ করিয়ে নিয়েছেন।
জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারটা পেয়েছি সেটা বলব না, তবে কারও কারও নামে বরাদ্দের ট্রলার যে পেয়েছি এটা সত্য।’
যেভাবে বরাদ্দ: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে মৎস্য অধিদপ্তর আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ট্রলারের কিছুসংখ্যক ফিশিং লাইসেন্স দেওয়ার জন্য দরখাস্ত আহ্বান করে। আবেদনের জন্য ১০টি শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করার মতো আর্থিক সংগতি থাকতে হবে। মন্ত্রণালয় এ নিয়ে একটি যাচাই-বাছাই কমিটি করে। কমিটি যোগ্য বিবেচিত ৩৩০টি আবেদনপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায়। সেখান থেকেই ৩৪টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। শর্ত অনুযায়ী আগামী দুই বছরের মধ্যে এসব ট্রলার আমদানি করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ: বাণিজ্যিক ট্রলারের সাহায্যে সাগরে অপরিকল্পিতভাবে মাছ ধরা বন্ধ করতে সরকার ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম মাহাবুবুজ্জমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিল। কমিটি সাগরে মাছের মজুদের ওপর বিস্তারিত জরিপ না করা পর্যন্ত ঢালাওভাবে ট্রলারের লাইসেন্স না দেওয়ার সুপারিশ করে। ১৯৯৭ সালে মৎস্য অধিদপ্তরের চিংড়ি বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল করিমকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিও ট্রলার সংখ্যা ৭৮টিতে সীমিত রাখার প্রস্তাব দেয়।
এই সুপারিশমালার ভিত্তিতে সরকার ২০০০ সালে নতুন কোনো ট্রলার অনুমোদন না দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে। তার পরও বিগত সরকারের সময় লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, এবারও দেওয়া হলো। এবার প্রথমে ৩০টি লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে ৩৪টিতে উন্নীত করা হয়।
বাণিজ্যিক ট্রলার পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজালাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকেও আমরা বলেছিলাম সমুদ্রে মাছের মজুদ পরিস্থিতির ওপর বিস্তারিত জরিপ চালিয়ে তারপর ট্রলারের সংখ্যা নির্ধারণ করা হোক। কিন্তু সরকার তা না করে রাজনৈতিক কারণে ইচ্ছেমতো ট্রলারের লাইসেন্স অনুমোদন দিচ্ছে। এতে সামুদ্রিক মাছের আহরণ খাত বিপন্ন হয়ে পড়েছে।’
বিএনপি নেতাদের ৫০ লাইসেন্স ব্যবসায়ীদের হাতে: বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে ৫০টি নতুন ট্রলারের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। লাইসেন্সগুলো পান হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও বিএনপির নেতারা। এর মধ্যে ছিলেন মোরশেদ খান, লুৎফুজ্জামান বাবর, মির্জা আব্বাস, আলী আজগার লবী, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন, সরোয়ার জামাল, হাফিজ ইব্রাহিম, ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মুফতি ইজহারুল হক, ব্যবসায়ী বাবুল কাজী, সলিমুল হক প্রমুখ। এসব লাইসেন্স প্রতিটি ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকায় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
No comments