আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস- সারা বিশ্বে একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিন by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী
১৯৯৯ সালের ১৭ই নবেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলন বাংলাদেশের প্রস্তাবমতো একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসাবে ঘোষণা দেয়।
প্রচলিত ঐতিহ্য অনুযায়ী ইউনেস্কো সচিবালয় ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্যারিসের সদর দফতরে এক চিত্তাকর্ষক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করে। কয়েকটি বহুভাষী ইউরোপীয় দেশ বাধা দেয়। তদানীন্তন উপ-মহাপরিচালক কলিন পাওয়ারের সাহায্যে তাদের নিবৃত্ত করলাম। ইউনেস্কো মহাসচিব মাৎসুরা সদস্যদের নিজ নিজ মাতৃভাষা রার অঙ্গীকারের অংশ হিসাবে প্রতিবছর যথাযথভাবে দিবসটি পালনেরও আহ্বান জানান। দিবসটি চালু হওয়া উপল েআমরা এক সঙ্গীতানুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছিলাম। এতে পার্থ প্রতীম মজুমদারের নেতৃত্বে স্থানীয় বাঙালী শিল্পীরা "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি" গানটি পরিবেশন করেন। সে এক স্মরণীয় ঐতিহাসিক মুহূর্ত।মূল প্রসত্মাবক হিসাবে আমাদের সামনে কি করণীয় আছে? বিশেষজ্ঞ ও ভাষাবিদরা বিভিন্ন ভাষার দ্রম্নত বিলুপ্তিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তারা স্বীকার করেন এই বিলুপ্তি এক চলমান প্রক্রিয়া এবং মানব সভ্যতার সূচনাপর্ব থেকে শুরম্ন করে এ পর্যনত্ম কমপ ে৩০ হাজার ভাষা (কেউ কেউ বলেন ৫ ল) বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে যে গতিতে ভাষার অপমৃতু্য ঘটছে সেটাই হলো উদ্বেগজনক ব্যাপারে। তাদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে বর্তমানের ৯৫ ভাগ ভাষাই চলতি শতাব্দীতে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিশ্বায়নের এই যুগে সব মাতৃভাষা রা করা প্রয়োজন। কারণ ভাষাই হলো আপন সত্তাকে দৃঢ়রূপে প্রকাশ করার সবচেয়ে উপযুক্ত উপায়গুলোর মধ্যে একটি। ভাষা একবার হারিয়ে গেলে আমরা মানবজাতির অভিন্ন ঐতিহ্যের একটি অংশকে হারিয়ে ফেলি। কাজেই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ভাষাগত বহুত্ববাদের ভিত্তিতেই শুধু সত্যিকার বিশ্বায়ন ঘটতে পারে।
বিশ্বজনীন এই ঘটনাটি আমাদের দেশের জন্যও সমান গুরম্নত্বপূর্ণ। আমাদের অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা, বাংলা_যা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। কিনত্মু আমাদের ভুললে চলবে না যে, বাংলাদেশে বেশ কিছু সুপরিচিত উপজাতীয় জাতিসত্তার ভাষা আছে। এ দেশের মোটামুটিভাবে ত্রিশটি সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও উপজাতীয় গোষ্ঠী আছে এবং প্রায় ২০ লাখ লোক বিভিন্ন জাতিসত্তাগত ও উপজাতীয় ভাষা ও বাচনে (উরধষবপঃ) কথা বলে। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই ১৩টি উপজাতি আছে। প্রতিটি উপজাতির নিজস্ব ভাষা বা স্বতন্ত্র ডায়ালেক্ট বা বাচন আছে। সর্ববৃহৎ গোষ্ঠী চাকমাদের নিজস্ব ভাষা ও লিপি (স্ক্রিপ্ট) আছে। মারমা, টিপরা, রিয়াং ও মুরংরা স্বতন্ত্র ডায়ালেক্ট বা বাচন ব্যবহার করে। একইভাবে অন্যান্য জেলায় বসবাসরত মনিপুরী খাসিয়ারা আছে। এগুলোর মধ্যে কোন কোন বাচন একেবারেই স্বতন্ত্র বা অন্যান্য।
এই সব আদিবাসীর ভাষা ও সংস্কৃতিকে সুরা করা প্রয়োজন। বাড়াতে হবে এর চর্চা। একে অপরের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় বন্ধন নিঃসন্দেহে আরো সুদৃঢ় করবে। স্কুলের পাঠ্য বইগুলোতে ভাষাগত পার্থক্যকে বিশেষভাবে তুলে ধরা যেতে পারে। উপজাতীয় ছাত্রদের যখন যেখানে সম্ভব তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। একইভাবে আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে উপজাতীয় ভাষায় আরো বেশি অনুষ্ঠান প্রচার এবং উপজাতীয় সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে অধিকতর সচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে।
আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনায় আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারের অংশ হিসাবে বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় একটি মাতৃভাষা অধ্যয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধানত্ম নিয়েছিল। ২০০১ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব কোফি আনানের ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রসত্মর স্থাপন করেন। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বিএনপি নেতৃত্বে জোট সরকার কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ ফেলে রাখে। আওয়ামী লীগ সরকার ৮ বছর পর মতায় এসে যথাযথ পদপে নিয়েছে। প্রকল্পটি যথাশীঘ্র সম্পন্ন করা এবং অনত্মতপ েআমাদের নিজস্ব মাতৃভাষাগুলো রার উদ্যোগ নেয়া আশু প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা দেশের বিশেষ করে ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় ও রিসার্চ সংস্থার সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
আজকের বিশ্বায়নের যুগে যেখানে কম্পিউটার অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সেখানে বাংলাভাষা আজো কম্পিউটার জগতে স্থান করে নিতে পারেনি। পৃথিবীর সেরা কম্পিউটার সফটওয়্যার বিক্রেতারা ২৫০টি ভাষা তাদের কম্পিউটারের প্রচলন জগতে লিপিবদ্ধ করেছেন। কিনত্মু বাংলা তার মধ্যে অনত্মভর্ুক্ত নয়। আরেকটি দুঃখের বিষয় আমাদের শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রভাষা বাংলা, কম্পিউটার ইউনিকোডে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাষা হিসাবে অনত্মভর্ুক্ত রয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে নয়, আমাদের জাতীয় স্বার্থে তা অচিরেই করা অতি প্রয়োজন। আমাদের ভাষার সমৃদ্ধির জন্য অনুবাদের কাজে আরও গুরম্নত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বিদেশী বই বাংলায় ও বাংলা বই বিদেশী ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। একুশে বইমেলার বর্ধন ও আনত্মর্জাতিকীকরণ প্রয়োজন।
বিদেশে আমাদের দূতাবাসের মাধ্যমে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরা দরকার। ডকুমেন্টারি ও পূর্ণদৈঘর্্য ছায়াছবি বানানো এবং বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন সেই চেতনাই প্রেরণা দিবে সারা বিশ্বকে। ১৮৫ রাষ্ট্র তাদের স্ব-স্ব মাতৃভাষা রার জন্য এগিয়ে আসবে। সেই বিশ্বব্যাপী উদযাপনই হবে আমাদের সত্যিকারের বিজয়।
লেখক : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। বাংলাদেশের প েতিনি প্রসত্মাবটি উত্থাপন করেন ও অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
No comments