শওকত ওসমান স্মৃতিতে অম্লান by সৈয়দা নূরুন্নাহার বুলু

রদ্ধেয় শওকত ওসমানের সঙ্গে পরিচিতি সেই ছাত্রজীবন থেকে। তার প্রবন্ধ, সাহিত্য, কবিতা, উপন্যাস পড়ে ছাত্রজীবন কেটেছে। তখন তাকে চোখে দেখিনি, কেবল মনে মনে শ্রদ্ধা করে এসেছি। এ মানুষটি যে পরে আমার কাছের মানুষ হয়ে যাবেন তা ভাবতেও পারিনি।
এটা সম্ভব হয়েছে আমার স্বামী সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের জন্য। শওকত ভাই ও নাজমুদ্দীন হাশেম ছিলেন বিশিষ্ট বন্ধু। তাদের মত-অভিমত, চিন্তাধারা ছিল একই রকম। শওকত ভাই ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ, কিন্তু বন্ধুত্বের মাত্রা এত গভীর ছিল যে, দু'জন দু'জনকে তুমি বলে সম্বোধন করতেন। বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাধারার গভীরতা অনেক প্রগাঢ় থাকলেও রসিকতায় তারা কম যেতেন না। প্রচুর আড্ডাবাজ ছিলেন দু'জনই। শওকত ওসমান সম্পর্কে বিজ্ঞজনরা অনেক লিখেছেন এবং আরও লিখবেন। আমি শওকত ভাই সম্পর্কে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কিছু আবোল-তাবোল কথা লিখে আমার অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করছি।
আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অতিমধুর, ভাই-বোনের সম্পর্ক। শান্তিনগর থেকে প্রায়ই হেঁটে চলে আসতেন আমাদের মগবাজারের ইস্পাহানি কমপ্লেক্সের বাসায়। হাতে কিছু না কিছু বাজার-সদাই সব সময়ই থাকত। কখনও পাকা পেঁপে, কখনও কুমড়ো বড়ি, কখনও শাকসবজি। তিনি শীতকালে একটি টুইডের জ্যাকেট, মাথায় ফেল্ট হ্যাট, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরে রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে আসতেন কখন তাকে দূর থেকে দেখে আমার ছেলে সি্নগ্ধ বলত, 'ওই যে প্রফেসর শংকু আসছেন।' সত্যিই তাকে সত্যজিৎ রায়ের শংকু চরিত্রের চেহারার মতোই লাগত। তারপর কয়েক ঘণ্টা গল্প-আড্ডায় কেটে যেত সময়। দুপুর অথবা রাতে আমাদের সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া হতো। তিনি ছিলেন স্বল্প আহারি আর আমার স্বামী ছিলেন ভোজনবিলাসী। শওকত ভাই আমাকে বলতেন, 'বুলু, তুমি তো তোমার স্বামীকে খাইয়ে খাইয়ে মোটা পেট আরও মোটা করে দিচ্ছ।'
আমি ছিলাম শওকত ভাইয়ের রান্নার রেসিপি দেওয়ার টিচার। একদিন টেলিফোনে আমাকে বললেন, 'ভাগ্যিস তুমি সলিসিটার নও, তাহলে তা তোমাকে ফিস দিতে দিতে আমি ফতুর হয়ে যেতাম।' বলেই অট্টহাসি। এভাবে সম্পর্ক গভীর হতে থাকল। প্রতি সকালে একবার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতেই হতো। একদিন আমি টেলিফোন ধরেছি তখন বলছেন, 'বহেন আমার বানহই কই?' শুনে আামি খুব হাসছি, তিনিও হেসে বললেন, 'এখন তোমার সঙ্গে আমার আসল সম্পর্ক_ হাশেম হয়েছে এখন বানহই (ভগি্নপতি)।' আমার খুব মজা লেগেছিল।
কত যে দু'চার লাইন কবিতা/ছড়া লিখে দিয়েছেন আমাদের দু'জনের নামে, কখনও কেবল আমাকেই_ তার কোনো হিসাব নেই। বইও উৎসর্গ করেছেন আমাদের দু'জনের নামে। একটি বইয়ের নাম 'আর এক ধারাভাষ্য' উৎসর্গ :সংলাপ অসৈয়দ নূরুনন্নাহার হাশেম ভগিনী শ্রীমতি,
সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম
আলস্যে বসতি
দম্পতি যুগলেষু_
এখানে কিছু কিছু কবিতা/ছড়া যুক্ত করা হলো।
বছর দুই এভাবেই আমাদের সময়গুলো কেটে যাচ্ছিল। তারপর জীবনে বিপর্যয় নেমে এলো। হাশেম ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। দিলি্লতে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়ে দুঃসংবাদটি জানা গেল ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে। খবরটি অতিদ্রুত ঢাকায় পেঁৗছে গেল। শওকত ভাইয়ের বার্তা হাসপাতালে পেলাম।
লিখেছেন_
হাশেম জীবন তোমার প্রতি অবিচার করেছে। ...
ফিরে এসো নিরাময়!
আমাদের অন্যান্য কামনা
জেনো সব বাক্যের অপচয়
রিঃয ষড়াব ঋৎড়স
শওকত ওসমান।
আবারও লিখেছেন 'হাশেম ও বুলুর জন্যে_ এখানে রাজনৈতিক মহল থেকে প্রশংসা ও গালাগাল খেয়ে অস্থির। তুমি নেই যে জবাব দিতে পারতে, হাশেম।
তোমার একান্তই শওকত
১৮.০৩.৯৮
শওকত ভাই হাশেমকে এই চিরকুট পাঠানোর ১০ দিন পরই নিজে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং অচেতন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। মাসখানেক পর সে অবস্থাতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অন্তরঙ্গ বন্ধুর আগেই তিনি চলে যান। তার বন্ধুও হয়তো দিন গুনছিলেন। তিনিও কখন সবার মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমাবেন।
এখন প্রতিনিয়ত ভাবতে থাকি। আমার স্বামীসহ সব গুণীজনের কথা যারা আজ আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। জীবিত না থাকলেও মনের মাঝে অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন আমার শওকত ভাই।

No comments

Powered by Blogger.