হতে পারত দিনটি ঐতিহাসিক by আবদুল মান্নান
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অনেকের নাম প্রাতঃস্মরণীয়। এঁদের অনেকের নাম, ত্যাগ আর ভূমিকার কথা প্রতিবছর ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রম্নয়ারিতে চর্চা করা হয়।
গণমাধ্যমে তাঁদের কথা স্মরণ করা হয়। একবাক্যে তাঁদের সম্পর্কে দেশের মানুষ জানে। এঁদের বাইরেও বাংলা ভাষাকে পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনেকে সে সময় জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন, এমনকি পশ্চিম পাকিসত্মানের অবাঙালী রাজনীতিবিদদের মধ্যেও কেউ কেউ বাংলাকে পাকিসত্মানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বাঙালীদের দাবির প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছিলেন। এঁদের অনেকের কথা এখন ইতিহাসের স্মৃতি থেকে বিস্মৃত হয়ে গেছে অথবা হারিয়ে গেছে।মুসলিম লীগের প্রাথর্ী হিসেবে ১৯৩৭ সালে চট্টগ্রাম হতে নূর আহমদ বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন সে সময়কার বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে একজন অসাধারণ মেধাবী ও কৃতিত্বের অংশীদার। চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে নূর আহমদ ১৯১২ সালে বিভাগীয় বৃত্তি নিয়ে প্রথম বিভাগে আইএ পরীা ও একই কলেজ হতে ১৯১৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে অনার্সসহ বিএ পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯১৬ সালে এমএ পরীায় সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে চ্যান্সেলরস স্বর্ণপদক দেয়া হয়। একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯১৭ সালে সমান কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি আইন ডিগ্রী অর্জন করেন। চট্টগ্রামে ফিরে ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং এই পদে তিনি দীর্ঘ তেত্রিশ বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি স্বেচ্ছায় এই পদে আর প্রতিদ্বন্দি্বতা না করার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামে এখন তিনি নূর আহমদ চেয়ারম্যান হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত।
১৯৩৭ সালে নূর আহমদ বঙ্গীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার সুবাদে পরবতর্ীকালে তিনি পাকিসত্মানের প্রথম আইন পরিষদেরও সদস্য নির্বাচিত হন। এই পদেও তিনি ১৯৫৪ সাল পর্যনত্ম অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৯৫২ সালে যখন সমগ্র পূর্ববাংলা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল তখন নূর আহমদ পাকিসত্মানের তদানীনত্মন রাজধানী করাচীতে। ১০ এপ্রিল গণপরিষদের সভা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই নূর আহমদ দাঁড়িয়ে বাংলাকে পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা করার একটি প্রসত্মাব উত্থাপন করেন। তিনি তাঁর প্রসত্মাবটা হঠাৎ করেই উত্থাপন করেন স্পীকার তমিজুদ্দীন খানের অনুমতি প্রার্থনা না করেই। নূর আহমদ ছিলেন একজন অসাধারণ বাগ্মী এবং প্রায়শ পূর্ববঙ্গের স্বার্থসংশিস্নষ্ট নানা বিষয়ে প্রসত্মাব উত্থাপন করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কোন কোন সময় তাঁর এইসব প্রসত্মাব নিজ দল মুসলিম লীগকেও অপ্রস্তুত করে দিত। বাংলাকে পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রসত্মাব করার পরমুহূর্তে স্পীকার তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, 'আপনি কি কিছু বলতে চান?' নূর আহমদ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই তাঁর দলীয় প্রভাবশালী সদস্য পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরম্নল আমিন তাঁকে থামানোর জন্য বলেন, 'তিনি (নূর আহমদ) ইতোমধ্যে বলেছেন।' পরিষদের আর একজন মুসলিম লীগ সদস্য পাঞ্জাবের সর্দার শওকত হায়াৎ খান প্রতিবাদ করে বলেন, সরকারের একজন কর্মকর্তা (নূরম্নল আমীন) তাঁকে (নূর আহমদ) কথা বলতে বাধা দিচ্ছেন। স্পীকার (তখন বলা হতো প্রেসিডেন্ট) তমিজুদ্দীন খান নূর আহমদের প্রসত্মাবটি আংশিক সংশোধন করে নিজেই উত্থাপন করেন। সংশোধনীতে তিনি উদর্ুকেও বাংলার সাথে পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের প্রসত্মাব করেন। পরমুহূর্তে সিন্ধু হতে নির্বাচিত মুসলিম লীগ সদস্য পীরজাদা আবদুস সাত্তার আবদুর রহমান একটি পাল্টা প্রসত্মাব উত্থাপন করে বলেন, যেহেতু এই মুহূর্তে রাষ্ট্রভাষা বিষয়টি পরিষদে উত্থাপন করার মতো কোন জরম্নরী পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি সেহেতু বিষয়টি পরবতর্ীকালে উত্থাপন করা হোক এবং সে সময় প্রয়োজনমাফিক সিদ্ধানত্ম গ্রহণ করা হোক।
