বেপরোয়া সিলেটের অপরাধীরা, পুলিশ ব্যস্ত সহিংসতা ঠেকাতে by ওয়েছ খছরু
রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে সিলেটে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। অপহরণের পর করা হচ্ছে খুন। হর-হামেশাই ঘটছে লাশ উদ্ধারের ঘটনা। রাজনৈতিক দলে নিজেদের মধ্যে হচ্ছে গোলাগুলি। খুন হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকরাও। চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এতে করে নগর জীবনেও নেমে এসেছে অস্বস্তি। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ। অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ। পুলিশ ও র্যাবের সোর্সরা হয়ে পড়েছে বেপরোয়া। শাসকদলের অঙ্গ সংগঠনের নেতারাও দাপট খাটিয়ে একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছেন। এ কারণে সিলেটের সামপ্রতিক ঘটনাবলীতে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। আর এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে মানুষ। সিলেট নগরীর রায়নগর ঝেরঝেরিপাড়া এলাকায় অপহরণ করে চতুর্থ শ্রেণী শিক্ষার্থী খুনের ঘটনায় ক্ষোভ বিরাজ করছে। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন নগরীর কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ করছে সাধারণ মানুষ। তবে, এ পরিস্থিতিতে অতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা সহিংসতা সামাল দিতে অধিক সংখ্যক পুলিশ মাঠে কাজ করছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনে ৬টি থানা ও অন্তত ৮টির মতো ফাঁড়ি রয়েছে। এসব ফাঁড়ির পুলিশরা বেশির ভাগ সময়ই রাজপথে সহিংসতা ঠেকাতে কাজ করেন। কিন্তু এই সুযোগে সিলেটে অন্য অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গত ১১ই মার্চ সিলেট নগরীর রায়নগর ঝেরঝেরিপাড়ায় চতুর্থ শ্রেণীর স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে অপহরণ করে পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান ও র্যাবের কথিত সোর্স আতাউর রহমান গেদা মিয়া ও ওলামা লীগ নেতা রাকিবের নেতৃত্বে অপরাধীরা। এ ঘটনার পরদিনই কোমলমতি ওই শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়। এ ঘটনার পর সিলেটের পুলিশ প্রশাসন মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে পুরো ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে। গ্রেপ্তার করা হয় এবাদুর, গেদা ও রাকিবকে। এর মধ্যে এবাদুর ও রাকিব আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ১৪ই মার্চ রাতে পুলিশ ওই শিশুর লাশ উদ্ধার করেছিলো। এ ঘটনায় সিলেটে ক্ষোভ-বিক্ষোভের অন্ত নেই। গত এক সপ্তাহ ধরে সিলেটে চলছে বিক্ষোভ। গতকালও নগরীর দুটি স্থানে এ ঘটনার প্রতিবাদে হয়েছে মানববন্ধন। গতকাল নগরীর তপোবন আবাসিক এলাকায় এক চিকিৎসকের বাসা থেকে কাজের মেয়ের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শরিফা ওরফে সুফিয়া নামের ওই কাজের মেয়ে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম আই এইচ জালালীর আখালিয়া তপোবন ১০০ নম্বর বাসায় কাজ করতো। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়িতে। লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই রবিউল হক মাসুম জানিয়েছেন, পুলিশ ডা. এস এম আই এইচ জালালীর বাসা থেকে গৃহকর্মী সুফিয়ার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে। যে রুম থেকে সুফিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ওই রুম ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। দরজা ভেঙে তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে সিলেট সদর উপজেলার শিবেরবাজার থেকে এক ব্যবসায়ীর বস্তাবন্দি গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আতাউর রহমান শাহজাহান (৩৭) নামের ওই ব্যবসায়ী শহরতলীর হাটখোলা ইউনিয়নের হাটখোলা গ্রামের মৃত সালামত উল্লার ছেলে এবং শিবেরবাজারের শুঁটকি ব্যবসায়ী। শনিবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শিবেরবাজার শাহী ঈদগাহের পাশ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের ছোট ভাই কবির আহমদ জানান, শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে শাহজাহানের বনিবনা ছিল না। প্রায় ৭ মাস থেকে শাহজাহানের স্ত্রী তার বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। শাহজাহান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন জড়িত থাকতে পারেন। কবির আহমদ জানান, শুক্রবার রাতে শাহজাহানের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় কামাল ও নাজির তাকে নিতে আসে। এ সময় শাহজাহান এশার নামাজ পড়ে যাওয়ার কথা বলে তাদেরকে বিদায় করেন। এশার নামাজে বের হওয়ার পর শাহজাহান বাড়ি ফিরেননি। জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় সিলেট নগরীর খাসদবীরে গ্রীস প্রবাসী ফখরুল ইসলামের বাসায় সন্ধ্যারাতে দুঃসাহসিক চুরির ঘটনা ঘটেছে। দারুস সালাম রোডের সৈয়দা মইনুদ্দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র সংলগ্ন বাসায় এ ঘটনা ঘটে। চোরেরা স্টিল আলমিরা ভেঙে নগদ ২০ হাজার টাকা, ২ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুটে নেয়। খবর পেয়ে বিমানবন্দর থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। সিলেট নগরীর তালতলা এলাকায় কয়েক দিন আগে ছাত্রলীগের সামাদ গ্রুপ ও পীযূষ গ্রুপের মধ্যে পরপর দুইদিন সংঘর্ষ হয়েছে। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় কয়েক জন আহত হন। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়া ছাড়াও রেজিস্ট্রি অফিস ও গণপূর্ত কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়েছে। গত তিনদিন ধরে সিলেট নগরীর উপশহরে চলছে টান টান উত্তেজনা। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নেয়ায় ওই এলাকার বাসিন্দারা রয়েছে অস্বস্তিতে। বৃহস্পতিবার রাতে ওই এলাকায় বিবদমান দু্’গ্রুপের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এর জের ধরে শুক্রবার বিকালে পশ্চিম তেররতন বাজারে ১৫টি দোকানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। আর গতকাল সিলেট নগরীর উপ-শহর তেররতন বাজারে ব্যবসায়ীদের মানববন্ধনে বাধা দিয়েছে যুবলীগ কর্মীরা। দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট ও ব্যবসায়ীদের আহত করার প্রতিবাদে এই মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল স্থানীয় এলাকাবাসী। ব্যবসায়ীরা জানান, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার যুবলীগের শামীম ইকবাল গ্রুপ ও ছাত্রলীগের দুলাল গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তেররতন বাজারে ব্যবসায়ীদের দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এসময় কয়েকজন ব্যবসায়ী আহত হন। এর প্রতিবাদে শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে মানববন্ধনের আয়োজন করেন স্থানীয় এলাকাবাসী। এসময় যুবলীগ নেতা শামীম ইকবাল গ্রুপের নেতাকর্মীরা মানববন্ধন আয়োজনের স্থানে অবস্থান নিয়ে মানববন্ধন না করতে হুমকি প্রদান করে। এসময় উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে ২৪ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বাদশা মিয়া ঘটনাস্থলে পৌঁছে উভয়পক্ষকে নিবৃত্ত করেন। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার এইচএসসি পরীক্ষার্থী এমরান হোসেনকে অপহরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় জিডি করা হয়েছে। সিলেটে অপরাধ ঘটাতে আসছে বহিরাগত অপরাধীরাও। গত মঙ্গলবার সিলেট নগরীর ধোপাদীঘির পাড় এলাকা থেকে মাইক্রোবাস সহ চালক সাহেদ আহমেদকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য ভাড়া করা হয়। এরপর তাকে অপহরণ করে যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীরা। পরিবহন শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন এরপর থেকে সাহেদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ঢাকার আশুলিয়া থানায় পাওয়া যায় তার লাশ। সিলেট নগরীর খুলিয়াটুলায় কাজের মেয়ে লিপি বেগম হত্যার ১০ দিন অতিবাহিত হলেও পিতা ও স্বজনদের কান্না থামছে না। এ ঘটনায় মামলা হলেও এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো বাদীর পরিবারকে মামলা তুলে নিতে দেয়া হচ্ছে নানা হুমকি। ভিক্ষুক পিতা আব্দুস সাত্তার মিয়ার দুই মেয়ের মধ্যে সবার বড় লিপি বেগম। ভিক্ষুক পিতার দরিদ্র পরিবারে দুঃখ লাঘবের আশায় ১১ বছর বয়সেই কাজের মেয়ে হিসেবে নগরীর খুলিয়াপাড়াস্থ লন্ডন প্রবাসী হোসনেয়ারা বেগমের বাসায় চাকরি নেয়। পরে ওই বাসাতে লিপিকে খুন করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আসামিরা লন্ডন প্রবাসী হওয়ায় ইতিমধ্যে দেশের সবক’টি বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় তাদের ছবি ও তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। সিলেটে কেন হঠাৎ করে অপরাধ বেড়ে গেলো এমন প্রশ্ন করা হলে এই অভিযোগ মানতে নারাজ সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মো. রহমতুল্লাহ। তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, এক সপ্তাহের পরিসংখ্যানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে সেটি বলা যাবে না। আর বাসার কাজের মেয়ে খুন, কিংবা পারিবারিক কারণে খুন সেটি অবনতির পর্যায়ে পড়ে না। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পুলিশের নিয়মিত টহল কিংবা নজরদারিতে কোন ব্যাঘাত ঘটছে না। তিনি বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ৬ থানায় মাত্র ৯০টি মামলা হয়েছে। অথচ দেশের কোথাও কোথাও এক থানায় ১২০টি মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশ সক্রিয় থাকায় শিশু সাঈদের খুনিরা গ্রেপ্তার হয়েছে।
No comments