কী ভয়ংকর চিকিৎসা!-চট্টগ্রাম মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে ডাক্তার ঘুমান চিকিৎসা দেন ওয়ার্ড বয়, সুইপার, এমএলএসএস by নূপুর দেব
আঁতকে উঠতে হয় এ রকম ঘটনায়। ১৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১টা। বুকে ব্যথা নিয়ে মোহাম্মদ সফি (৫০) নামের এক ব্যক্তি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন। ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের রুমে ডাক্তার নেই। একজন ওয়ার্ড বয় জরুরি বিভাগের টিকিটে (চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র) ইসিজি করার কথা লিখে তাঁকে ১২ নম্বর হৃদরোগ ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর ওই রোগী ইসিজি রিপোর্ট আনলে ওয়ার্ড বয়রা ভেতরের রুমে বিশ্রামরত বিভাগের ইনচার্জ ডা. ফখরুজ্জাহানের কাছে সেটি নিয়ে যান। তিনি ঘুম থেকে উঠে ওয়ার্ড বয়দের কথামতো মোহাম্মদ সফিকে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য লেখেন।
কিন্তু তাঁর লেখা এই ভর্তির টিকিটে তাঁর স্বাক্ষর নেই। তাঁর পরিবর্তে সই করেন ওয়ার্ড বয়। ওয়ার্ড বয়ের এই স্বাক্ষরেই ভর্তি হয়ে যান শফি। তাঁকে জরুরি চিকিৎসার জন্য প্রথমে দেওয়া টিকিট তথা ব্যবস্থাপত্রে মেডিক্যাল অফিসারের আলাদা সিলে একটিতে ওয়ার্ড বয়, অন্যটিতে ডা. ফখরুজ্জাহানের স্বাক্ষর রয়েছে বোঝা যায়। টিকিটে রোগের বিবরণ লেখার নিয়ম থাকলেও কোনোটিতেই তা নেই।
শুধু এক দিনই এ রকম অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে, তা নয়। দেশের অন্যতম বৃহৎ, এক হাজার ১০ শয্যার এ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীদের এখন প্রতিদিনই চিকিৎসা দিচ্ছেন ওয়ার্ড বয়, এমএলএসএস (নূ্যনতম অষ্টম শ্রেণী পাস চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী) এমনকি সুইপাররা। জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসকরা 'বিশ্রামে গেলে' সেই সময়ে আসা মুমূর্ষু রোগীদের তাঁরা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। রোগীর ব্যবস্থাপত্রেও মেডিক্যাল অফিসারের সিলের ওপর স্বাক্ষর দেন!
হাসপাতাল ঘুরে রোগী ও তাদের স্বজন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পাওয়া গেছে। চাক্ষুষ করা গেছে অবিশ্বাস্য এসব কাণ্ড। কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে গত দুই দিন অনুসন্ধানে গেলে টনক নড়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের। তোলপাড় সৃষ্টি হয় পুরো হাসপাতালে। হাসপাতালের পরিচালক জরুরি বিভাগের চিকিৎসকসহ সব স্টাফকে ইউনিফর্ম এবং ইউনিফর্মে নেইমপ্লেট রাখার নির্দেশ দেওয়ার কথা জানান।
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সিটিজেন চার্টারে (নাগরিক সনদ) উল্লেখ আছে, 'জরুরি বিভাগ ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এবং রোগীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়।' এ সেবাসহ আরো আটটি সেবা ও সুযোগ-সুবিধা জরুরি বিভাগে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এসব সুযোগ-সুবিধা রোগীর পাওয়ার কথা উল্লেখ করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে একটি সিটিজেন চার্টার টানানো আছে। কিন্তু বাস্তবচিত্র এখানে ভিন্ন। জরুরি বিভাগে চিকিৎসাসেবা থেকে প্রতিদিন শত শত রোগী বঞ্চিত হচ্ছে।
গত শনিবার দুপুর ১২টা থেকে ৩টা এবং রাত ১০টা থেকে গতকাল রবিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত এ প্রতিবেদক জরুরি বিভাগের আশপাশে অবস্থান নিয়ে দেখেছেন, জরুরি বিভাগের এক নম্বর রুমের যেখানে রোগী দেখার কথা, সেই রুমটি তালা লাগানো। জানা যায়, ওই রুমে চিকিৎসকরা বিশ্রাম নেন ও ঘুমান। তিন নম্বর রুম ওয়ার্ড বয়দের দখলে থাকে। সাতজন ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন জরুরি বিভাগে। সকাল ও বিকেলের শিফটে দুজন করে চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও ছিলেন মাত্র একজন। বাইরে থেকে মুমূর্ষু রোগীরা এসে জরুরি চিকিৎসা নেওয়ার পর চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দায়িত্ব তাদের ট্রলিতে করে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু দেখা গেছে, এ কাজ করছেন বেসরকারিভাবে বিনা বেতনে নিয়োগকৃত 'অবৈতনিক কর্মচারীরা'। ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা রোগী প্রতি ২০ টাকা থেকে ১০০ টাকা করে নিচ্ছেন। ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের রুমের সামনে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা ঘিরে আছেন। কাটাছেঁড়া রোগীদের সেলাই করার কথা ডাক্তারদের। কিন্তু এ কাজ করছেন ব্রাদাররা। তাঁরা ড্রেসিং করছেন ও ব্লাডপ্রেসার দেখছেন।
১৩ অক্টোবর রাতে দৌলতপুর এলাকা থেকে বুকে ব্যথা নিয়ে আসা রোগী মোহাম্মদ সফির জরুরি বিভাগের টিকিটে ওয়ার্ড বয়দের মধ্যে কে স্বাক্ষর করেছিলেন তা নির্ণয় করা যায়নি। তবে ওই রাতে চতুর্থ শ্রেণীর চারজন কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। তাঁরা হলেন এমএলএসএস আবুল কালাম ও গোলাম রহমান, সুইপার দীলিপ সরকার ও ফাতেমা বেগম। আর জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. ফখরুজ্জাহান ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসক ওই রাতে জরুরি বিভাগে ছিলেন না বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন।
জরুরি বিভাগের এ হাল এবং ওয়ার্ড বয়, এমএলএসএসদের চিকিৎসা দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. ফখরুজ্জাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ডাক্তারের স্বাক্ষর ওয়ার্ড বয়রা করবে এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।' এ সময় তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করলে তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে বিভিন্ন কথা বলার চেষ্টা করেন। কখনো বলেন 'একটা আমার স্বাক্ষর, অন্যটি কার তা জানি না।' আবার বলেন, এনওডিতে (নো অফিসিয়াল ডিলে) অনুস্বাক্ষর এবং ব্যবস্থাপত্রে নিজে স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু ব্যবস্থাপত্রে অনুস্বাক্ষর দেওয়া যায় না_এ কথা তাঁকে বললে তিনি নীরব হয়ে যান। প্রসঙ্গত, খুব মুমূর্ষু রোগীদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে এনওডি স্লিপ দেওয়া হয়। জরুরি বিভাগে রোগীদের আসল চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ ও অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।
একই রাতে ১১টা ৩৫ মিনিটে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে বাদশা মিয়া (৭৫), রাত ১২টায় রেহানা বেগম (৩৫), সাইদুল ইসলাম (১৮), ১৪ অক্টোবর রাত ১২টা ১৫ মিনিটে বিষ খাওয়া রোগী উম্মে কুলসুম (২০) ও সাজু বেগমকে (৬০) ভর্তি করান ওয়ার্ড বয়রা। এর মধ্যে উম্মে কুলসুমের ঘটনাটি পুলিশ কেইস ছিল। শুধু এসব রোগী নন, জরুরি বিভাগে আসা অনেক রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা ও কোন ওয়ার্ডে ভর্তি হবে তা নির্ধারণ করে দেন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা। যখন ডাক্তার থাকেন তখনো চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কথামতো ডাক্তাররা রোগীকে ওয়ার্ডে ভর্তি করান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গতকাল সকাল ১০টায় বোয়ালখালীর সারোয়াতলি এলাকা থেকে রিপন (১০) নামের এক শিশুকে তার দাদি অ্যাম্বুলেন্সে করে চমেক হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। এ সময় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা ডাক্তারের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অ্যাম্বুলেন্স থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় রিপনকে অস্থায়ী দুই জন ওয়ার্ড বয় একটি ট্রলিতে করে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। গাছ থেকে পড়ে গুরুতর আহত শিশুটি তখন ট্রলিতে শুয়ে কাতরাচ্ছিল। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তার দাদি। এ সময় দুজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও দায়িত্বে ছিলেন বিভাগের ইনচার্জ ডা. ফখরুজ্জাহান। তিনি তাঁর কক্ষে বসে ছিলেন। হঠাৎ কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক ও ফটোগ্রাফারকে দেখে ১০ মিনিট পর মুমূর্ষু রিপনকে দেখতে যান ফখরুজ্জাহান। এরপর দ্রুত তাকে ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করান। সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে নগরীর বায়েজিদ এলাকা থেকে বুকে ব্যথা নিয়ে দিনমজুর মোহাম্মদ আক্কাস আলী (৫০) চিকিৎসা নিতে আসেন। এ সময় ট্রলিতে শুয়ে ব্যথায় ১৫ মিনিট ধরে কাতরাতে থাকলেও চিকিৎসকসহ কোনো কর্মচারীকে তাঁর আশপাশে দেখা যায়নি। পরে ডাক্তার এসেই তাঁকে ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে দেন।
এ পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিষয়টি আমি নিজেই খতিয়ে দেখব। জরুরি বিভাগের ইনচার্জের কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছি। কোনো অপরাধের পক্ষে আমি নই। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা সব রোগী যাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পায় সেই ব্যবস্থা করব।' এ সময় পরিচালকের কক্ষে কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র দুজন চিকিৎসক অবস্থান করছিলেন। পরিচালক তাঁদের সামনে এ প্রতিবেদককে বলেন, 'জরুরি বিভাগে চিকিৎসকসহ সব স্টাফের ইউনিফর্ম ও নেইমপ্লেইট থাকতে হবে। সবাই যাতে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে, সেজন্য নোটিশ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। তদন্তে চিকিৎসকের পরিবর্তে এমএলএসএস ও সুইপার ব্যবস্থাপত্রে স্বাক্ষর দেওয়ার ঘটনাটি প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. বিজন কান্তি বিশ্বাস বলেন, 'এ রকম কিছু হলে তা অবশ্যই দুঃখজনক। ডাক্তার থাকতে কেন কর্মচারীরা এ ধরনের জঘন্য কাজ করবে, তা বোধগম্য হচ্ছে না। এরই মধ্যে জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. ফখরুজ্জাহানকে ডেকে বিষয়টি জানতে চেয়েছি। তবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।'
এ সময় তাঁকে ডা. ফখরুজ্জাহান ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর স্বাক্ষরিত বেশ কিছু ব্যবস্থাপত্র দেখালে ডা. বিজন বলেন, 'যে অপরাধ করে সে কি তার অপরাধ স্বীকার করে? এসব ঘটনা সত্য হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি শোনার পর থেকে জরুরি বিভাগের সব কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে।'
জানা যায়, গত ৮ অক্টোবর জরুরি বিভাগে ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। এর মধ্যে ৩৯৯ জন বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে। একইভাবে ৯ অক্টোবর ৫০১ জনের মধ্যে ৩৭৬ জন, ১০ অক্টোবর ৫৩০ জনের মধ্যে ৪০৮ জন, ১১ অক্টোবর ৫১০ জনের মধ্যে ৩৯৫ জন, ১২ অক্টোবর ৫০০ জনের মধ্যে ৩০০ জন, ১৩ অক্টোবর ৫৭০ জনের মধ্যে ৪২৫ জন, ১৪ অক্টোবর ৫১০ জনের মধ্যে ৩৯০ জন, ১৫ অক্টোবর ৫৪১ জনের মধ্যে ৪০৫ জন ও ১৬ অক্টোবর ৫২২ জনের মধ্যে ৩৭৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। গতকাল সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ১২০ জন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে।
No comments