হীরক রাজার দেশের প্রগল্ভ অর্থমন্ত্রী- বিচিন্তা by সাদেক খান
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত
সাংবাদিকদের ওপর জবর গোসসা হয়েছেন। কারণ সাংবাদিকেরা বিশেষ করে
অর্থনৈতিকবিষয়ক সাংবাদিকেরা তার কথা ঠিকভাবে তুলে ধরেন না।
তার
ভাষায় অনেক সময় ‘বিকৃত’ভাবে তার বক্তব্য তুলে ধরা হয়। সরকার যখন
সাফল্যের কথা বলে, দেশের গণমাধ্যম তাতে গুরুত্ব দেয় না। অথচ একই তথ্য যখন
বিদেশী পত্রিকায় আসে, দেশের গণমাধ্যমে তা ফলাও করে প্রচার করে। তিনি
বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক গার্ডিয়ান ১৮ ডিসেম্বর
সংখ্যায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে যে প্রতিবেদন
প্রকাশ করেছে সেটির কথা। গার্ডিয়ানের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের
অর্থনীতি ২০৫০ সাল নাগাদ পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রীর
ােভ : ‘আমাদের চরিত্রটাই এমন, যখন ইকোনমিস্ট বলে, যখন ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট
জার্নাল বলে, যখন গার্ডিয়ান বলে তখন আমরা খুব উচ্ছ্বসিত ও উদ্বেলিত হয়ে
যাই। আর আমরা (সরকার) যখন বলি, তখন এটা ঠিক নয়, এটা খারাপ বলে প্রচার করা
হয়।’
অর্থমন্ত্রী মনের সুখে দেশের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠান হয়েছে। কী যেন নাম তার…। এর একটি থিঙ্ক ট্যাংক হয়েছে। তার জঘন্য ফাইন্ডিংস, তার মধ্যে কোনো স্কলার আছে কি না আমার সন্দেহ আছে। ইদানীং সব কাগজে তাদের কথা খুব বলে। তারা বলে, সরকারের গ্রোথ হবে না। এটা বলে, ওটা বলে, সব নেগেটিভ। আর নেগেটিভ হলেই… (ইঙ্গিত, সাংবাদিকেরা সমালোচনা লুফে নেয়)। এ সময় তিনি তার কথা শেষ না করে অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। তবে তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেননি।
সাংবাদিকদের লেখারও কঠোর সমালোচনা করেন অর্থমন্ত্রী। তাই তাদের সাংবাদিকতা শিাও দিতে চান তিনি। কারণ তারা তার বক্তব্য ঠিকভাবে তুলে ধরেন না। তিনি ইংরেজিতে বলেন, ‘হোয়াট আই অ্যাম গোয়িং টু ডু, আই টেল ইউ, হোয়েন আই অ্যাম কম্পারেটিভলি ফ্রি, আই উড লাইক টু টেক এ ট্রেনিং কোর্স অন ইকোনমিক রিপোর্টিং’ (আমি যখন অবসর নেব তখন কী করব, তা আমি তোমাদের বলছি। আমি অর্থনৈতিক রিপোর্টিংয়ের ওপর প্রশিণ দিতে চাই)।
সাংবাদিকদের ‘প্রশিণ’ দিয়ে বাগে আনার সরকারি বাসনার কথা অর্থমন্ত্রীর আগেই প্রকাশ করেছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বলেছিলেন, সাংবাদিকদের প্রশিণ দেয়ার জন্য একটি ইনস্টিটিউট খুলবেন। জনাব শাজাহান খান শুধু মন্ত্রী নন, চাঁদাবাজ পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্ঘশক্তিরও তিনি অধিনায়ক। তার গোসসা আরো ভয়ঙ্কর। একটা টেলিভিশন টকশো বিতর্কে তিনি তার প্রতিপরে গায়ে হাত তোলা থেকে বিরত হয়েছিলেন বটে। তবে গালাগাল দিয়ে প্রতিপরে মনে মৃত্যুভয় ঢুকিয়ে দেয়ার পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে দ্বিধা করেননি। কিছু তরুণ সাংবাদিকের দুর্ভাবনা, দুই মন্ত্রী মিলে সাংবাদিকতার ইনস্টিউট খুললে একজনের কাছে কড়া ইংরেজি শিখতে হিমশিম খেতে হবে। অন্যজন অবশ্যই পান থেকে চুন খসলে বকাবকিসহ বেত্রদণ্ডের ব্যবস্থা করবেন; সে জন্য কানে তুলো দেয়া পিঠ কুলো করা, দুটোই অভ্যেস করতে হবে।
