বাংলাদেশে বড় প্রকল্পের কাজ পেতে ভারত-চীন প্রতিযোগিতা by দীন ইসলাম
বাংলাদেশে বড় প্রকল্পের ঠিকাদারি নিতে দুই শক্তিধর দেশ ভারত-চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, কর্ণফুলী নদীতে টানেল, বেশ কিছু রেলপথ নির্মাণ, রেলপথের ইঞ্জিন, কোচ সরবরাহ, নতুন রেললাইন নির্মাণ, বাস-ট্রাক কেনার উদ্যোগ এবং পদ্মা সেতুর বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ। এরই মধ্যে চীন কয়েকটি সেক্টর রীতিমতো দখল করে ফেলেছে। সরকারের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে চীনের সরকারি কোম্পানিগুলোর ব্যবসা থাকায় তারা বাজার দখল করছে সহজেই। কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারত ও চীনের কেউই এককভাবে অন্যকে বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে রাজি নয়। এজন্য যে যার অবস্থান থেকে নানা ধরনের তদবিরও করছে। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলমান বড় অবকাঠামো প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুর বড় দুই অংশের কাজ এককভাবে করছে চীন। দেশটির চায়না মেজর ব্রিজ মূল সেতু ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন নদীশাসনের কাজ করছে। আবার কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণেও আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এরই মধ্যে টানেলটি নির্মাণ ও অর্থায়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও সমঝোতা স্মারক সই করেছে চীন। এদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ নিতে চাইছে ভারত। এজন্য ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দরপত্র শিথিলের প্রস্তাব করেছে দেশটি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে হলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিদেশে ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আর ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) চায়, দরপত্র প্রতিযোগিতামূলক করতে এ শর্ত তুলে দেয়া হোক। কেননা পিডিবির শর্ত বহাল থাকলে ভারতীয় কোম্পানি দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে চীন, জাপান, কোরিয়া ও ইউরোপের কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করবে। কিন্তু এ দরপত্রে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেডের (ভেল) অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় দেশটি। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের দরপত্রেও অংশ নিয়েছে ভারত। মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ-সংক্রান্ত দরপত্র যাচাই কমিটির সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছে দেশটির সর্ববৃহৎ গ্যাস আমদানিকারক পেট্রোনেট এলএনজি। দরপত্র মূল্যায়নে নির্বাচিত হলে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বছরে ৫০ লাখ টন এলএনজি আমদানি, টার্মিনাল নির্মাণ ও তা পরিচালনায় দায়িত্ব পাবে। জ্বালানি খাত ছাড়াও সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের আগ্রহ দেখিয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপ। প্রস্তাবিত বন্দরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং কয়লা খালাস ও সংরক্ষণে একটি পৃথক জেটি নির্মাণেও আগ্রহী দেশটির শিল্প গ্রুপ। যদিও এর আগে কখনোই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভারত আগ্রহ দেখায়নি। অন্যদিকে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য বরাবরই আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। ২০১৩ সালে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবও দেয় দেশটি। তবে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সরকার এককভাবে কোন দেশকে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ভারত আগ্রহ দেখায়। স্বল্পসুদে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও দুই দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। চীনের বায়ার্স ক্রেডিটের বিপরীতে ১০০ কোটি ডলার লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) হিসেবে দিয়েছে ভারত। এর মধ্যে ৮০ কোটি ডলার অবকাঠামো ঋণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি ২০ কোটি ডলার পদ্মা সেতু নির্মাণে অনুদান হিসেবে দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েও ভারত-চীনের মধ্যে বড় ধরনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। টঙ্গী-ভৈরব বাজার ও লাকসাম-চিনকি আস্তানা ডাবল লাইন নির্মাণের কাজ করছে চীন। ঈশ্বরদী-পাবনা- ঢালারচর রেলপথও নির্মাণ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম ডুয়াল গেজ ডাবল লাইনসহ হাইস্পিড ট্রেন, দোহাজারী- কক্সবাজার-গুনদুম ডুয়াল গেজ রেলপথ ও ময়মনসিংহ-জয়দেবপুর ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। তবে ডলার ক্রেডিট লাইনের (এলওসি) আওতায় দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস রেল সেতু নির্মাণ করছে ভারত। এ ছাড়া খুলনা- মংলা রেলপথ ও ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন নির্মাণ করতে যাচ্ছে ভারত। যদিও গত কয়েক বছরে রেলওয়ের ইঞ্জিন-কোচ সরবরাহেও ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। এরই মধ্যে দুই ধাপে ২৬টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন সরবরাহ করেছে দেশটি। আর ১২০টি ব্রডগেজ কোচ সরবরাহে চুক্তি হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এ ছাড়া ১৬৫টি ব্রডগেজ ও ৮১টি মিটার গেজ তেলবাহী ট্যাংকার ও ২২০টি পণ্যবাহী ওয়াগন এলওসির আওতায় সরবরাহ করেছে ভারত। তবে ২০ সেট ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডেমু) ২০১৩ সালে সরবরাহ করে চীন। এ ডেমু ট্রেন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস সরবরাহ নিয়েও দুই দেশের প্রতিযোগিতা রয়েছে। ২০১১ সালে বিআরটিসিকে ২৭৫টি বাস সরবরাহ করে চীন। কিন্তু পরে বিআরটিসির বাজার দখল করে নেয় ভারত। এলওসির আওতায় ২৯০টি দ্বিতল, ৮৮টি এসি একতলা ও ৫০টি আর্টিকুলেটেড (দুই বগির জোড়া লাগানো) বাস সরবরাহ করে দেশটি। তবে বসে নেই চীনও। বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় তারা ২০০ দ্বিতল ও ১০০ আর্টিকুলেটেড বাস এবং ৫০০ ট্রাক সরবরাহ করার জন্য সরকারি মহলে ধরনা দিচ্ছে। এসব নিয়ে সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বড় প্রকল্পের কাজ পেতে দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য শুভ ফল বয়ে না-ও আনতে পারে। কারণ প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে দাম কমিয়ে দিচ্ছেন ঠিকাদাররা। অথবা দরপত্রে বিশেষ শর্ত জুড়ে দেয়া বা ছাড় দেয়া হচ্ছে। এতে ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রতিযোগিতায় ভারত-চীনের সঙ্গে পেরে উঠছে না। এতে কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
No comments