কর বাকি থাকা জমি খুঁজে বের করে ভূমিদস্যুরা, পরে ঘুষের বিনিময়ে দখল করে- সরকারী জমি দখল by রশিদ মামুন
সরকারের ৩৫ মন্ত্রণালয়ের ভূমি উন্নয়ন কর বাকি পড়েছে ৭০২ কোটি ১০ লাখ টাকা। সরকারী দফতর, অধিদফতর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দখলীয় সম্পত্তির ৰেত্রে নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও শুধু ব্যক্তি বিশেষের গাফিলতির কারণে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারী সম্পত্তি বেদখল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করা। ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে সম্পত্তির হিসেবে হাল নাগাদ করলে সরকারী সম্পত্তি বেদখলের মাত্রা অনেক কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশিস্নষ্টরা।সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করার সুযোগ নিচ্ছে ভূমি দসু্যরা। অধিকাংশ ৰেত্রে দেখা যায়, সরকার কোন জমির কর দীর্ঘদিন পরিশোধ করছে না প্রথমে ভূমিদসু্যরা তা খুঁজে বের করে। পরবর্তীতে মাঠ পর্যায়ে ভূমি অফিসের কর্মচারীদের উৎকোচের মাধ্যমে নিজের নামে কর দিতে থাকে। সরকার যখন এসব জমির দখল বুঝে নিতে যায় তখন ওই জমিটি নিজের দাবি করে ব্যক্তি বিশেষ আদালতে মামলা ঠুকে দেয়। এ প্রক্রিয়ায় সব চেয়ে বেশি দখল হচ্ছে বন বিভাগ এবং রেলের জমি। এ দু'টি সংস্থার জমির পরিমাণ যেমন বেশি তেমনি ভূমি উন্নয় কর বাকির পরিমাণও অনেক বেশি। সূত্র জানায়, আদালত বিচারের ৰেত্রে জমির দখল এবং ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধকে গুরম্নত্ব দেয়ায় কোন কোন ৰেত্রে সরকার মামলায় হারছে।
সূত্র জানায়, নিজের প্রতিষ্ঠানের আয় বেশি দেখানোর জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে না। বিশেষ করে লোকসানী প্রতিষ্ঠান রেল বিভাগ নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করলে তাদের লোকসানের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেত। অন্যদিকে বন বিভাগ যদি নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করত সে ৰেত্রে তাদের আয়ও কমে আসত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করে সরকারকে বিভ্রানত্ম করছে।
আইন অনুযায়ী ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফের কোন সুযোগ নেই। কর পরিশোধ না করা হলে সরকারী দাবি আদায় আইন (পিডিআর এ্যাক্ট ১৯১৩) অনুশারে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরম্নদ্ধে মামলা করার বিধান রয়েছে। তবে সরকারী প্রতিষ্ঠানের ৰেত্রে মামলা করার নজির তেমন দেখা যায় না। সূত্র বলছে ব্রিটিশ আমলে জমির করকে বলা হতো খাজনা, পাকিসত্মান সরকারের সময় যা ছিল ভূমি রাজস্ব এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে যাকে ভূমি উন্নয়ন কর হিসেবে অবিহিত করা হয়।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নানা পদৰেপ গ্রহণের পরও সরকারী প্রতিষ্ঠানের ৰেত্রে কর আদায়ের পরিমাণ সনত্মোষজনক নয়। ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের জন্য সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। অধিকাংশ ৰেত্রে সরকারী সংস্থাগুলো ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ তাদের চাহিদা অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানায় না। গত বছর ১২ মে এ বিষয়ে সব মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিলেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেৰিতে রেল বিভাগ ভূমি মন্ত্রণালয়কে জানায়, ২০০৫ সালে সরকার রেলের ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ করে দিয়েছে, কিন্তু গত সপ্তাহে ভূমি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী রেজাউল করিম হিরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আনত্মঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে জানানো হয় রেলের ওই দাবির সমর্থনে সরকারী কোন প্রজ্ঞাপন পাওয়া যায়নি। একই বৈঠকে বলা হয় বন বিভাগ তাদের কর মওকুফ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে এমন দাবি করলেও দাবির সমর্থনে কোন প্রজ্ঞাপন দেখাতে পারেনি।
বৈঠকে সিদ্ধানত্ম নেয়া হয়, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদা স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়ে থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে এবং কোন মন্ত্রণালয়ের ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ করা হয়ে থাকলে এ সম্পর্কিত প্রজ্ঞাপন ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে।
ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের ৰেত্রে মন্ত্রণালয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মোজাম্মেল হক খান জনকণ্ঠকে বলেন, তার মন্ত্রণালয় ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের পৰে। এ জন্য তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চাইবেন। তবে চলতি বছর বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে কিনা তা জানাতে পারেননি সচিব।
একই বিষয়ে বন এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মিহির কানত্মি মজুমদার জানান, তাঁরা ভূমি উন্নয়ন কর দেয়ার পৰে নয়। বনের জমির ভূমি উন্নয়ন কর দেয়ার প্রয়োজন নেই জানিয়ে সচিব বলেন, কর মওকুফের জন্য তাঁরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আবেদন জানাবেন।
এ বিষয়ে বিমান এবং পর্যটন সচিব শফিক আলম মেহেদী বলেন, সরকারের আয় -ব্যয়ের হিসেব ঠিক রাখার জন্য তাদের মন্ত্রণালয় ভূমি উন্নয়ন কর দেয়ার পৰে। তিনি বলেন, যেহেতু আমরা বিভিন্ন ৰেত্রে কর আদায় করে থাকি তাই আমাদের কাছে কারও কর পাওনা থাকুক আমরা তা চাই না। এ জন্য সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ চাওয়া হবে বলে জানান তিনি।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৭৬ ও ১৯৮২ সালের ভূমি উন্নয়ন কর অধ্যাদেশে বলা হয়েছে সকল সরকারী দফতর, অধিদফতর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, পরিবার এবং ব্যক্তির দখলে থাকা সম্পত্তির ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক।
১৯৮২ সালের সংশোধিত অধ্যাদেশের ৩ (ক) ধারা অনুযায়ী কেবলমাত্র পাবলিক কবরস্থান, শ্মশানঘাট, মসজিদ, মন্দির, গির্জার ৰেত্রে ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হয় না।
ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। জাতীয় বাজেট এবং পরিকল্পনা বাসত্মবায়নের জন্য ভূমি উন্নয়ন করের বিশেষ অবদান রয়েছে। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের আয় কমে গেছে।
কোন্ মন্ত্রণালয়ের কত বাকি
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পররাষ্ট্র এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ছাড়া সকল মন্ত্রণালয়ের ভূমি উন্নয়ন কর বকেয়া রয়েছে। সর্বোচ্চ ৩৯৪ কোটি ৬২ লাখ ১০ হাজার ৪৩৭ টাকা কর বকেয়া রয়েছে পরিবেশ এবং বন মন্ত্রণালয়ের। সর্বনিম্ন ২ হাজার ৮৬৬ টাকা কর বকেয়া রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের।
এ ছাড়া যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ২২৪ কোটি ১৭ লাখ ২৭ হাজার ৬১৮ টাকা, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৬ কোটি ৬৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৭৪ টাকা, শিৰা মন্ত্রণালয়ের ১ কোটি ৫৮ লাখ ৩১ হাজার ৯২১ টাকা, প্রাথমিক এবং গণশিৰা মন্ত্রণালয়ের ৩ কোটি ২ লাখ ৩৫ হাজার ১১০ টাকা, নৌ মন্ত্রণালয়ের ৪ কোটি ৭১ লাখ ৩২ হাজার ৮৪ টাকা, গৃহায়ন এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ৩ কোটি ৩২ লাখ ৩১ হাজার ৬৭২ টাকা, প্রতিরৰা মন্ত্রণালয়ের ২ কোটি ১ লাখ ৩১ হাজার ৬১৮ টাকা, বস্ত্র এবং পাট মন্ত্রণালয়ের ১০ কোটি ৯৮ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৪ টাকা, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৭৮ হাজার ৭৯৩ টাকা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫৯২ টাকা, এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের ১৯ কোটি ৫২ লাখ ২১ হাজার ৪৫৫ টাকা, বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ২৯ লাখ ২২ হাজার ১৮৩ টাকা, মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৫০ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৪ টাকা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৮ টাকা, বিদু্যত, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২ কোটি ৯ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪৭ টাকা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৬৭ লাখ ৯১ হাজার ১৭০ টাকা, ডাক এবং টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ২৪ লাখ ৩০ হাজার ৮৮৪ টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৭২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩ টাকা, যুব এবং ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ১ কোটি ৪০ লাখ ৯১ হাজার ৫২০ টাকা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ১ কোটি ৬০ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৪ টাকা, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ২৪ লাখ ২৩ হাজার ১৯৩ টাকা, আইন, বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৫ লাখ ৬২ হাজার ৭৭৫ টাকা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ৬ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টাকা, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৪ টাকা, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ১৫ লাখ ৯১ হাজার ৮৮১ টাকা, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮৫৪ টাকা, শ্রম এবং কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৯ টাকা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৭ টাকা, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৭৪৮ টাকা, মহিলা এবং শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২ লাখ ৭ হাজার ১৪৮ টাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১ লাখ ২১ হাজার ২৭৮ টাকা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৩৬৪ টাকা, প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ৫ হাজার ৭০৫ টাকা।
No comments