সেই ভয়েই কি সাংবাদিকেরা অর্থমন্ত্রীকে দেশের নামে কোনো ‘সুখবর’ হলেও অর্থমন্ত্রীকে কোনো ‘ক্রেডিট’ দিতে নারাজ? ‘নতুন ধারার অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে প্রবৃদ্ধিতে’ (নিউ ওয়েভ ইকোনমিক্স গ্রোয়িং ফর গ্রোথ) এই শিরোনামে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বাংলাদেশের নামে যেসব ভালো ভালো কথা ছাপা হলো, সে জন্য আমজনতার পত্রপত্রিকাগুলোতেও আওয়ামী লীগের তারিফ হলো না। বাস্তবিকই অর্থমন্ত্রীর গুণ গাইতে কৃপণ তরুণ রিপোর্টাররা একটা জনপ্রিয় (সস্তা) দৈনিকে যেমন সংবাদভাষ্যে দ্য গার্ডিয়ানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে : পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে বাংলাদেশের অর্থনীতির আর মাত্র চার দশক সময় লাগবে এবং এ েেত্র সবচেয়ে বড় অবদান থাকছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। তাদের পাঠানো অর্থেই বাংলাদেশের অর্থনীতি জোরদার হচ্ছে। ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে অর্থনীতির চিত্র। একই সাথে বাড়ছে অবকাঠামো ও শিা খাতে বিনিয়োগ। আর এই উন্নয়নের হার মন্দায় পতিত পশ্চিমা দেশগুলোকে এক সময় ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বিশ্বের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার কর্ণধারেরা অতীতে বহুবার বাংলাদেশের সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক নিয়ে যেসব ইতিবাচক কথা বলেছেন এবং বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে সেসব মহল থেকে যা যা বলা হয়েছে তা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা আমলে নিয়ে পরবর্তী পদপে কতটা কী নিয়েছেন তা অজানা। তবে এ কথা সত্য, নানা রকম প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উন্নয়নের প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত আশা জাগানিয়া। চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য না থাকা, দায়িত্বশীল অনেকের বিভিন্ন রকম নেতিবাচক কর্মকাণ্ড, অনেক েেত্রই অপরিকল্পিত কার্যকলাপ, দুর্নীতি, মতার অপব্যবহার, জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতার পাঠ চুকে যাওয়া ইত্যাদি আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির েেত্র বাধার প্রাচীর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এর অপসারণ করা গেলে বাংলাদেশের সম্ভাবনার সব দরজা নিঃসন্দেহে আরো অনেক প্রশস্ত হতো এবং এর সুফল ভোগ করত দেশ ও জাতি। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জাতীয় ইস্যুতেও সবার এক কাতারে না দাঁড়াতে পারার বিরূপ প্রভাব বহুমুখী হয়ে উঠেছে। আমাদের রফতানিযোগ্য পণ্য যথেষ্ট না হলেও যা আছে তাও কম নয় এবং এখনো এসবের কদর আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শিতা আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈরী মনোভাব সব সম্ভাবনার দরজায় কাঁটা দিয়ে রেখেছে। প্রবাসীরা বাংলাদেশের অনেক বড় শক্তি বটে কিন্তু অনেক েেত্রই তাদের অবমূল্যায়ন হচ্ছে। জনশক্তি রফতানি চিত্র ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে। নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধান, দ শ্রমিক তৈরি ইত্যাদি েেত্রও আশানুরূপ সফলতা মিলছে না। তবুও আমরা এগিয়ে চলেছি এটি বিস্ময়কর বৈকি। খুব সহজেই অনুমেয়, উল্লিখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে একই সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসন করে জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যমঞ্চ গড়তে পারলে আমাদের অগ্রগতির পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক নেতারা কি বিষয়গুলো আমলে নেবেন? তারা কি এসব প্রতিবেদন, মূল্যায়ন কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী পর্যালোচনা করে দেশ-জাতির জন্য সাফল্যজনক অধ্যায় রচনা করতে উদ্যোগী হবেন?
