আগামীর হাতিয়ারঃ জীবপ্রযুক্তি ও প্রাণরসায়ন by মামুন রশীদ চৌধুরী
মানুষের জীবনযাত্রা গতিময় ও সমৃদ্ধ করাই হলো বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার মূল উদ্দেশ্য। এখন জীববিজ্ঞান, বিশেষ করে জীবপ্রযুক্তি আমাদের এই স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনকে প্রভাবিত করছে, জীবনযাত্রাকে করেছে প্রাচুর্যময়। তাই একবিংশ শতাব্দীকে জীববিজ্ঞানের শতাব্দী বলা হচ্ছে। জীবপ্রযুক্তি কী? মানুষের জীবনযাত্রার উন্নততর প্রক্রিয়ায় জীবন্ত বস্তু, জীবন্ত কোষ বা তার অংশবিশেষের প্রযুক্তিগত ব্যবহারই হলো জীবপ্রযুক্তি।
আর জীবন্ত বস্তু হলো অতিসাধারণ পারমাণবিক সত্তাকে জটিল থেকে জটিলতর সংগঠন পদ্ধতিতে সংগঠিত করে নিয়ন্ত্রিত এনজাইম দ্বারা বিপাকজনিত রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় শক্তি ও গাঠনিক যৌগ সৃষ্টি করা এবং প্রজননের মাধ্যমে বংশগতির ধারা বজায় রাখা। জীবন্ত বস্তুর সব গাঠনিক ও কার্যক্রম-সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও বিশ্লেষণ করাই হলো প্রাণরসায়নের মূল বিষয়। তাই বলা চলে, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ হলো জীবপ্রযুক্তির মূল ভিত্তি।
অতি প্রাচীনকালে মিসরীয়দের গাঁজন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এলকোহল তৈরি করা জীবপ্রযুক্তির আদিরূপ। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ফাঙ্গাস দ্বারা পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির এই প্রযুক্তির কিছুটা আধুনিক সংস্করণ। বর্তমানে আছে খাদ্য ও পানীয় শিল্পজাত পণ্যের মানোন্নয়ন ও সহজলভ্য করা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হিসেবে রাসায়নিক বস্তুর পরিবর্তে কাগজ ও মণ্ডশিল্প, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ বা ট্যানারিশিল্পে বিশেষ বিশেষ এনজাইমের ব্যবহার। এ ছাড়া দৈনন্দিন ব্যবহার্য গুঁড়ো সাবানে কাপড়ের দাগ দূর করায় এনজাইমের ব্যবহার তো চলেই আসছে। অতি সম্প্রতি ওলব্যাকিয়া গোত্রের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মহিলা এডিস মশাকে আক্রান্ত করে তার ডেঙ্গু ভাইরাস বহনের ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে জীবপ্রযুক্তির এ ব্যবহারে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে। সাগরতীরে নিঃসৃত তেল নষ্ট করে পরিবেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতেও রূপান্তরিত রিকমবিন্যাট ব্যাকটেরিয়া ব্যবহূত হয়েছে।
জিন প্রকৌশল জীবপ্রযুক্তির অত্যন্ত সাফল্যজনক একটি অবদান। জিন বা ডিএনএ একটা অংশে প্রোটিন তৈরির তথ্য সুপ্ত থাকে, যা ডিকোড হয়ে প্রোটিন তৈরি হয়। জীবজগতে এমন কোনো কাজ নেই, যার সঙ্গে প্রোটিনের সংশ্লিষ্টতা নেই। সত্তর দশকের প্রথম দিকে স্মিথের রেজিস্ট্রেশন এনডোনুক্লিজের আবিষ্কার এবং পরে বার্গ, কোহেন ও বয়ার ১৯৭৪ সালে এই এনজাইমের সাহায্য নিয়ে এক জীবের জিন অন্য জীবে স্থাপনের মাধ্যমে জিন প্রকৌশল পদ্ধতির সূচনা করেন। রেজিস্ট্রেশন এনডোনুক্লিজের দ্বারা মানুষের ক্রোমোজম থেকে একটি জিন আলাদা করে প্লাজমিড জাতীয় ভেকটর বা পরিবাহকে স্থাপন করে পরে ব্যাকটেরিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। সেখানে মানুষের জিন-সংশ্লিষ্ট প্রোটিন তৈরি হয় এবং পরে তাকে পরিশোধন করা হয়। ১৯৭৬ সালে নবীন ব্যবসায়ী সোয়ানসন ও জীবপ্রযুক্তিবিদ বয়ার জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে প্রোটিন তৈরির জন্য জিনেনটেক নামে প্রথম জিন-প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বর্তমানে এ ধরনের কারখানার সংখ্যা অনেক। ১৯৮২ সালে রূপান্তরিত ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে ব্যবহার করে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ইনসুলিন তৈরি করে বাজারজাত করা হয়। এর পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের বায়োফার্মাসিউটিক্যালস, যেমন বর্ধনজনিত সমস্যার জন্য এইচজিএইচ (হিউম্যান গ্রোথ হরমোন), হার্ট অ্যাটাকে সৃষ্ট হূৎপিণ্ডে জমাট নষ্ট করার জন্য প্লাজমিনোজেন অ্যাকটিভেটর ইত্যাদি বাজারে আসতে থাকে। নিরাপদ, কার্যক্রম ও দামে সস্তা এ ধরনের বায়োফার্মাসিউটিক্যালস বাজারে প্রচুর আছে এবং অনেকগুলো কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আছে। শুধু ওষুধ তৈরি নয়, জিন প্রকৌশল প্রযুক্তির ব্যবহারে রোগ নির্ণয় সহজ হয়েছে, এমনকি ভ্রূণে কোনো রূপান্তরিত ক্ষতিকর জিন আছে কি না, তা-ও আমরা জানতে পারি। নতুন নতুন টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা বাড়ছে। কৃষি ক্ষেত্রে এই জীবপ্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা উন্নতমানের ফসল সৃষ্টি ও উৎপন্ন করছি। লবণসহিষ্ণু ধান, পোকার আক্রমণমুক্ত ফসল, যেমন—বিটি কটন, বিটা-কেরোটিন (ভিটামিন-‘এ’র পূর্বসূরি) সংশ্লেষণে উপযুক্ত সোনালি ধানের কয়েকটি উদাহরণ। এই প্রযুক্তিতে সৃষ্ট ভেড়া ডলির কথা আমরা জানি। মানুষের রোগপ্রতিষেধক তৈরিতেও ফসলের ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। যেমন—ধানের মধ্যে কলেরার তৈরি। তবে জিএমও/জিএম খাবার নিয়ে তর্কের শেষ নেই। কোনো একসময় মানুষের উন্নয়নের কথা ভেবে হয়তো সমঝোতায় আসা যাবে।
হিউম্যান জেনোম প্রজেক্টের ফলে ক্রোমোজমের কোথায় কোন জিনের অবস্থান, তা আমরা জানতে পারি। জিন থেরাপির মাধ্যমে অতি শিগগিরই আমরা ক্ষতিকর বা রূপান্তরিত জিনের স্থানে ভালো জিন প্রতিস্থাপন করে জিনবাহিত রোগের নিরাময়ে সক্ষম হব। ফরেনসিক বিজ্ঞানে জিনপ্রযুক্তির ব্যবহারে সন্তানের পিতৃত্ব-মাতৃত্ব নির্ধারণ, ক্রিমিনাল শনাক্তকরণ, গলিত লাশ শনাক্তকরণ ইত্যাদি এর অন্যতম ব্যবহার। সম্প্রতি ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত ঘটনায় গলিত লাশ থেকে হারিয়ে যাওয়া সামরিক কর্মকর্তাদের শনাক্তকরণ এই প্রযুক্তির ব্যবহারের জ্বলন্ত উদাহরণ। তাই বর্তমান শতাব্দীতে বিজ্ঞান এগিয়ে যাবে জীবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল বিজ্ঞানের হাত ধরে। জীবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল শিক্ষা এবং গবেষণায় উৎকৃষ্টতা অর্জনে প্রধানতম ভিত্তি বা সোপান হলো প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞানের দখল। প্রাণরসায়নের শিক্ষা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান আমাদের দেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জীবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশলে প্রতিযোগিতা করার যোগ্যতা এবং মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানের ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা।
লেখক * চেয়ারম্যান, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অতি প্রাচীনকালে মিসরীয়দের গাঁজন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এলকোহল তৈরি করা জীবপ্রযুক্তির আদিরূপ। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ফাঙ্গাস দ্বারা পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির এই প্রযুক্তির কিছুটা আধুনিক সংস্করণ। বর্তমানে আছে খাদ্য ও পানীয় শিল্পজাত পণ্যের মানোন্নয়ন ও সহজলভ্য করা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হিসেবে রাসায়নিক বস্তুর পরিবর্তে কাগজ ও মণ্ডশিল্প, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ বা ট্যানারিশিল্পে বিশেষ বিশেষ এনজাইমের ব্যবহার। এ ছাড়া দৈনন্দিন ব্যবহার্য গুঁড়ো সাবানে কাপড়ের দাগ দূর করায় এনজাইমের ব্যবহার তো চলেই আসছে। অতি সম্প্রতি ওলব্যাকিয়া গোত্রের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা মহিলা এডিস মশাকে আক্রান্ত করে তার ডেঙ্গু ভাইরাস বহনের ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে জীবপ্রযুক্তির এ ব্যবহারে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে। সাগরতীরে নিঃসৃত তেল নষ্ট করে পরিবেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতেও রূপান্তরিত রিকমবিন্যাট ব্যাকটেরিয়া ব্যবহূত হয়েছে।
জিন প্রকৌশল জীবপ্রযুক্তির অত্যন্ত সাফল্যজনক একটি অবদান। জিন বা ডিএনএ একটা অংশে প্রোটিন তৈরির তথ্য সুপ্ত থাকে, যা ডিকোড হয়ে প্রোটিন তৈরি হয়। জীবজগতে এমন কোনো কাজ নেই, যার সঙ্গে প্রোটিনের সংশ্লিষ্টতা নেই। সত্তর দশকের প্রথম দিকে স্মিথের রেজিস্ট্রেশন এনডোনুক্লিজের আবিষ্কার এবং পরে বার্গ, কোহেন ও বয়ার ১৯৭৪ সালে এই এনজাইমের সাহায্য নিয়ে এক জীবের জিন অন্য জীবে স্থাপনের মাধ্যমে জিন প্রকৌশল পদ্ধতির সূচনা করেন। রেজিস্ট্রেশন এনডোনুক্লিজের দ্বারা মানুষের ক্রোমোজম থেকে একটি জিন আলাদা করে প্লাজমিড জাতীয় ভেকটর বা পরিবাহকে স্থাপন করে পরে ব্যাকটেরিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। সেখানে মানুষের জিন-সংশ্লিষ্ট প্রোটিন তৈরি হয় এবং পরে তাকে পরিশোধন করা হয়। ১৯৭৬ সালে নবীন ব্যবসায়ী সোয়ানসন ও জীবপ্রযুক্তিবিদ বয়ার জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে প্রোটিন তৈরির জন্য জিনেনটেক নামে প্রথম জিন-প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বর্তমানে এ ধরনের কারখানার সংখ্যা অনেক। ১৯৮২ সালে রূপান্তরিত ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে ব্যবহার করে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ইনসুলিন তৈরি করে বাজারজাত করা হয়। এর পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের বায়োফার্মাসিউটিক্যালস, যেমন বর্ধনজনিত সমস্যার জন্য এইচজিএইচ (হিউম্যান গ্রোথ হরমোন), হার্ট অ্যাটাকে সৃষ্ট হূৎপিণ্ডে জমাট নষ্ট করার জন্য প্লাজমিনোজেন অ্যাকটিভেটর ইত্যাদি বাজারে আসতে থাকে। নিরাপদ, কার্যক্রম ও দামে সস্তা এ ধরনের বায়োফার্মাসিউটিক্যালস বাজারে প্রচুর আছে এবং অনেকগুলো কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আছে। শুধু ওষুধ তৈরি নয়, জিন প্রকৌশল প্রযুক্তির ব্যবহারে রোগ নির্ণয় সহজ হয়েছে, এমনকি ভ্রূণে কোনো রূপান্তরিত ক্ষতিকর জিন আছে কি না, তা-ও আমরা জানতে পারি। নতুন নতুন টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা বাড়ছে। কৃষি ক্ষেত্রে এই জীবপ্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা উন্নতমানের ফসল সৃষ্টি ও উৎপন্ন করছি। লবণসহিষ্ণু ধান, পোকার আক্রমণমুক্ত ফসল, যেমন—বিটি কটন, বিটা-কেরোটিন (ভিটামিন-‘এ’র পূর্বসূরি) সংশ্লেষণে উপযুক্ত সোনালি ধানের কয়েকটি উদাহরণ। এই প্রযুক্তিতে সৃষ্ট ভেড়া ডলির কথা আমরা জানি। মানুষের রোগপ্রতিষেধক তৈরিতেও ফসলের ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। যেমন—ধানের মধ্যে কলেরার তৈরি। তবে জিএমও/জিএম খাবার নিয়ে তর্কের শেষ নেই। কোনো একসময় মানুষের উন্নয়নের কথা ভেবে হয়তো সমঝোতায় আসা যাবে।
হিউম্যান জেনোম প্রজেক্টের ফলে ক্রোমোজমের কোথায় কোন জিনের অবস্থান, তা আমরা জানতে পারি। জিন থেরাপির মাধ্যমে অতি শিগগিরই আমরা ক্ষতিকর বা রূপান্তরিত জিনের স্থানে ভালো জিন প্রতিস্থাপন করে জিনবাহিত রোগের নিরাময়ে সক্ষম হব। ফরেনসিক বিজ্ঞানে জিনপ্রযুক্তির ব্যবহারে সন্তানের পিতৃত্ব-মাতৃত্ব নির্ধারণ, ক্রিমিনাল শনাক্তকরণ, গলিত লাশ শনাক্তকরণ ইত্যাদি এর অন্যতম ব্যবহার। সম্প্রতি ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত ঘটনায় গলিত লাশ থেকে হারিয়ে যাওয়া সামরিক কর্মকর্তাদের শনাক্তকরণ এই প্রযুক্তির ব্যবহারের জ্বলন্ত উদাহরণ। তাই বর্তমান শতাব্দীতে বিজ্ঞান এগিয়ে যাবে জীবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল বিজ্ঞানের হাত ধরে। জীবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল শিক্ষা এবং গবেষণায় উৎকৃষ্টতা অর্জনে প্রধানতম ভিত্তি বা সোপান হলো প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞানের দখল। প্রাণরসায়নের শিক্ষা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান আমাদের দেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জীবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশলে প্রতিযোগিতা করার যোগ্যতা এবং মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানের ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা।
লেখক * চেয়ারম্যান, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments