মন্তব্য প্রতিবেদন-নতুন আসবে নাকি পুরাতন… by ফরহাদ মজহার
আরেকটি ঈসায়ী সাল চলে যাচ্ছে। কাল কালের গতিতে চলে। তার চলন ও গতি মানুষের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ। মানে, আমরা চাইলেও সময় বসে থাকবে না।
হজরত ঈসার আবির্ভাবকে আরম্ভ ধরে নিয়ে তার আগে পিছের সময় গণনার যে বিধি তা মেনে বলা হয় বছর শেষ হোল, নতুন বছর আসছে।
মানুষ নশ্বর। তারও শুরু ও শেষ আছে। কিন্তু তার পরও মানুষ বিস্ময়কর। কোন
মানুষই সময়ের অধীনে সাময়িক জীব মাত্র নয়। নিজের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে
মূর্ত করার মধ্য দিয়ে মানুষ নিজের ইতিহাস নিজে তৈরি করে। ওর মধ্যে সময়কে
আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি। বহমান সময়ের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলি না।
বলি, এ হচ্ছে ইতিহাস, সময় থেকে ইতিহাস আলাদা পদার্থ। আমরা বুঝতে পারি,
সময় আর ইতিহাস সমার্থক নয়। কিন্তু তারপরও সময় যায়, পুরানা বছর শেষ হয়,
নতুন বছর আসে। আমরা দাবি করি নতুন বছর এসেছে।
আসলে কি তাই? সময় গেলো বলেই কি বছর নতুন হয়? হয়তো যা আসবে তা নতুন নয়, পুরানা জিনিস। শেখ হাসিনার শাসনের জায়গায় খালেদা জিয়ার শাসন। আওয়ামী-বাকশালী দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের জায়গায় জাতীয়তাবাদী দুর্বৃত্ত ও লুটেরা। সঙ্গে ইসলামপন্থিদের না থাকবার কোন কারণ দেখি না। দুর্নীতি ও লুটপাট আগের মতোই চলবে, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না, মানুষ গুম হয়ে যাওয়াও কমবে না। যারা ক্ষমতায় আসবে প্রতিপক্ষের ওপর তাদের প্রতিশোধ নেবার ভাল পদ্ধতি হচ্ছে মানুষ গুম করে ফেলা। এই আমলে শেখ হাসিনার শাসনের অভিজ্ঞতা থেকে আগামি দিনের শাসকরা এই বিশেষ শিক্ষাটা ভাল ভাবেই রপ্ত করে নিতে সক্ষম হয়েছে। নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আর ‘গুম’ করে ফেলার মধ্যে তফাত আছে। গুম হচ্ছে সরকারের উক্ত বা অনুক্ত নির্দেশে সরকারী বাহিনী কাউকে গ্রেফতার বা তুলে নিয়ে যাবার পরে যার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না এবং সরকার দাবি করে এই ঘটনার তারা কিছুই জানে না। আওয়ামী বিচার ব্যবস্থার বদলে আমরা পাব জাতীয়তাবাদী বিচার ব্যবস্থা। বিচারকদের মধ্যে সেইসব (রাজ) কর্মচারীদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না, যারা বেগম খালেদা জিয়াকে সন্তুষ্ট রাখতে মোটেও কার্পণ্য করবে না। রিমান্ডে নিয়ে অভিযুক্তদের নির্যাতন করে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় এখনকার মতো চলতে থাকবে। আগামি বছর কেমন যাবে যদি ভাবি তবে খুব একটা ভরসার কথা ভাবতে পারি না।
সত্য যে আগাম আন্দাজ করা কঠিন কিভাবে শেখ হাসিনা বিডিআর হত্যাযজ্ঞের দায় এড়াবেন? হেফাজতে থাকা অবস্থায় বিদ্রোহী জওয়ানদের মৃত্যুর ব্যাখ্যা কিভাবে দেবেন? তাদের যেভাবে গণকায়দায় বিচার করা হয়েছে তা নিয়ে দেশী বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা থেকে আপত্তি উঠেছে। কিন্তু পুরা ঘটনার মধ্য দিয়ে সাধারণ জওয়ান ও সেনা অফিসারদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে তার সুদূরপ্রসারী কুফল বইতে হবে সেনাবাহিনীকেই। এ দায়িত্বও এই সরকারকেই বহন করতে হবে। যেমন বহন করতে হবে বিডিআরকে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী হিসাবে কার্যত বিলুপ্ত করে দিয়ে ‘গার্ড’ বা পাহারাদার বাহিনীর সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও।
বলা মুশকিল যেসব মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর ভাষা জ্ঞান ও প্রতিভা থেকে সবক নিয়ে অভদ্র ও অরাজনৈতিক ভাষায় বিরোধী দলের মুন্ডপাত করেছেন তাদের কি হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহসচিব মির্জা আলমগীর যদি ময়লা ট্রাক পোড়াবার মামলায় হুকুমের আসামি হয়ে থাকেন তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহিউদ্দীন খান বিশ্বজিৎ হত্যার ক্ষেত্রে হুকুমের আসামি হবেন না কেন? মির্জা আলমগীরের ক্ষেত্রে তা প্রমাণ করা অসম্ভব। কারণ তিনি তার কর্মীদের কোথাও জ্বালাও পোড়াওর নির্দেশ দিয়েছেন প্রমাণ নাই। তার পরও যদি তিনি আওয়ামী আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন তবে ময়লা ট্রাক জ্বালানোর জন্য তাকে কি শাস্তি দেওয়া হয় দেখব বলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর অপরাধ প্রমাণ করা সহজ। বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিরোধ করতে তিনি ছাত্রলীগের কর্মীদের যে নির্দেশ দিয়েছেন তারই বাস্তবায়ন কুপিয়ে ও রডের আঘাতে বিশ্বজিৎ হত্যা।
এই সব কথা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে চালু রয়েছে সেই জায়গা থেকে বলা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের গুণগত বিকাশ ঘটবার কোন লক্ষণ দেখছি না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের সংস্কৃতি ইত্যাদি বিবেচনা করে অনেকে আন্দাজ করছেন আগামি দিনে আরো সংঘর্ষ ঘটবার ও রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনাই বেশি। গত চার বছরে ক্ষমতাসীন মহাজোট তারই বিষ বপন করেছে। তার বিষাক্ত বাষ্পের উদ্গীরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সে যাই হোক, নতুন ঈসায়ী বছরে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নতুন কিছুর সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। এটা হতাশার কথা নয়, বাস্তবতার কথা। পুরাতনই ফিরে আসবে। সংঘর্ষ, সংঘাত, দাঙ্গাহাঙ্গামা ও রক্তপাতই শুধু বাড়তি উপাদান হিশাবে যুক্ত হতে পারে, তবে তা কোন ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিণতির দিকে যাবে না। তবে একটু ব্যাখার প্রয়োজন আছে।
সংঘর্ষ ও সংঘাত অনিবার্য যারা মনে করছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ধারনা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই সংঘর্ষ ও সন্ত্রাস দেখা দেবে, শেখ হাসিনা এই দাবি মানবেন না, বিরোধী দল এই দাবিতেই মাঠে থাকবে এবং যার ফল হবে অনিবার্য সংঘাত। আমি তা মনে করি না।
আমি মনে করি না বিরোধী দলের সঙ্গে কোন একটা আপোসে আসা ছাড়া ক্ষমতাসীনদের সামনে আর কোন পথ খোলা আছে। বিরোধী দলের পক্ষে বিপুল জনমত তৈরী হয়েছে বলে নয়। ক্ষমতাসীনদের দুঃশাসন থেকে রক্ষা পাবার জন্য জনগণের বড় একটা অংশ বিরোধী দলের প্রতি হয়ত ঝুঁকে যাচ্ছে, অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বিএনপির সঙ্গে একটা আপোসরফার প্রধান কারণ আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীদের একটা বড় অংশ গত চার বছরের কুশাসনের দায় শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের চামড়া রক্ষা করতে চান। তারা নির্বাচন না দেবার পরিণতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিছুদিন দেখেছি আওয়ামীপন্থি গণমাধ্যমগুলো প্রাণপণ বলছে যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করলে অসুবিধা কি? সেই নির্বাচনকে ‘বৈধ’বলে প্রমাণ করাও কঠিন নয়। যদি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে তার অধীনে নির্বাচন করতে সক্ষম হন তবে অবশ্যই তা ‘বৈধ’ হবে। অন্তত আইনের দিক থেকে – বিশেষত আদালত যে রায় দিয়েছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে অবৈধ বলা যাবে না।