আমাদের কপালে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ হিসেবে যে তিলক লেগেছিল তা অপসারিত হয়েছে অনেক আগেই এবং আমরা এখন উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার টেকসই ও শক্তিশালী করতে অভিবাসীদের পাঠানো অর্থ ব্যাপক অবদান রাখছে। অভিবাসীদের প্রতি গুরুত্বের সাথে দৃষ্টি দেয়ার পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধান করা এবং রফতানিযোগ্য পণ্যের বাজার বিস্তৃত করার প্রয়াস চালাতে হবে।
পাশাপাশি খবর : মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানির হার এ বছর তলানিতে ঠেকেছে, যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতে। এ অবস্থা পরিবর্তনে সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি নয়, তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। গত এক বছরে বিভিন্ন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিভিন্ন নেতার বাংলাদেশ সফর ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সে দেশ সফরের সময় এ দেশে বিনিয়োগের বিষয়টি বারবার আলোচিত হয়েছে।
আমিরাতে বাংলাদেশীদের লেবার ভিসা বা আত্মীয় সফর ভিসা দেয়া বন্ধ। সৌদি আরবেও আকামা ভিসা দেয়া বন্ধ। বাংলাদেশী কর্মজীবীরা উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মসংস্থান হারাচ্ছে। তবে সরকার বলছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশে চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা এ অর্থের বিনিময়ে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন, চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, মংলা বন্দরের উন্নয়ন এবং ঢাকায় রেলসংযোগসহ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো স্থাপন করতে আগ্রহী। এ বছরের জুন মাসে ঢাকা সফর করেন সৌদি প্রিন্স আল-ওয়ালিদ বিন তালাল বিন আবদুল আজিজ আল সউদ। তখন বাংলাদেশ এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কক্সবাজারে সমুদ্রতীরে ট্যুরিস্ট স্পট নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে।
কুয়েতের সাথে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি একেবারেই বন্ধ রয়েছে। কুয়েত সরকার দ জনশক্তি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কোনো শ্রমিক নেবে না। এ অবস্থায় কুয়েত থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী আনার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
জনশক্তি রফতানির কথায় আমল না দিয়ে বিনিয়োগের প্রশ্নে বাহরাইন সরকার দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পরামর্শমূলক সভা নিয়মিত করার ল্েয সমঝোতা স্মারক স্বারের আহ্বান জানিয়েছে। সেই প্রক্রিয়া চলছে ঢিমেতালে। মধ্যপ্রাচ্যে হালআমলে ক্রমান্বয়ে এভাবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে এসেছে। আরব দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রায় সরকারের অবহেলাকে এ জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন অনেক সংবাদভাষ্যকার। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অছিলা : মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশী নাগরিক আর না নেয়ার পেছনে মূল কারণ সেখানে এখন অনেক বেশি বাংলাদেশী রয়েছেন। শুধু সৌদি আরবেই ২৫ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই অদ শ্রমিক। তথা মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানির প্রশ্নে খোদ সরকারই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন।
এভাবে সরকারের খুঁত ধরে ধরে অর্থমন্ত্রীকে বিব্রত করেছে বাংলাদেশের সাংবাদিকগোষ্ঠী। অর্থমন্ত্রীর দুর্ভাগ্য, বিদেশের নামকরা পত্রপত্রিকাগুলোও একই পথ ধরেছে। যুদ্ধাপরাধী বিচারের এক নম্বর ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি স্কাইপ সংলাপ কেলেঙ্কারির জেরে পদত্যাগ করেছেন। হ্যাককরা ওই স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করেছে বিলেতের ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা। বাংলাদেশে ওই পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি জব্দ করা হয়েছে, বাজারে নেই। তবে ইন্টারনেটে প্রচার বন্ধ করা যায়নি। এখন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকদের সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’তেও বাংলাদেশ সরকারের নানা বিচ্যুতি বিভ্রাটের কথা লেখা হয়েছে ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকাকে উদ্ধৃত করে। ‘ফরেন পলিসি’র মোদ্দা উপপাদ্য :
