‘সেদিন যদি আমরা পদত্যাগ না করতাম ওনাদের ক্ষমতায় আসা হতো না
কাজল ঘোষ: ব্যর্থ উপদেষ্টাদের দেয়া ফর্মুলায় গণতন্ত্র রক্ষা হবে না- প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে ড. আকবর আলি খান বলেছেন, সেদিন আমরা ব্যর্থ হইনি। সেদিন যদি আমরা পদত্যাগ না করতাম তাহলে দেশে বহুদলীয় নির্বাচন হতো না।
আর বহুদলীয় নির্বাচন না হলে বর্তমান সরকারও ক্ষমতায় আসতে পারতো না। রাজনীতিবিদরা কোন ফর্মুলায় কার হালুয়া-রুটি কতটুকু প্রাপ্তি হবে তারই হিসাব করছে উল্লেখ করে ডাকসাইটে এ আমলা বলেন, গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন নয়- এর সঙ্গে কতগুলো মূল্যবোধও জড়িত। মূল্যবোধ না থাকলে গণতন্ত্র ব্যাহত হবে। আর বর্তমান সমস্যার জন্ম দিয়েছেন রাজনীতিকরাই। কাজেই সমাধান তাদেরই করতে হবে। সম্প্রতি সিএফএসডি আয়োজিত ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর: অপশন ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামের গোলটেবিলে নির্বাচন নিয়ে দেয়া সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের ৪ ফর্মুলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি বাঁকেই সরব ভূমিকায় থেকেছেন ড. আকবর আলি খান। ২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে আরও তিন সহযোগীসহ পদত্যাগ করে দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। সে সময় একদলীয় নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে দেশব্যাপী জনমত সৃষ্টি হয়। পরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ড. ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে টানাপড়েন ও সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেন মানবজমিন-এর সঙ্গে।
ড. আকবর আলি খান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ সমস্ত ক্ষমতা প্রধান উপদেষ্টার হাতে কেন্দ্রীভূত। সে কারণে কোন উপদেষ্টা প্রধান উপদেষ্টার বাধার মুখে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে কাজ করতে পারেন না। একই ভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতেও সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। এ কারণে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর অনিচ্ছায় কোন মন্ত্রীর পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয় না।
বর্তমান সঙ্কট নিরসনে কোনও ফর্মুলা দেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার দেয়া ফর্মুলা শেষ কথা নয়। আইন ও সংবিধান মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোনও কিছুই আইন ও সংবিধান করতে পারে না। আমি কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য দিইনি এটা ছিল আমার একাডেমিক বক্তব্য। আমার বক্তব্য রাজনীতিবিদরা গ্রহণ করতেও পারেন, না-ও করতে পারেন।
উপদেষ্টা থাকাকালীন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব ছিল দু’টি। এক. একদলীয় নির্বাচন যেন না হয় তা নিশ্চিত করা। দুই. সুষ্ঠু বহুদলীয় নির্বাচন আয়োজন। প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমিসহ অন্য তিন উপদেষ্টা পদত্যাগ করায় ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হওয়ায় ইয়াজউদ্দিন সরকারের পক্ষে একদলীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হয়নি। পরে সকল উপদেষ্টার পদত্যাগে ড. ফখরুদ্দিন প্রধান উপদেষ্টা হলে বহুদলীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হয়েছিল। এর ফলে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছিল।
বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়ায় বিদায়ী বছরে সহিংসতা, হানাহানি ও পারস্পরিক অবিশ্বাস বেড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে সঙ্কট আরও বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বড় দু’দলের এ দ্বিমুখী অবস্থানের ফলে চলতি বছর রাজনীতিতে সংঘাত বাড়বে।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন সংঘাতময় পরিবেশে চলছে। গণতন্ত্র বিপন্ন হচ্ছে। বড় দু’দল একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে গণতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করবে না। আর রাজনীতিবিদরা যেভাবে একে অন্যের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন, একে অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধা করে কথা বলেন তাতে গণতন্ত্র রক্ষা হবে না।
সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের দেয়া সংলাপ নিয়ে নিরাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল তা কোন সমঝোতার মধ্য দিয়ে হয়নি। ছিয়ানব্বইতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল আন্দোলনের মাধ্যমে। বড় দু’দলের সমঝোতা হয়েছিল একবারই। তা স্বৈরাচারের পতনের সময়। আর মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের সংলাপও আমরা দেখেছি। সে সংলাপে কোন সমাধান আসেনি, সমঝোতা হয়নি। তবে বর্তমান সঙ্কট থেকে বের হতে না পারলে আবারও সংঘাত অনিবার্য।
অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার চার বছরে অর্থনীতিতে গতিধারা অক্ষুণœ রাখতে পেরেছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও সমৃদ্ধ ও শাণিত করতে পেরেছে। আর তাদের ব্যর্থতা হচ্ছে বিদায়ী বছরে দেশে সুশাসনের সমস্যা প্রকট হয়েছে, সংঘাত বেড়েছে। পদ্মা সেতু ও অবকাঠামো খাতে এখনও অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ড. আকবর আলি খান শনিবার সিএফএসডির সেমিনারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অর্থপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে চারটি প্রস্তাব পেশ করেন। ১. দু’দল থেকে পাঁচ জন করে নিয়ে ১০ জনের মন্ত্রিসভা গঠন করা। কিন্তু সরকারি দল থেকে কারা নির্বাচিত হবেন সেটা নির্ধারণ করবে বিরোধী দল। অন্যদিকে, বিরোধী দল থেকে কারা নির্বাচিত হবেন সেটা নির্ধারণ করবে সরকারি দল। ২. ’৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে রকম ছিল ওইরকম বিধান প্রণয়ন করা। কিন্তু দু’টার্মের জন্য বিধান করার আগে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে হবে, ৩. সংবিধান সংশোধন করে সংসদ তিন মাসের জন্য নির্বাচন করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সরকারি ও বিরোধী দল ১০ জন করে নির্দলীয় লোক মনোনয়ন দেবে। তাদের মধ্য থেকে ৫ জন ৫ জন করে সংসদ নির্বাচিত করবে। আর দু’দলের ১০ জন মিলে একজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্বাচিত করবে। প্রধানকে নির্বাচিত না করতে পারলে লটারি করে নির্বাচিত করবে। ৪. উপরের তিন প্রস্তাব যদি গ্রহণযোগ্য না হয় বিরোধী দল বিএনপি তাদের প্রস্তাব দেবে। প্রস্তাবের ওপর গণভোট হবে। জনগণ তাদের সিদ্ধান্ত নেবে।
No comments