নেতানিয়াহু আবার ক্ষমতায় এবার যা ঘটতে পারে by মীযানুল করীম
কট্টরপন্থী
ইহুদি নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আবার নির্বাচিত হয়েছেন ইসরাইলের
প্রধানমন্ত্রী। এমনিতেই ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া’ ইসরাইল বিশ্বের সর্বাধিক
বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপরাষ্ট্রশক্তি। তার ওপর এবার পরাজয়ের সম্ভাবনা
সত্ত্বেও পুনর্নির্বাচিত হলেন নেতানিয়াহু। তাই তার এই অবাঞ্ছিত বিজয়
ফিলিস্তিনি জনগণসহ আরব বিশ্ব তো বটেই, দুনিয়ার তাবৎ শান্তিকামী মানুষ, এমন
কি খোদ ইসরাইলের বিবেকবান ইহুদিদের জন্য ও দ্বিগুণ দুঃখের কারণ হয়ে এসেছে।
১৭ মার্চ ইসরাইলি পার্লামেন্ট বা নেসেট-এর বহুলালোচিত নির্বাচনটি হয়েছে। নির্বাচন-পূর্ব জরিপে নেতানিয়াহুর দক্ষিণপন্থী লিকুদ পার্টি মধ্য বাম জায়োনিস্ট ইউনিয়নের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ভোটের ফলাফলে তা প্রমাণিত হয়নি। বেনজামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি ৩০টি, জিপি লিভনি ও আইজ্যাক হার্জগের জায়োনিস্ট ইউনিয়ন ২৪টি এবং আরব দলগুলো যৌথভাবে ১৪টি আসন পেয়েছে। নেতানিয়াহু মোট আসনের অর্ধেকের কম আসন পেলেও তার দলই এককভাবে সর্বাধিক আসনে জিতেছে। তার আবার সরকার পরিচালনার সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত।
নেতানিয়াহুর মতো একজন চরমপন্থী লোক ইসরাইলের নেতৃত্বে থাকা দেশটির মিত্রদের জন্যও অস্বস্তিকর। এবার আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, তার পরাজয়ের সম্ভাবনার মাঝেই জয়ের খবর এসেছে। অবশ্য এতে বিস্মিত হননি ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা। তারা স্মরণ করিয়ে দিলেন নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সূচনাকালীন ঘটনা।
সেটা নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়। এর কিছু দিন আগে ইহুদি চরমপন্থীরা হত্যা করেছে প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনকে। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে তিনিও ভূষিত হয়েছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কারে। তার মৃত্যুর পর ক্ষমতাসীন হন পাকা ঘুঘু শিমন পেরেজ লেবাননে রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। তার আশা ছিল, এর মধ্য দিয়ে ভোটারদের কাছে নিজেকে ইসরাইলের নিরাপত্তার কাণ্ডারি রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন এবং এতে নির্বাচনী বাজিমাত সম্ভব হবে। কিন্তু নির্বাচনের আগের রাতে নেতানিয়াহু হেঁয়ালি করে বললেন, The hour is still early and the night is long. পরদিনের নির্বাচনে পেরেস বাজিমাত নয়, একেবারে কুপোকাত। নেতানিয়াহু তখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
ইসরাইলের এবারকার নেসেট নির্বাচনে কোন কোন নেতা দাঁড়িয়েছিলেন প্রার্থী হিসেবে? প্রথমেই বলতে হয় নেতানিয়াহুর মতো মুসলিমবিদ্বেষীর কথা, নির্বাচনের দিনও যার মূল বক্তব্য ছিল, ইসরাইলে আরব বসবাসরত, নাগরিকেরা দেশটার দুশমন। এই ব্যক্তি পেয়েছেন ২৫ শতাংশের মতো ভোট। প্রার্থীদের মধ্যে আরো ছিলেন নেতানিয়াহুর ওই বক্তব্যের প্রতিধ্বনিকারী চরম ডানপন্থী নাফতালি বেনেট; ছিলেন বহুলালোচিত মন্ত্রী আভিগদর লিবেরমান যার প্রধান কাজ হলো আরবদের বিরুদ্ধে ইহুদিদের উসকে দেয়া; আরো ছিলেন মোশে কাহলন যার সাফ কথা, আরবদের ভোটের ওপর নির্ভরশীল কোনো সরকারে যোগ দেবো না; সেই সাথে প্রার্থী হয়েছিলেন আরইয়ে দেরি, যিনি এমনই আরববিদ্বেষী যে, আরবেরা নিপীড়িতদের জোটে যোগ দেয়ার আহ্বান জানালে এই আদমি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এসব অত্যন্ত সঙ্কীর্ণমনা ও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি সবাই মিলে ভোটের এক-চতুর্থাংশ বাগিয়েছেন। তবে তাদের বিপরীত মেরুতে আরবদের জোট Joint List-এর সাফল্য কম নয়। চার লাখ ভোটারের প্রতিনিধিত্বকারী এই মোর্চা ১৪টি আসন জিতে নেসেটে তৃতীয় বৃহত্তম শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। দেখা গেছে, গড়ে ইহুদিদের চেয়ে আরবরা এবার নির্বাচনে বেশি অংশ নিয়েছেন ভোটার হিসেবে।
