কেন্দ্রে গোলযোগ হলে ভোট বন্ধ: সিইসি

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে কোনো কেন্দ্রে গোলযোগ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হবে। প্রয়োজনে সেসব কেন্দ্রে নেওয়া হবে আবারও ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা। ভোটগ্রহণের এক সপ্তাহ আগে গতকাল রোববার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, সুশীল সমাজ ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদা এ কথা বলেছেন।রটার্নিং কর্মকর্তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রিটার্নিং অফিসার বিশ্বাস লুৎফর রহমান, জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) সৈয়দ মেহেদী হাসান ও নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার শেখ নাজমুল আলম।


মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে শামীম ওসমান, ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, তৈমুর আলম খন্দকার, আতিকুল ইসলাম জীবন, আতিকুর রহমান নান্নু মুন্সী এবং ২৭টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। সিইসিকে সামনে পেয়ে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তিন প্রার্থী তাদের অভিযোগ ও ক্ষোভের কথা তুলে ধরেন।
এদিকে তিন হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত দু'জনের পক্ষে রোববার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ শহরের বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন। অন্য প্রার্থী আইভীও তার সমর্থিত নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। নানা গুঞ্জনের পর বিএনপির সমর্থন পাওয়া তৈমুর আলমের পক্ষে গতকালই প্রথম কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ
গণসংযোগে নামায় চাঙ্গা হয়ে ওঠেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। নির্বাচনের ছয় দিন আগে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পেয়ে উৎফুল্ল এবং উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন তৃণমূল কর্মীরা।
স্থানীয় শহীদ জিয়া হলে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় ডা. আইভী অভিযোগ করেন, নির্বাচনে প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রভাব খাটাচ্ছেন। তার সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আইভী সরাসরি কারও নাম না বললেও ইঙ্গিত ছিল শামীম ওসমানের প্রতি। সিইসির উদ্দেশে আইভী বলেন, নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে এক দিন; কিন্তু আমাদের যাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে তারা এখানেই থাকব। সুতরাং আমাদের তেমন ব্যবহারই করতে হবে। সভায় শামীম ওসমান অভিযোগ করেন, তাকে 'সন্ত্রাসী' উল্লেখ করে অন্য এক প্রার্থী প্রচার চালাচ্ছেন। এসব থামাতে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ চান তিনি। শামীম অভিযোগ করেন, একটি পত্রিকা ও একটি টেলিভিশন চ্যানেল আমাকে খাটো করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে। টেলিভিশনে টক শো অনুষ্ঠানে আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেই মন্তব্য করা হচ্ছে। গণসংযোগের বক্তব্য অসম্পূর্ণ প্রচার করা হচ্ছে। এর প্রতিকার কী করে করা যায় তিনি সিইসির কাছে জানতে চান।
আইভী সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর থানায় কারচুপির আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, বন্দর থানার ওসি ভোটারদের বাড়িতে গিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন। তিনি আরও অভিযোগ করেন, তাকে নোংরা ভাষায় গালাগাল করা হচ্ছে। তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। আইভী বলেন, এ নির্বাচনের সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি জড়িয়ে আছে। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়, সে বিষয়ে সিইসি গুরুত্ব দেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
আইভীর অভিযোগের জবাবে সিইসি বলেন, বর্তমান কমিশনের এটি শেষ নির্বাচন। যে কোনো মূল্যে একে সুষ্ঠু ও সুন্দর করা হবে। এর বিকল্প নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ভোটারদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, আপনারা আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কোনো ধরনের অনিয়ম বা গাফিলতি সহ্য করা হবে না। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, নির্বাচনে কমিশনের প্রায় ৫০ জন নীরব পর্যবেক্ষক থাকবেন। তারা গোপনে কমিশনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখবেন।
অন্য হেভিওয়েট প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, এবারের নির্বাচন হবে দাদাগিরি প্রতিরোধের নির্বাচন। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এলাকায় দাদাগিরির অবসান ঘটবে। এ জন্য ভোটারদের চিন্তাভাবনা করে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এটিএম শামসুল হুদা আরও বলেন, কালো টাকার প্রভাব পুরোপুরি রোধ করা না গেলেও নির্বাচনে কালো টাকা ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করতে নির্বাচন কমিশন সচেষ্ট রয়েছে। ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের কেউ টাকা দিলে তা গ্রহণ করবেন। কারণ এ টাকা আপনাদেরই। ভোট দেওয়ার সময় নিজেদের বিবেক খাটিয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেবেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ফল ঘোষণায় তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সিইসি বলেন, ভোটগণনার স্থান অবরুদ্ধ এলাকা হিসেবে গণ্য করা হবে। সেনাসদস্যরা টহলে থাকবে। ভেতরে ও বাইরে একাধিক টিভি থাকবে। এ ছাড়া নির্বাচনোত্তর সহিংসতা এড়াতে ফল ঘোষণার পরদিনও সেনাবাহিনী থাকবে।
সিইসি বলেন, এখানে কারও কোনো এজেন্ডা নেই। কমিশন কাউকে হারাতে বা জেতাতে পারে না। এর মালিক জনগণ। কমিশন শুধু ভোটগ্রহণের আয়োজন করে। সিইসি দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকারের কোনো মন্ত্রী কমিশনের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেননি। তাদের সঙ্গে কমিশনের যোগাযোগ নেই। বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। এ কমিশনের ওপর সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোনো মন্ত্রীর আছর নেই। সরকারি ও বিরোধী দলও এটা বিশ্বাস করে না। মেয়র প্রার্থীদের অভিযোগের জবাবে সিইসি বলেন, দলীয় কার্যালয়কে নির্বাচনী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পাশাপাশি নির্বাচন উপলক্ষে বন্দরে ফেরিঘাট নির্মাণ স্থগিত কেন করা হলো সে সম্পর্কে খোঁজ নেবেন বলে জানান তিনি।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আশঙ্কা সম্পর্কে সিইসি বলেন, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় যদি আপনারা আমাদের ওপর আস্থা রাখেন। বাংলাদেশে এবং ভারতে এক ধরনের মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা পরীক্ষিত মেশিন। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার ফলে হ্যাক করার কোনো সুযোগ এতে নেই। এটা ব্যবহার করা মোটেও জটিল কাজ নয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যারা ভোট দিয়েছেন তারা সবাই ইভিএমকে ভালো বলেছেন। এটা ব্যবহার করতে দিন। আমি নিশ্চিত, এখানকার লোকও একে ভালো বলবেন।
এবারের নির্বাচনকে কমিশন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন সিইসি। তিনি বলেন, নাসিক নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে র‌্যাব, পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, আনসার-ভিডিপির পাশাপাশি সেনাসদস্যসহ প্রায় ৫ হাজার সদস্য থাকবে। অতীতের কোনো নির্বাচনেই এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, এখানে সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না কমিশন। তারপরও প্রার্থীদের দাবির কারণে সেনা মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষে জনগণের আস্থা অর্জনে কমিশন বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সিইসি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের পাশাপাশি ১০০টি কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে। এ ক্যামেরা দিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে যা হচ্ছে তা দেখা যাবে। ভোটকেন্দ্রের পুরো চিত্র দেখা যাবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও নাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে বসে। তিনি আরও বলেন, তিন থানায় তিনজন সমন্বয়ক, ভ্রাম্যমাণ আদালত, ভিডিও ক্যামেরার ব্যবস্থা ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে। নির্বাচনী আচরণবিধি বা নির্বাচনের দিন কোনো অভিযোগ করতে চাইলে লিখিতভাবে নাম-পরিচয় দিয়ে করতে হবে। অনুমানের ভিত্তিতে কোনো অভিযোগ আমলে নেওয়া হবে না।
শামসুল হুদা বলেন, নির্বাচনে কমিশনের অনেক কর্মকর্তা গোয়েন্দার মতো কাজ করবেন। তারা কোথাও কোনো অনিয়ম ঘটলে কমিশনকে জানাবেন। আবার কমিশন কোথাও কোনো অনিয়মের অভিযোগ পেলে তৎক্ষণাৎ তাকে সেখানে পাঠিয়ে ঘটনা তদন্ত করা হবে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে প্রার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ বিরাজ করছে। এ পরিবেশ ভোটের দিন পর্যন্ত অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।
এর আগে সকাল সাড়ে ১১টায় সিইসি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে নির্বাচন সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.