শক্তিশালী অবস্থান থেকে আপসরফা by রেহমান সোবহান
গেল শতকের ষাটের দশকে ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’র প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান
খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূচনাপর্বের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বহির্বিশ্বে অগ্রণী
ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন রেহমান সোবহান।
১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাবলি তাঁর পর্যবেক্ষেণ উঠে এসেছে, যা প্রথম ছাপা
হয়েছিল তাঁর সম্পাদিত ফোরাম–এ। তিন কিস্তিতে তাঁর এই ধারাবাহিক রচনাটি
প্রকাশিত হচ্ছে....
বাংলাদেশের দাবিতে আন্দোলন তৃতীয় সপ্তাহে পা দিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। মুদ্রার আরেক পিঠে ছিল ইসলামাবাদের সঙ্গে অসহযোগিতা, সেটাও চলতে থাকে। এমনকি প্রেসিডেন্টকে বরণ করার জন্য কোনো বেসামরিক কর্মকর্তা বিমানবন্দরে যাননি। সামরিক বাহিনীর বেসামরিক কর্মকর্তাদের ১৫ মার্চের মধ্যে কাজে যোগদানের নির্দেশনা দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা সেটা উপেক্ষা করেন। কর্মীরা তঁাদের এক দিনের বেতন আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিলে দান করেন। জয়দেবপুরের অর্ডন্যান্স কারখানার ১১ হাজার বেসামরিক কর্মী কাজ বাদ দিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
ওদিকে জনগণ সেনাবাহিনীতে রসদ সরবরাহ করবে না—এ সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ফলে সরবরাহ পরিস্থিতি দেখভাল করার জন্য সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেলকে ঢাকায় চলে আসতে হয়। তথ্যমতে, বিশাল আকৃতির সি-১৩০ পরিবহন বিমানে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে টিনজাত রসদ আনা হয়।
অন্যদিকে সেনাবাহিনী তার শক্তি বাড়াতে থাকে। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরে সাড়ে সাত হাজার অতিরিক্ত সেনার দলটি
জাহাজ থেকে নামতে পারেনি। কুমিল্লা থেকে এসএসজি কমান্ডো ইউনিট ও রংপুরে সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত ট্যাংকগুলো ঢাকায় আনা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কোনো ঘোষণা ছাড়াই ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ বেলা আড়াইটায় ঢাকায় পৌঁছান। পাকিস্তান রেডিওর আগে অল ইন্ডিয়া রেডিও তাঁর আগমনের খবর দেয়। তবে তাঁর নিরাপত্তাবহরের কারণে খবরটি আর চাপা ছিল না। বিমানবন্দর থেকে তাঁর বাসভবন পর্যন্ত পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনী রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তখনো ঢাকার আকাশে কালো পতাকা ছিল আর বাতাসে ছিল সহানুভূতিহীন নীরবতা। এর মধ্যেই তাঁর আগমন ঘটে।
তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে অনেক কানাঘুষা ছিল। অনেকে বলেন, তিনি পুরো যুদ্ধ ক্যাবিনেট নিয়েই ঢাকায় আসেন।
এটা নিশ্চিত যে প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল পীরজাদা ও বাহিনীর নিরাপত্তাপ্রধান ওমর তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আর সাবেক আইনমন্ত্রী বিচারপতি কর্নেলিয়াস প্রেসিডেন্টের আইনি উপদেষ্টা হয়ে ১৭ মার্চ ঢাকায় আসেন। আন্তবাহিনী জনসংযোগ বিভাগের ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী সংবাদকর্মীদের এটা বোঝাতে গলদঘর্ম হন যে প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী জেনারেলরা বিশেষ কোনো কাজে আসেননি, তবু মানুষের সন্দেহ দূর হয়নি।
পরের দিন সকালে মুজিবের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের বৈঠক শুরু হয়। দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি সিংহের গুহায় প্রবেশ করেন। প্রথম বৈঠক আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। পরের দিনের বৈঠক স্থায়ী হয় এক ঘণ্টা। বৈঠকে কী হয়েছে, তা তখনো জানা না গেলেও একজন আইনবিশেষজ্ঞকে ডেকে আনায় মানুষের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। আবার উদ্বেগমিশ্রিত সন্দেহও ছিল। শোনা যায়, মুজিব প্রথম বৈঠক থেকে রাগে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে গেছেন।
হ্যাঁ, ঢাকার উত্তেজনার ব্যারোমিটারের পারদ ওঠা–নামা করেছে। মধ্যবিত্তরা গুলির নিশানা না হতে গ্রামে পালাতে থাকে। আর রণমুখীরা নানা প্রস্তুতির মাধ্যমে উত্তেজনা জিইয়ে রাখে।
সে সময় অর্থনীতির অবস্থা চিল তথৈবচ। অর্থনীতি সে সময় স্থবিরতা ও পুনর্জাগরণের মাঝে খুবই বিপজ্জনকভাবে দোল খাচ্ছিল। ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগ যে ডিক্রি জারি করে, তাতে প্রশাসন আংশিক ও অর্থনীতি পূর্ণাঙ্গ রূপে কার্যকর হয়। কর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে যখন ‘বাংলাদেশ সরকারের’ জন্য কর প্রদানের ঘোষণা আসে, তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আরও পোক্ত হয়। দুটি ব্যাংকে বিশেষ হিসাবের মাধ্যমে এ কর প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। সে দুটি ব্যাংকের সদর দপ্তর ছিল বাংলাদেশে।
স্টেট ব্যাংক ও অন্য সব বাণিিজ্যক ব্যাংক আওয়ামী লীগের নির্দেশনায় চলছিল। কিন্তু ব্যাংকের কার্যক্রমে আরও কিছুটা শিথিলতা দেওয়া হলে পরিস্থিতি উন্নয়নের আভাস পাওয়া যায়।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে অসহযোগ থেকে জনগণের রাজ কায়েম হওয়ার পরও এর কোনো প্রভাব ছিল না। ব্যাংকিং খাত ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল। কারণ, স্থানীয় ব্যাংকগুলো বাইরের ব্যাংকগুলোকে হটিয়ে নিজেরাই আমানত সংগ্রহ করছিল। করাচিতে ব্যাংকের প্রধান শাখা স্থানীয় শাখার তহবিল স্থানান্তরের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। যাতে বাইরের ব্যাংকগুলো শেষমেশ স্থানীয় স্টেট ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে শিল্প খাতে অনিশ্চয়তার কারণে উৎপাদন কমে যায়, আর দক্ষতাও নিম্নগামী হয়। এটা আবারও অসহযোগ ও জনগণের রাজের মধ্যকার পার্থক্যটা দেখিয়ে দেয়। পার্টি যে বাংলাদেশের জন্য নব উদ্যমে কাজের অনুপ্রেরণা দিচ্ছিল, সেটা শেষ পর্যন্ত কারখানার কর্মীদের কানে পৌঁছাতে পারেনি। পার্টির নির্দেশনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা না থাকায় কর্মীরা কিছুটা সন্দিহান ছিল। কারণ, বাংলাদেশের সমৃদ্ধির সঙ্গে তাদের কারখানার সমৃদ্ধি সম্পর্কিত ছিল।
প্রতিদিনের এই অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা ব্যাপার নিশ্চিত ছিল, সেটা হচ্ছে ইসলামাবাদের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছিল। সেটা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা অনেকটা ব্রিটিশদের উপমহাদেশ পুনরুদ্ধারের চেষ্টার শামিল। সে অবস্থায় ইসলামাবাদের ক্ষমতার ক্ষেত্র ছিল একটাই: মানুষ হত্যা করা। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে পারত তারা। খাদ্যভর্তি জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে করাচি নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সে অভিপ্রায় পরিষ্কার। তাহলে এ প্রশ্ন উঠতে পারে, তারা কেন এমন অচিন্তনীয় পর্যায়ে চলে গেল। শেখ মুজিবের দাবির সঙ্গে সমঝোতা না করলে তাদের হাতে উপায় ছিল শুধু একটি, গণহত্যা শুরু করা।