আজ থেকে ৪১ বছর আগে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের সময় যে ত সৃষ্টি হয়েছিল, সেটির একটি উপশম চাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এ উপশম ঘটানোর কাজটি যতটা সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছিল, ততটা সহজ বলে এখন আর মনে হচ্ছে না।
১৯৭১ সালে এক রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার সময় সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্তদের বিচারে গঠিত হয়েছে একটি ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) নামে অভিহিত এই বিশেষ আদালত যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সৈন্যদের ও পাকিস্তানের পাবলম্বনকারী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর লোকজনের মাধ্যমে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধের বিচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অতি সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারকের পদত্যাগ, মামলার একজন গুরুত্বপূর্ণ সাীকে গুম এবং এ মামলায় রাজনৈতিক হস্তেেপর অভিযোগের পরিপ্রেেিত বিচারকার্যের নিরপেতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অনেকেই এ মামলার রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে নাকি পুরনো দলীয় সঙ্ঘাত আরো মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে, সে ব্যাপারে ভাবতে শুরু করেছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মকর্তা তেজ থাপা বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই আইসিটি ও এর কার্যপ্রণালীর ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। এ উদ্বেগের অন্যতম কারণ হচ্ছে এ মামলার প্রায় সব আসামি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট, যারা বিগত সরকারের অংশ ছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
(একাত্তরে) গুরুতর অপরাধ যারা করেছে তাদের অনেকেই হয় মারা গেছেন নয়তো পাকিস্তানে চলে গেছেন। তবে তাদের কেউ কেউ আবার বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে দশকের পর দশক কাজ করে যাচ্ছেন। আর এ বিষয়টি বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে রয়েছে। এর ফলে বর্তমানে যে বিচারকাজ চলছে, সে বিচারকে দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
গত ৪০ বছর বাংলাদেশের রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে রয়েছে। এর একটি হচ্ছে রণশীল পাকিস্তানপন্থী, যারা বাংলাদেশকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে একটি ইসলামিক দেশ হিসেবে দেখতে আগ্রহী। অন্য গোষ্ঠীটি বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপে রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে আগ্রহী।
গত ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করলে এ মামলার কার্যক্রম এক বড় ধরনের ধাক্কা খায়। বিচারপতি নিজামুল হক হচ্ছেন আইসিটির তিনজন বিচারকের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বিচারক। দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তিনি পদত্যাগ করেন। ইকোনমিস্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে ব্রাসেলসভিত্তিক একজন আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের ১৭ ঘণ্টার স্কাইপ সংলাপ এ দুইজনের মধ্যে বিনিময় করা শত শত ই-মেইল তাদের হস্তগত হয়েছে। এ স্কাইপ ডকুমেন্টে বলা হয়, নিজামুল হক তার বন্ধুকে বলেছেন, ‘সরকার একটি রায় পাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে গেছে। সরকার পাগল হয়ে গেছে। আমি বলছি, তারা সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে। তারা সোজা কথায় ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে একটা রায় পেতে চায়।’
এ থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, বিচারপতি নিজামুল হক দ্রুত রায় প্রদান কিভাবে করা যায় সে ব্যাপারে জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে সহায়তা চেয়েছেন। এ দিকে জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে যে, তিনি বিচারপতিকে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র তৈরিতেও সহায়তা করেছেন।