পরিষদের স্পীকার পীরজাদা রহমানের প্রসত্মাবটিও হাউসে উত্থাপন করেন। পরবতর্ীকালে গণপরিষদে এক অভাবনীয় ঘটনার সূত্রপাত হয়। সর্দার শওকত হায়াৎ খান, যিনি পাকিসত্মানের রাজনীতিতে জিন্নাহর একানত্ম ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত ছিলেন।
তিনি পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতিদানের প েএক দীর্ঘ আবেগঘন বক্তব্য রাখেন। তিনি পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিষয় উলেস্নখ করতে গিয়ে বলেন, পূর্ববঙ্গে এই দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘাত হয়েছে, গুলি হয়েছে, হত্যা হয়েছে। তিনি পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নূরম্নল আমীনের ভূমিকারও প্রচ- সমালোচনা করেন এবং বলেন যে, বিষয়টি তিনি প্রাদেশিক পরিষদে সুরাহা করতে সম ছিলেন তা এখন কেন্দ্রীয় গণপরিষদে আলোচিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলা পাকিসত্মানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী পূর্ববাংলার চার কোটি নয় লাখ মানুষের ভাষা। তাকে যদি আমরা যথাযথ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হই তাহলে এক সময় দেখা যাবে এই ইসু্যটাকে কেন্দ্র করে পাকিসত্মানের মূল আবরণটাই খসে যাবে। তিনি জোরালোভাবে নূর আহমদের প্রসত্মাব সমর্থন করেন। তিনি বার বার স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে থাকেন, রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি তুলে রাখার মতো কোন বিষয় নয়। বিষয়টির যদি ত্বরিত সমাধানের ব্যবস্থা নিতে আমরা ব্যর্থ হই তাহলে খুব দ্রম্নত পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা মনে করবেন পশ্চিম পাকিসত্মানীরা তাদের ওপর আধিপত্য বিসত্মার করতে চাইছে।
সর্দার শওকত হায়াতের দীর্ঘ যুক্তিপূর্ণ ও আবেগঘন বক্তৃতার পর ফোর নিয়ে আর এক দীর্ঘ বক্তৃতা দেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তিনি প্রত্যাশিতভাবেই নূর আহমদের প্রসত্মাবকে জোরালো সমর্থন করেন। কিন্তু এও বলেন, নূর আহমদের গণপরিষদে প্রসত্মাব উত্থাপন করার খ্যাতি আছে কিন্তু অনেক সময় অন্যরা এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে সময় পান না। তবে তিনি প্রসত্মাবটার গুরম্নত্বের ওপর দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন এবং তাঁর স্বভাবসুলভ বাচনভঙ্গি দিয়ে পরিষদকে অনেকটা সম্মোহিত করে রাখেন। বিচণ শেরেবাংলা ফজলুল হক বুঝতে পারেন, সংসদে নূর আহমদের প্রসত্মাব পাস করানোর মতো যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও পাওয়া যেতে পারে। আর, একবার একটি প্রসত্মাব ভোটে দিয়ে তা পাস করাতে ব্যর্থ হলে সে প্রসত্মাবের মৃতু্য ঘটবে। এ সময় প্রচলিত অর্থে সরকারী দল আর বিরোধী দল না থাকলেও সাধারণত মনে করা হতো মুসলিম লীগ মানে সরকারী দল, আর অন্যরা বিরোধী দল। পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল পঁচাত্তর। এর মধ্যে ৪৪ জন পূর্ববাংলার, ২২ জন পাঞ্জাবের, ৫ জন সিন্ধু প্রদেশের, ৩ জন উত্তর-পশ্চিম সীমানত্ম প্রদেশের এবং একজন বালুচিসত্মানের। এঁরা ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাকিসত্মানের গণপরিষদে এ সময়ে বাঙালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও অনেক ঐতিহাসিক মুহূর্তে তাঁরা ঐকমত্যে পেঁৗছতে পারেননি। মুসলিম লীগের দলীয় সদস্যরাও অনেকে দলের বৃত্তের বাইরে এসে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেরেবাংলা ফজলুল হক সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করে প্রসত্মাব করেন_ বিষয়টি অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। দ্রম্নততম সময়ে তার সুরাহা হওয়া উচিত। তবে তা সেদিন না করে অন্য আর একদিন করা হোক। তিনি রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রসত্মাবটি যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে পুনরায় পরিষদে উত্থাপনের প্রসত্মাব করেন।
শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের এই দীর্ঘ এবং অত্যনত্ম জোরালো বক্তৃতার পর ত্রিপুরা (কুমিলস্না) হতে নির্বাচিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ফোর নিয়ে প্রশ্ন রাখেন, বিষয়টি এই মুহূর্তে স্থগিত রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা? তিনিও এক দীর্ঘ বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার প েজোরালো বক্তব্য রাখেন এবং বলেন, যদিও নূর আহমদ প্রসত্মাবটি উত্থাপন করেছেন, তিনি তাঁর প েকোন কিছু বলেননি এবং অন্যরাও (মুসলিম লীগ) নিশ্চুপ রয়েছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার প েপূর্ববঙ্গের প্রত্যেক বাঙালীর সমর্থন আছে এবং বিষয়টি উত্থাপন না করে এখনই মীমাংসা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, পূর্ববঙ্গ হতে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের নীরবতার অন্যতম কারণ হতে পারে তাঁদের ওপর দলীয় চাপ। তিনি আপে করে বলেন, দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী (নূরম্নল আমীন) সব জেনেও চুপ করে আছেন। তিনি পূর্ববাংলার সকল সদস্যকে সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার অনুরোধ করেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাকে পাকিসত্মানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়োজন পাকিসত্মানেরই স্বার্থে। তিনি মনত্মব্য করেন, পশ্চিম পাকিসত্মানের মানুষ যদি বাংলা আর পূর্ব পাকিসত্মানের মানুষ উদর্ু শেখে তাহলে উভয়ের মাঝে যোগসূত্র স্থাপিত হবে।
ভাষার বিষয় নিয়ে সেদিন দীর্ঘ সময় ধরে গণপরিষদে আলোচনা ও বিতর্ক হয়। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে নূরম্নল আমীনের ভূমিকাকে অনেকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। সকলের আলোচনা ও বক্তব্য শোনার পর স্পীকার পীরজাদা আবদুর রহমানের প্রসত্মাব, অর্থাৎ ভাষার বিষয়টি এই মুহূর্তে সিদ্ধানত্মের জন্য গ্রহণ না করে তা পরবতর্ীকালের কোন একটি অধিবেশনে সিদ্ধানত্মের জন্য গৃহীত হোক_ ভোটে দেন। এই প্রসত্মাবের প েএকচলিস্নশটি ভোট পড়ে। মুসলিম লীগের প্রায় সকল সদস্যই এই প্রসত্মাবের প েভোট দেন। যে সকল বাঙালী সেদিন প েভোট দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা আকরম খাঁ, ফজলুর রহমান, শহুদুল হক, ডা. এএম মালেক, হাবিবুলস্নাহ বাহার, নূর আহমদ, নূরম্নল আমীন, খাজা নাজিমউদ্দিন, খাজা সাহাবুদ্দিন, ধনঞ্জয় রায়, অয় কুমার দাশ, আব্দুল মোনেম খান অন্যতম। এঁদের কেউ কেউ পরবতর্ীকালে বাংলাকে পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। প্রসত্মাবটির বিপ েমোট বারোটি ভোট পড়ে। এই বারো জনের মধ্যে ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রাজকুমার চক্রবতর্ী, ভবেশচন্দ্র নন্দী, সরদার শওকত হায়াৎ খান, সর্দার আসাদলস্নাহ জান খান প্রমুখ সদস্য। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ভোট গ্রহণের সময় অনুপস্থিত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ১০ এপ্রিল পাকিসত্মানের গণপরিষদে যদি পূর্ববাংলার সকল বাঙালী সদস্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে আপোসহীন থাকতেন এবং ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করতেন তাহলে বাঙালীর ১৯৫৪ সালের ৭ মে পর্যনত্ম বাংলাকে পাকিসত্মানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য অপো করতে হতো না। হয়ত এদিন ইতিহাস তাদের সাথে ছিল না। থাকলে এদিন মূল প্রসত্মাবক নূর আহমদসহ অনেকে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকতেন। তারপরও যাঁরা সেদিন গণপরিষদে বাংলার প েজোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন, প্রসত্মাব উপস্থাপক নূর আহমদ, সমর্থনকারী সরদার শওকত হায়াৎ খান, একে ফজলুল হক, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। প্রতিবছর আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই সকল বিষয় যত বেশি চর্চা হয় তত বেশি বর্তমান প্রজন্মের জন্য মঙ্গল।
[তথ্য সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র-প্রথম খ-, পৃ. ২৪৬-২৫৯]
লেখক : শিাবিদ
No comments