ব্যাংকের মুনাফার হিসাব প্রকাশ ও তা বাজারে আনার সুপারিশ
পুঁজিবাজার থেকে গত কয়েক বছরে ব্যাংক, বিমা ও অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ মুনাফা করেছে, তার হিসাব প্রকাশের দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ওই মুনাফার টাকা পুনরায় শেয়ারবাজারে ফিরিয়ে আনারও সুপারিশ করা হয়েছে।
গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর ইস্কাটনে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এসব দাবি জানানো হয়। বৈঠকে শেয়ারবাজারের ধসের জন্য কারা দায়ী, তা নিয়েও অনেক কথাবার্তা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানা উপায়ে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে অর্থ তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ নিয়ে এক দফা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় বলেও জানা গেছে।
শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হওয়া এ বৈঠক চলে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।
অর্থমন্ত্রী ছাড়াও বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি এ কে আজাদ, এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ চৌধুরী, সাবেক উপদেষ্টা ও শিল্পপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান, বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সহসভাপতি আল মারুফ খান, বাংলাদেশ পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএলসিএ) সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী, ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার, এবি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কাইজার এ চৌধুরী, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি শেখ মর্তুজা আহমেদসহ শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা বলেন, গত কয়েক বছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এসব টাকা বাজারে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন ব্যাংক কত টাকা মুনাফা করেছে তাও জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবি জানিয়ে তাঁরা বলেন, ব্যাংকের আমানতের কোনো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। কেউ তা চায়ও না।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান সভায় বলেন, যেসব কোম্পানির শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির পর নির্দেশক দামের নিচে নেমে এসেছে, ওই সব কোম্পানির বেলায় আইন করে নিজ কোম্পানির শেয়ার পুনঃক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে তুলে নেওয়া টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম তালিকাভুক্তির ছয় মাসের মধ্যে নির্দেশক দামের নিচে নেমে আসে তাহলে কোম্পানিটির শেয়ারের যে পরিমাণ দাম কমবে সমপরিমাণ অর্থ কোম্পানিটিকে বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে বা ওই সমপরিমাণ টাকায় তাকে নিজ কোম্পানির শেয়ার কিনতে হবে।
রকিবুর রহমানের এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সালমান এফ রহমান। তিনিও শেয়ার পুনঃক্রয় (বাই-ব্যাক) ব্যবস্থা চালুর কথা বলেন।
সালমান এফ রহমান বৈঠকের একটি আলোচনাকে কেন্দ্র করে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জানা গেছে, বৈঠকে উপস্থিত একজন তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি উড়োজাহাজ কোম্পানির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই বক্তা বলেন, কোম্পানিটি বছরের পর বছর লোকসান দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ করে আইপিওতে আসার প্রস্তুতি নেওয়ার আগের বছর কোম্পানিটি মুনাফা দেখিয়েছে। যখন কোম্পানিটি লোকসান করেছে, তখন খরচ বেশি দেখানো হয়েছে। কিন্তু যে বছর মুনাফা করেছে, সে বছর খরচ দেখানো হলো কম। এটা কীভাবে সম্ভব, তা বোধগম্য নয়। কোম্পানিটি যে টেলিফোন খরচ দেখিয়েছে, তা তাঁর ব্রোকারেজ হাউসের টেলিফোন খরচের চেয়েও কম।
এ বক্তব্যের পরপরই সালমান এফ রহমান বলেন, তিনি বহু ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও তাঁকে এভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়নি। এসব আলোচনা এ ফোরামের বিষয় নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর উড়োজাহাজ বহরে নতুন নতুন জাহাজ যুক্ত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রুট চালু করা হয়েছে। এসব কারণে মুনাফা হয়েছে। টেলিফোন খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ‘সিটা’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এ কারণে টেলিফোন খরচ কম হয়েছে। এসব বিষয়ে না জেনে ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হয়নি।
সিএসইর সহসভাপতি আল মারুফ খান প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে একসঙ্গে পুরো টাকা বাজার থেকে তোলার সুযোগ না দিয়ে ধাপে ধাপে টাকা তোলার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি আইপিও-প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে যুক্ত করার দাবি জানিয়ে বলেন, এতে পুরো প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমবে। দীর্ঘদিন টাকা আটকে থাকবে না। পাশাপাশি কোম্পানির দামভেদে আরোপিত সার্কিট ব্রেকার (দাম বাড়া-কমার নির্ধারিত সীমা) সীমা কমিয়ে আনার কথা বলেন, যাতে খুব বেশি লাভ-লোকসানের সুযোগ না থাকে। পাশাপাশি প্রাইভেট প্লেসমেন্টকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান সিএসইর প্রতিনিধিরা।
দুই এক্সচেঞ্জের নেতারা বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা কোম্পানিগুলোর হিসাব বিবরণী নিরীক্ষার দাবি জানান।
সভায় উপস্থিত ব্যাংকাররা বলেন, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে যে মুনাফা করেছে তার একটি অংশ ওই ব্যাংকেরই সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংকে রিজার্ভ হিসেবে রাখতে হবে। তার পরই ওই ব্যাংক মুনাফার ভিত্তিতে লভ্যাংশ ঘোষণা করবে।
জানা গেছে, সভায় তিনটি কোম্পানি বাজার থেকে বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, ওই সব কোম্পানি তালিকাভুক্তির শুরুতে বিনিয়োগকারীদের কাছে যে দামে শেয়ার বিক্রি করেছে, ধীরে ধীরে তার দাম কমেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কীভাবে কোম্পানিগুলোকে উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রির সুযোগ দেওয়া হলো, এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
সভায় উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি একপর্যায়ে বক্তব্য দিতে চাইলে অর্থমন্ত্রী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আলাদা বৈঠকে তোমাদের কথা শোনা হবে। এখানে আমি অন্যদের কথা শুনতে চাই।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম শেয়ারবাজারের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসে গেলে সেখানে দলের লোকজন বাজার সম্পর্কে জানতে চান। শেয়ারবাজারের অস্থিরতার কারণে দলের অনেক কর্মীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে তাঁদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ বাজারের সঙ্গে এখন সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোক জড়িত। এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটিকে কোনোভাবেই অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই।
সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আশানুরূপ ফল অর্জন না করার পেছনে শেয়ারবাজারের অস্থিরতার একটা প্রভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
সভায় সব শেয়ারের অভিন্ন অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) নির্ধারণের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, অভিহিত মূল্য পরিবর্তনে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলেও এটিকে কেন্দ্র করে বাজারে কারসাজি হয়েছে। এটিও বাজারে অস্থিরতা তৈরিতে সহায়তা করেছে। ভবিষ্যতে কেউ যাতে এভাবে আর দামে কারসাজি করতে না পারে, সে জন্য সব কোম্পানির অভিন্ন অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করা উচিত।
পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতার স্বার্থে এসইসির জনবল বাড়ানো এবং একে আরও বেশি শক্তিশালী করার পরামর্শ তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া বাজার নিয়ে যেকোনো মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন উপস্থিত অনেকে। তাঁরা বলেন, সরকারের লোকজনই বাজার নিয়ে যেসব মন্তব্য করছেন, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট আরও বাড়াচ্ছে।
সভায় উপস্থিত অনেকে সরাসরি নাম উল্লেখ না করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সাম্প্রতিক বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, এ মুহূর্তে কারোরই দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়।
শেয়ারবাজার সম্পর্কে না জেনে, না বুঝে কেউ যাতে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে না পারেন, সে জন্য আর্থিক বিশ্লেষক লাইসেন্স পদ্ধতি চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাজারের গভীরতা বাড়াতে তহবিল ও পত্রকোষ (পোর্টফোলিও) ছাড়পত্র চালুরও কথা বলেন কেউ কেউ।
সকালের এই সভাতেই মূল্যসূচকের ওপর আরোপিত সার্কিট ব্রেকার তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গতকালের সভায় শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করা হয়। বাজারের এই অস্থিরতার কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন অনেকে।
গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর ইস্কাটনে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এসব দাবি জানানো হয়। বৈঠকে শেয়ারবাজারের ধসের জন্য কারা দায়ী, তা নিয়েও অনেক কথাবার্তা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানা উপায়ে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে অর্থ তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ নিয়ে এক দফা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় বলেও জানা গেছে।
শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হওয়া এ বৈঠক চলে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।
অর্থমন্ত্রী ছাড়াও বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি এ কে আজাদ, এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ চৌধুরী, সাবেক উপদেষ্টা ও শিল্পপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান, বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সহসভাপতি আল মারুফ খান, বাংলাদেশ পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএলসিএ) সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী, ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার, এবি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কাইজার এ চৌধুরী, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি শেখ মর্তুজা আহমেদসহ শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা বলেন, গত কয়েক বছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এসব টাকা বাজারে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন ব্যাংক কত টাকা মুনাফা করেছে তাও জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবি জানিয়ে তাঁরা বলেন, ব্যাংকের আমানতের কোনো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। কেউ তা চায়ও না।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান সভায় বলেন, যেসব কোম্পানির শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির পর নির্দেশক দামের নিচে নেমে এসেছে, ওই সব কোম্পানির বেলায় আইন করে নিজ কোম্পানির শেয়ার পুনঃক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে তুলে নেওয়া টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম তালিকাভুক্তির ছয় মাসের মধ্যে নির্দেশক দামের নিচে নেমে আসে তাহলে কোম্পানিটির শেয়ারের যে পরিমাণ দাম কমবে সমপরিমাণ অর্থ কোম্পানিটিকে বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে বা ওই সমপরিমাণ টাকায় তাকে নিজ কোম্পানির শেয়ার কিনতে হবে।
রকিবুর রহমানের এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সালমান এফ রহমান। তিনিও শেয়ার পুনঃক্রয় (বাই-ব্যাক) ব্যবস্থা চালুর কথা বলেন।
সালমান এফ রহমান বৈঠকের একটি আলোচনাকে কেন্দ্র করে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জানা গেছে, বৈঠকে উপস্থিত একজন তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি উড়োজাহাজ কোম্পানির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই বক্তা বলেন, কোম্পানিটি বছরের পর বছর লোকসান দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ করে আইপিওতে আসার প্রস্তুতি নেওয়ার আগের বছর কোম্পানিটি মুনাফা দেখিয়েছে। যখন কোম্পানিটি লোকসান করেছে, তখন খরচ বেশি দেখানো হয়েছে। কিন্তু যে বছর মুনাফা করেছে, সে বছর খরচ দেখানো হলো কম। এটা কীভাবে সম্ভব, তা বোধগম্য নয়। কোম্পানিটি যে টেলিফোন খরচ দেখিয়েছে, তা তাঁর ব্রোকারেজ হাউসের টেলিফোন খরচের চেয়েও কম।
এ বক্তব্যের পরপরই সালমান এফ রহমান বলেন, তিনি বহু ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও তাঁকে এভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়নি। এসব আলোচনা এ ফোরামের বিষয় নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর উড়োজাহাজ বহরে নতুন নতুন জাহাজ যুক্ত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রুট চালু করা হয়েছে। এসব কারণে মুনাফা হয়েছে। টেলিফোন খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ‘সিটা’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এ কারণে টেলিফোন খরচ কম হয়েছে। এসব বিষয়ে না জেনে ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হয়নি।