আসামিপরে আইনজীবী ও জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এ ঘটনা আদালতের বিশ্বাসযোগ্যতাকে মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই মামলায় নির্বাহী বিভাগের উচ্চপর্যায় থেকে হস্তপে করা হয়েছে।’ (এ ছাড়া) ….. ৫ নভেম্বর আসামিপরে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাী সুখরঞ্জন বালী নিখোঁজ হয়েছেন। এ ঘটনা এই আদালতের নিরপেতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কেননা, সুখরঞ্জন ছিলেন মূলত রাষ্ট্রপরে সাী। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপরে সাী হিসেবে আদালতে এক দিনের জন্যও উপস্থিত হননি। তার লিখিত বক্তব্যকেই আদালত স্যা হিসেবে গ্রহণ করে নিচ্ছিলেন এবং মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ জন্য সমালোচনামুখর হয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী বলতে পারেন, এ তো রাজনৈতিক বিড়ম্বনা; ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধির সড়কে’ তো আমরা বাংলাদেশকে ঠিকই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। মুশকিল হলো, ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ বলছে, সে কথাও বেঠিক। কুইক রেন্টাল দিয়ে পুকুরচুরির সুযোগ দেয়া হয়েছে, বিদ্যুৎ সঙ্কট কাটেনি; শিল্পকারখানা, আবাসন প্রকল্পে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ মিলছে না। লোডশেডিং তো লেগেই আছে। শেয়ার কেলেঙ্কারি, ডলার সঙ্কট, ব্যাংকিং সঙ্কট, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ইত্যাদি একটার পর একটা তো লেগেই ছিল। চাঁদাবাজি-ছিনতাই-গুম-খুন আর গ্রেফতার বাণিজ্যের কাছে জিম্মি থেকেছে জননিরাপত্তা আর আর্থসামাজিক উদ্যোগ। অর্থমন্ত্রীকে ‘হীরক রাজার’ প্রধানমন্ত্রী সাব্যস্ত করে প্রধান বিরোধী দলের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম বলেছেন : ‘শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, টেলিকম ও বিদ্যুৎ খাতসহ সব ত্রে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করছে বর্তমান সরকার। এই লুটেরা বাহিনীই দেশ পরিচালিত করছে। আমরা হীরক রাজার দেশে বাস করছি।’
১৮ দলীয় জোটের গণবিােভ সমাবেশে তরিকুল ঘোষণা করেছেন : ‘২৬ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজধানীতে গণসংযোগ কর্মসূচির পর ধাপে ধাপে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটানো হবে। হীরক রাজার রশি ধরে দেবো টান গদি হবে খান খান।’
অর্থমন্ত্রীর প্রগল্ভতার সম্ভবত এটাই সমুচিত জবাব।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট
অর্থমন্ত্রী মনের সুখে দেশের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠান হয়েছে। কী যেন নাম তার…। এর একটি থিঙ্ক ট্যাংক হয়েছে। তার জঘন্য ফাইন্ডিংস, তার মধ্যে কোনো স্কলার আছে কি না আমার সন্দেহ আছে। ইদানীং সব কাগজে তাদের কথা খুব বলে। তারা বলে, সরকারের গ্রোথ হবে না। এটা বলে, ওটা বলে, সব নেগেটিভ। আর নেগেটিভ হলেই… (ইঙ্গিত, সাংবাদিকেরা সমালোচনা লুফে নেয়)। এ সময় তিনি তার কথা শেষ না করে অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। তবে তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেননি।
সাংবাদিকদের লেখারও কঠোর সমালোচনা করেন অর্থমন্ত্রী। তাই তাদের সাংবাদিকতা শিাও দিতে চান তিনি। কারণ তারা তার বক্তব্য ঠিকভাবে তুলে ধরেন না। তিনি ইংরেজিতে বলেন, ‘হোয়াট আই অ্যাম গোয়িং টু ডু, আই টেল ইউ, হোয়েন আই অ্যাম কম্পারেটিভলি ফ্রি, আই উড লাইক টু টেক এ ট্রেনিং কোর্স অন ইকোনমিক রিপোর্টিং’ (আমি যখন অবসর নেব তখন কী করব, তা আমি তোমাদের বলছি। আমি অর্থনৈতিক রিপোর্টিংয়ের ওপর প্রশিণ দিতে চাই)।
সাংবাদিকদের ‘প্রশিণ’ দিয়ে বাগে আনার সরকারি বাসনার কথা অর্থমন্ত্রীর আগেই প্রকাশ করেছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বলেছিলেন, সাংবাদিকদের প্রশিণ দেয়ার জন্য একটি ইনস্টিটিউট খুলবেন। জনাব শাজাহান খান শুধু মন্ত্রী নন, চাঁদাবাজ পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্ঘশক্তিরও তিনি অধিনায়ক। তার গোসসা আরো ভয়ঙ্কর। একটা টেলিভিশন টকশো বিতর্কে তিনি তার প্রতিপরে গায়ে হাত তোলা থেকে বিরত হয়েছিলেন বটে। তবে গালাগাল দিয়ে প্রতিপরে মনে মৃত্যুভয় ঢুকিয়ে দেয়ার পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে দ্বিধা করেননি। কিছু তরুণ সাংবাদিকের দুর্ভাবনা, দুই মন্ত্রী মিলে সাংবাদিকতার ইনস্টিউট খুললে একজনের কাছে কড়া ইংরেজি শিখতে হিমশিম খেতে হবে। অন্যজন অবশ্যই পান থেকে চুন খসলে বকাবকিসহ বেত্রদণ্ডের ব্যবস্থা করবেন; সে জন্য কানে তুলো দেয়া পিঠ কুলো করা, দুটোই অভ্যেস করতে হবে।