নির্বাচন উপলক্ষে এই জোটটির চেয়ারম্যান আয়মান ওদেহকে ইসরাইলি টিভি, রেডিও, সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়া গুরুত্ব না দিয়ে পারেনি। তিনি ইসরাইলের সব নাগরিকের জন্য মুক্ত পরিবেশ, অংশদারিত্ব, সমতা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। পুনর্মিলনের মাধ্যমে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা তার স্বপ্ন। এবার নির্বাচনের পরে সে রাতে যখন ফলাফল স্পষ্ট, তখন আয়মান ওদেহ এবং দোভ খেনিন আইজ্যাক হার্জগকে জানান, তাদের শরিক করা হলে তারা নতুন প্রধানমন্ত্রীরূপে হার্জগকে সমর্থন দেবেন। এটা বাস্তবে ঘটলে তা হতো এক ঐতিহাসিক নজির।
ইসরাইলের বিশিষ্ট সাংবাদিক গিডিওন লেভি প্রভাবশালী পত্রিকা হারেতজ-এর কলামিস্ট। তিনি নেতানিয়াহু আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, যদি ভীতি, উদ্বেগ, ঘৃণা ও নিরাশার বীজ ছয় বছর ধরে বপনের পরও এটাই হয়ে থাকে, তবে তা আসলেই নিদারুণ মন্দ ব্যাপার। সম্প্রতি কয়েক মাসে অনেক কিছুই হয়েছে উদঘাটিত। তবুও নেতানিয়াহু আরো চার বছরের জন্য নির্বাচিত হলেন। তাহলে বুঝতে হবে, ইসরাইলে কিছু একটা ভেঙে গেছে, যা আর মেরামত করা সম্ভব নয়।’
উল্লেখ্য, ইসরাইলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন দীর্ঘ দিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির লোক হিসেবে রাজনীতি করেছেন। তিনি নেতানিয়াহুকে যে সরকার গঠনের জন্য ডাকছেন, তা নিশ্চিত। নেতানিয়াহু মোট আসনের অর্ধেকও জিততে পারেনি। তাই দ্বিতীয় প্রধান দল, জায়োনিস্ট ইউনিয়ন নেতা আইজ্যাক হার্জগ পরাজয় মেনে নিতে বলেছিলেন নেতানিয়াহুকে। ইসরাইলি সংবিধান মোতাবেক, মোট প্রদত্ত ভোটের অন্তত ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ পেয়েছে, এমন ১০টি দলের মধ্যে পার্লামেন্ট আসন বণ্টনের পর সরকার গঠনের জন্য একজন নেতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানানো হয়।
নেতানিয়াহু আগে থেকেই মেনাচেম বেগিনের মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক ও কট্টর ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমালোচিত। তবে এবার যা সবাইকে বিস্মিত, মানবাধিকারকামীমাত্রকেই বিক্ষুব্ধ এবং খোদ যুক্তরাষ্ট্রকে বিব্রত করেছে, তা হলো নির্বাচনের প্রাক্কালে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে চরম অসহিষ্ণু ও উসকানিমূলক কিছু উক্তি। যেমন নেতানিয়াহু স্বদেশে উদারপন্থী ইহুদিদের কিংবা বিদেশে ইসরাইলের মিত্রদের কোনো তোয়াক্কা না করেই বললেন, আমরা জয়লাভ করলে কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়তে দেবো না; ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হবে, ইত্যাদি।
গত শুক্রবার এসব বক্তব্য এবং এর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নিন্দার খবর বিভিন্ন টিভি ট্যানেলে প্রচার করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশী কোনো কোনো চ্যানেলে নেতানিয়াহুর উক্তিকে রদবদল করে মোলায়েম রূপ দিয়ে তুলে ধরায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ রয়েছে।
একই দিন জানা যায়, নেতানিয়াহু বলেছেন, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) সন্ত্রাসীদের সাহচর্য না ছাড়লে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মেনে নেবো না। জবাবে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়া নস্যাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত।
উগ্র সন্ত্রাসী ইহুদিবাদী চক্রের অন্যতম হোতা হয়ে নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন সংগ্রামী যারা, তাদের যে সন্ত্রাসী বলে হেয় করতে চান, তা তার এ যাবৎ অনুসৃত নীতি ও কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট। বিভিন্ন দেশে একই কায়দায় জনগণের অধিকার, তথা গণতন্ত্রের জন্য জানবাজি রেখে যারা আন্দোলন করেন, স্বৈরাচারী শাসক ও সরকার তাদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অভিহিত করে নির্যাতন চালিয়ে থাকে।
নেতানিয়াহুকে স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনি জনগণ মনে করে কোনো রাজনীতিক নন, বরং ঠাণ্ডামাথার একজন খুনি এবং গণহত্যায় তার আনন্দ। তাদের কাছে এই ব্যক্তি জাতিগত আগ্রাসন এবং নির্মূল অভিযানের প্রতীক, নির্বিচার ধ্বংসের উন্মত্ত তাণ্ডবই যার স্বপ্ন ও সুখের বিষয়।
ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের একজন সংগঠক আলী আবুনিমাহ বলেছেন, Netanyahu is a blood soaked killer. He should be put on trial for his many crimes, from the relentless theft of Palestinian land to last summers' massacre in Gaza and I yearn to see the day.'