যেকোনো আগ্রাসী যুদ্ধের মতো এর উত্তর নিহিত রয়েছে ভুল হিসাবের মধ্যে। যারা অধিবেশন স্থগিত করে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছে; তারা ভেবেছে এর প্রতিক্রিয়া তেমন জোরালো হবে না, আর তার পরিসরও হবে ক্ষুদ্র। কিছু মারপিট আর খুনখারাবি করে তা বাগে আনা যাবে। ভুট্টো নাকি এ কথাও বলেছেন যে আন্দোলনের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিলেই আওয়ামী লীগের বোধোদয় ঘটবে। সাত দিনের মধ্যেই যে এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, সেটা কেউই ভাবেননি। সম্ভবত আওয়ামী লীগের নেতারাও না।
দ্বিতীয় ভুল হিসাবটি হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে এ ধারণা ছিল যে মুজিব এত তাড়াতাড়ি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন না। কিন্তু সেটা তিনি করে ফেলায় এর সুযোগে গণহত্যা চালানোর অজুহাত আর থাকল না। লুটপাট ও খুনখারাবির অজুহাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের সাফাই গাওয়ার যে চেষ্টা ইয়াহিয়া করলেন, সেটা আর হালে পানি পায়নি। ইয়াহিয়া ঢাকায় আসার পর পরিস্থিতি যে শান্ত হয়ে গেল, সেটা থেকেই বোঝা যায় মুজিবের কর্তৃত্ব কতটা ব্যাপ্ত।
এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে থাকে। চেয়ারম্যান ভুট্টোকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জনতাকে খেপিয়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ঢাক পিটিয়ে মিথ্যাচার শুরু করেন, ছয় দফার মধ্য দিয়ে বাঙালিরা চিরকালের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর ছড়ি ঘোরাতে চায়। অথচ এই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধেই বাঙালিরা ছয় দফা দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা আশা করেছিল, ভুট্টো জনগণের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য দলগুলোকে সংসদ বয়কট করতে ভয় দেখাতে পারবেন। আর এতে করে সংঘর্ষ সামগ্রিক আকার লাভ করবে।
ভুট্টো শুরুর দিকে সফল হলেও ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে তাঁর প্রচেষ্টা বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র কাইয়ুম মুসলিম লীগ এই বর্জনে অংশ নেয়। এই দলটি প্রশাসনের কাছ থেকে নানা সুবিধা পেয়ে এসেছে। প্রশাসনই তাদের চাপ দিয়ে সংসদ বর্জনে বাধ্য করে। এমনকি ভুট্টো তাঁর দলের মধ্যেও বিরোধিতার সম্মুখীন হন। আর সময়ক্ষেপণ করা হয়েছিল ভুট্টোর পেছনে ভঙ্গুর পশ্চিম পাকিস্তানকে এককাট্টা করার জন্য। যাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সংঘর্ষটা সার্বিক হয়। অথবা তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাত করতে চেয়েছে।
বাংলাদেশে স্থগিতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে নজিরবিহীন প্রতিরোধ হয়, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা অনিবার্য ছিল। অনেক পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিক স্থগিতের ব্যাপারটা সমর্থন করলেও জনগণের রাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর তারা দাবি করে বসে, ইয়াহিয়া খান যেন মুজিবের চার দফা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নেন। ভুট্টো ১ মার্চের পর থেকে রক্ষণাত্মক ও দুঃখজ্ঞাপক ছিলেন। এর ফলে তিনিও তাঁর উচ্চাশা খোলাসা করতে বাধ্য হন। তিনি করাচিতে ১৪ মার্চ প্রথমবারের মতো পশ্চিম পাকিস্তানকে দ্বিজাতিতত্ত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপলস পার্টির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। এতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, এটা ভুট্টোর মাধ্যমে তাদের ওপর নতুন পাঞ্জাবি শাসন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এমনকি খোদ পিপিপির মধ্যেও ভুট্টোর অভিসন্ধি নিয়ে সন্দেহ ছিল। কারণ, পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী নয়, তারা এর মাধ্যমে সামরিক জান্তার বেসামরিক ফ্রন্টে পর্যবসিত হতে পারে।
কিন্তু জেনারেল ও নেতা তাদের ভুল না শুধরে পরিস্থিতি আরও জটিল করে ফেলায় সাধারণ ভুল থেকে এক চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের দাবিতে আন্দোলন তৃতীয় সপ্তাহে পা দিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। মুদ্রার আরেক পিঠে ছিল ইসলামাবাদের সঙ্গে অসহযোগিতা, সেটাও চলতে থাকে। এমনকি প্রেসিডেন্টকে বরণ করার জন্য কোনো বেসামরিক কর্মকর্তা বিমানবন্দরে যাননি। সামরিক বাহিনীর বেসামরিক কর্মকর্তাদের ১৫ মার্চের মধ্যে কাজে যোগদানের নির্দেশনা দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা সেটা উপেক্ষা করেন। কর্মীরা তঁাদের এক দিনের বেতন আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিলে দান করেন। জয়দেবপুরের অর্ডন্যান্স কারখানার ১১ হাজার বেসামরিক কর্মী কাজ বাদ দিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
ওদিকে জনগণ সেনাবাহিনীতে রসদ সরবরাহ করবে না—এ সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ফলে সরবরাহ পরিস্থিতি দেখভাল করার জন্য সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেলকে ঢাকায় চলে আসতে হয়। তথ্যমতে, বিশাল আকৃতির সি-১৩০ পরিবহন বিমানে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে টিনজাত রসদ আনা হয়।
অন্যদিকে সেনাবাহিনী তার শক্তি বাড়াতে থাকে। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরে সাড়ে সাত হাজার অতিরিক্ত সেনার দলটি
জাহাজ থেকে নামতে পারেনি। কুমিল্লা থেকে এসএসজি কমান্ডো ইউনিট ও রংপুরে সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত ট্যাংকগুলো ঢাকায় আনা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কোনো ঘোষণা ছাড়াই ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ বেলা আড়াইটায় ঢাকায় পৌঁছান। পাকিস্তান রেডিওর আগে অল ইন্ডিয়া রেডিও তাঁর আগমনের খবর দেয়। তবে তাঁর নিরাপত্তাবহরের কারণে খবরটি আর চাপা ছিল না। বিমানবন্দর থেকে তাঁর বাসভবন পর্যন্ত পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনী রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তখনো ঢাকার আকাশে কালো পতাকা ছিল আর বাতাসে ছিল সহানুভূতিহীন নীরবতা। এর মধ্যেই তাঁর আগমন ঘটে।
তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে অনেক কানাঘুষা ছিল। অনেকে বলেন, তিনি পুরো যুদ্ধ ক্যাবিনেট নিয়েই ঢাকায় আসেন।
এটা নিশ্চিত যে প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল পীরজাদা ও বাহিনীর নিরাপত্তাপ্রধান ওমর তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আর সাবেক আইনমন্ত্রী বিচারপতি কর্নেলিয়াস প্রেসিডেন্টের আইনি উপদেষ্টা হয়ে ১৭ মার্চ ঢাকায় আসেন। আন্তবাহিনী জনসংযোগ বিভাগের ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী সংবাদকর্মীদের এটা বোঝাতে গলদঘর্ম হন যে প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী জেনারেলরা বিশেষ কোনো কাজে আসেননি, তবু মানুষের সন্দেহ দূর হয়নি।
পরের দিন সকালে মুজিবের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের বৈঠক শুরু হয়। দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি সিংহের গুহায় প্রবেশ করেন। প্রথম বৈঠক আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। পরের দিনের বৈঠক স্থায়ী হয় এক ঘণ্টা। বৈঠকে কী হয়েছে, তা তখনো জানা না গেলেও একজন আইনবিশেষজ্ঞকে ডেকে আনায় মানুষের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। আবার উদ্বেগমিশ্রিত সন্দেহও ছিল। শোনা যায়, মুজিব প্রথম বৈঠক থেকে রাগে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে গেছেন।
হ্যাঁ, ঢাকার উত্তেজনার ব্যারোমিটারের পারদ ওঠা–নামা করেছে। মধ্যবিত্তরা গুলির নিশানা না হতে গ্রামে পালাতে থাকে। আর রণমুখীরা নানা প্রস্তুতির মাধ্যমে উত্তেজনা জিইয়ে রাখে।
সে সময় অর্থনীতির অবস্থা চিল তথৈবচ। অর্থনীতি সে সময় স্থবিরতা ও পুনর্জাগরণের মাঝে খুবই বিপজ্জনকভাবে দোল খাচ্ছিল। ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগ যে ডিক্রি জারি করে, তাতে প্রশাসন আংশিক ও অর্থনীতি পূর্ণাঙ্গ রূপে কার্যকর হয়। কর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে যখন ‘বাংলাদেশ সরকারের’ জন্য কর প্রদানের ঘোষণা আসে, তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আরও পোক্ত হয়। দুটি ব্যাংকে বিশেষ হিসাবের মাধ্যমে এ কর প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। সে দুটি ব্যাংকের সদর দপ্তর ছিল বাংলাদেশে।
স্টেট ব্যাংক ও অন্য সব বাণিিজ্যক ব্যাংক আওয়ামী লীগের নির্দেশনায় চলছিল। কিন্তু ব্যাংকের কার্যক্রমে আরও কিছুটা শিথিলতা দেওয়া হলে পরিস্থিতি উন্নয়নের আভাস পাওয়া যায়।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে অসহযোগ থেকে জনগণের রাজ কায়েম হওয়ার পরও এর কোনো প্রভাব ছিল না। ব্যাংকিং খাত ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল। কারণ, স্থানীয় ব্যাংকগুলো বাইরের ব্যাংকগুলোকে হটিয়ে নিজেরাই আমানত সংগ্রহ করছিল। করাচিতে ব্যাংকের প্রধান শাখা স্থানীয় শাখার তহবিল স্থানান্তরের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। যাতে বাইরের ব্যাংকগুলো শেষমেশ স্থানীয় স্টেট ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে শিল্প খাতে অনিশ্চয়তার কারণে উৎপাদন কমে যায়, আর দক্ষতাও নিম্নগামী হয়। এটা আবারও অসহযোগ ও জনগণের রাজের মধ্যকার পার্থক্যটা দেখিয়ে দেয়। পার্টি যে বাংলাদেশের জন্য নব উদ্যমে কাজের অনুপ্রেরণা দিচ্ছিল, সেটা শেষ পর্যন্ত কারখানার কর্মীদের কানে পৌঁছাতে পারেনি। পার্টির নির্দেশনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা না থাকায় কর্মীরা কিছুটা সন্দিহান ছিল। কারণ, বাংলাদেশের সমৃদ্ধির সঙ্গে তাদের কারখানার সমৃদ্ধি সম্পর্কিত ছিল।
প্রতিদিনের এই অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা ব্যাপার নিশ্চিত ছিল, সেটা হচ্ছে ইসলামাবাদের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছিল। সেটা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা অনেকটা ব্রিটিশদের উপমহাদেশ পুনরুদ্ধারের চেষ্টার শামিল। সে অবস্থায় ইসলামাবাদের ক্ষমতার ক্ষেত্র ছিল একটাই: মানুষ হত্যা করা। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে পারত তারা। খাদ্যভর্তি জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে করাচি নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সে অভিপ্রায় পরিষ্কার। তাহলে এ প্রশ্ন উঠতে পারে, তারা কেন এমন অচিন্তনীয় পর্যায়ে চলে গেল। শেখ মুজিবের দাবির সঙ্গে সমঝোতা না করলে তাদের হাতে উপায় ছিল শুধু একটি, গণহত্যা শুরু করা।
যেকোনো আগ্রাসী যুদ্ধের মতো এর উত্তর নিহিত রয়েছে ভুল হিসাবের মধ্যে। যারা অধিবেশন স্থগিত করে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছে; তারা ভেবেছে এর প্রতিক্রিয়া তেমন জোরালো হবে না, আর তার পরিসরও হবে ক্ষুদ্র। কিছু মারপিট আর খুনখারাবি করে তা বাগে আনা যাবে। ভুট্টো নাকি এ কথাও বলেছেন যে আন্দোলনের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিলেই আওয়ামী লীগের বোধোদয় ঘটবে। সাত দিনের মধ্যেই যে এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, সেটা কেউই ভাবেননি। সম্ভবত আওয়ামী লীগের নেতারাও না।
দ্বিতীয় ভুল হিসাবটি হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে এ ধারণা ছিল যে মুজিব এত তাড়াতাড়ি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন না। কিন্তু সেটা তিনি করে ফেলায় এর সুযোগে গণহত্যা চালানোর অজুহাত আর থাকল না। লুটপাট ও খুনখারাবির অজুহাত দিয়ে হত্যাকাণ্ডের সাফাই গাওয়ার যে চেষ্টা ইয়াহিয়া করলেন, সেটা আর হালে পানি পায়নি। ইয়াহিয়া ঢাকায় আসার পর পরিস্থিতি যে শান্ত হয়ে গেল, সেটা থেকেই বোঝা যায় মুজিবের কর্তৃত্ব কতটা ব্যাপ্ত।
এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে থাকে। চেয়ারম্যান ভুট্টোকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জনতাকে খেপিয়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ঢাক পিটিয়ে মিথ্যাচার শুরু করেন, ছয় দফার মধ্য দিয়ে বাঙালিরা চিরকালের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর ছড়ি ঘোরাতে চায়। অথচ এই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধেই বাঙালিরা ছয় দফা দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা আশা করেছিল, ভুট্টো জনগণের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য দলগুলোকে সংসদ বয়কট করতে ভয় দেখাতে পারবেন। আর এতে করে সংঘর্ষ সামগ্রিক আকার লাভ করবে।
ভুট্টো শুরুর দিকে সফল হলেও ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে তাঁর প্রচেষ্টা বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র কাইয়ুম মুসলিম লীগ এই বর্জনে অংশ নেয়। এই দলটি প্রশাসনের কাছ থেকে নানা সুবিধা পেয়ে এসেছে। প্রশাসনই তাদের চাপ দিয়ে সংসদ বর্জনে বাধ্য করে। এমনকি ভুট্টো তাঁর দলের মধ্যেও বিরোধিতার সম্মুখীন হন। আর সময়ক্ষেপণ করা হয়েছিল ভুট্টোর পেছনে ভঙ্গুর পশ্চিম পাকিস্তানকে এককাট্টা করার জন্য। যাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সংঘর্ষটা সার্বিক হয়। অথবা তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাত করতে চেয়েছে।
বাংলাদেশে স্থগিতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে নজিরবিহীন প্রতিরোধ হয়, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা অনিবার্য ছিল। অনেক পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিক স্থগিতের ব্যাপারটা সমর্থন করলেও জনগণের রাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর তারা দাবি করে বসে, ইয়াহিয়া খান যেন মুজিবের চার দফা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নেন। ভুট্টো ১ মার্চের পর থেকে রক্ষণাত্মক ও দুঃখজ্ঞাপক ছিলেন। এর ফলে তিনিও তাঁর উচ্চাশা খোলাসা করতে বাধ্য হন। তিনি করাচিতে ১৪ মার্চ প্রথমবারের মতো পশ্চিম পাকিস্তানকে দ্বিজাতিতত্ত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপলস পার্টির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। এতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, এটা ভুট্টোর মাধ্যমে তাদের ওপর নতুন পাঞ্জাবি শাসন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এমনকি খোদ পিপিপির মধ্যেও ভুট্টোর অভিসন্ধি নিয়ে সন্দেহ ছিল। কারণ, পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী নয়, তারা এর মাধ্যমে সামরিক জান্তার বেসামরিক ফ্রন্টে পর্যবসিত হতে পারে।
কিন্তু জেনারেল ও নেতা তাদের ভুল না শুধরে পরিস্থিতি আরও জটিল করে ফেলায় সাধারণ ভুল থেকে এক চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
সূত্র: ফোরাম, ২০ মার্চ, ১৯৭১
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান।
সূত্র: ফোরাম, ২০ মার্চ, ১৯৭১
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান।
No comments