কিন্তু আমরা ‘আইন’ নিয়ে কথা বলছি না, রাজনীতি নিয়ে কথা বলছি। সেই জন্য যারা আইন আর রাজনীতির ফারাক বোঝেন, তারা বলছেন এই ধরনের নির্বাচন তো হতেই পারে তবে তা রাজনৈতিক ভাবে ‘গ্রহণযোগ্য’ হবে না। আইনের চোখে ‘বৈধ’ হওয়া আর রাজনৈতিক ভাবে ‘গ্রহণযোগ্য’ হওয়ার মধ্যে ফারাক বিস্তর। যদি রাজনৈতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে তা রাজনৈতিক অস্থিতশীলতা বাড়াবে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে আগামি বছরগুলোতে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কোন গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। নতুন বছর গুলোতে ‘নতুন’ কিছু আশু ঘটে যাবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু রাজনীতির বিশ্লেষণ গণকবিদ্যার মধ্যে পড়ে না। তার মধ্যেও হেরফের ঘটতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই অনেকে ‘তৃতীয় শক্তি’র কথা বলছেন। তৃতীয় শক্তি নামক বিকট ও রহস্যজনক কিছু নাই। আসলে বলা হয় রাজনীতির প্রধান দুই পরে বাইরে নতুন কোন রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে ক্ষমতাসীন হওয়া সম্ভব কিনা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এর দুটো মানে আছে। এক : সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল। দুই : গণ-অভ্যুত্থান। দুটোই অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখল। ক্ষমতাসীন সরকার সংবিধানের পরিবর্তন ঘটিয়ে অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখল নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু অভ্যুত্থান সংবিধান মেনে চলে না। শেখ হাসিনার নিষেধ মানবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। অভ্যুত্থানের শক্তির উৎস সশস্ত্র ক্ষমতা অথবা জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প। সশস্ত্র ক্ষমতার চর্চা মানেই অগণতান্ত্রিক অর্থাৎ তা জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প ধারণ করতে অক্ষম- রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিম্বা আইনশাস্ত্র কোনটিই সেকথা বলে না। সাম্প্রতিক দর্শন এই দিক থেকে এক কাঠি চড়া। বলা হয়, বলপ্রয়োগই বরং সংবিধান বা আইনের উৎস। সশস্ত্র ক্ষমতার বৈধতা নির্বাচন দ্বারা ঠিক হয় না। এর বৈধতা প্রথমত তৈরী হয় জালিম সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম ধারণের মাত্রা দিয়ে, দ্বিতীয়ত যারা অভ্যুত্থানের কারিগর জনগণের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি ও বর্তমান ব্যবস্থা উৎখাত করে নতুন কি ব্যবস্থা তারা কায়েম করতে চায় তার প্রস্তাবনা দাখিল করে, তৃতীয়ত যারা এই অভ্যুত্থানে জড়িত তাদের সামাজিক অবস্থান দিয়ে।
সারকথা হচ্ছে, নির্বাচনই গণতান্ত্রিক বৈধতা নির্মাণের একমাত্র পথ নয়। যে কোন অভ্যুত্থানের পেছনে জনগণের সমর্থন রয়েছে কিনা কিম্বা তা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করতে সক্ষম কিনা কেবল তার দ্বারাই তার গণতান্ত্রিক চরিত্র নির্ভর করে। বাংলাদেশের সংবিধানের এখন যে অবস্থা তাকে কোন অবস্থাতেই গণতন্ত্র বলা যায় না। যদি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিবেচনার মধ্যে রাখি এবং তার সঙ্গে স্থানীর সরকার ব্যবস্থার অনুপস্থিতি যোগ করি তাহলে বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আপাদমস্তক এক ব্যক্তির একনায়কী শাসন ছাড়া আর কিছুই নয়। যাকে ভদ্র ভাষায় ‘সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র’ বলা হয়। এই ধরনের সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎখাত ও নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠন ছাড়া বাংলাদেশে আদৌ গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব কিনা সেটা ক্রমশ কঠিন প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। ফলে অভ্যুত্থান সেটা সেনাবাহিনীর বা জনগণের, উভয়ের পারস্পরিক সমর্থনে ঘটবার একটা বাস্তব পরিস্থিতি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অবশ্যই বিরাজ করে। একে নীতিকথা দিয়ে কিম্বা গণতন্ত্রের জন্য মায়া কান্না দিয়ে ঠেকানো সম্ভব কিনা কে জানে।
জনগণের দিক থেকে সেনা অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করার অনেক যুক্তি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যারা সেনা অভ্যুত্থানের বিরোধী তারা এর বিরোধিতা করতে গিয়ে মূলত অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোরই পক্ষাবলন্বন করে। সেটা মূলত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দলীয় প্রধানের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে দাঁড়ানো। এই প্রতারণায় জনগণের বিভ্রান্ত হবার কোন কারণ নাই। একই সঙ্গে তা হয়ে ওঠে সীমাহীন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনার পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখা। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সেই পরিস্থিতি তৈরী করে দেয় তাহলে তাকে গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের মামলা আকারে দেখলে চলবে না। একে দেখতে হবে দুই ধরনের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের ভাল মন্দ বিচার হিশাবে। দু’টির কোনটিই গণতন্ত্র নয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ইস্যু সেনাবাহিনী বনাম রাজনৈতিক দল নয়, বরং সব কিসিমের একনায়কতন্ত্র বনাম জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে গণতন্ত্র গঠন। অর্থাৎ রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গড়ে তোলা।
‘মাইনাস টু’ থিওরির প্রবক্তারা গেল বারে ধরা খেয়ে গিয়েছিল ভিন্ন কারণে। এক-এগারোর ঘটনা ঘটাবার সময় তারা দুই পক্ষকে মাইনাস করবার কথা মুখে বলেছে, কিন্তু কার্যত একটি পক্ষকে মাইনাস করে আরেক পকে ক্ষমতায় বসিয়েছে তারা। রাজনীতির দুর্বৃত্তপনাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে তারা বাংলাদেশকেই রাজনীতিশূন্য করতে চেষ্টা করেছে। তারা আঁতাত করেছে গণবিরোধী সুশীল সমাজ ও পরাশক্তির সঙ্গে। জগণের সঙ্গে নয়। এরপর আমরা নির্বাচন দেখেছি। বিডিআর বিদ্রোহ দেখেছি, দেখেছি কিভাবে সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করা হয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীদের কিভাবে পাহারাদার বানানো হয়েছে। দেখেছি বাংলাদেশকে কিভাবে দিল্লীর দাসে পরিণত করা হয়েছে।
এক-এগারোর সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত ধরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তাকে নির্বাচন দিয়ে সংশোধন করা যাবে না। তিনি বিচার ব্যবস্থাকে যেখানে নিয়ে গেছেন সেই কলুষ থেকে মুক্ত হতে হলে নির্বাচনে কাজ হবে না। বিচার ব্যবস্থাকে নতুন ভাবে সাজাতে হবে। এই কঠিন কাজ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণ এখনও সচেতন নয়।
আমাদের আরো কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। আরো অনেক ঈসায়ী সাল আমাদের পার করে দিতে হবে। জনগণকে ভাবতে হবে গত নির্বাচনে ভোট দিয়ে তারা কি এনেছে। আগামি নির্বাচনে তারা আবার কি আনে। সমাজে গণতন্ত্র সম্পর্কে যে অসচেতনতা, মৌলিক মানবিক ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মানুষের আবেগ ও ভালবাসা ব্যবহার করবার দীর্ঘ দিনের চর্চাই শেখ হাসিনার সরকারের চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চরিত্রের, তার রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার কিম্বা তার মধুর ভাষা চর্চার মূল্যায়ন করলে কোন লাভ হবে না। পুরা সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সামগ্রিক বাস্তবতা এবং তার নানামুখি অভিপ্রকাশের মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক অশিক্ষা, অসচেতনতা ও দৈন্যতাই চতুর্দিকে প্রকাশিত হচ্ছে।
নতুন বছরে দরকার নিজেদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করা। সামরিক শাসন আর সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের মধ্যে যে বিশেষ ফারাক নাই, এতোটুকু বুঝলে অন্তত এক কদম আমরা এগিয়ে যাব।
৩১ ডিসেম্বর ২০১২। ১৭ পৌষ ১৪১৯। শ্যামলী।
আসলে কি তাই? সময় গেলো বলেই কি বছর নতুন হয়? হয়তো যা আসবে তা নতুন নয়, পুরানা জিনিস। শেখ হাসিনার শাসনের জায়গায় খালেদা জিয়ার শাসন। আওয়ামী-বাকশালী দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের জায়গায় জাতীয়তাবাদী দুর্বৃত্ত ও লুটেরা। সঙ্গে ইসলামপন্থিদের না থাকবার কোন কারণ দেখি না। দুর্নীতি ও লুটপাট আগের মতোই চলবে, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না, মানুষ গুম হয়ে যাওয়াও কমবে না। যারা ক্ষমতায় আসবে প্রতিপক্ষের ওপর তাদের প্রতিশোধ নেবার ভাল পদ্ধতি হচ্ছে মানুষ গুম করে ফেলা। এই আমলে শেখ হাসিনার শাসনের অভিজ্ঞতা থেকে আগামি দিনের শাসকরা এই বিশেষ শিক্ষাটা ভাল ভাবেই রপ্ত করে নিতে সক্ষম হয়েছে। নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আর ‘গুম’ করে ফেলার মধ্যে তফাত আছে। গুম হচ্ছে সরকারের উক্ত বা অনুক্ত নির্দেশে সরকারী বাহিনী কাউকে গ্রেফতার বা তুলে নিয়ে যাবার পরে যার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না এবং সরকার দাবি করে এই ঘটনার তারা কিছুই জানে না। আওয়ামী বিচার ব্যবস্থার বদলে আমরা পাব জাতীয়তাবাদী বিচার ব্যবস্থা। বিচারকদের মধ্যে সেইসব (রাজ) কর্মচারীদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না, যারা বেগম খালেদা জিয়াকে সন্তুষ্ট রাখতে মোটেও কার্পণ্য করবে না। রিমান্ডে নিয়ে অভিযুক্তদের নির্যাতন করে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় এখনকার মতো চলতে থাকবে। আগামি বছর কেমন যাবে যদি ভাবি তবে খুব একটা ভরসার কথা ভাবতে পারি না।
সত্য যে আগাম আন্দাজ করা কঠিন কিভাবে শেখ হাসিনা বিডিআর হত্যাযজ্ঞের দায় এড়াবেন? হেফাজতে থাকা অবস্থায় বিদ্রোহী জওয়ানদের মৃত্যুর ব্যাখ্যা কিভাবে দেবেন? তাদের যেভাবে গণকায়দায় বিচার করা হয়েছে তা নিয়ে দেশী বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা থেকে আপত্তি উঠেছে। কিন্তু পুরা ঘটনার মধ্য দিয়ে সাধারণ জওয়ান ও সেনা অফিসারদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে তার সুদূরপ্রসারী কুফল বইতে হবে সেনাবাহিনীকেই। এ দায়িত্বও এই সরকারকেই বহন করতে হবে। যেমন বহন করতে হবে বিডিআরকে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী হিসাবে কার্যত বিলুপ্ত করে দিয়ে ‘গার্ড’ বা পাহারাদার বাহিনীর সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও।
বলা মুশকিল যেসব মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর ভাষা জ্ঞান ও প্রতিভা থেকে সবক নিয়ে অভদ্র ও অরাজনৈতিক ভাষায় বিরোধী দলের মুন্ডপাত করেছেন তাদের কি হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহসচিব মির্জা আলমগীর যদি ময়লা ট্রাক পোড়াবার মামলায় হুকুমের আসামি হয়ে থাকেন তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহিউদ্দীন খান বিশ্বজিৎ হত্যার ক্ষেত্রে হুকুমের আসামি হবেন না কেন? মির্জা আলমগীরের ক্ষেত্রে তা প্রমাণ করা অসম্ভব। কারণ তিনি তার কর্মীদের কোথাও জ্বালাও পোড়াওর নির্দেশ দিয়েছেন প্রমাণ নাই। তার পরও যদি তিনি আওয়ামী আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন তবে ময়লা ট্রাক জ্বালানোর জন্য তাকে কি শাস্তি দেওয়া হয় দেখব বলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর অপরাধ প্রমাণ করা সহজ। বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিরোধ করতে তিনি ছাত্রলীগের কর্মীদের যে নির্দেশ দিয়েছেন তারই বাস্তবায়ন কুপিয়ে ও রডের আঘাতে বিশ্বজিৎ হত্যা।
এই সব কথা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে চালু রয়েছে সেই জায়গা থেকে বলা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের গুণগত বিকাশ ঘটবার কোন লক্ষণ দেখছি না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের সংস্কৃতি ইত্যাদি বিবেচনা করে অনেকে আন্দাজ করছেন আগামি দিনে আরো সংঘর্ষ ঘটবার ও রক্তক্ষয়ের সম্ভাবনাই বেশি। গত চার বছরে ক্ষমতাসীন মহাজোট তারই বিষ বপন করেছে। তার বিষাক্ত বাষ্পের উদ্গীরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সে যাই হোক, নতুন ঈসায়ী বছরে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নতুন কিছুর সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। এটা হতাশার কথা নয়, বাস্তবতার কথা। পুরাতনই ফিরে আসবে। সংঘর্ষ, সংঘাত, দাঙ্গাহাঙ্গামা ও রক্তপাতই শুধু বাড়তি উপাদান হিশাবে যুক্ত হতে পারে, তবে তা কোন ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিণতির দিকে যাবে না। তবে একটু ব্যাখার প্রয়োজন আছে।
সংঘর্ষ ও সংঘাত অনিবার্য যারা মনে করছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ধারনা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই সংঘর্ষ ও সন্ত্রাস দেখা দেবে, শেখ হাসিনা এই দাবি মানবেন না, বিরোধী দল এই দাবিতেই মাঠে থাকবে এবং যার ফল হবে অনিবার্য সংঘাত। আমি তা মনে করি না।
আমি মনে করি না বিরোধী দলের সঙ্গে কোন একটা আপোসে আসা ছাড়া ক্ষমতাসীনদের সামনে আর কোন পথ খোলা আছে। বিরোধী দলের পক্ষে বিপুল জনমত তৈরী হয়েছে বলে নয়। ক্ষমতাসীনদের দুঃশাসন থেকে রক্ষা পাবার জন্য জনগণের বড় একটা অংশ বিরোধী দলের প্রতি হয়ত ঝুঁকে যাচ্ছে, অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বিএনপির সঙ্গে একটা আপোসরফার প্রধান কারণ আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীদের একটা বড় অংশ গত চার বছরের কুশাসনের দায় শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের চামড়া রক্ষা করতে চান। তারা নির্বাচন না দেবার পরিণতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিছুদিন দেখেছি আওয়ামীপন্থি গণমাধ্যমগুলো প্রাণপণ বলছে যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করলে অসুবিধা কি? সেই নির্বাচনকে ‘বৈধ’বলে প্রমাণ করাও কঠিন নয়। যদি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে তার অধীনে নির্বাচন করতে সক্ষম হন তবে অবশ্যই তা ‘বৈধ’ হবে। অন্তত আইনের দিক থেকে – বিশেষত আদালত যে রায় দিয়েছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে অবৈধ বলা যাবে না।
কিন্তু আমরা ‘আইন’ নিয়ে কথা বলছি না, রাজনীতি নিয়ে কথা বলছি। সেই জন্য যারা আইন আর রাজনীতির ফারাক বোঝেন, তারা বলছেন এই ধরনের নির্বাচন তো হতেই পারে তবে তা রাজনৈতিক ভাবে ‘গ্রহণযোগ্য’ হবে না। আইনের চোখে ‘বৈধ’ হওয়া আর রাজনৈতিক ভাবে ‘গ্রহণযোগ্য’ হওয়ার মধ্যে ফারাক বিস্তর। যদি রাজনৈতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে তা রাজনৈতিক অস্থিতশীলতা বাড়াবে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে আগামি বছরগুলোতে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কোন গুণগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। নতুন বছর গুলোতে ‘নতুন’ কিছু আশু ঘটে যাবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু রাজনীতির বিশ্লেষণ গণকবিদ্যার মধ্যে পড়ে না। তার মধ্যেও হেরফের ঘটতে পারে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই অনেকে ‘তৃতীয় শক্তি’র কথা বলছেন। তৃতীয় শক্তি নামক বিকট ও রহস্যজনক কিছু নাই। আসলে বলা হয় রাজনীতির প্রধান দুই পরে বাইরে নতুন কোন রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে ক্ষমতাসীন হওয়া সম্ভব কিনা। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এর দুটো মানে আছে। এক : সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল। দুই : গণ-অভ্যুত্থান। দুটোই অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখল। ক্ষমতাসীন সরকার সংবিধানের পরিবর্তন ঘটিয়ে অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখল নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু অভ্যুত্থান সংবিধান মেনে চলে না। শেখ হাসিনার নিষেধ মানবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। অভ্যুত্থানের শক্তির উৎস সশস্ত্র ক্ষমতা অথবা জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প। সশস্ত্র ক্ষমতার চর্চা মানেই অগণতান্ত্রিক অর্থাৎ তা জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প ধারণ করতে অক্ষম- রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিম্বা আইনশাস্ত্র কোনটিই সেকথা বলে না। সাম্প্রতিক দর্শন এই দিক থেকে এক কাঠি চড়া। বলা হয়, বলপ্রয়োগই বরং সংবিধান বা আইনের উৎস। সশস্ত্র ক্ষমতার বৈধতা নির্বাচন দ্বারা ঠিক হয় না। এর বৈধতা প্রথমত তৈরী হয় জালিম সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম ধারণের মাত্রা দিয়ে, দ্বিতীয়ত যারা অভ্যুত্থানের কারিগর জনগণের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি ও বর্তমান ব্যবস্থা উৎখাত করে নতুন কি ব্যবস্থা তারা কায়েম করতে চায় তার প্রস্তাবনা দাখিল করে, তৃতীয়ত যারা এই অভ্যুত্থানে জড়িত তাদের সামাজিক অবস্থান দিয়ে।
সারকথা হচ্ছে, নির্বাচনই গণতান্ত্রিক বৈধতা নির্মাণের একমাত্র পথ নয়। যে কোন অভ্যুত্থানের পেছনে জনগণের সমর্থন রয়েছে কিনা কিম্বা তা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করতে সক্ষম কিনা কেবল তার দ্বারাই তার গণতান্ত্রিক চরিত্র নির্ভর করে। বাংলাদেশের সংবিধানের এখন যে অবস্থা তাকে কোন অবস্থাতেই গণতন্ত্র বলা যায় না। যদি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিবেচনার মধ্যে রাখি এবং তার সঙ্গে স্থানীর সরকার ব্যবস্থার অনুপস্থিতি যোগ করি তাহলে বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আপাদমস্তক এক ব্যক্তির একনায়কী শাসন ছাড়া আর কিছুই নয়। যাকে ভদ্র ভাষায় ‘সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র’ বলা হয়। এই ধরনের সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎখাত ও নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠন ছাড়া বাংলাদেশে আদৌ গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব কিনা সেটা ক্রমশ কঠিন প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। ফলে অভ্যুত্থান সেটা সেনাবাহিনীর বা জনগণের, উভয়ের পারস্পরিক সমর্থনে ঘটবার একটা বাস্তব পরিস্থিতি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অবশ্যই বিরাজ করে। একে নীতিকথা দিয়ে কিম্বা গণতন্ত্রের জন্য মায়া কান্না দিয়ে ঠেকানো সম্ভব কিনা কে জানে।
জনগণের দিক থেকে সেনা অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করার অনেক যুক্তি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যারা সেনা অভ্যুত্থানের বিরোধী তারা এর বিরোধিতা করতে গিয়ে মূলত অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোরই পক্ষাবলন্বন করে। সেটা মূলত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দলীয় প্রধানের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে দাঁড়ানো। এই প্রতারণায় জনগণের বিভ্রান্ত হবার কোন কারণ নাই। একই সঙ্গে তা হয়ে ওঠে সীমাহীন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনার পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখা। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সেই পরিস্থিতি তৈরী করে দেয় তাহলে তাকে গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের মামলা আকারে দেখলে চলবে না। একে দেখতে হবে দুই ধরনের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের ভাল মন্দ বিচার হিশাবে। দু’টির কোনটিই গণতন্ত্র নয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ইস্যু সেনাবাহিনী বনাম রাজনৈতিক দল নয়, বরং সব কিসিমের একনায়কতন্ত্র বনাম জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করে গণতন্ত্র গঠন। অর্থাৎ রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গড়ে তোলা।
‘মাইনাস টু’ থিওরির প্রবক্তারা গেল বারে ধরা খেয়ে গিয়েছিল ভিন্ন কারণে। এক-এগারোর ঘটনা ঘটাবার সময় তারা দুই পক্ষকে মাইনাস করবার কথা মুখে বলেছে, কিন্তু কার্যত একটি পক্ষকে মাইনাস করে আরেক পকে ক্ষমতায় বসিয়েছে তারা। রাজনীতির দুর্বৃত্তপনাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে তারা বাংলাদেশকেই রাজনীতিশূন্য করতে চেষ্টা করেছে। তারা আঁতাত করেছে গণবিরোধী সুশীল সমাজ ও পরাশক্তির সঙ্গে। জগণের সঙ্গে নয়। এরপর আমরা নির্বাচন দেখেছি। বিডিআর বিদ্রোহ দেখেছি, দেখেছি কিভাবে সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করা হয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীদের কিভাবে পাহারাদার বানানো হয়েছে। দেখেছি বাংলাদেশকে কিভাবে দিল্লীর দাসে পরিণত করা হয়েছে।
এক-এগারোর সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত ধরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তাকে নির্বাচন দিয়ে সংশোধন করা যাবে না। তিনি বিচার ব্যবস্থাকে যেখানে নিয়ে গেছেন সেই কলুষ থেকে মুক্ত হতে হলে নির্বাচনে কাজ হবে না। বিচার ব্যবস্থাকে নতুন ভাবে সাজাতে হবে। এই কঠিন কাজ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণ এখনও সচেতন নয়।
আমাদের আরো কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। আরো অনেক ঈসায়ী সাল আমাদের পার করে দিতে হবে। জনগণকে ভাবতে হবে গত নির্বাচনে ভোট দিয়ে তারা কি এনেছে। আগামি নির্বাচনে তারা আবার কি আনে। সমাজে গণতন্ত্র সম্পর্কে যে অসচেতনতা, মৌলিক মানবিক ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মানুষের আবেগ ও ভালবাসা ব্যবহার করবার দীর্ঘ দিনের চর্চাই শেখ হাসিনার সরকারের চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চরিত্রের, তার রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার কিম্বা তার মধুর ভাষা চর্চার মূল্যায়ন করলে কোন লাভ হবে না। পুরা সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সামগ্রিক বাস্তবতা এবং তার নানামুখি অভিপ্রকাশের মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক অশিক্ষা, অসচেতনতা ও দৈন্যতাই চতুর্দিকে প্রকাশিত হচ্ছে।
নতুন বছরে দরকার নিজেদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করা। সামরিক শাসন আর সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রের মধ্যে যে বিশেষ ফারাক নাই, এতোটুকু বুঝলে অন্তত এক কদম আমরা এগিয়ে যাব।
৩১ ডিসেম্বর ২০১২। ১৭ পৌষ ১৪১৯। শ্যামলী।
No comments