নেতানিয়াহু আবার প্রধানমন্ত্রী হোন আর যত হুমকি-হুঙ্কার ছাড়ুন না কেন, দেশে তার বিরোধিতা দিন দিন বাড়ছে। তিনি উগ্র ইহুদিবাদ আর মুসলিমবিদ্বেষ পুঁজি করে ভেবেছিলেন, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠবেন এবং বহুকাল থাকবেন ইসরাইলের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক মহলে তার ওপর অনেক নেতাই ক্ষুব্ধ। আর মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী মহলে তার ভূমিকার সমালোচনাও কম নয়। এবার নির্বাচনের প্রাক্কালে তেলআবিবে তার বিরুদ্ধে নির্দলীয় সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি ইসরাইলের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এতে প্রমাণিত, সাধারণ ইসরাইলিদের একটা বড় অংশই সচেতন হয়ে উঠছেন বাস্তবতা সম্পর্কে। তাদের আকাঙ্ক্ষা Live and let live, অর্থাৎ নিজেদের রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্রও থাকুক। নেতানিয়াহুর মতো ফিলিস্তিন ধ্বংসের মিশন নিয়ে নামলে ইসরাইলকে চিরদিন মাশুল দিতে হবে, তা বুদ্ধিমান নাগরিকদের অজানা নয়। নেতানিয়াহু ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান’ ফর্মুলায় বাস্তবে অবিশ্বাসী। অথচ এটাই জাতিসঙ্ঘ তথা বিশ্বসম্প্রদায়ের সর্বসম্মত অভিমত। ওআইসি কিংবা আরব লিগও কার্যত এর বিরোধী নয়। এমনকি, যে হামাসকে নেতানিয়াহুর মতো গোঁড়া ইহুদিবাদীরা ‘সন্ত্রাসী’ মনে করে এবং যাদের নির্মূল করার খায়েশে ইসরাইল বারবার গাজায় আগ্রাসন চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, সেই হামাস পর্যন্ত পরোক্ষভাবে বলেছে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সীমান্তে ফিরে গেলে ইসরাইলের অস্তিত্বের স্বীকৃতি বিবেচনাযোগ্য। এসব কিছু সত্ত্বেও নেতানিয়াহুর মতো উগ্রবাদীরা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আন্তরিকভাবে মেনে নিচ্ছেন না অসলো চুক্তির ২২ বছর পরও। আরাফাতের সাথে সম্পাদিত সে চুক্তিতে ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিরা পরস্পরের কর্তৃপক্ষকে স্বীকার করে নেয়ার উল্লেখ ছিল। নেতানিয়াহুর মতো অপরিণামদর্শী লোকদের নেতা বানালে অশান্তির আগুন কোনো দিন নিভবে না এবং তাতে ইসরাইলকেও জ্বলতে হবে- এই উপলব্ধি ইহুদিদের মধ্যে যত বেশি মানুষের হবে, ততই সেটা তাদের জন্য হবে মঙ্গলজনক।
নেতানিয়াহু দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্বের সব চেয়ে কৃত্রিম, অস্বাভাবিক, বর্ণবাদী ও সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ সময়ে তার গৃহীত নীতি, কর্মসূচি ও কর্মপন্থা এবং এবার নির্বাচন উপলক্ষে প্রদত্ত তার বক্তব্য ও ঘোষণার ভিত্তিতে সামনের দিনগুলোতে ইসরাইলের আচরণ ও পদক্ষেপ কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে একটা ধারণা তুলে ধরা যায়। ইসরাইলের শুধু বেআইনি বসতি বৃদ্ধি পাচ্ছে না, সেই সাথে বাড়ছে দম্ভ ও ঔদ্ধত্যও। সম্প্রতি নেতানিয়াহু মার্কিন কংগ্রেসে বক্তৃতার নামে যে আগ্রাসী আস্ফালন করেছেন, তা এর একটি নগ্ন নজির।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্সের চক্রান্তে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্মতিতে ফিলিস্তিন ভূমিতে ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ছিল আইন, মানবাধিকার, ন্যায়নীতি ও নৈতিকতার চরম লঙ্ঘন। ‘বেজন্মা রাষ্ট্রটির জন্ম দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্থায়ী ও স্বীকৃত সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়ে। ফলে ইসরাইলের সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড চিহ্নিত করা হয়নি। অর্থাৎ আরব ভূমি জবরদখল ও অবৈধ সম্প্রসারণের মাধ্যমে এর সীমানা বর্ধনের পুরো সুযোগ রাখা হয় পরিকল্পিতভাবেই। এভাবে আন্তর্জাতিক আইন ও প্রথা লঙ্ঘন করে যে অপরাষ্ট্র জন্ম দেয়া হলো, তা যে পদে পদে আন্তর্জাতিক আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক। জাতিসঙ্ঘের কোনো প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত না মেনে ইসরাইল এর প্রমাণ রেখেছে। আর সে জানে, জনক ও মদদগার আমেরিকা ও তার দোসর বৃহৎ শক্তির কাছে হাজার খুনও মাফ পেয়ে যাবে। এ অবস্থায় সময় যত এগিয়েছে, ইসরাইলের স্পর্ধা ও অহঙ্কার তত বেড়েছে। এখন সে আর কারো পরোয়া করে না, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও। তা না হলে নেতানিয়াহু সে দেশে গিয়ে, ওই দেশের পার্লামেন্টে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে পারতেন না। কথায় বলে ‘কুকুর নেজ নাড়ে’। এখন দেখা যাচ্ছে, লেজই নাড়াচ্ছে প্রাণীটাকে। নেতানিয়াহুর হুমকি-হুঙ্কারের জবাবে প্রেসিডেন্ট ওবামার ‘মিউ মিউ’ প্রতিক্রিয়া থেকে প্রশ্ন জাগে, আমেরিকা চালায় কারা? সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটির প্রেসিডেন্টের এমন অসহায়ত্ব দেখে কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পোষক (পৃষ্ঠপোষক) থেকে তোষক (তোষামোদকারী) হয়ে গেছে।
নেতানিয়াহুর বিজয়ে অদূরভবিষ্যতে যা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা হচ্ছে :
ক. স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে বিশ্বসংস্থায় এবং ফিলিস্তিন ভূমিতে নানাভাবে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হবে।
খ. দখলকৃত ভূমিতে বেআইনি ইহুদি বসতি সম্প্রসারণে গতি বাড়ানো হবে।
গ. ইরানের সাথে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের পরমাণু চুক্তি হলেও তার বাস্তবায়নে বিঘ্নসহ ইরানকে চাপে রাখার সাধ্যমতো চেষ্টা চালানো হবে। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসে রিপাবলিকান গরিষ্ঠতা নেতানিয়াহুর সহায়ক । এর সাথে ইরানবিরোধী রণোন্মাদনা জাগানোর প্রয়াস চলবে।
ঘ. মার্কিন কংগ্রেসে, হোয়াইট হাউজে, প্রশাসনে ও পেন্টাগনে AIPAC-সহ বিভিন্ন ফোরাম ও কৌশলের মাধ্যমে ইহুদি লবির ‘চাপ ও তাপ’ বাড়ানো হবে। এবার বুশের পার্টির ‘নিউকন’ গোষ্ঠী কংগ্রেসে যে মদদ জুগিয়েছে, তা নেতানিয়াহুর জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। ধারণা করা যায়, আগামী বছরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটের হিসাব কষে ওবামার পার্টিও ইহুদি লবিকে ছাড় দিতে পারে।
ঙ. হামাসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পদক্ষেপ হিসেবে আবারো কোনো ছুতায় গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে গাজাসংলগ্ন মিসরে হামাসের ঘোরবিরোধী স্বৈরাচারী সরকার থাকা নেতানিয়াহুর জন্য একধরনের প্রণোদনা।
চ. লেবানন-সিরিয়া-ইরাক-ইরান-আফগানিস্তান, অর্থাৎ ভূমধ্যসাগর থেকে হিন্দুকুশ অবধি ইসরাইলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের তথ্য সংগ্রহ-পাচার, বিভেদ চক্রান্ত, অন্তর্ঘাত প্রভৃতি বৃদ্ধি পেতে পারে।
ছ. নাশকতা, সন্ত্রাস, জঙ্গি দমনের নামে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে স্বেচ্ছাচারী শাসনাধীন কোনো কোনো দেশের সাথে ইসরাইলের গোপন যোগাযোগ ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিতে পারে।
এখন ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব জাহান, ওআইসি তথা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোসহ শান্তিকামী বিশ্বসম্প্রদায়ের কী করণীয়?
১. এ প্রসঙ্গে ফিলিস্তিন মুক্তিআন্দোলনে সক্রিয় লেখক এবং ‘ইলেকট্রনিক ইনতিফাদার’ সহপ্রতিষ্ঠাতা আলী আবুনিমাহ বলেছেন, BDS জোরদার করতে। BDS সুপরিচিত পরিভাষা, যা Boycott, Divestment and Sanctions- এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর দ্বারা বুঝানো হয়, ইসরাইলকে আন্তর্জাতিকভাবে বর্জন ও তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং দখলকৃত ভূমি থেকে তাকে উচ্ছেদ করতে হবে।
২. ফিলিস্তিনিদের সব বিভেদ বিভাজন দূর করে ঐক্য সুদৃঢ় করতে হবে। তাহলে বিপদের মুহূর্তে পরস্পরের সাহায্য এবং সুসংহত শক্তির বলে কার্যকর প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
৩. অবরুদ্ধ গাজায় শুধু ত্রাণ ও পুনর্বাসন নয়, পর্যাপ্ত পুনর্গঠন ও উন্নয়ন এবং সর্বোপরি এই বিচ্ছিন্ন জনপদের পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা চাই।
৪. স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদাপ্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত রাখা জরুরি।
৫. কোনো আরব বা মুসলিম দেশ যাতে ইসরাইলি ফাঁদে পা না দেয়, কোনোভাবে তার অনুকূল ভূমিকা না রাখে, বরং সব মুসলিম রাষ্ট্র দৃঢ়তার সাথে ফিলিস্তিনকে সাহায্য-সমর্থন জোগায়, তা নিশ্চিত করা উচিত।
৬. যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য জগৎ এবং জাতিসঙ্ঘসমেত বিশ্বফোরামগুলোতে লবিং তথা কূটনৈতিক তৎপরতা অনেক বেশি জোরালো হতে হবে।
শেষ কথা হলো, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসঙ্ঘ, মুসলিম উম্মাহ, সর্বোপরি বিশ্ববিবেকের প্রতি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। এখনই তাকে সামলানো না গেলে মধ্যপ্রাচ্যের শুধু নয়, আশপাশেও অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়বে। দেখা যাক, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হওয়ার দাবিদার, স্বঘোষিত মোড়ল বিগ ব্রাদাররা এখন কোন ভূমিকা পালন করেন।
১৭ মার্চ ইসরাইলি পার্লামেন্ট বা নেসেট-এর বহুলালোচিত নির্বাচনটি হয়েছে। নির্বাচন-পূর্ব জরিপে নেতানিয়াহুর দক্ষিণপন্থী লিকুদ পার্টি মধ্য বাম জায়োনিস্ট ইউনিয়নের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ভোটের ফলাফলে তা প্রমাণিত হয়নি। বেনজামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি ৩০টি, জিপি লিভনি ও আইজ্যাক হার্জগের জায়োনিস্ট ইউনিয়ন ২৪টি এবং আরব দলগুলো যৌথভাবে ১৪টি আসন পেয়েছে। নেতানিয়াহু মোট আসনের অর্ধেকের কম আসন পেলেও তার দলই এককভাবে সর্বাধিক আসনে জিতেছে। তার আবার সরকার পরিচালনার সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত।
নেতানিয়াহুর মতো একজন চরমপন্থী লোক ইসরাইলের নেতৃত্বে থাকা দেশটির মিত্রদের জন্যও অস্বস্তিকর। এবার আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, তার পরাজয়ের সম্ভাবনার মাঝেই জয়ের খবর এসেছে। অবশ্য এতে বিস্মিত হননি ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা। তারা স্মরণ করিয়ে দিলেন নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সূচনাকালীন ঘটনা।
সেটা নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়। এর কিছু দিন আগে ইহুদি চরমপন্থীরা হত্যা করেছে প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনকে। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে তিনিও ভূষিত হয়েছিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কারে। তার মৃত্যুর পর ক্ষমতাসীন হন পাকা ঘুঘু শিমন পেরেজ লেবাননে রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। তার আশা ছিল, এর মধ্য দিয়ে ভোটারদের কাছে নিজেকে ইসরাইলের নিরাপত্তার কাণ্ডারি রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন এবং এতে নির্বাচনী বাজিমাত সম্ভব হবে। কিন্তু নির্বাচনের আগের রাতে নেতানিয়াহু হেঁয়ালি করে বললেন, The hour is still early and the night is long. পরদিনের নির্বাচনে পেরেস বাজিমাত নয়, একেবারে কুপোকাত। নেতানিয়াহু তখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
ইসরাইলের এবারকার নেসেট নির্বাচনে কোন কোন নেতা দাঁড়িয়েছিলেন প্রার্থী হিসেবে? প্রথমেই বলতে হয় নেতানিয়াহুর মতো মুসলিমবিদ্বেষীর কথা, নির্বাচনের দিনও যার মূল বক্তব্য ছিল, ইসরাইলে আরব বসবাসরত, নাগরিকেরা দেশটার দুশমন। এই ব্যক্তি পেয়েছেন ২৫ শতাংশের মতো ভোট। প্রার্থীদের মধ্যে আরো ছিলেন নেতানিয়াহুর ওই বক্তব্যের প্রতিধ্বনিকারী চরম ডানপন্থী নাফতালি বেনেট; ছিলেন বহুলালোচিত মন্ত্রী আভিগদর লিবেরমান যার প্রধান কাজ হলো আরবদের বিরুদ্ধে ইহুদিদের উসকে দেয়া; আরো ছিলেন মোশে কাহলন যার সাফ কথা, আরবদের ভোটের ওপর নির্ভরশীল কোনো সরকারে যোগ দেবো না; সেই সাথে প্রার্থী হয়েছিলেন আরইয়ে দেরি, যিনি এমনই আরববিদ্বেষী যে, আরবেরা নিপীড়িতদের জোটে যোগ দেয়ার আহ্বান জানালে এই আদমি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এসব অত্যন্ত সঙ্কীর্ণমনা ও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি সবাই মিলে ভোটের এক-চতুর্থাংশ বাগিয়েছেন। তবে তাদের বিপরীত মেরুতে আরবদের জোট Joint List-এর সাফল্য কম নয়। চার লাখ ভোটারের প্রতিনিধিত্বকারী এই মোর্চা ১৪টি আসন জিতে নেসেটে তৃতীয় বৃহত্তম শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। দেখা গেছে, গড়ে ইহুদিদের চেয়ে আরবরা এবার নির্বাচনে বেশি অংশ নিয়েছেন ভোটার হিসেবে।
নির্বাচন উপলক্ষে এই জোটটির চেয়ারম্যান আয়মান ওদেহকে ইসরাইলি টিভি, রেডিও, সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়া গুরুত্ব না দিয়ে পারেনি। তিনি ইসরাইলের সব নাগরিকের জন্য মুক্ত পরিবেশ, অংশদারিত্ব, সমতা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। পুনর্মিলনের মাধ্যমে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা তার স্বপ্ন। এবার নির্বাচনের পরে সে রাতে যখন ফলাফল স্পষ্ট, তখন আয়মান ওদেহ এবং দোভ খেনিন আইজ্যাক হার্জগকে জানান, তাদের শরিক করা হলে তারা নতুন প্রধানমন্ত্রীরূপে হার্জগকে সমর্থন দেবেন। এটা বাস্তবে ঘটলে তা হতো এক ঐতিহাসিক নজির।
ইসরাইলের বিশিষ্ট সাংবাদিক গিডিওন লেভি প্রভাবশালী পত্রিকা হারেতজ-এর কলামিস্ট। তিনি নেতানিয়াহু আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, যদি ভীতি, উদ্বেগ, ঘৃণা ও নিরাশার বীজ ছয় বছর ধরে বপনের পরও এটাই হয়ে থাকে, তবে তা আসলেই নিদারুণ মন্দ ব্যাপার। সম্প্রতি কয়েক মাসে অনেক কিছুই হয়েছে উদঘাটিত। তবুও নেতানিয়াহু আরো চার বছরের জন্য নির্বাচিত হলেন। তাহলে বুঝতে হবে, ইসরাইলে কিছু একটা ভেঙে গেছে, যা আর মেরামত করা সম্ভব নয়।’
উল্লেখ্য, ইসরাইলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন দীর্ঘ দিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির লোক হিসেবে রাজনীতি করেছেন। তিনি নেতানিয়াহুকে যে সরকার গঠনের জন্য ডাকছেন, তা নিশ্চিত। নেতানিয়াহু মোট আসনের অর্ধেকও জিততে পারেনি। তাই দ্বিতীয় প্রধান দল, জায়োনিস্ট ইউনিয়ন নেতা আইজ্যাক হার্জগ পরাজয় মেনে নিতে বলেছিলেন নেতানিয়াহুকে। ইসরাইলি সংবিধান মোতাবেক, মোট প্রদত্ত ভোটের অন্তত ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ পেয়েছে, এমন ১০টি দলের মধ্যে পার্লামেন্ট আসন বণ্টনের পর সরকার গঠনের জন্য একজন নেতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানানো হয়।
নেতানিয়াহু আগে থেকেই মেনাচেম বেগিনের মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক ও কট্টর ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমালোচিত। তবে এবার যা সবাইকে বিস্মিত, মানবাধিকারকামীমাত্রকেই বিক্ষুব্ধ এবং খোদ যুক্তরাষ্ট্রকে বিব্রত করেছে, তা হলো নির্বাচনের প্রাক্কালে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে চরম অসহিষ্ণু ও উসকানিমূলক কিছু উক্তি। যেমন নেতানিয়াহু স্বদেশে উদারপন্থী ইহুদিদের কিংবা বিদেশে ইসরাইলের মিত্রদের কোনো তোয়াক্কা না করেই বললেন, আমরা জয়লাভ করলে কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়তে দেবো না; ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হবে, ইত্যাদি।
গত শুক্রবার এসব বক্তব্য এবং এর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নিন্দার খবর বিভিন্ন টিভি ট্যানেলে প্রচার করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশী কোনো কোনো চ্যানেলে নেতানিয়াহুর উক্তিকে রদবদল করে মোলায়েম রূপ দিয়ে তুলে ধরায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ রয়েছে।
একই দিন জানা যায়, নেতানিয়াহু বলেছেন, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) সন্ত্রাসীদের সাহচর্য না ছাড়লে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মেনে নেবো না। জবাবে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়া নস্যাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত।
উগ্র সন্ত্রাসী ইহুদিবাদী চক্রের অন্যতম হোতা হয়ে নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন সংগ্রামী যারা, তাদের যে সন্ত্রাসী বলে হেয় করতে চান, তা তার এ যাবৎ অনুসৃত নীতি ও কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট। বিভিন্ন দেশে একই কায়দায় জনগণের অধিকার, তথা গণতন্ত্রের জন্য জানবাজি রেখে যারা আন্দোলন করেন, স্বৈরাচারী শাসক ও সরকার তাদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অভিহিত করে নির্যাতন চালিয়ে থাকে।
নেতানিয়াহুকে স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনি জনগণ মনে করে কোনো রাজনীতিক নন, বরং ঠাণ্ডামাথার একজন খুনি এবং গণহত্যায় তার আনন্দ। তাদের কাছে এই ব্যক্তি জাতিগত আগ্রাসন এবং নির্মূল অভিযানের প্রতীক, নির্বিচার ধ্বংসের উন্মত্ত তাণ্ডবই যার স্বপ্ন ও সুখের বিষয়।
ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের একজন সংগঠক আলী আবুনিমাহ বলেছেন, Netanyahu is a blood soaked killer. He should be put on trial for his many crimes, from the relentless theft of Palestinian land to last summers' massacre in Gaza and I yearn to see the day.'
নেতানিয়াহু আবার প্রধানমন্ত্রী হোন আর যত হুমকি-হুঙ্কার ছাড়ুন না কেন, দেশে তার বিরোধিতা দিন দিন বাড়ছে। তিনি উগ্র ইহুদিবাদ আর মুসলিমবিদ্বেষ পুঁজি করে ভেবেছিলেন, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠবেন এবং বহুকাল থাকবেন ইসরাইলের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক মহলে তার ওপর অনেক নেতাই ক্ষুব্ধ। আর মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী মহলে তার ভূমিকার সমালোচনাও কম নয়। এবার নির্বাচনের প্রাক্কালে তেলআবিবে তার বিরুদ্ধে নির্দলীয় সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি ইসরাইলের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এতে প্রমাণিত, সাধারণ ইসরাইলিদের একটা বড় অংশই সচেতন হয়ে উঠছেন বাস্তবতা সম্পর্কে। তাদের আকাঙ্ক্ষা Live and let live, অর্থাৎ নিজেদের রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্রও থাকুক। নেতানিয়াহুর মতো ফিলিস্তিন ধ্বংসের মিশন নিয়ে নামলে ইসরাইলকে চিরদিন মাশুল দিতে হবে, তা বুদ্ধিমান নাগরিকদের অজানা নয়। নেতানিয়াহু ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান’ ফর্মুলায় বাস্তবে অবিশ্বাসী। অথচ এটাই জাতিসঙ্ঘ তথা বিশ্বসম্প্রদায়ের সর্বসম্মত অভিমত। ওআইসি কিংবা আরব লিগও কার্যত এর বিরোধী নয়। এমনকি, যে হামাসকে নেতানিয়াহুর মতো গোঁড়া ইহুদিবাদীরা ‘সন্ত্রাসী’ মনে করে এবং যাদের নির্মূল করার খায়েশে ইসরাইল বারবার গাজায় আগ্রাসন চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, সেই হামাস পর্যন্ত পরোক্ষভাবে বলেছে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সীমান্তে ফিরে গেলে ইসরাইলের অস্তিত্বের স্বীকৃতি বিবেচনাযোগ্য। এসব কিছু সত্ত্বেও নেতানিয়াহুর মতো উগ্রবাদীরা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আন্তরিকভাবে মেনে নিচ্ছেন না অসলো চুক্তির ২২ বছর পরও। আরাফাতের সাথে সম্পাদিত সে চুক্তিতে ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিরা পরস্পরের কর্তৃপক্ষকে স্বীকার করে নেয়ার উল্লেখ ছিল। নেতানিয়াহুর মতো অপরিণামদর্শী লোকদের নেতা বানালে অশান্তির আগুন কোনো দিন নিভবে না এবং তাতে ইসরাইলকেও জ্বলতে হবে- এই উপলব্ধি ইহুদিদের মধ্যে যত বেশি মানুষের হবে, ততই সেটা তাদের জন্য হবে মঙ্গলজনক।
নেতানিয়াহু দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্বের সব চেয়ে কৃত্রিম, অস্বাভাবিক, বর্ণবাদী ও সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ সময়ে তার গৃহীত নীতি, কর্মসূচি ও কর্মপন্থা এবং এবার নির্বাচন উপলক্ষে প্রদত্ত তার বক্তব্য ও ঘোষণার ভিত্তিতে সামনের দিনগুলোতে ইসরাইলের আচরণ ও পদক্ষেপ কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে একটা ধারণা তুলে ধরা যায়। ইসরাইলের শুধু বেআইনি বসতি বৃদ্ধি পাচ্ছে না, সেই সাথে বাড়ছে দম্ভ ও ঔদ্ধত্যও। সম্প্রতি নেতানিয়াহু মার্কিন কংগ্রেসে বক্তৃতার নামে যে আগ্রাসী আস্ফালন করেছেন, তা এর একটি নগ্ন নজির।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্সের চক্রান্তে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্মতিতে ফিলিস্তিন ভূমিতে ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ছিল আইন, মানবাধিকার, ন্যায়নীতি ও নৈতিকতার চরম লঙ্ঘন। ‘বেজন্মা রাষ্ট্রটির জন্ম দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্থায়ী ও স্বীকৃত সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়ে। ফলে ইসরাইলের সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড চিহ্নিত করা হয়নি। অর্থাৎ আরব ভূমি জবরদখল ও অবৈধ সম্প্রসারণের মাধ্যমে এর সীমানা বর্ধনের পুরো সুযোগ রাখা হয় পরিকল্পিতভাবেই। এভাবে আন্তর্জাতিক আইন ও প্রথা লঙ্ঘন করে যে অপরাষ্ট্র জন্ম দেয়া হলো, তা যে পদে পদে আন্তর্জাতিক আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক। জাতিসঙ্ঘের কোনো প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত না মেনে ইসরাইল এর প্রমাণ রেখেছে। আর সে জানে, জনক ও মদদগার আমেরিকা ও তার দোসর বৃহৎ শক্তির কাছে হাজার খুনও মাফ পেয়ে যাবে। এ অবস্থায় সময় যত এগিয়েছে, ইসরাইলের স্পর্ধা ও অহঙ্কার তত বেড়েছে। এখন সে আর কারো পরোয়া করে না, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও। তা না হলে নেতানিয়াহু সে দেশে গিয়ে, ওই দেশের পার্লামেন্টে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে পারতেন না। কথায় বলে ‘কুকুর নেজ নাড়ে’। এখন দেখা যাচ্ছে, লেজই নাড়াচ্ছে প্রাণীটাকে। নেতানিয়াহুর হুমকি-হুঙ্কারের জবাবে প্রেসিডেন্ট ওবামার ‘মিউ মিউ’ প্রতিক্রিয়া থেকে প্রশ্ন জাগে, আমেরিকা চালায় কারা? সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটির প্রেসিডেন্টের এমন অসহায়ত্ব দেখে কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পোষক (পৃষ্ঠপোষক) থেকে তোষক (তোষামোদকারী) হয়ে গেছে।
নেতানিয়াহুর বিজয়ে অদূরভবিষ্যতে যা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা হচ্ছে :
ক. স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে বিশ্বসংস্থায় এবং ফিলিস্তিন ভূমিতে নানাভাবে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হবে।
খ. দখলকৃত ভূমিতে বেআইনি ইহুদি বসতি সম্প্রসারণে গতি বাড়ানো হবে।
গ. ইরানের সাথে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের পরমাণু চুক্তি হলেও তার বাস্তবায়নে বিঘ্নসহ ইরানকে চাপে রাখার সাধ্যমতো চেষ্টা চালানো হবে। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসে রিপাবলিকান গরিষ্ঠতা নেতানিয়াহুর সহায়ক । এর সাথে ইরানবিরোধী রণোন্মাদনা জাগানোর প্রয়াস চলবে।
ঘ. মার্কিন কংগ্রেসে, হোয়াইট হাউজে, প্রশাসনে ও পেন্টাগনে AIPAC-সহ বিভিন্ন ফোরাম ও কৌশলের মাধ্যমে ইহুদি লবির ‘চাপ ও তাপ’ বাড়ানো হবে। এবার বুশের পার্টির ‘নিউকন’ গোষ্ঠী কংগ্রেসে যে মদদ জুগিয়েছে, তা নেতানিয়াহুর জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। ধারণা করা যায়, আগামী বছরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটের হিসাব কষে ওবামার পার্টিও ইহুদি লবিকে ছাড় দিতে পারে।
ঙ. হামাসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের পদক্ষেপ হিসেবে আবারো কোনো ছুতায় গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে গাজাসংলগ্ন মিসরে হামাসের ঘোরবিরোধী স্বৈরাচারী সরকার থাকা নেতানিয়াহুর জন্য একধরনের প্রণোদনা।
চ. লেবানন-সিরিয়া-ইরাক-ইরান-আফগানিস্তান, অর্থাৎ ভূমধ্যসাগর থেকে হিন্দুকুশ অবধি ইসরাইলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের তথ্য সংগ্রহ-পাচার, বিভেদ চক্রান্ত, অন্তর্ঘাত প্রভৃতি বৃদ্ধি পেতে পারে।
ছ. নাশকতা, সন্ত্রাস, জঙ্গি দমনের নামে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে স্বেচ্ছাচারী শাসনাধীন কোনো কোনো দেশের সাথে ইসরাইলের গোপন যোগাযোগ ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিতে পারে।
এখন ফিলিস্তিনি জনগণ, আরব জাহান, ওআইসি তথা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোসহ শান্তিকামী বিশ্বসম্প্রদায়ের কী করণীয়?
১. এ প্রসঙ্গে ফিলিস্তিন মুক্তিআন্দোলনে সক্রিয় লেখক এবং ‘ইলেকট্রনিক ইনতিফাদার’ সহপ্রতিষ্ঠাতা আলী আবুনিমাহ বলেছেন, BDS জোরদার করতে। BDS সুপরিচিত পরিভাষা, যা Boycott, Divestment and Sanctions- এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর দ্বারা বুঝানো হয়, ইসরাইলকে আন্তর্জাতিকভাবে বর্জন ও তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং দখলকৃত ভূমি থেকে তাকে উচ্ছেদ করতে হবে।
২. ফিলিস্তিনিদের সব বিভেদ বিভাজন দূর করে ঐক্য সুদৃঢ় করতে হবে। তাহলে বিপদের মুহূর্তে পরস্পরের সাহায্য এবং সুসংহত শক্তির বলে কার্যকর প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
৩. অবরুদ্ধ গাজায় শুধু ত্রাণ ও পুনর্বাসন নয়, পর্যাপ্ত পুনর্গঠন ও উন্নয়ন এবং সর্বোপরি এই বিচ্ছিন্ন জনপদের পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা চাই।
৪. স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদাপ্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত রাখা জরুরি।
৫. কোনো আরব বা মুসলিম দেশ যাতে ইসরাইলি ফাঁদে পা না দেয়, কোনোভাবে তার অনুকূল ভূমিকা না রাখে, বরং সব মুসলিম রাষ্ট্র দৃঢ়তার সাথে ফিলিস্তিনকে সাহায্য-সমর্থন জোগায়, তা নিশ্চিত করা উচিত।
৬. যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য জগৎ এবং জাতিসঙ্ঘসমেত বিশ্বফোরামগুলোতে লবিং তথা কূটনৈতিক তৎপরতা অনেক বেশি জোরালো হতে হবে।
শেষ কথা হলো, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসঙ্ঘ, মুসলিম উম্মাহ, সর্বোপরি বিশ্ববিবেকের প্রতি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। এখনই তাকে সামলানো না গেলে মধ্যপ্রাচ্যের শুধু নয়, আশপাশেও অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়বে। দেখা যাক, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হওয়ার দাবিদার, স্বঘোষিত মোড়ল বিগ ব্রাদাররা এখন কোন ভূমিকা পালন করেন।
No comments