সিএসইর সহসভাপতি আল মারুফ খান প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে একসঙ্গে পুরো টাকা বাজার থেকে তোলার সুযোগ না দিয়ে ধাপে ধাপে টাকা তোলার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি আইপিও-প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে যুক্ত করার দাবি জানিয়ে বলেন, এতে পুরো প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমবে। দীর্ঘদিন টাকা আটকে থাকবে না। পাশাপাশি কোম্পানির দামভেদে আরোপিত সার্কিট ব্রেকার (দাম বাড়া-কমার নির্ধারিত সীমা) সীমা কমিয়ে আনার কথা বলেন, যাতে খুব বেশি লাভ-লোকসানের সুযোগ না থাকে। পাশাপাশি প্রাইভেট প্লেসমেন্টকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান সিএসইর প্রতিনিধিরা।
দুই এক্সচেঞ্জের নেতারা বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা কোম্পানিগুলোর হিসাব বিবরণী নিরীক্ষার দাবি জানান।
সভায় উপস্থিত ব্যাংকাররা বলেন, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে যে মুনাফা করেছে তার একটি অংশ ওই ব্যাংকেরই সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংকে রিজার্ভ হিসেবে রাখতে হবে। তার পরই ওই ব্যাংক মুনাফার ভিত্তিতে লভ্যাংশ ঘোষণা করবে।
জানা গেছে, সভায় তিনটি কোম্পানি বাজার থেকে বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, ওই সব কোম্পানি তালিকাভুক্তির শুরুতে বিনিয়োগকারীদের কাছে যে দামে শেয়ার বিক্রি করেছে, ধীরে ধীরে তার দাম কমেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কীভাবে কোম্পানিগুলোকে উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রির সুযোগ দেওয়া হলো, এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
সভায় উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি একপর্যায়ে বক্তব্য দিতে চাইলে অর্থমন্ত্রী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আলাদা বৈঠকে তোমাদের কথা শোনা হবে। এখানে আমি অন্যদের কথা শুনতে চাই।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম শেয়ারবাজারের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসে গেলে সেখানে দলের লোকজন বাজার সম্পর্কে জানতে চান। শেয়ারবাজারের অস্থিরতার কারণে দলের অনেক কর্মীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে তাঁদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ বাজারের সঙ্গে এখন সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোক জড়িত। এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটিকে কোনোভাবেই অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই।
সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আশানুরূপ ফল অর্জন না করার পেছনে শেয়ারবাজারের অস্থিরতার একটা প্রভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
সভায় সব শেয়ারের অভিন্ন অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) নির্ধারণের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, অভিহিত মূল্য পরিবর্তনে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলেও এটিকে কেন্দ্র করে বাজারে কারসাজি হয়েছে। এটিও বাজারে অস্থিরতা তৈরিতে সহায়তা করেছে। ভবিষ্যতে কেউ যাতে এভাবে আর দামে কারসাজি করতে না পারে, সে জন্য সব কোম্পানির অভিন্ন অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করা উচিত।
পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতার স্বার্থে এসইসির জনবল বাড়ানো এবং একে আরও বেশি শক্তিশালী করার পরামর্শ তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া বাজার নিয়ে যেকোনো মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন উপস্থিত অনেকে। তাঁরা বলেন, সরকারের লোকজনই বাজার নিয়ে যেসব মন্তব্য করছেন, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট আরও বাড়াচ্ছে।
সভায় উপস্থিত অনেকে সরাসরি নাম উল্লেখ না করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সাম্প্রতিক বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, এ মুহূর্তে কারোরই দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়।
শেয়ারবাজার সম্পর্কে না জেনে, না বুঝে কেউ যাতে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে না পারেন, সে জন্য আর্থিক বিশ্লেষক লাইসেন্স পদ্ধতি চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাজারের গভীরতা বাড়াতে তহবিল ও পত্রকোষ (পোর্টফোলিও) ছাড়পত্র চালুরও কথা বলেন কেউ কেউ।
সকালের এই সভাতেই মূল্যসূচকের ওপর আরোপিত সার্কিট ব্রেকার তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গতকালের সভায় শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করা হয়। বাজারের এই অস্থিরতার কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন অনেকে।
No comments