যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যয়ে by ড. আবুল আজাদ
স্বাধীনতার ৩৯ বছরে পা রাখল বাংলাদেশ। পরিণত এক বটবৃই বটে। কিন্তু বৃটি ডালপালা ছাঁটা। সংবিধান ত-বিত। জননী জন্ম ভূমি বাংলাদেশ আমার, এমন একটি পটভূমিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কথা বলছি।
বাংলাদেশের অনেক সমস্যা। অর্থনৈতিক সমস্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের দুর্বিপাক, দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ, আমলাতান্ত্রিক সঙ্কট_ এত কিছুর মাঝে সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন জাতির অসত্মিত্বের সঙ্কট। এই অস্তিত্বের সঙ্কটটি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দ্বারা তৈরি। স্বাধীনতার পর পরই সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির এদেশীয় দোসর এবং সেনাবাহিনীর নীতিবিচু্যত কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের যোগসাজশে দেশের স্বাধীনতার চেতনা পরিপন্থী একটি বহুমুখী শক্তি তৈরি হয়। এই শক্তি বাংলাদেশে ধমর্ীয় রাজনীতির সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এদের ধর্মীয় রাজনীতিটি একটি লেবাস। এই লেবাসের অন্তরালে এরা প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ব্যবসায় লিপ্ত। এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা ১৯৭১ সালে ধর্মের নামে মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে মানুষ হত্যা করেছে। আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম হরণ করেছে। হাজার হাজার যুদ্ধশিশুর জন্ম দিয়েছে। আমরা খুব আশ্চর্য হয়ে ল্য করি, জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে এই যুদ্ধাপরাধীদের আইন করে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। সেই থেকে বর্তমান পর্যনত্ম তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করে আসছে। সরকার গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়েছে। এই যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠিত দলটির নাম জামায়াতে ইসলামী।'৭৭-এ এই জামায়াতীরা রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হলেও মূলত '৭১-এর পর থেকেই এরা সক্রিয় ছিল পর্দার অনত্মরালে। '৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালী জাতির জনক মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা, পরবতর্ীতে কারাগারে বন্দী চার জাতীয় নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পেছনেও এই অপশক্তির হাত ছিল। আর '৭৭-এ রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতিচিহ্নকে মুছে ফেলা, বধ্যভূমির ওপর বাজার স্থাপন, শহীদদের সমাধিকে অমর্যাদা করা, মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরিচু্যতি_ এসব ঘটনার নেপথ্য নক্সাকার এই মৌলবাদী রাজাকাররা। জেনারেল জিয়ার ন্যাশনালিস্ট পার্টি মুহুমর্ুহু রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের জন্য এই মৌলবাদীদের বাহবা দিয়েছে এবং তাদের নক্সা অনুযায়ী পরিকল্পনা বাসত্মবায়ন করেছে।
আমি একটু পেছনে যেতে চাই। গেল বছর দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। 'রাজাকাররা একাত্তরে আত্মসমর্পণ করেনি : ওদের তিন লাখ অস্ত্র কোথায়?' এই লেখাটি পরে আমার 'একাত্তরের বধ্যভূমি : নৃশংস গণহত্যা' গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। আমার এ প্রশ্নের সদুত্তর কিন্তু আজও আমি পাইনি। কোন সরকারকেই এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতেও দেখিনি। আজকে দেশব্যাপী দাবির ঝড় উঠেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের। সরকারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরম্ন করেছে। কিন্তু আমি মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে হবে দু'টি। একটি যুদ্ধাপরাধের, অপরটি আত্মসমর্পণ না করে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার।
দেশ উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদীগোষ্ঠীর জঙ্গী তৎপরতায় বিত। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও জঙ্গীরা অস্ত্র, বোমা এবং বোমা বানানোর সরঞ্জামসহ ধরা পড়ছে। কী ভয়ঙ্কর ঔদ্ধত্য তাদের! একই সঙ্গে ৬৩ জেলায় বোমা ফুটিয়ে স্বাধীন দেশে শক্তির মহড়া দিয়েছে। জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে।
এতসব ঘটছে কী করে? ঘটার কারণ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ ও অস্ত্রের উপস্থিতি। নামের কী বাহার! হরকত-উল-জিহাদ, আল বাইয়্যিনাত ইত্যাদি। এ রকম প্রায় চলিস্নশটি সংগঠনের নাম প্রকাশ্যে এসেছে, যারা জঙ্গী তৎপরতার লিপ্ত। আর এই জঙ্গীদের সকলেই জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী ছাত্রসেনা এবং ইসলামী ছাত্রশক্তির সাবেক নেতাকমর্ী। সবকিছু দেখেশুনে তাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এই সমসত্ম জঙ্গী তৎপরতার নেপথ্য শক্তি জামায়াতে ইসলামী। আমার বিশ্বাস, জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে সক্রিয় রেখে এদেশে জঙ্গীবাদ নিমর্ূল করা কিছুতেই সম্ভব নয়। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে জঙ্গীবাদ নিমর্ূল চেষ্টার অর্থ হচ্ছে গাছের আগা কেটে গোড়ায় পানি ঢালা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি যতই সোচ্চার হচ্ছে এবং সরকারী উদ্যোগ যতই ত্বরান্বিত হচ্ছে, জামায়াতের গাত্রদাহ থেকে শুরম্ন করে নানা অপতৎপরতা ততই প্রকট হচ্ছে। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে। আজ স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৯ বছরের মাথায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ওঠার পর '৭১-এর সেই ঘাতক জামায়াতে ইসলামী আজ মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিচ্ছে। অথচ গত ৩৮ বছর কিন্তু দেয়নি, ভ-ামি তথা হিপোক্রেসির একটা সীমা থাকা উচিত। দেশের নিরাপত্তা রাকারী কর্তৃপ এবং আইন আদালত আমাদের এতটাই উদাসীন যে, এসব বিষয়ে কোন সুয়োমোটো রম্নল জারি হয় না। অথচ দুঃখ হয়, পুলিশের সার্জেন্ট বিচারপতির গাড়িকে সিগন্যালে অপো করতে বলা এবং স্যালুট না করায় আমাদেরই উচ্চ আদালত সুয়োমোটো মামলা করেন। কিন্তু '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরা যখন রাষ্ট্রের জনককে উপহাস করে বিবৃতি দেয়, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অভব্য আচরণ করে এবং '৭১-এ তাদের ভূমিকাকে অস্বীকার করে মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয় তখন কোন সুয়োমোটো হয় না। আজকে তাই সব বদলে দেবার সময় এসেছে। এর জন্য আর একটি যুদ্ধের প্রয়োজন। নতুন প্রজন্ম ও মুক্তিযোদ্ধার সনত্মানদের এই যুদ্ধটি করতে হবে। নতুন এই যুদ্ধটি হবে মেধাযুদ্ধ। এই মেধাযুদ্ধ এবং দেশ-রাষ্ট্রের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য আমি এখানে কিছু সুপারিশ তুলে ধরতে চাই। এসব সুপারিশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীল আপামর জনগোষ্ঠীকে চলার পথের দিকনির্দেশনা দেবে।
১. সর্বপ্রথম রাষ্ট্রকে '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে হবে এবং ধমর্ীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
২. মুক্তিযুদ্ধ চেতনার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সকল কর্মকা- প্রতিরোধ করতে হবে।
৩. নতুন প্রজন্মের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠদানের কর্মসূচী সামাজিক পর্যায়ে ও শিা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. জামায়াতে ইসলামী এবং সকল জঙ্গী সংগঠনের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৫. অবিলম্বে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে হবে।
৬. '৭১-এর যে সমসত্ম রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, মুজাহিদ বাহিনী ও শানত্মি কমিটির সশস্ত্র ব্যক্তি ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ না করে অস্ত্রসহ পালিয়ে গিয়েছিল অবিলম্বে তাদের বিচার করতে হবে।
৭. মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে গতিশীল ও সক্রিয় করতে হবে।
৮. সপ্তাহে দুইদিন অনত্মত পূর্ণ দিবস মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের সাাত প্রদান এবং তাঁদের বক্তব্য শোনার জন্য বরাদ্দ রাখবেন।
৯. প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার জন্য মাসিক ১০ হাজার টাকা ভাতা বরাদ্দ করতে হবে এবং তাঁদের রেশন প্রদানসহ সমাজের সকল সত্মরে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
১০. মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা উচ্চ আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদের অনুরূপ ৬৫ বছর করতে হবে। কেননা, '৭১-এর চেতনা পরিপন্থী উচ্চ আদালতের বিচারপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকরাও এই সুবিধা ভোগ করে আসছেন।
১১. মুক্তিযোদ্ধার সনত্মানদের স্কুল, কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, মিলিটারি একাডেমী ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনাখরচে শিার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
১২. মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল এদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র কেন্দ্রীয় প্রাণের প্রতিষ্ঠান। অবিলম্বে এই প্রতিষ্ঠানটিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন করে নেতৃত্ব নির্ধারণপূর্বক তা পরিচালনার জন্য নির্বাচিতদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
১৩. কোন টালবাহানা না করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচিত নেতৃত্বের মাধ্যমে অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের চূড়ানত্ম তালিকা প্রণয়নের কাজ নিশ্চিত করতে হবে।
১৪. পাকিসত্মান গমন প্রত্যাশী বিহারীদের অবিলম্বে পাকিসত্মানে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
১৫. এদেশে এতকাল যত হত্যা, সন্ত্রাস, নির্যাতন, নিপীড়ন, জবরদসত্মি ও চাকরিচু্যতির ঘটনা ঘটেছে, তার প্রত্যেকটি মামলার আইনানুগ সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
১৬. যে সকল ব্যবসায়ী মজুদদারি করে, কালোবাজারী করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, নিরপে তদনত্মের মাধ্যমে তাদের বিরম্নদ্ধে আইনানুগ শাসত্মিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
১৭. বাংলাদেশের ভূখ-ে ভারতীয় উলফাসহ বিদেশী সকল শক্তির তৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
১৮. ছাত্ররা রাজনীতি করবে। সরকার ও সরকারের তাঁবেদার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সকল অন্যায় সিদ্ধানত্মের অবশ্যই প্রতিবাদ করবে। কিন্তু শিার স্থিতিশীল পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। শ্রেণীক এবং পরীাকে আন্দোলনবহিভর্ূত রেখে সকল দুঃশাসন ও পুলিশী নিপীড়নের বিরম্নদ্ধে ছাত্ররা অবশ্যই রাজপথে আন্দোলন করবে।
১৯. বে-আইনী অস্ত্রসহ কেউ ধরা পড়লে, খুনের মামলায় দ-িত আসামি এবং কালো টাকার মালিকদের রাজনীতি করাসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমনকি ধমর্ীয় সংগঠন করার বিষয়টি নিষিদ্ধ করতে হবে।
২০. পুলিশের অপরাধ দমনে বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে তদারকির ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। পাশর্্ববতর্ী দেশে প্রতিটি থানায় সামাজিক কমিটি নামে এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আমাদের দেশে এই ধরনের কিছু না থাকায় পুলিশ যা চালাতে চাই তা-ই চলে। এই অবস্থা রোধ করতে হবে।
২১. ব্যক্তিমালিকানা বা তত্ত্বাবধানে মসজিদ-মাদ্রাসা স্থাপন, পরিচালনা ও ভোগদখল করার বিধান রহিত করতে হবে। কওমী মাদ্রাসাসহ সকল মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্থানীয় পর্যায়ের পেশাজীবী ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে তদারকি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এসব দাবিনামা বা শর্তসমূহ পূরণ হলেই কেবল দেশ যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গীবাদমুক্ত হবে। বাংলাদেশ পরিণত হবে কল্যাণ রাষ্ট্রে।
লেখক : শিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments