এবার ৬২ লাখ ভোটারের সঙ্গে সংলাপ! by সোহরাব হাসান
জাতিসংঘের
মহাসচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের মাননীয় দূতেরা, নাগরিক সমাজের
সম্মানিত প্রতিনিধিরা যখন হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচি প্রত্যাহার
করতে বলেন, তখন সেটি বিএনপি জোটের ভালো লাগে না। তারা মনে করে, সরকারের
হয়েই তাঁরা কথা বলছেন। আবার এসব ব্যক্তি যখন বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায়
বসে সমস্যা সমাধানের তাগিদ দেন, তখন সেটিকে সরকার দেখে তাদের ওপর অযাচিত
হস্তক্ষেপ হিসেবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির বড় দুর্বলতা হলো: এখানে ন্যায়-অন্যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদির বিচার করা হয় নিজের সুবিধা-অসুবিধার ভিত্তিতে। এ কারণেই আজ ক্ষমতাসীনদের কাছে হরতাল-অবরোধ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং বিরোধী দলের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত। বিএনপি-জামায়াত জোট এখন যেসব মৌলিক মানবাধিকার কিংবা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের জন্য লড়াই করছে, তাদের আমলে সেগুলো সমুন্নত ছিল, সেই দাবি কেউ করবে না। অন্যদিকে সরকার এখন দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালানোকে যেভাবে জায়েজ করতে চাইছে, তারা বিরোধী দলে থাকতে সেই সময়কার ক্ষমতাসীনেরা একই যুক্তি দেখাতেন। কে বলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সবটাই অমিল? ঢের মিল আছে। আর সেই মিলটি হলো, একে অপরের কাছে থেকে মন্দ নজিরটা গ্রহণ করা। ‘তুমি অধম হইলে আমি উত্তম হইব না কেন’ বলে বাংলায় যে একটি নীতিকথা আছে, আমাদের রাজনীতিকেরা তার বিপরীতে চলতেই ভালোবাসেন। তাঁদের ভাবনা হলো ‘তুমি অধম হইলে আমি অধম হইব না কেন?’ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি যে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, সেটি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলের সঙ্গে দ্বিতীয় কিংবা বর্তমান আমলকে মিলিয়ে নিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
----২.
সরকারি দলের নেতারা পণ করেছেন, বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো সংলাপ করবেন না। তাদের সঙ্গে আলোচনা করলেই নাকি গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। অন্যদিকে বিএনপিও আন্দোলন ‘যৌক্তিক পরিণতি’ লাভ না করা পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ তুলে নেবে না। পেট্রলবোমায় মানুষ মরুক, দেশের অর্থনীতি গোল্লায় যাক; আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আবার দুই মাসের আন্দোলনে বাজেটের অর্ধেক পরিমাণ ক্ষতি হলেও সরকারের টনক নড়ে না।
কিন্তু এতে নেতা-নেত্রীদের গোঁয়ার্তুমি বজায় থাকলেও দেশের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। দুই পক্ষই যার যার অবস্থানে অনড়। পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই তাদের নড়াতে পারে। তাহলে সমাধান কী? বিদেশি দূতেরা হতাশ। দেশের নাগরিক সমাজ মানসম্মান নিয়ে চিন্তিত। কারও বক্তৃতা-বিবৃতি এ পক্ষের প্রতিকূলে গেলে যাবে, তিনি চিহ্নিত হবেন প্রতিপক্ষের দালাল হিসেবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নতজানু অবস্থানের প্রতিবাদ করে যে চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করে বিএনপির সাজানো নির্বাচনটি নস্যাৎ করে দিলেন, তাঁরা এখন নির্বাচন নিয়ে হক কথা বললেও আওয়ামী লীগের নেতারা সহ্য করেন না, ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেন। আবার যেই স্বৈরাচারের হাত ময়েজ উদ্দিন-নূর হোসেনসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মীর রক্তে রঞ্জিত, সেই স্বৈরাচার এখন গণতন্ত্রের সাচ্চা সেবক বনে যান। এমনকি স্বৈরাচারের গালিও তাঁরা মুখ বুজে সহ্য করেন। ক্ষমতার রাজনীতির আশ্চর্য মাহাত্ম্য বটে।
বর্তমান বাস্তবতায় অদূর ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে সংলাপের সম্ভাবনা নেই, তা প্রায় নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে আমরা আসন্ন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে একটি বিকল্প সংলাপের প্রস্তাব করছি। সংলাপটি হবে দলের সঙ্গে জনগণের। দলের সমর্থক প্রার্থীর সঙ্গে ভোটারদের। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। আগামী ২৮ এপ্রিল ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখ ২৯ মার্চ, বাছাই ১ ও ২ এপ্রিল ও প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৯ এপ্রিল। এরপরই শুরু হবে নির্বাচনী প্রচারণা। ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের ধরনা।
এই সংলাপের প্রস্তাবটি এ কারণে আনছি যে প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও বিএনপি সিটি নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চাইছে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচনটি যাতে সুচারুভাবে হয়, সেই ব্যবস্থা করা। সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হবে তাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করা। এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য যেমন পরীক্ষা তেমনি সরকারের জন্যও। এই পরীক্ষায় হারজিতের ওপরই ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হবে আশা করা যায়।
তিন সিটি করপোরেশনের মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে নির্বাচন হচ্ছে ১৩ বছর পর। সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০০২ সালের এপ্রিলে। বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকারের কল্যাণে চার বছর বেশি মেয়রগিরি করেছেন। যে দেশে ক্ষমতা বদলের পর মধ্যরাতে উপাচার্যের চেয়ার দখল হয়ে যায়, সে দেশে এটি ব্যতিক্রমী ঘটনা বটে। তবে সেই ব্যতিক্রম ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ঔদার্যের জন্য নয়; যোগ্য প্রার্থী না থাকার কারণে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালা করে প্রায় তিন দশক দেশ পরিচালনা করলেও তরুণ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি বা করার চেষ্টাও করেনি (ছাত্রসংসদ নির্বাচনে তাদের রয়েছে প্রচণ্ড অনীহা)। সবখানেই একধরনের নেতৃত্বশূন্যতা চলছে।
২০১১ সালে যোগ্য নেতৃত্ব না পেয়ে আওয়ামী লীগ ঢাকা সিটি করপোরেশনটি দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল। নির্বাচন এলেই নতুন নতুন প্রার্থীর নাম শোনা যায়। কিন্তু তাতেও তারা আশ্বস্ত হতে পারছে বলে মনে হয় না। বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধের মুখে সিটি নির্বাচন দিয়ে সরকার সম্ভবত এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল। তবে বিএনপির সবাই নিশ্চয়ই তারেক রহমানের মতো মাথা গরম নন। তাঁরা বাস্তবতার নিরিখে চলতে চান। সিটি নির্বাচনকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চান। এ খবর চাউর হওয়ার পর ক্ষমতাসীন মহলে চাপান-উতর শুরু হয়ে গেছে। প্রার্থীর গুণাগুণ পরখ করা হচ্ছে।
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন বিলম্বিত হলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন হচ্ছে মেয়াদ থাকতেই। সেখানে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলম না শাহাদৎ হোসেন হবেন, সেটি নিয়ে জল্পনা চলছে। পুরোনো দুই প্রতিদ্বন্দ্বী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আবদুচ ছালামকে বাদ দিয়ে আ জ ম নাছিরকে সমর্থন দেওয়ার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ। ঢাকায় বিএনপির পক্ষে যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁরা হলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু, আসাদুজ্জামান রিপন, আবদুস সালাম, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও বরকত উল্লা। আওয়ামী লীগ উত্তরে ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক ও দক্ষিণে সাঈদ খোকনকে সমর্থন দেওয়ার কথা বললেও একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। বাম দলগুলো থেকে রুহিন হোসেন প্রিন্স, আবদুল্লাহ হেল কাফি ও জুনায়েদ সাকী প্রমুখ প্রার্থী হচ্ছেন। জাতীয় পার্টি থেকে সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন।
-----৩.
এটা ঠিক যে এই নির্বাচনে সরকার পড়ে যাবে না। বিরোধী দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তবে জনপ্রিয়তার পরীক্ষা হবে। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুই সিটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে চার সিটি করপোরেশন যথা বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী ও খুলনায় জিতেছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী। কিন্তু ২০১৩ সালে গাজীপুরসহ ওই পাঁচ সিটিতে জয়ী হন বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা। এবার কারা জয়ী হবেন, তা ঠিক করবেন তিন সিটির ৬২ লাখ (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে ভোটার যথাক্রমে ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ও ১০ লাখ ৯ হাজার এবং চট্টগ্রামে সাড়ে ১৮ লাখ) ভোটার।
সরকার ও বিএনপি পরস্পর সংলাপ করতে না চাইলেও এই ভোটারদের সঙ্গে একটি সংলাপ তাদের করতে হবে। সম্ভাব্য এই সংলাপে ভোটাররা নিশ্চয়ই সরকারি দলের সমর্থক প্রার্থীর কাছে জানতে চাইবেন, সেবা দেওয়ার নাম করে ঢাকা সিটিকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন; কিন্তু আমরা নাগরিক সেবা থেক কেন বঞ্চিত আছি? কেন এত দিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলো না। তাঁরা আরও জানতে চাইবেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে ঢাকাকে বসবাসের অনুপযোগী সিটিগুলোর মধ্যেও নিকৃষ্টতর বলে চিহ্নিত করার পরও কেন সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিল না? কেন এত দিনে ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে ট্যানারি কারখানা, রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেওয়া হলো না? কেন সরকারি জমি, খেলার মাঠ, খাল, জলাভূমি প্রভাবশালীদের দখলে আছে? কেন সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সমন্বয় নেই? কেন সংস্কারের নামে যত্রতত্র রাস্তা কাটাকাটি করা হচ্ছে? তাঁরা জানতে চাইবেন, সরকারি দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা কেন পাড়ায় পাড়ায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন? কেন তাঁদের চাঁদা না দিয়ে এলাকায় কোনো ঘরবাড়ি নির্মাণ করা যায় না? কেন চট্টগ্রামে নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভারের নিচে চাপা পড়ে এতগুলো মানুষ মারা গেল?
আর বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী তথা তাঁদের সমর্থক প্রার্থীর কাছে প্রশ্ন হবে, হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির নামে কেন ঢাকা ও চট্টগ্রামের জনজীবনকে প্রায় নিশ্চল করে রাখা হয়েছে? কেন দুই নগরের লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না? কেন এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মানসিক পীড়নের মধ্যে রাখা হয়েছে? তারা নিশ্চয়ই জানতে চাইবে কেন আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মারা হলো? কেন বিভিন্ন স্থানে বোমা বানাতে গিয়ে যুবদল, ছাত্রদল ও শিবির কর্মীরা বমাল ধরা পড়ল? কেন হেফাজতের মহাসমাবেশে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল, তার প্রতি বিএনপির নেত্রী সমর্থন জানালেন? একদা সাজানো গোছানো চট্টগ্রামকে কেন নোংরা ও আবর্জনার নগরে পরিণত করা হলো? কেন পাঁচ বছরেও জলাবদ্ধতার অবসান হলো না?
আমরা কেবল সংলাপে জনগণের মনের কথাগুলো তুলে ধরলাম। সাধারণ মানুষের প্রশ্নগুলো এখানে উপস্থাপন করলাম। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা, তাঁদের সমর্থক প্রার্থীরা কী জবাব দেন এবং সেই জবাবে নাগরিকেরা সন্তুষ্ট হবেন কি হবেন না, সেটি জানার জন্য আমাদের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
বাংলাদেশের রাজনীতির বড় দুর্বলতা হলো: এখানে ন্যায়-অন্যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদির বিচার করা হয় নিজের সুবিধা-অসুবিধার ভিত্তিতে। এ কারণেই আজ ক্ষমতাসীনদের কাছে হরতাল-অবরোধ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং বিরোধী দলের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত। বিএনপি-জামায়াত জোট এখন যেসব মৌলিক মানবাধিকার কিংবা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের জন্য লড়াই করছে, তাদের আমলে সেগুলো সমুন্নত ছিল, সেই দাবি কেউ করবে না। অন্যদিকে সরকার এখন দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালানোকে যেভাবে জায়েজ করতে চাইছে, তারা বিরোধী দলে থাকতে সেই সময়কার ক্ষমতাসীনেরা একই যুক্তি দেখাতেন। কে বলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সবটাই অমিল? ঢের মিল আছে। আর সেই মিলটি হলো, একে অপরের কাছে থেকে মন্দ নজিরটা গ্রহণ করা। ‘তুমি অধম হইলে আমি উত্তম হইব না কেন’ বলে বাংলায় যে একটি নীতিকথা আছে, আমাদের রাজনীতিকেরা তার বিপরীতে চলতেই ভালোবাসেন। তাঁদের ভাবনা হলো ‘তুমি অধম হইলে আমি অধম হইব না কেন?’ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি যে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, সেটি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলের সঙ্গে দ্বিতীয় কিংবা বর্তমান আমলকে মিলিয়ে নিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
----২.
সরকারি দলের নেতারা পণ করেছেন, বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো সংলাপ করবেন না। তাদের সঙ্গে আলোচনা করলেই নাকি গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। অন্যদিকে বিএনপিও আন্দোলন ‘যৌক্তিক পরিণতি’ লাভ না করা পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ তুলে নেবে না। পেট্রলবোমায় মানুষ মরুক, দেশের অর্থনীতি গোল্লায় যাক; আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আবার দুই মাসের আন্দোলনে বাজেটের অর্ধেক পরিমাণ ক্ষতি হলেও সরকারের টনক নড়ে না।
কিন্তু এতে নেতা-নেত্রীদের গোঁয়ার্তুমি বজায় থাকলেও দেশের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। দুই পক্ষই যার যার অবস্থানে অনড়। পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই তাদের নড়াতে পারে। তাহলে সমাধান কী? বিদেশি দূতেরা হতাশ। দেশের নাগরিক সমাজ মানসম্মান নিয়ে চিন্তিত। কারও বক্তৃতা-বিবৃতি এ পক্ষের প্রতিকূলে গেলে যাবে, তিনি চিহ্নিত হবেন প্রতিপক্ষের দালাল হিসেবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নতজানু অবস্থানের প্রতিবাদ করে যে চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করে বিএনপির সাজানো নির্বাচনটি নস্যাৎ করে দিলেন, তাঁরা এখন নির্বাচন নিয়ে হক কথা বললেও আওয়ামী লীগের নেতারা সহ্য করেন না, ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেন। আবার যেই স্বৈরাচারের হাত ময়েজ উদ্দিন-নূর হোসেনসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মীর রক্তে রঞ্জিত, সেই স্বৈরাচার এখন গণতন্ত্রের সাচ্চা সেবক বনে যান। এমনকি স্বৈরাচারের গালিও তাঁরা মুখ বুজে সহ্য করেন। ক্ষমতার রাজনীতির আশ্চর্য মাহাত্ম্য বটে।
বর্তমান বাস্তবতায় অদূর ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে সংলাপের সম্ভাবনা নেই, তা প্রায় নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে আমরা আসন্ন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে একটি বিকল্প সংলাপের প্রস্তাব করছি। সংলাপটি হবে দলের সঙ্গে জনগণের। দলের সমর্থক প্রার্থীর সঙ্গে ভোটারদের। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। আগামী ২৮ এপ্রিল ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখ ২৯ মার্চ, বাছাই ১ ও ২ এপ্রিল ও প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৯ এপ্রিল। এরপরই শুরু হবে নির্বাচনী প্রচারণা। ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের ধরনা।
এই সংলাপের প্রস্তাবটি এ কারণে আনছি যে প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও বিএনপি সিটি নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চাইছে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচনটি যাতে সুচারুভাবে হয়, সেই ব্যবস্থা করা। সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হবে তাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করা। এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য যেমন পরীক্ষা তেমনি সরকারের জন্যও। এই পরীক্ষায় হারজিতের ওপরই ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হবে আশা করা যায়।
তিন সিটি করপোরেশনের মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে নির্বাচন হচ্ছে ১৩ বছর পর। সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০০২ সালের এপ্রিলে। বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকারের কল্যাণে চার বছর বেশি মেয়রগিরি করেছেন। যে দেশে ক্ষমতা বদলের পর মধ্যরাতে উপাচার্যের চেয়ার দখল হয়ে যায়, সে দেশে এটি ব্যতিক্রমী ঘটনা বটে। তবে সেই ব্যতিক্রম ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ঔদার্যের জন্য নয়; যোগ্য প্রার্থী না থাকার কারণে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালা করে প্রায় তিন দশক দেশ পরিচালনা করলেও তরুণ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি বা করার চেষ্টাও করেনি (ছাত্রসংসদ নির্বাচনে তাদের রয়েছে প্রচণ্ড অনীহা)। সবখানেই একধরনের নেতৃত্বশূন্যতা চলছে।
২০১১ সালে যোগ্য নেতৃত্ব না পেয়ে আওয়ামী লীগ ঢাকা সিটি করপোরেশনটি দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল। নির্বাচন এলেই নতুন নতুন প্রার্থীর নাম শোনা যায়। কিন্তু তাতেও তারা আশ্বস্ত হতে পারছে বলে মনে হয় না। বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধের মুখে সিটি নির্বাচন দিয়ে সরকার সম্ভবত এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল। তবে বিএনপির সবাই নিশ্চয়ই তারেক রহমানের মতো মাথা গরম নন। তাঁরা বাস্তবতার নিরিখে চলতে চান। সিটি নির্বাচনকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চান। এ খবর চাউর হওয়ার পর ক্ষমতাসীন মহলে চাপান-উতর শুরু হয়ে গেছে। প্রার্থীর গুণাগুণ পরখ করা হচ্ছে।
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন বিলম্বিত হলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন হচ্ছে মেয়াদ থাকতেই। সেখানে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলম না শাহাদৎ হোসেন হবেন, সেটি নিয়ে জল্পনা চলছে। পুরোনো দুই প্রতিদ্বন্দ্বী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আবদুচ ছালামকে বাদ দিয়ে আ জ ম নাছিরকে সমর্থন দেওয়ার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ। ঢাকায় বিএনপির পক্ষে যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁরা হলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু, আসাদুজ্জামান রিপন, আবদুস সালাম, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও বরকত উল্লা। আওয়ামী লীগ উত্তরে ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক ও দক্ষিণে সাঈদ খোকনকে সমর্থন দেওয়ার কথা বললেও একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। বাম দলগুলো থেকে রুহিন হোসেন প্রিন্স, আবদুল্লাহ হেল কাফি ও জুনায়েদ সাকী প্রমুখ প্রার্থী হচ্ছেন। জাতীয় পার্টি থেকে সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন।
-----৩.
এটা ঠিক যে এই নির্বাচনে সরকার পড়ে যাবে না। বিরোধী দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তবে জনপ্রিয়তার পরীক্ষা হবে। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুই সিটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে চার সিটি করপোরেশন যথা বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী ও খুলনায় জিতেছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী। কিন্তু ২০১৩ সালে গাজীপুরসহ ওই পাঁচ সিটিতে জয়ী হন বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা। এবার কারা জয়ী হবেন, তা ঠিক করবেন তিন সিটির ৬২ লাখ (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে ভোটার যথাক্রমে ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ও ১০ লাখ ৯ হাজার এবং চট্টগ্রামে সাড়ে ১৮ লাখ) ভোটার।
সরকার ও বিএনপি পরস্পর সংলাপ করতে না চাইলেও এই ভোটারদের সঙ্গে একটি সংলাপ তাদের করতে হবে। সম্ভাব্য এই সংলাপে ভোটাররা নিশ্চয়ই সরকারি দলের সমর্থক প্রার্থীর কাছে জানতে চাইবেন, সেবা দেওয়ার নাম করে ঢাকা সিটিকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন; কিন্তু আমরা নাগরিক সেবা থেক কেন বঞ্চিত আছি? কেন এত দিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলো না। তাঁরা আরও জানতে চাইবেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে ঢাকাকে বসবাসের অনুপযোগী সিটিগুলোর মধ্যেও নিকৃষ্টতর বলে চিহ্নিত করার পরও কেন সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিল না? কেন এত দিনে ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে ট্যানারি কারখানা, রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেওয়া হলো না? কেন সরকারি জমি, খেলার মাঠ, খাল, জলাভূমি প্রভাবশালীদের দখলে আছে? কেন সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সমন্বয় নেই? কেন সংস্কারের নামে যত্রতত্র রাস্তা কাটাকাটি করা হচ্ছে? তাঁরা জানতে চাইবেন, সরকারি দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা কেন পাড়ায় পাড়ায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন? কেন তাঁদের চাঁদা না দিয়ে এলাকায় কোনো ঘরবাড়ি নির্মাণ করা যায় না? কেন চট্টগ্রামে নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভারের নিচে চাপা পড়ে এতগুলো মানুষ মারা গেল?
আর বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী তথা তাঁদের সমর্থক প্রার্থীর কাছে প্রশ্ন হবে, হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির নামে কেন ঢাকা ও চট্টগ্রামের জনজীবনকে প্রায় নিশ্চল করে রাখা হয়েছে? কেন দুই নগরের লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না? কেন এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মানসিক পীড়নের মধ্যে রাখা হয়েছে? তারা নিশ্চয়ই জানতে চাইবে কেন আন্দোলনের নামে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মারা হলো? কেন বিভিন্ন স্থানে বোমা বানাতে গিয়ে যুবদল, ছাত্রদল ও শিবির কর্মীরা বমাল ধরা পড়ল? কেন হেফাজতের মহাসমাবেশে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছিল, তার প্রতি বিএনপির নেত্রী সমর্থন জানালেন? একদা সাজানো গোছানো চট্টগ্রামকে কেন নোংরা ও আবর্জনার নগরে পরিণত করা হলো? কেন পাঁচ বছরেও জলাবদ্ধতার অবসান হলো না?
আমরা কেবল সংলাপে জনগণের মনের কথাগুলো তুলে ধরলাম। সাধারণ মানুষের প্রশ্নগুলো এখানে উপস্থাপন করলাম। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা, তাঁদের সমর্থক প্রার্থীরা কী জবাব দেন এবং সেই জবাবে নাগরিকেরা সন্তুষ্ট হবেন কি হবেন না, সেটি জানার জন্য আমাদের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments