পিলখানা হত্যাকাণ্ড এবং বিভিন্ন তারিখ by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক)

মনের অশান্তি
আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু দ্বিমুখী। প্রথমে, পিলখানায় সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে লিখব। আজ বুধবার ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। আগামীকাল ২৫ ফেব্রুয়ারি। সাত বছর আগে, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে ঢাকা মহানগরের পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস তথা বিডিআর সদর দফতরে একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। অনেকের কাছে এটা একটি বিছিন্ন ঘটনা, আবার অনেকের কাছে অপ্রকাশ্যভাবে এই ঘটনার সাথে অতীতের যোগসূত্র আছে। তাই আমি প্রস্তাব করছি, পাঠক যেন নিজেই কষ্ট করে চিন্তা করেন। দেশ নিয়ে চিন্তা করলে দেশপ্রেম গভীর হয়। দ্বিতীয়ত, এই চিন্তায় সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তারিখের মধ্য থেকে কয়েকটি মাত্র গুরুত্বপূর্ণ তারিখের কথা পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করব। পিলখানার ঘটনা কতটুকু পরিকল্পিত অথবা কতটুকু কাকতালীয়, সেই প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করার সপক্ষে দালিলিক প্রমাণ (ইংরেজি পরিভাষায় : ডকুমেন্টারি এভিডেন্স) আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের হাতে মজুদ নেই; মজুদ থাকার কথাও নয়। কিন্তু আমার মতো সাধারণ লাখ লাখ নাগরিক মানসিক অশান্তি ও অস্বস্তিতে আছে এই মর্মে যে, পিলখানার ঘটনার পেছনে দেশের ভেতরে বা দেশের বাইরের কে বা কারা জড়িত বা জড়িত না, সেটা সুস্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপিত হয়নি। জনগণের মনে আরো একটি অস্বস্তি কাজ করে এই মর্মে যে, ঘটনাটির তদন্ত আদৌ নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কি না? বলে রাখা প্রয়োজন যে, কলামের দ্বিতীয় অংশে তারিখগুলো উপস্থাপন করতে গিয়ে আমি বাংলাদেশের অন্যতম সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং অন্যতম সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখিত বা সঙ্কলিত একটি বই যার নাম- ‘বাংলাদেশের তারিখ’ (প্রকাশ ১৯৯৮) থেকে নিবিড় সহায়তা নিয়েছি। আশা করি, সম্মানিত পাঠকদের মধ্যে যারা চিন্তাশীল তরুণ, তারা একটি তারিখের সাথে আরেকটি তারিখ মিলিয়ে মিলিয়ে নিজের মতো করে, নিজের মনের ভেতরে, উপসংহার টানবেন।
নৃশংসতায় ও সংখ্যায় অতুলনীয়
পিলখানা হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড। যুদ্ধের ময়দানে, এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। এতে হতাহত হতে বাধ্য। ছোট, মাঝারি বা বড় অপারেশনে বিভিন্ন মাত্রার হতাহতের ঘটনা ঘটে। এখন থেকে আনুমানিক ১৫৫ বছর আগে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে একটি অপারেশনে আক্রমণকারী ব্রিটিশ লাইট-ব্রিগেডের চার ভাগের তিন ভাগ হতাহত হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে কামালপুর যুদ্ধে বা সালদা নদীর যুদ্ধে বা আখাউড়ার যুদ্ধে উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা উচ্চ মাত্রায় ছিল। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার মাধ্যমে নিষ্ঠুরতার সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। পিলখানা কোনো যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না, কর্মকর্তারা নিরস্ত্র ছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে অথবা ১৯৭৭-এর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বগুড়া ও ঢাকায় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু দিনদুপুরে, প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ৫৭ জন কর্মকর্তাকে হত্যা করার জন্য যেই কলঙ্কময় দুঃসাহস ওই দিনের পিলখানার বিডিয়ার সৈন্যরা প্রদর্শন করেছিল, সেটা অকল্পনীয়। তৎকালীণ সেনাবাহিনীর উচ্চতম কর্তৃপক্ষ অথবা বাংলাদেশের উচ্চতম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ কর্মকর্তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য (তথা বিদ্রোহ দমনের জন্য) সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়েছিল কি না, সেটি একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। আমি কোনো জরিপের ফলাফল উদ্ধৃৃত করে বলতে পারব না, কিন্তু লাখ লাখ মানুষের মানসপটে প্রোথিত ধারণা হলো, সময়োচিত পদক্ষেপ কোনো মহলই নেয়নি। কেন করেনি তার জন্য কিছু ব্যাখ্যা এ দিকে-ও দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সম্প্রতি ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ওই সময়ের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ নতুন করে বই লিখছেন, যেই বইয়ে তিনি ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির নৃশংস ঘটনাবলির প্রসঙ্গে তার দায়ভার ব্যাখ্যা করবেন। আমি একজন সাবেক সেনাকর্মকর্তা হিসেবে ওই দিন বিদ্রোহীদের হাতে শহীদ হওয়া সব সেনাকর্মকর্তা ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। ওই ৫৭ সেনাকর্মকর্তার মধ্যে কয়েকজনই ছিল আমার হাতের ক্যাডেট।
উল্লেখ্য, আমি ১০ মে ১৯৯৩ তারিখ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির কমান্ড্যান্ট ছিলাম। একজন কমান্ড্যান্টের কাছে তার হাতের ক্যাডেটরা অতি প্রিয় ও স্নেহভাজন হয়।
মোটিভ ছাড়া হত্যাকাণ্ড হয় কি?
পৃথিবীতে দেশে দেশে এবং যুগে যুগে ক্ষমতার জন্য, পিতা-পুত্র, মাতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-ভাই, এই বংশ বনাম ওই বংশ, বিভিন্ন মাত্রার যুদ্ধ করেছে বা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কেউ বা ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী কেউ তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপসারণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র করে অথবা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিডিআরে কর্মরত কর্মকর্তারা কারো জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কি না অথবা কারো জন্য হুমকি ছিল কি না সেটা তাৎক্ষণিক ও নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যেকোনো হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেহেতু উদ্দেশ্য (মোটিভ) থাকতে বাধ্য, তাই পিলখান হত্যাকাণ্ডের পেছনে কার পক্ষ থেকে কী মোটিভ থাকতে পারে, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। রাশিয়ার বিখ্যাত সাবেক স্বৈরশাসক জোসেফ স্টালিনের শাসনামলের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি- ১৯১৮ সালে যখন কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল হয় তখন সাবেক ‘জার’-এর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা তুখাচেভসকি কমিউনিস্ট সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তুখাচেভসকি মেধাবী-কর্মঠ কর্মকর্তা ছিলেন এবং নিজ গুণে তরতর করে ওপরের দিকে প্রমোশন পান। ১৯৩৫ সালে তিনি ‘মার্শাল অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ র‌্যাংক-এ ঊন্নীত হন। কিন্তু জোসেফ স্টালিন মেধাবীদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ এবং বৈরী ছিলেন। কারণ স্টালিন মনে করতেন যে, মেধাবীরা তাদের মেধা ব্যবহার করে স্টালিনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। তাই স্টালিন একটি সাজানো তদন্ত করিয়ে মার্শাল মিখাইল তুখাচেভসকি এবং আরো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। অভিযোগ হলো যে, এরা সোভিয়েত রাশিয়ার স্বার্থ লঙ্ঘন করে জার্মানির অনুকূলে কিছু কাজ করছেন। এই কর্মকর্তাদের ধরে তাদের ওপর অত্যাচার করে, তাদের মুখ দিয়ে সাজানো স্বীকৃতি আদায় করে আরো হাজার হাজার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ফাঁসানো হয়। এরপর তাদের একাধিক নিয়মে রুশ সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের পর অর্ধেকর বেশির কোনো খোঁজখবর পৃথিবী পায়নি। একটি মুদ্রিত সূত্র মোতাবেক, যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল তাদের সংখ্যা নিম্নরূপ : মোট পাঁচজন মার্শালের মধ্যে তিনজন, পনেরোজন আর্মি-কমান্ডারের মধ্যে ১৩ জন, ৯ জন অ্যাডমিরালের মধ্যে আটজন, মোট ৫৪ জন আর্মি কোর-কমান্ডারের মধ্যে ৫০ জন, ১৮৬ জন ডিভিশন-কমান্ডারের মধ্যে ১৫৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। মুদ্রিত সূত্রের মূল্যায়ন মোতাবেক, জার্মানির হিটলার মনে করেছিল- এত জ্যেষ্ঠ, দক্ষ, মেধাবী কর্মকর্তা যখন গায়েব হয়ে গেছে, তাহলে নিশ্চই সোভিয়েত আর্মি দুর্বল হয়ে গেছে; অতএব, সোভিয়েত রাশিয়াকে আক্রমণ করা যেতেই পারে। হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করেছিল। জুনিয়ররা জ্যেষ্ঠ হয়ে জার্মানিকে প্রতিরোধ করতে সময় দিয়েছিল।
১৯৭৪-এর কয়েকটি তারিখ
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ : ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য ও বৈদেশিকমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান কর্তৃক মন্ত্রিপরিষদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগপত্র পেশ করেন এবং তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ : বাণিজ্যমন্ত্রী পদে খন্দকার মোশতাক আহমেদ স্থলাভিষিক্ত। ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পকিস্তানের লাহোর মহানগরীতে ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণ। ২৭ জুন ১৯৭৪ : তিন দিনের সফরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন। ২৫ সেপ্টম্বর ১৯৭৪ : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক, জাতিসঙ্ঘে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ : সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি। ধর্মঘট-লকআউট ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা; মৌলিক অধিকার স্থগিত।
১৯৭৫-এর কয়েকটি তারিখ
২ জানুয়ারি ১৯৭৫ : পুলিশের সাথে এক সংঘর্ষে (?) পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রধান সিরাজ সিকদার নিহত হন। ৩ জানুয়ারি ১৯৭৫ : সরকার চোরাচালানি-কালোবাজারিদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার লক্ষ্যে জরুরি ক্ষমতা আইন ১৯৭৫ ঘোষণা করে। ৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ : সরকারি জরুরি ক্ষমতা আইন ১৯৭৫-এর আদেশ বলে জনসভা, জনসমাগম ও সব ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২১ জানুয়ারি ১৯৭৫ : আওয়ামী লীগ সংসদীয় কমিটির সমাপনী সভায় জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য যেকোনো পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ : জাতীয় সংসদে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি ও একদলীয় বা একমাত্র রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত। সংশোধনী বলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট পদে আসীন। ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ : মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নতুনভাবে বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অন্যতম মন্ত্রী মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে দায়িত্বভার নেন। ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৫ : জাসদপন্থী দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’-এর কার্যালয় পুলিশ ‘সিজ’ করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ : বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে নতুন জাতীয় রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেন; বঙ্গবন্ধু দলের চেয়ারম্যান। অন্য সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা। ১৬ জুন ১৯৭৫ : সংবাদপত্র অর্ডিনেন্স ঘোষিত। শুধু চারটি দৈনিক যথা : বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা এবং সারা দেশে শুধু ১২২টি ম্যাগাজিনের প্রকাশনা অব্যাহত থাকবে; অন্য সব পত্রিকা ও ম্যাগাজিন প্রকাশনা বন্ধ। ১২ আগস্ট ১৯৭৫ : প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী যশোর ক্যান্টনমেন্টে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সামরিক বাহিনীকে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ : অতি ভোরে সামরিক বাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ পরিচালিত ক্যু-দ্য-তার ফলে বঙ্গবন্ধু নিহত তথা শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু ক্যাবিনেটের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন; দেশে সামরিক আইন জারি করেন; বিগত তথা বঙ্গবন্ধু সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ক্যাবিনেটের দশজন মন্ত্রী ও ছয়জন প্রতিমন্ত্রী পুনর্বহাল; খন্দকার মোশতাকের সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক। ১৭ আগস্ট ১৯৭৫ : সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর সাথে রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ। ২০ আগস্ট ১৯৭৫ : বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ। ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ : মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর স্থলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নতুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত। ১ সেপ্টম্বর ১৯৭৫ : বাকশাল পদ্ধতি রহিত। ৫ অক্টোবর ১৯৭৫ : জাতীয় রক্ষীবাহিনী তথা সংক্ষেপে জেআরবি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে একীভূত করার জন্য আদেশ জারি। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ : অতি প্রত্যুষে, তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ বীর উত্তমের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি অংশের ক্যু-দ্য-তা সংঘটিত; সেনাবাহিনীপ্রধান জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে গৃহবন্দী করা হয়; কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতা নিহত। ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ : ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ সেনাবাহিনী প্রধান হন। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ : প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ : তারিখ শুরু হওয়ার সাথে সাথে জাসদপন্থী গোপন সৈনিক সংস্থার উদ্যোগে সৈনিক বিপ্লøব শুরু। রাতের অন্ধকারে ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবী সৈনিকদের হাতে বা জাসদপন্থী বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে মহিলা ডাক্তারসহ ১১ জন সেনাকর্মকর্তা নিহত। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ : সৈনিক জনতার বিপ্লব; মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম আবার সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নেন।
১৯৭৬-এর কয়েকটি তারিখ
৩ মার্চ ১৯৭৬ : বাঙালি জাতীয়তার পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তা আখ্যায়িত করার নির্দেশ। ২২ মার্চ ১৯৭৬ : নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণের খসড়া প্রণীত। ২৮ মে ১৯৭৬ : সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের পৃথকীকরণ প্রসঙ্গে আদেশ জারি। ২৮ জুন ১৯৭৬ : নির্বাচনী এলাকার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ। ৩০ জুন ১৯৭৬ : সংবাদপত্র ডিক্লারেশন বাতিল আদেশ রহিত ঘোষণা। ২৮ জুলাই ১৯৭৬ : রাজনৈতিক বিধি জারি। ৩০ জুলাই ১৯৭৬ : ঘরোয়া রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু। ৪ আগস্ট ১৯৭৬ : রাজনৈতিক দল গঠনের বিস্তারিত নিতিমালা প্রকাশ। ১৩ সেপ্টম্বর ১৯৭৬ : ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে সরকারি শ্বেতপত্র প্রকাশ। ১ নভেম্বর ১৯৭৬ : যশোরে যদুনাথপুর বেতনা নদীতে স্বেচ্ছাশ্রমে, খাল খননকাজ উদ্বোধন করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। ৪ নভেম্বর ১৯৭৬ : রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অনুমোদন লাভ। ২৯ নভেম্বর ১৯৭৬ : প্রেসিডেন্ট সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বরাবরে হস্তান্তর করেন।
১৯৭৭-১৯৭৮-এর কয়েকটি তারিখ
২২ এপ্রিল ১৯৭৭ : জাতীর উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ভাষণ। কয়েকটি ঘোষণা : ৩০ মে ১৯৭৭: গণভোট, ডিসেম্বর ১৯৭৮ নির্বাচন। ৩০ এপ্রিল ১৯৭৭ : জাতির উদ্দেশে জিয়াউর রহমান সমৃদ্ধির ১৯ দফা নীতি কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২৫ সেপ্টম্বর ১৯৭৭ : দীর্ঘ ১৩ বছর পর ঢাকা পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত। ২৮ সেপ্টম্বর ১৯৭৭ : ছিনতাই করা একটি জাপানি বিমানের ১৫৬ জন আরোহীসহ ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ। ২৯ সেপ্টম্বর ১৯৭৭ : নয়াদিল্লিতে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি অনুস্বাক্ষরিত। ৩০ সেপ্টম্বর ১৯৭৭ : বগুড়া সেনানিবাসে সৈনিক বিদ্রোহ বা গোলযোগ। ১ অক্টোবর ১৯৭৭ : বিমান ছিনতাই ঘটনা : পারস্পরিকভাবে শর্ত পূরণ। ২ অক্টোবর ১৯৭৭ : ঢাকা সেনানিবাসে সৈন্যদের মধ্যে গুলিবিনিময়। ঢাকা মহানগরির বিভিন্ন এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গ। ঢাকা বিমানবন্দরে কর্তব্যরত অবস্থায় বিমানবাহিনীর ১১ জন কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনীর ১০ ব্যক্তি নিহত। সেনাবাহিনীর ৪০ জন আহত। ২ অক্টোবর ১৯৭৭ : চিনতাই নাটকের অবসান। ১৭ অক্টোবর ১৯৭৭ : বগুড়া ও ঢাকার ঘটনা তদন্তে বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি গঠনের নির্দেশ। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭ : জাতির উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ৯৫ মিনিটব্যাপী ভাষণ, নয়া রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত। ৯ এপ্রিল ১৯৭৮ : জিয়াউর রহমান নতুন রাজনৈতিক দলে যোগদানের কথা ঘোষণা করেন। ২২ এপ্রিল ১৯৭৮ : ১ মে থেকে রাজনৈতিক সভা করার অনুমতি দান। ১ মে ১৯৭৮ : জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ৬-দলের জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠিত। ৩ জুন ১৯৭৮ : বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বিপুল ভোটে জিয়াউর রহমানের জয়লাভ। ১ সেপ্টম্বর ১৯৭৮ : প্রেসিডেন্ট জিয়া নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেন।
১৯৭৯ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত কয়েকটি তারিখ
১৯ এপ্রিল ১৯৭৯ : চট্টগ্রাম মহানগরে প্রেসিডেন্ট বিপ্লব উদ্যান উদ্বোধন করেন। ২৭ নভেম্বর ১৯৭৯ : ১৯৭৪ সালে ঘোষিত জরুরি অবস্থার অবসান; স্থগিত মৌলিক অধিকার পুনর্বহাল। ২ জানুয়ারি ১৯৮০ : মন্ত্রিপরিষদ থেকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে অব্যাহতি দান। ১৭ মে ১৯৮১ : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কমবেশি ছয় বছর পর বাংলাদেশে ফেরত আসেন। ৩০ মে ১৯৮১ : চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে অতি প্রত্যুষে, বিদ্রোহী সেনাসদস্যদের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হন তথা শাহাদতবরণ করেন। ১২ জুন ১৯৮১ : শেখ হাসিনার কাছে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি হস্তান্তর। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২ : রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার দুর্নীতিবাজ মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা। ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২ : ১৮ সদস্যবিশিষ্ট নয়া মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ। ২৪ মার্চ ১৯৮২ : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে, ক্যু-দ্য-তা সংঘটিত; নির্বাচিত সরকার অপসারিত; সারা দেশে সামরিক আইন জারি; রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ; জেনারেল এরশাদের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ। ২৭ মাচ ১৯৮২ : রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দিন চৌধুরীর শপথ গ্রহণ। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ : প্রেসিডেন্ট আহসানউদ্দিন চৌধুরীর পদত্যাগ ও জেনারেল এরশাদ কর্তৃক প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ। ১ জানুয়ারি ১৯৮৬ : নয়া রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টি’ গঠিত। ৭ মে ১৯৮৬ : তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত। ৪ সেপ্টম্বর ১৯৮৬ : সেনাবাহিনী থেকে প্রেসিডেন্ট এরশাদের অবসর গ্রহণ। ২৭ নভেম্বর ১৯৯০ : দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা। সব সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ। সরাকারি আদেশ অমান্য করা শুরু ব্যাপকভাবে। ৪ ডিসেম্বর ১৯৯০ : গণ-অভ্যুত্থান। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ : রাষ্ট্রপতি এরশাদের পদত্যাগ; প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। ১২ আগস্ট ১৯৯১ : সংবিধান সংশোধনী প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য ১৫ সেপ্টম্বর ১৯৯১ তারিখটি নির্ধারিত হয়। ১৫ সেপ্টম্বর ১৯৯১ : গণভোট অনুষ্ঠিত। হ্যাঁ ভোট=৮৪.৪২ ভাগ। অর্থাৎ ১৯৭৫-এর জানুয়ারি থেকে চলে আসা প্রেসিডেন্সিয়াল বা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারের বদলে পার্লামেন্টারি বা সংসদীয় পদ্ধতির সরকার বহাল করার জন্য বাংলাদেশ সংবিধানে প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী দেশে গণভোট বা রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত করা হয়েছিল।
উপসংহার
এবারের কলামটিতে আমি আবেদন করেছি, চিন্তাশীল তরুণেরা যেন চিন্তা করেন। চিন্তা করা একটি কঠিন কাজ, যদি অভ্যাস না থাকে। নিজে চিন্তা করে কোনো উপসংহারে পৌঁছলে তা মানুষের মনে স্থিতিশীল হয় বেশি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

No comments

Powered by Blogger.