সেই ভয়েই কি সাংবাদিকেরা অর্থমন্ত্রীকে দেশের নামে কোনো ‘সুখবর’ হলেও অর্থমন্ত্রীকে কোনো ‘ক্রেডিট’ দিতে নারাজ? ‘নতুন ধারার অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে প্রবৃদ্ধিতে’ (নিউ ওয়েভ ইকোনমিক্স গ্রোয়িং ফর গ্রোথ) এই শিরোনামে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বাংলাদেশের নামে যেসব ভালো ভালো কথা ছাপা হলো, সে জন্য আমজনতার পত্রপত্রিকাগুলোতেও আওয়ামী লীগের তারিফ হলো না। বাস্তবিকই অর্থমন্ত্রীর গুণ গাইতে কৃপণ তরুণ রিপোর্টাররা একটা জনপ্রিয় (সস্তা) দৈনিকে যেমন সংবাদভাষ্যে দ্য গার্ডিয়ানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে : পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে বাংলাদেশের অর্থনীতির আর মাত্র চার দশক সময় লাগবে এবং এ েেত্র সবচেয়ে বড় অবদান থাকছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। তাদের পাঠানো অর্থেই বাংলাদেশের অর্থনীতি জোরদার হচ্ছে। ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে অর্থনীতির চিত্র। একই সাথে বাড়ছে অবকাঠামো ও শিা খাতে বিনিয়োগ। আর এই উন্নয়নের হার মন্দায় পতিত পশ্চিমা দেশগুলোকে এক সময় ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বিশ্বের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার কর্ণধারেরা অতীতে বহুবার বাংলাদেশের সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক নিয়ে যেসব ইতিবাচক কথা বলেছেন এবং বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে সেসব মহল থেকে যা যা বলা হয়েছে তা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা আমলে নিয়ে পরবর্তী পদপে কতটা কী নিয়েছেন তা অজানা। তবে এ কথা সত্য, নানা রকম প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উন্নয়নের প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত আশা জাগানিয়া। চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্য না থাকা, দায়িত্বশীল অনেকের বিভিন্ন রকম নেতিবাচক কর্মকাণ্ড, অনেক েেত্রই অপরিকল্পিত কার্যকলাপ, দুর্নীতি, মতার অপব্যবহার, জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতার পাঠ চুকে যাওয়া ইত্যাদি আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির েেত্র বাধার প্রাচীর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এর অপসারণ করা গেলে বাংলাদেশের সম্ভাবনার সব দরজা নিঃসন্দেহে আরো অনেক প্রশস্ত হতো এবং এর সুফল ভোগ করত দেশ ও জাতি। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জাতীয় ইস্যুতেও সবার এক কাতারে না দাঁড়াতে পারার বিরূপ প্রভাব বহুমুখী হয়ে উঠেছে। আমাদের রফতানিযোগ্য পণ্য যথেষ্ট না হলেও যা আছে তাও কম নয় এবং এখনো এসবের কদর আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শিতা আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈরী মনোভাব সব সম্ভাবনার দরজায় কাঁটা দিয়ে রেখেছে। প্রবাসীরা বাংলাদেশের অনেক বড় শক্তি বটে কিন্তু অনেক েেত্রই তাদের অবমূল্যায়ন হচ্ছে। জনশক্তি রফতানি চিত্র ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে। নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধান, দ শ্রমিক তৈরি ইত্যাদি েেত্রও আশানুরূপ সফলতা মিলছে না। তবুও আমরা এগিয়ে চলেছি এটি বিস্ময়কর বৈকি। খুব সহজেই অনুমেয়, উল্লিখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে একই সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসন করে জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যমঞ্চ গড়তে পারলে আমাদের অগ্রগতির পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক নেতারা কি বিষয়গুলো আমলে নেবেন? তারা কি এসব প্রতিবেদন, মূল্যায়ন কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী পর্যালোচনা করে দেশ-জাতির জন্য সাফল্যজনক অধ্যায় রচনা করতে উদ্যোগী হবেন?
আমাদের কপালে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ হিসেবে যে তিলক লেগেছিল তা অপসারিত হয়েছে অনেক আগেই এবং আমরা এখন উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার টেকসই ও শক্তিশালী করতে অভিবাসীদের পাঠানো অর্থ ব্যাপক অবদান রাখছে। অভিবাসীদের প্রতি গুরুত্বের সাথে দৃষ্টি দেয়ার পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজার সন্ধান করা এবং রফতানিযোগ্য পণ্যের বাজার বিস্তৃত করার প্রয়াস চালাতে হবে।
পাশাপাশি খবর : মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানির হার এ বছর তলানিতে ঠেকেছে, যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতে। এ অবস্থা পরিবর্তনে সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি নয়, তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। গত এক বছরে বিভিন্ন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিভিন্ন নেতার বাংলাদেশ সফর ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সে দেশ সফরের সময় এ দেশে বিনিয়োগের বিষয়টি বারবার আলোচিত হয়েছে।
আমিরাতে বাংলাদেশীদের লেবার ভিসা বা আত্মীয় সফর ভিসা দেয়া বন্ধ। সৌদি আরবেও আকামা ভিসা দেয়া বন্ধ। বাংলাদেশী কর্মজীবীরা উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মসংস্থান হারাচ্ছে। তবে সরকার বলছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশে চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা এ অর্থের বিনিময়ে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন, চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, মংলা বন্দরের উন্নয়ন এবং ঢাকায় রেলসংযোগসহ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো স্থাপন করতে আগ্রহী। এ বছরের জুন মাসে ঢাকা সফর করেন সৌদি প্রিন্স আল-ওয়ালিদ বিন তালাল বিন আবদুল আজিজ আল সউদ। তখন বাংলাদেশ এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কক্সবাজারে সমুদ্রতীরে ট্যুরিস্ট স্পট নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে।
কুয়েতের সাথে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি একেবারেই বন্ধ রয়েছে। কুয়েত সরকার দ জনশক্তি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কোনো শ্রমিক নেবে না। এ অবস্থায় কুয়েত থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী আনার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
জনশক্তি রফতানির কথায় আমল না দিয়ে বিনিয়োগের প্রশ্নে বাহরাইন সরকার দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পরামর্শমূলক সভা নিয়মিত করার ল্েয সমঝোতা স্মারক স্বারের আহ্বান জানিয়েছে। সেই প্রক্রিয়া চলছে ঢিমেতালে। মধ্যপ্রাচ্যে হালআমলে ক্রমান্বয়ে এভাবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে এসেছে। আরব দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রায় সরকারের অবহেলাকে এ জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন অনেক সংবাদভাষ্যকার। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অছিলা : মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশী নাগরিক আর না নেয়ার পেছনে মূল কারণ সেখানে এখন অনেক বেশি বাংলাদেশী রয়েছেন। শুধু সৌদি আরবেই ২৫ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই অদ শ্রমিক। তথা মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানির প্রশ্নে খোদ সরকারই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন।
এভাবে সরকারের খুঁত ধরে ধরে অর্থমন্ত্রীকে বিব্রত করেছে বাংলাদেশের সাংবাদিকগোষ্ঠী। অর্থমন্ত্রীর দুর্ভাগ্য, বিদেশের নামকরা পত্রপত্রিকাগুলোও একই পথ ধরেছে। যুদ্ধাপরাধী বিচারের এক নম্বর ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি স্কাইপ সংলাপ কেলেঙ্কারির জেরে পদত্যাগ করেছেন। হ্যাককরা ওই স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করেছে বিলেতের ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা। বাংলাদেশে ওই পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি জব্দ করা হয়েছে, বাজারে নেই। তবে ইন্টারনেটে প্রচার বন্ধ করা যায়নি। এখন মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকদের সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’তেও বাংলাদেশ সরকারের নানা বিচ্যুতি বিভ্রাটের কথা লেখা হয়েছে ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকাকে উদ্ধৃত করে। ‘ফরেন পলিসি’র মোদ্দা উপপাদ্য :
আজ থেকে ৪১ বছর আগে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের সময় যে ত সৃষ্টি হয়েছিল, সেটির একটি উপশম চাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এ উপশম ঘটানোর কাজটি যতটা সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছিল, ততটা সহজ বলে এখন আর মনে হচ্ছে না।
১৯৭১ সালে এক রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার সময় সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্তদের বিচারে গঠিত হয়েছে একটি ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) নামে অভিহিত এই বিশেষ আদালত যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সৈন্যদের ও পাকিস্তানের পাবলম্বনকারী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর লোকজনের মাধ্যমে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধের বিচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অতি সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারকের পদত্যাগ, মামলার একজন গুরুত্বপূর্ণ সাীকে গুম এবং এ মামলায় রাজনৈতিক হস্তেেপর অভিযোগের পরিপ্রেেিত বিচারকার্যের নিরপেতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অনেকেই এ মামলার রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে নাকি পুরনো দলীয় সঙ্ঘাত আরো মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে, সে ব্যাপারে ভাবতে শুরু করেছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মকর্তা তেজ থাপা বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই আইসিটি ও এর কার্যপ্রণালীর ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। এ উদ্বেগের অন্যতম কারণ হচ্ছে এ মামলার প্রায় সব আসামি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট, যারা বিগত সরকারের অংশ ছিলেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
(একাত্তরে) গুরুতর অপরাধ যারা করেছে তাদের অনেকেই হয় মারা গেছেন নয়তো পাকিস্তানে চলে গেছেন। তবে তাদের কেউ কেউ আবার বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে দশকের পর দশক কাজ করে যাচ্ছেন। আর এ বিষয়টি বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে রয়েছে। এর ফলে বর্তমানে যে বিচারকাজ চলছে, সে বিচারকে দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
গত ৪০ বছর বাংলাদেশের রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে রয়েছে। এর একটি হচ্ছে রণশীল পাকিস্তানপন্থী, যারা বাংলাদেশকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে একটি ইসলামিক দেশ হিসেবে দেখতে আগ্রহী। অন্য গোষ্ঠীটি বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপে রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে আগ্রহী।
গত ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করলে এ মামলার কার্যক্রম এক বড় ধরনের ধাক্কা খায়। বিচারপতি নিজামুল হক হচ্ছেন আইসিটির তিনজন বিচারকের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বিচারক। দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তিনি পদত্যাগ করেন। ইকোনমিস্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বিচারপতি নিজামুল হকের সাথে ব্রাসেলসভিত্তিক একজন আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের ১৭ ঘণ্টার স্কাইপ সংলাপ এ দুইজনের মধ্যে বিনিময় করা শত শত ই-মেইল তাদের হস্তগত হয়েছে। এ স্কাইপ ডকুমেন্টে বলা হয়, নিজামুল হক তার বন্ধুকে বলেছেন, ‘সরকার একটি রায় পাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে গেছে। সরকার পাগল হয়ে গেছে। আমি বলছি, তারা সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে। তারা সোজা কথায় ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে একটা রায় পেতে চায়।’
এ থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, বিচারপতি নিজামুল হক দ্রুত রায় প্রদান কিভাবে করা যায় সে ব্যাপারে জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে সহায়তা চেয়েছেন। এ দিকে জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে যে, তিনি বিচারপতিকে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র তৈরিতেও সহায়তা করেছেন।
আসামিপরে আইনজীবী ও জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এ ঘটনা আদালতের বিশ্বাসযোগ্যতাকে মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই মামলায় নির্বাহী বিভাগের উচ্চপর্যায় থেকে হস্তপে করা হয়েছে।’ (এ ছাড়া) ….. ৫ নভেম্বর আসামিপরে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাী সুখরঞ্জন বালী নিখোঁজ হয়েছেন। এ ঘটনা এই আদালতের নিরপেতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কেননা, সুখরঞ্জন ছিলেন মূলত রাষ্ট্রপরে সাী। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপরে সাী হিসেবে আদালতে এক দিনের জন্যও উপস্থিত হননি। তার লিখিত বক্তব্যকেই আদালত স্যা হিসেবে গ্রহণ করে নিচ্ছিলেন এবং মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ জন্য সমালোচনামুখর হয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী বলতে পারেন, এ তো রাজনৈতিক বিড়ম্বনা; ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধির সড়কে’ তো আমরা বাংলাদেশকে ঠিকই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। মুশকিল হলো, ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ বলছে, সে কথাও বেঠিক। কুইক রেন্টাল দিয়ে পুকুরচুরির সুযোগ দেয়া হয়েছে, বিদ্যুৎ সঙ্কট কাটেনি; শিল্পকারখানা, আবাসন প্রকল্পে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ মিলছে না। লোডশেডিং তো লেগেই আছে। শেয়ার কেলেঙ্কারি, ডলার সঙ্কট, ব্যাংকিং সঙ্কট, হলমার্ক কেলেঙ্কারি ইত্যাদি একটার পর একটা তো লেগেই ছিল। চাঁদাবাজি-ছিনতাই-গুম-খুন আর গ্রেফতার বাণিজ্যের কাছে জিম্মি থেকেছে জননিরাপত্তা আর আর্থসামাজিক উদ্যোগ। অর্থমন্ত্রীকে ‘হীরক রাজার’ প্রধানমন্ত্রী সাব্যস্ত করে প্রধান বিরোধী দলের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম বলেছেন : ‘শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, টেলিকম ও বিদ্যুৎ খাতসহ সব ত্রে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করছে বর্তমান সরকার। এই লুটেরা বাহিনীই দেশ পরিচালিত করছে। আমরা হীরক রাজার দেশে বাস করছি।’
১৮ দলীয় জোটের গণবিােভ সমাবেশে তরিকুল ঘোষণা করেছেন : ‘২৬ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজধানীতে গণসংযোগ কর্মসূচির পর ধাপে ধাপে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটানো হবে। হীরক রাজার রশি ধরে দেবো টান গদি হবে খান খান।’
অর্থমন্ত্রীর প্রগল্ভতার সম্ভবত এটাই সমুচিত জবাব।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments