সারা দিন রোদ অথচ... by নোমান মোহাম্মদ,

লেখক হুমায়ূন আহমেদের ভূতবিষয়ক ব্যাখ্যাটি খুব চমৎকার। পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই, কিন্তু ভূতের ভয় আছে পুরোমাত্রায়, আর তাই আছে ভূতের গল্প। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে কাল মধ্যাহ্নের তীব্র রোদে সেই ব্যাখ্যাটি কী দারুণভাবেই না মিলে গেল ক্রিকেটের সঙ্গে! নির্মল নীল আকাশের ঈষান-নৈঋত কোনো কোণেই নেই বৃষ্টির সামান্যতম আভাস, কিন্তু মাঠের সবুজ মানচিত্রে বৃষ্টির টলটলে-কর্দময় প্রভাব বিদ্যমান, আর তাই বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলাও পরিত্যক্ত!ভূত আছে কী নেই, সেটি তর্কসাপেক্ষ। বৃষ্টির অস্তিস্ত্ব নিয়ে তো আর প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। তবে কাল দুপুরে সাগরিকার আকাশ দেখে বিস্ময় জাগতে বাধ্য।


এই আকাশ গত দুই রাত ধরে কাঁদছে কিভাবে! রাতের কান্না শেষ হয়ে যাচ্ছে রাতেই। কিন্তু তার ছাপ থেকে যাচ্ছে পর দিন পর্যন্ত। গত দুই দিন ম্যাচের যে সময়, সেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বৃষ্টি হচ্ছে না এতটুকুন। বিশ্বের অন্য যেকোনো স্টেডিয়ামে, এমনকি মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এমন ধারার বৃষ্টি হলে দিনে খেলা হতো অন্তত ৭০-৮০ ওভার করে। সেখানে চট্টগ্রামে দিনের খেলা পরিত্যক্ত ঘোষিত হচ্ছে সাতসকালেই। প্রাগৈতিহাসিক ড্রেনেজ সিস্টেমের কী অবিশ্বাস্য অবদান!
আগের দিন তাও দুই দল মাঠে এসেছিল। খেলা না হলেও খানিকটা গা গরম করে নেওয়ার তাগিদে। সমান্তরালে হয়তো আশার আলো জ্বলছিল নিবু নিবু করে হলেও। সেটি এক ফুৎকারে নিভে যেতে সময় লাগেনি। পরশু মাঠে গিয়েই ক্যারিবীয় দল বুঝে গিয়েছিল এর অবস্থা। চষা ক্ষেতের মতো সেই মাঠ কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, ক্রিকেটারদের নয়। তাই কষ্ট স্বীকার করে আর কাল স্টেডিয়ামে যাননি ক্যারিবীয়রা। বাংলাদেশ দলেরও সবাই আসেননি। ঐচ্ছিক অনুশীলনে এসেছিলেন জনা আষ্টেক ক্রিকেটার। বোলিং কোচ শেন ইয়ুর্গেনসেন এবং ফিল্ডিং কোচ জ্যাসন সুইফটকে নিয়ে। ইনডোরে এবং নেটে খানিকক্ষণ হালকা মেজাজের অনুশীলন শেষে আবার তাঁরা ফিরে গেছেন ডেরায়।
ইনডোরের নেটে বেশ খানিকক্ষণ ব্যাটিংটা ঝালিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকে সেঞ্চুরির সুবাস পাচ্ছেন তিনি। অথচ দুই দিন ধরে মাঠেই নামা হচ্ছে না। দল এত ভালো অবস্থানে থাকার সুবিধাটাও এখন আর সেভাবে নেই সময় স্বল্পতায়। অনুশীলন শেষে বাসে ওঠার আগে হতাশাটা গোপন করেননি মুশফিকুর, 'একটু তো হতাশই। তবে বৃষ্টির ব্যাপারটা তো আর আমাদের হাতে নেই।' তা নেই, কিন্তু নিজের ও দলের এমন অবস্থায় দুই দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকাটা তো সহজ নয়। বিশেষত যখন জানেন, ম্যাচটি মিরপুরে হলে ব্যাট-বলের লড়াই আবার শুরুর জন্য দুই দিন অপেক্ষা করতে হতো না।
অপেক্ষার সময়টায় কাল নেটে কম্পিউটার অ্যানালিস্ট নাসির আহমেদকে নিয়ে ব্যাটিংয়ে হাত মকশো করেছেন শাহরিয়ার নাফীস ও ইমরুল কায়েস। ইনডোরে আরো ছিলেন রকিবুল হাসান, নাঈম ইসলাম, শাহাদাত হোসেন, সোহরাওয়ার্দী শুভ ও ইলিয়াস সানি। টেস্ট অভিষেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নামার অপেক্ষার প্রহরটা আরো দীর্ঘ হলো ইলিয়াসের। নামলে যেন মুহূর্তটি স্মরণীয় করে রাখতে পারেন, সে জন্য অনুশীলনে হয়তো অন্যদের চেয়ে বাড়তি মনোযোগই ছিল তাঁর। ইলিয়াস ও সোহরাওয়ার্দী যখন ব্যাটিং করছিলেন, তখন দেখা গেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিরল দৃশ্য। নেট বোলারের অভাবে খানিকক্ষণ হাত ঘোরালেন যে মুশফিকুর ও রকিবুল। প্রথমজন অফব্রেক, দ্বিতীয়জন লেগস্পিন। বেধড়ক পিটুনি খেয়ে মুশফিকুর-রকিবুল বুঝিয়ে দিতে দেরি করলেন না যে ওটি তাদের কম্ম নয়।
শেন জার্গেনসনের যে কাজ, সেটি তিনি শুরু করে দিয়েছেন প্রবলভাবে। বাংলাদেশের নতুন বোলিং কোচ কালও নেটে এটা-ওটা দেখিয়ে দিয়েছেন শাহাদাত-সোহরাওয়ার্দী-ইলিয়াসদের। খেলা না হওয়ার হতাশা ঝরেছে তাঁর কণ্ঠেও, 'বৃষ্টি তো আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এ নিয়ে হা-হুতাশ করেও তাই লাভ নেই। এটাই ক্রিকেট আর বিশ্বের সব জায়গাতেই এমনটা হয়। আমার ঠিক মনে নেই কোন ভেন্যুতে, তবে বৃষ্টির কারণে খেলা দুই দিন বন্ধ থাকতে বোধহয় দেখেছিলাম নিউজিল্যান্ডে।' আবহাওয়ার বৈরিতা এবং মান্ধাতা আমলের ড্রেনেজ সিস্টেমের কারণে শিষ্যদের ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে টেস্ট-পরীক্ষায় দেখার সুযোগ এখনো পাননি ইয়ুর্গেনসেন। তবে দলের ওপর তাঁর প্রবল আস্থা। সেটি এমনভাবেই যে দুই দিন বৃষ্টিতে ভেসে গেলেও ম্যাচের ফল নিয়ে উপসংহারে আসতে পারছেন না তিনি, 'ম্যাচে বাকি সময়টা ব্যাট-বলে আমাদের দক্ষতা দেখাতে হবে। যদি সেটি আমরা করতে পারি, তাহলে হয়তো জয়ের মতো জায়গায় দল চলে যেতে পারে। শুরুটা ভালো হলে এবং ব্যাট-বলে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করতে পারলে কে জানে, টেস্টের শেষ দিন শেষ সেশনে কী হবে!'
তবে তার আগে টেস্টটা তত দূর গড়াতে হবে তো! ম্যাচের শেষ সেশনের খেলা এরই মধ্যে হয়ে গেল কি না, কে জানে! রাতের সব তারাই যেমন থাকে দিনের আলোর গভীরে, সাগরিকার আকাশ যে তেমনি খেয়ালি। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আকাশের ওপারের আকাশে ঘাপটি মেরে মেঘকণিকার দলের বসতি। কাল রাতে যদি আরেকবার অঝোরে তা ঝরে থাকে, তাহলেই সর্বনাশ!

No comments

Powered by Blogger.