তার পরও দুই নেত্রীর পক্ষে-বিবিধ প্রসঙ্গ by মাসুদ মজুমদার
ভালো-মন্দের তুলনামূলক বিচার হতেই পারে। তবে তুলনার মানদণ্ডটা অতুলনীয় না
হলেও মোটামুটি চলনসই হতে হয়। আজকাল অনেকেই রাজনৈতিক সঙ্কটের গভীরতা বোঝাতে
গিয়ে অসম তুলনা করছেন।
বলব না এটা শুধু হতাশার বহিঃপ্রকাশ, এটাও বলব না
বর্তমান অবস্থায় অতিষ্ঠ হওয়ার পর ক্ষোভ প্রকাশের এটাও একটা ধরন। তবে এটা
বলা বোধ করি অসমীচীন হবে নাÑ বর্তমান সরকার সব শ্রেণীর মানুষের আশাভঙ্গের
কারণ সৃষ্টি করেছে। তাই তুলনা করতে গিয়েও মন্দ লোকের সাথে তুলনা দিতে
হচ্ছে। হয়তো বলা চলে বর্তমান সরকারকে আর কোনো মানে রেখে তুলনা করার
অবস্থায় নেই।
এটা মানতে দ্বিধা নেই, গতানুগতিক রাজনীতি পচে গেছে। দুর্নীতির আজদাহা রাজনীতিকে গিলে খাচ্ছে। জনগণের আমানত খাবলে খাচ্ছে পাঁচ বছরের ইজারা পাওয়া রাজনীতির তস্করেরা। তার পরও রাজনীতির বিকল্প রাজনীতি। নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নির্বাচিত সরকার। এরশাদীয় স্বৈরাচার কিংবা মইন উদ্দিনের দুরাচার নয়।
সঙ্কট এতটা ঘনীভূত হওয়ার পরও বলব না এরশাদের সাথে দুই নেত্রীর তুলনা চলে। দুই নেত্রীর রাজনীতি সম্পর্কে যত হতাশাই থাকুক তুলনা করতে হলে তাদের দু’জনের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে। তাদের মধ্যে একজনকে যদি বলা হয় আসমান, অন্যজন হবেন জমিন। অথবা দুই প্রান্তের দু’জন। তার পরও তুলনাযোগ্য। তাদের সাথে তুলনা অন্তত এরশাদের চলে না। এরশাদের রাজনৈতিক জন্মটাই আজন্ম পাপ। সেই পাপ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধারণার আদি পাপের চেয়েও বড়। এরশাদ যে দিন গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করে একটি নির্বাচিত সরকারকে উপড়ে ফেলে ক্ষমতা দখল করলেন, সে দিনের কথা স্মরণ করলে আজো ঘৃণায় গা রি রি করে ওঠে। এরশাদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক দিয়ে রাজনৈতিক তামাশার জন্ম দিলেন। কবিয়াল সেজে প্রেমিক পুরুষ হয়ে গেলেন। তার পরও এরশাদের পক্ষে উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা বলার দশটা যুক্তি যে নেই তা বলব না। তবে কোনো নির্বাচিত সরকারের সাথে তার তুলনা করা হলে প্রতিবাদ করা দায়িত্ব ভাবব। কারণ এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে, একটি মন্দ নির্বাচিত সরকারও স্বৈরাচার কিংবা সামরিকতন্ত্রের চেয়ে ভালো।
দুই নেত্রী পরস্পরকে সমীহ করে কথা না বলার দায় তাদের। তাদের রাজনৈতিক অপকর্মের লায়াবেলিটিসও আমাদের নয়। আমরা জানি, কোন নেত্রী কখন স্বৈরাচারকে তোষামোদ করেছেন। কখন সাথে নিয়েছেন। কিংবা কে কখন কাকে শত্রুর শত্রু বন্ধু ভেবেছেন। এক-এগারো কার কাছে সমর্থিত ছিল তা-ও কারো অজানা নয়। তার পরও বলব দু’টি বড় দল বারবার তাদের সামনে রাখে। এর প্রতি সমীহবোধ না থাকলেও বিদ্বেষী হবো কেন। দল দু’টির অসংখ্য নেতাকর্মীর অনুভূতি ও নেতৃত্ব বাছাইয়ের পথ ও প্রক্রিয়াকে অভিযুক্ত করব কোন যুক্তিতে। নেতৃত্ব একধরনের যোগ্যতা, মানবীয় গুণ। এটা সবার ভেতর থাকে না। শুধু ঘঘে-মেজে নেতা বানানো যায় না। যারা ক্যাডার ধারণায় বিশ্বাসী তারা আনুগত্য করে বিশ্বাস থেকে, সাধারণ রাজনীতিতে নেতা উঠে আসে সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট ফর্মুলায়। তবে একজন নেতার প্রধান দায়িত্ব তার যোগ্য উত্তরাধিকার তথা তার মতোই যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নেতা সৃষ্টি করা বা রেখে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে দুই নেত্রীর অবস্থানগত বিষয়টি পরবর্তী নেতৃত্ব উঠে আসার পথে বাঁধা কি না সেটা তারাই ভাববেন।
চোরকেও ভালো কিংবা বেশি খারাপ চোর বলার একটা রেওয়াজ আছে। এ ব্যাপারে একটা গ্রাম্য গল্পও স্মরণে পড়ল। কোনো এক গ্রামে এক পেশাদার চোরের উপদ্রব ছিল। জনগণ তাকে প্রকাশ্যে চোর বলেই সম্বোধন করত। তার ছেলেকেও বলত চোরের পোলা। এ জন্য চোরের পোলার কষ্ট লাগত; কিন্তু কিছুই বলত না। তবে মনে মনে দুঃখবোধ লালনের ক্ষোভ থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলÑ তোমরা আমার বাপকে চোর বলো, আমি এমন চুরিই করব তোমরা আমার বাপকে ভালো বলতে বাধ্য হবে। একসময় বাপকা বেটা চুরির পথে পা বাড়াল। তত দিনে তার বাবা পটোল তুলেছে। তাও গণপিটুনি খেয়ে। চোরের বেটা আরো প্রতিজ্ঞা করেছিল, আমার বাপকে তোমরা মেরে সুখ পেয়েছ। আমি তোমাদেরকে মরেও সুখ দেবো না। জ্বালিয়ে ছাড়ব। চোরের বেটা চোর চুরি করে যাওয়ার সময় ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যেত। এখন গ্রামের মানুষ বলাবলি শুরু করল, চোরার বাবাই তো ভালো ছিল। চুরি করে সটকে পড়ত। তার বেটা তো আচ্ছা পাজি। এক দিন গ্রামের লোকজন মিলে তাকে ধরে এমন মারই দিলো, বেটা অক্কা গেল। প্রাণ যখন যায় যায় তখন চোরের বেটা চোর জনগণের কাছে মিনতি করল, আমার পাপ তো ক্ষমার অযোগ্য, তোমরা তো আমাকে মেরেই ফেলবে, তবে মরে গেলে আমার লাশটা রাস্তার চৌমাথায় বাঁশের মাথায় পুঁতে রাখবে। তারপর হয়তো আমার পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হবে। গ্রামের সরল মানুষ ভাবল মেরেই তো ফেলা হলোÑ তাহলে তার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিতে আপত্তি কিসের। জওয়ান-বুড়ো সবাই মিলে তার শেষ ইচ্ছেমতো শরীরে বাঁশ ঢুকিয়ে তাকে চৌরাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে দিলো।
এ দিকে থানায় খবর গেল, পুলিশ এসে আইন হাতে তুলে নিয়ে মানুষ মেরে ফেলা ও লাশের প্রতি অমানবিক আচরণের জন্য গ্রামের সব শ্রেণীর মানুষকে থানায় নিয়ে হাজতে পুরল। হাজতে বসে সবাই কপালে হাত দিয়ে বলতে লাগল, বেটা আমাদের মরে গিয়েও জ্বালিয়ে ছাড়ল। শান্তি দিলো না।
আমাদের রাজনীতির জন্য এ গল্পের কোনো শিক্ষা আছে কি নেই জানি না। মিল-অমিলও খুঁজতে চাইব না। শুধু বলব, মানুষ সব সময় মন্দের ভালো বাছাই করতে চায়, করেও।
দুই নেত্রীর হাজার দোষ আছে। কিছু গুণও আছে কিন্তু রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নিতে হলে তাদের পক্ষেই থাকতে হয়। এক-এগারো এখনো অনেকের কাছে টাটকা স্মৃতি। মাইনাস টু ফর্মুলা নিয়ে ক’জন সংস্কারবাদী রাজনৈতিক নেতা মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সাথে হাত মেলাল। অতি প্রগতিশীল দুটো দৈনিকও সুর মেলাল। রাতারাতি কিং পার্টির মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা প্রত্যক্ষ করা গেল। হাতেগোনা আমরা ক’জন রাজনীতির পক্ষে এবং দুই নেত্রীর পক্ষে দাঁড়ালাম। কলমযুদ্ধে সাহসী হতে সচেষ্ট হলাম। অনেকেই আমাদের সাহসকে দুঃসাহস ভাবল। বারবার সতর্ক করল, আমাদের গর্দান যাবে। রিমান্ডে নিয়ে বিদ্যুতের শক দেবে। হাত-পা বেঁধে ওপর থেকে নিচে ছুড়ে ফেলে কোমর-পাঁজর হাত-পা ভেঙে দেবে। তার পরও আমরা মাইনাস প্লাস করার এখতিয়ার জনগণের বলে আপসহীন কলম চালিয়ে গেলাম।
এখনো জোর করে, কৃত্রিমভাবে, দুই নেত্রীকে মাইনাস করার পক্ষে নই। এই এখতিয়ার শুধুই নিজ নিজ দলের ও দেশের জনগণের। যত দিন সম্ভব তারা রাজনীতি করবেনÑ জনগণ না চাইলে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবেন। কিংবা অবসরে যেতে বাধ্য হবেন। এর মধ্যে রাজতন্ত্র খুঁজব কেন? এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষ দুই নেত্রীর পেছনে কাতারবন্দী। একজনের বিকল্প অন্যজন। কে নিন্দুকদের ভাষায় ডাইনি, কে কার সতিন, কে নন; সেটা দু’জনের সাথে তুলনার ব্যাপার হলেও শোভন নয়। এত বড় দুটো দল, তাতে অসংখ্য সিনিয়র নেতা রয়েছেনÑ কর্মী-সমর্থকেরা তাদের ওপর ভরসা পায় না কেন! তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয় না কেন! ডান-বাম-ইসলামপন্থীরাই বা নতুন নেতৃত্ব ও নতুন বক্তব্য নিয়ে হাজির হওয়ার পথে কি শুধু দুই নেত্রীর কারিশমাই অন্তরায় ভাববেন, নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো আমলে নেবেন না! বামপন্থীরা আওয়ামী লীগের কোলে উঠে কিংবা সাথে সাথে পোঁ ধরে ডিগবাজি দিচ্ছেন। ইসলামপন্থীরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিএনপির বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন। এই যখন অবস্থা তখন দুই নেত্রীকে মাইনাস করার অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য কি অর্থহীন মনে হয় না। আগে নিজেদের মূল্যায়ন করুন। নিজেদের রাজনীতি ও গ্রহণযোগ্যতা বিশ্লেষণ করুন। সীমাবদ্ধতা মাপুন। জনগণ বিকল্প নেতৃত্ব চাইলে দুই নেত্রী শাড়ির গিঁট দিয়েও কাউকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না।
এখনো কাউকে কাউকে বলতে শুনি, দুই জোটে কোনো সাহসী পৌরুষদীপ্ত পুরুষ নেই, আছেন দু’জন মহিলা। মহিলা বলেই তাদের সীমাবদ্ধতা খুঁজব এতটা পুরুষবাদী হওয়া কারো সাজে না, উচিতও নয়। আর জনগণের পালস বুঝে কোনো নেত্রী অবসরে গেলেও আমাদের মন্তব্য করার অধিকার আছে, ঠেকানোর এখতিয়ার নেই, যা আছে তা শুধু দুই নেত্রীরই। এ সত্যটা আড়াল করা হবে কেন। দুই নেত্রীর সাপলুডু খেলা, হাওয়াই বিতর্ক, চুলোচুলি ভালো লাগার বিষয় নয়; কিন্তু বিকল্প কোথায়! এরশাদের সাথে তুলনায় সেই বিকল্প কিভাবে পাওয়া সম্ভব। এরশাদ শুধু ডুবন্ত মানুষ নন, তার রাজনীতিও দুই নেত্রীকে আড়াল করে সামনে যাওয়ার অবস্থায় নেই। এত সুবিধাবাদের চাষবাস করে দুই নেত্রীকে আড়ালে ঠেলে দেয়া সম্ভব নয়। তাতে ছাগলের তৃতীয় ছানা ও কোলবালিশ ধরনের রাজনীতি করা সম্ভব, বাংলাদেশের মানুষের মন ভরানো সম্ভব নয়। বিকল্প ধারা সৃষ্টিও দিল্লি হনুজ দূরাস্ত। তার পরও বুঝবার বিষয় হচ্ছে, জনগণের আস্থা ও ভরসার একটা জায়গা আছে। রুচিবোধেরও একটা মানদণ্ড থাকা চাই। ডক্টর ইউনূসকে ‘সুদখোর’ বললে ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে ‘কার খালু’ বললে কিংবা ড. আকবর আলি খানকে ‘ব্যর্থ’ বলা হলে জনগণ যে খুশি হয় না, ‘তেল’ মারার গল্প শোনালেও ভোটার মন জয় হয় না, তা তো যারা বা যিনি বলেন তাকেই বুঝতে হবে। দুই নেত্রী হাইব্রিড নেতা নন। সময়ের বাঁক ঘুরে, অনেক পোড় খেয়ে অসংখ্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তারা আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার দায় পূরণ না করলে খেসারতের মাত্রাও বাড়বে। কিন্তু আমরা মাইনাসের মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করা সমীচীন মনে করতে পারি না। দুই নেত্রীর দেশপ্রেম কোনো প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় নয়। তবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও এই দেশের স্বাতন্ত্র্য বুঝতে যিনি যতটা অদূরদর্শী হবেন তিনি ততটা নিন্দিত হবেন।
নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে নতুন রক্ত চায়। নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব ও উত্থান দুটোই চায়। সেটা উত্তরাধিকার স্রোতধারা হবে, না মাঠ থেকে গজিয়ে উঠবেÑ সেটা সময়ই বলে দেবে। সময়ের প্রয়োজনে রাহুল-বিলাওয়ালরা উঠে এলে মানুষ যেমন হকচকিত হয় না, তারেক-জয়রা এলেও আঁতকে ওঠার কোনো কারণ নেই। মাহি বি চৌধুরী, আন্দালিব, আলাল কিংবা রনিরা তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য ঐক্যপ্রয়াসী হওয়ার কারণে। প্রতিহিংসার বদলে জাতীয় ঐক্যের প্রতি বেশি আগ্রহী হওয়ার জন্য। বাংলাদেশের প্রথম সারির অসংখ্য নেতা বাপ-দাদার পরিচয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। দোষটা শুধু খালেদা-হাসিনার হবে কেন! বণিকের পুত্র বণিক হয়, ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার, গায়কের ছেলে গায়ক হয়, নায়কের ছেলে নায়ক। রাজনীতিবিদের ঘরে রাজনীতির উত্তর পুরুষের উপস্থিতি দোষের কেন। আওয়ামী লীগ বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে বিতর্কিত করে উপস্থাপন করবেই। বিএনপিও চাইবে সেই বক্তব্যের শোধ দিতে। রাজনীতির এ কুজ্ঝটিকা থেকেই তো গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। ললিপপ চুষতে চুষতে রাজনীতিতে আসার দিন শেষ। প্রয়োজন এ যুগের রাজনীতি। যারা ভাঙার চেয়ে গড়বেন বেশি তারাই সমর্থন কুড়াবেনÑ সে ক্ষেত্রেও নির্বাচনের স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জনগণের পছন্দটাই মুখ্য। তবে গুণগত পরিবর্তনের অঙ্গীকার, সততা ও দেশপ্রেমের সবক যাদের নেই তাদের জন্য কোনো শুভকামনা নেই। জনগণের বোধ-বিশ্বাসের বিপরীতে যাদের অবস্থান, তাদেরকেও বন্ধু ভাবার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মাটি-মানুষ ও এই মানচিত্র রক্ষার শপথ যাদের আছে তাদের কোনো সুহৃদের অভাব হবে না। অতীতেও হয়নি।
বাংলাদেশ কারো করুণার ফসল নয়। এই মাটি স্বর্ণ ফলায়। শহীদ-গাজীর রক্তধারা বহন করে। এ জাতি জ্বলেপুড়ে ছারখার হবে কিন্তু কোনো আধিপত্যের কাছে মাথা নত করবে না।
digantaeditorial@gmail.com
এটা মানতে দ্বিধা নেই, গতানুগতিক রাজনীতি পচে গেছে। দুর্নীতির আজদাহা রাজনীতিকে গিলে খাচ্ছে। জনগণের আমানত খাবলে খাচ্ছে পাঁচ বছরের ইজারা পাওয়া রাজনীতির তস্করেরা। তার পরও রাজনীতির বিকল্প রাজনীতি। নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নির্বাচিত সরকার। এরশাদীয় স্বৈরাচার কিংবা মইন উদ্দিনের দুরাচার নয়।
সঙ্কট এতটা ঘনীভূত হওয়ার পরও বলব না এরশাদের সাথে দুই নেত্রীর তুলনা চলে। দুই নেত্রীর রাজনীতি সম্পর্কে যত হতাশাই থাকুক তুলনা করতে হলে তাদের দু’জনের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে। তাদের মধ্যে একজনকে যদি বলা হয় আসমান, অন্যজন হবেন জমিন। অথবা দুই প্রান্তের দু’জন। তার পরও তুলনাযোগ্য। তাদের সাথে তুলনা অন্তত এরশাদের চলে না। এরশাদের রাজনৈতিক জন্মটাই আজন্ম পাপ। সেই পাপ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধারণার আদি পাপের চেয়েও বড়। এরশাদ যে দিন গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করে একটি নির্বাচিত সরকারকে উপড়ে ফেলে ক্ষমতা দখল করলেন, সে দিনের কথা স্মরণ করলে আজো ঘৃণায় গা রি রি করে ওঠে। এরশাদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক দিয়ে রাজনৈতিক তামাশার জন্ম দিলেন। কবিয়াল সেজে প্রেমিক পুরুষ হয়ে গেলেন। তার পরও এরশাদের পক্ষে উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা বলার দশটা যুক্তি যে নেই তা বলব না। তবে কোনো নির্বাচিত সরকারের সাথে তার তুলনা করা হলে প্রতিবাদ করা দায়িত্ব ভাবব। কারণ এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে, একটি মন্দ নির্বাচিত সরকারও স্বৈরাচার কিংবা সামরিকতন্ত্রের চেয়ে ভালো।
দুই নেত্রী পরস্পরকে সমীহ করে কথা না বলার দায় তাদের। তাদের রাজনৈতিক অপকর্মের লায়াবেলিটিসও আমাদের নয়। আমরা জানি, কোন নেত্রী কখন স্বৈরাচারকে তোষামোদ করেছেন। কখন সাথে নিয়েছেন। কিংবা কে কখন কাকে শত্রুর শত্রু বন্ধু ভেবেছেন। এক-এগারো কার কাছে সমর্থিত ছিল তা-ও কারো অজানা নয়। তার পরও বলব দু’টি বড় দল বারবার তাদের সামনে রাখে। এর প্রতি সমীহবোধ না থাকলেও বিদ্বেষী হবো কেন। দল দু’টির অসংখ্য নেতাকর্মীর অনুভূতি ও নেতৃত্ব বাছাইয়ের পথ ও প্রক্রিয়াকে অভিযুক্ত করব কোন যুক্তিতে। নেতৃত্ব একধরনের যোগ্যতা, মানবীয় গুণ। এটা সবার ভেতর থাকে না। শুধু ঘঘে-মেজে নেতা বানানো যায় না। যারা ক্যাডার ধারণায় বিশ্বাসী তারা আনুগত্য করে বিশ্বাস থেকে, সাধারণ রাজনীতিতে নেতা উঠে আসে সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট ফর্মুলায়। তবে একজন নেতার প্রধান দায়িত্ব তার যোগ্য উত্তরাধিকার তথা তার মতোই যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নেতা সৃষ্টি করা বা রেখে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে দুই নেত্রীর অবস্থানগত বিষয়টি পরবর্তী নেতৃত্ব উঠে আসার পথে বাঁধা কি না সেটা তারাই ভাববেন।
চোরকেও ভালো কিংবা বেশি খারাপ চোর বলার একটা রেওয়াজ আছে। এ ব্যাপারে একটা গ্রাম্য গল্পও স্মরণে পড়ল। কোনো এক গ্রামে এক পেশাদার চোরের উপদ্রব ছিল। জনগণ তাকে প্রকাশ্যে চোর বলেই সম্বোধন করত। তার ছেলেকেও বলত চোরের পোলা। এ জন্য চোরের পোলার কষ্ট লাগত; কিন্তু কিছুই বলত না। তবে মনে মনে দুঃখবোধ লালনের ক্ষোভ থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলÑ তোমরা আমার বাপকে চোর বলো, আমি এমন চুরিই করব তোমরা আমার বাপকে ভালো বলতে বাধ্য হবে। একসময় বাপকা বেটা চুরির পথে পা বাড়াল। তত দিনে তার বাবা পটোল তুলেছে। তাও গণপিটুনি খেয়ে। চোরের বেটা আরো প্রতিজ্ঞা করেছিল, আমার বাপকে তোমরা মেরে সুখ পেয়েছ। আমি তোমাদেরকে মরেও সুখ দেবো না। জ্বালিয়ে ছাড়ব। চোরের বেটা চোর চুরি করে যাওয়ার সময় ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যেত। এখন গ্রামের মানুষ বলাবলি শুরু করল, চোরার বাবাই তো ভালো ছিল। চুরি করে সটকে পড়ত। তার বেটা তো আচ্ছা পাজি। এক দিন গ্রামের লোকজন মিলে তাকে ধরে এমন মারই দিলো, বেটা অক্কা গেল। প্রাণ যখন যায় যায় তখন চোরের বেটা চোর জনগণের কাছে মিনতি করল, আমার পাপ তো ক্ষমার অযোগ্য, তোমরা তো আমাকে মেরেই ফেলবে, তবে মরে গেলে আমার লাশটা রাস্তার চৌমাথায় বাঁশের মাথায় পুঁতে রাখবে। তারপর হয়তো আমার পাপের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হবে। গ্রামের সরল মানুষ ভাবল মেরেই তো ফেলা হলোÑ তাহলে তার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিতে আপত্তি কিসের। জওয়ান-বুড়ো সবাই মিলে তার শেষ ইচ্ছেমতো শরীরে বাঁশ ঢুকিয়ে তাকে চৌরাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে দিলো।
এ দিকে থানায় খবর গেল, পুলিশ এসে আইন হাতে তুলে নিয়ে মানুষ মেরে ফেলা ও লাশের প্রতি অমানবিক আচরণের জন্য গ্রামের সব শ্রেণীর মানুষকে থানায় নিয়ে হাজতে পুরল। হাজতে বসে সবাই কপালে হাত দিয়ে বলতে লাগল, বেটা আমাদের মরে গিয়েও জ্বালিয়ে ছাড়ল। শান্তি দিলো না।
আমাদের রাজনীতির জন্য এ গল্পের কোনো শিক্ষা আছে কি নেই জানি না। মিল-অমিলও খুঁজতে চাইব না। শুধু বলব, মানুষ সব সময় মন্দের ভালো বাছাই করতে চায়, করেও।
দুই নেত্রীর হাজার দোষ আছে। কিছু গুণও আছে কিন্তু রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নিতে হলে তাদের পক্ষেই থাকতে হয়। এক-এগারো এখনো অনেকের কাছে টাটকা স্মৃতি। মাইনাস টু ফর্মুলা নিয়ে ক’জন সংস্কারবাদী রাজনৈতিক নেতা মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সাথে হাত মেলাল। অতি প্রগতিশীল দুটো দৈনিকও সুর মেলাল। রাতারাতি কিং পার্টির মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা প্রত্যক্ষ করা গেল। হাতেগোনা আমরা ক’জন রাজনীতির পক্ষে এবং দুই নেত্রীর পক্ষে দাঁড়ালাম। কলমযুদ্ধে সাহসী হতে সচেষ্ট হলাম। অনেকেই আমাদের সাহসকে দুঃসাহস ভাবল। বারবার সতর্ক করল, আমাদের গর্দান যাবে। রিমান্ডে নিয়ে বিদ্যুতের শক দেবে। হাত-পা বেঁধে ওপর থেকে নিচে ছুড়ে ফেলে কোমর-পাঁজর হাত-পা ভেঙে দেবে। তার পরও আমরা মাইনাস প্লাস করার এখতিয়ার জনগণের বলে আপসহীন কলম চালিয়ে গেলাম।
এখনো জোর করে, কৃত্রিমভাবে, দুই নেত্রীকে মাইনাস করার পক্ষে নই। এই এখতিয়ার শুধুই নিজ নিজ দলের ও দেশের জনগণের। যত দিন সম্ভব তারা রাজনীতি করবেনÑ জনগণ না চাইলে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবেন। কিংবা অবসরে যেতে বাধ্য হবেন। এর মধ্যে রাজতন্ত্র খুঁজব কেন? এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষ দুই নেত্রীর পেছনে কাতারবন্দী। একজনের বিকল্প অন্যজন। কে নিন্দুকদের ভাষায় ডাইনি, কে কার সতিন, কে নন; সেটা দু’জনের সাথে তুলনার ব্যাপার হলেও শোভন নয়। এত বড় দুটো দল, তাতে অসংখ্য সিনিয়র নেতা রয়েছেনÑ কর্মী-সমর্থকেরা তাদের ওপর ভরসা পায় না কেন! তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয় না কেন! ডান-বাম-ইসলামপন্থীরাই বা নতুন নেতৃত্ব ও নতুন বক্তব্য নিয়ে হাজির হওয়ার পথে কি শুধু দুই নেত্রীর কারিশমাই অন্তরায় ভাববেন, নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো আমলে নেবেন না! বামপন্থীরা আওয়ামী লীগের কোলে উঠে কিংবা সাথে সাথে পোঁ ধরে ডিগবাজি দিচ্ছেন। ইসলামপন্থীরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিএনপির বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন। এই যখন অবস্থা তখন দুই নেত্রীকে মাইনাস করার অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য কি অর্থহীন মনে হয় না। আগে নিজেদের মূল্যায়ন করুন। নিজেদের রাজনীতি ও গ্রহণযোগ্যতা বিশ্লেষণ করুন। সীমাবদ্ধতা মাপুন। জনগণ বিকল্প নেতৃত্ব চাইলে দুই নেত্রী শাড়ির গিঁট দিয়েও কাউকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না।
এখনো কাউকে কাউকে বলতে শুনি, দুই জোটে কোনো সাহসী পৌরুষদীপ্ত পুরুষ নেই, আছেন দু’জন মহিলা। মহিলা বলেই তাদের সীমাবদ্ধতা খুঁজব এতটা পুরুষবাদী হওয়া কারো সাজে না, উচিতও নয়। আর জনগণের পালস বুঝে কোনো নেত্রী অবসরে গেলেও আমাদের মন্তব্য করার অধিকার আছে, ঠেকানোর এখতিয়ার নেই, যা আছে তা শুধু দুই নেত্রীরই। এ সত্যটা আড়াল করা হবে কেন। দুই নেত্রীর সাপলুডু খেলা, হাওয়াই বিতর্ক, চুলোচুলি ভালো লাগার বিষয় নয়; কিন্তু বিকল্প কোথায়! এরশাদের সাথে তুলনায় সেই বিকল্প কিভাবে পাওয়া সম্ভব। এরশাদ শুধু ডুবন্ত মানুষ নন, তার রাজনীতিও দুই নেত্রীকে আড়াল করে সামনে যাওয়ার অবস্থায় নেই। এত সুবিধাবাদের চাষবাস করে দুই নেত্রীকে আড়ালে ঠেলে দেয়া সম্ভব নয়। তাতে ছাগলের তৃতীয় ছানা ও কোলবালিশ ধরনের রাজনীতি করা সম্ভব, বাংলাদেশের মানুষের মন ভরানো সম্ভব নয়। বিকল্প ধারা সৃষ্টিও দিল্লি হনুজ দূরাস্ত। তার পরও বুঝবার বিষয় হচ্ছে, জনগণের আস্থা ও ভরসার একটা জায়গা আছে। রুচিবোধেরও একটা মানদণ্ড থাকা চাই। ডক্টর ইউনূসকে ‘সুদখোর’ বললে ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে ‘কার খালু’ বললে কিংবা ড. আকবর আলি খানকে ‘ব্যর্থ’ বলা হলে জনগণ যে খুশি হয় না, ‘তেল’ মারার গল্প শোনালেও ভোটার মন জয় হয় না, তা তো যারা বা যিনি বলেন তাকেই বুঝতে হবে। দুই নেত্রী হাইব্রিড নেতা নন। সময়ের বাঁক ঘুরে, অনেক পোড় খেয়ে অসংখ্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তারা আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার দায় পূরণ না করলে খেসারতের মাত্রাও বাড়বে। কিন্তু আমরা মাইনাসের মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করা সমীচীন মনে করতে পারি না। দুই নেত্রীর দেশপ্রেম কোনো প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় নয়। তবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও এই দেশের স্বাতন্ত্র্য বুঝতে যিনি যতটা অদূরদর্শী হবেন তিনি ততটা নিন্দিত হবেন।
নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে নতুন রক্ত চায়। নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব ও উত্থান দুটোই চায়। সেটা উত্তরাধিকার স্রোতধারা হবে, না মাঠ থেকে গজিয়ে উঠবেÑ সেটা সময়ই বলে দেবে। সময়ের প্রয়োজনে রাহুল-বিলাওয়ালরা উঠে এলে মানুষ যেমন হকচকিত হয় না, তারেক-জয়রা এলেও আঁতকে ওঠার কোনো কারণ নেই। মাহি বি চৌধুরী, আন্দালিব, আলাল কিংবা রনিরা তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য ঐক্যপ্রয়াসী হওয়ার কারণে। প্রতিহিংসার বদলে জাতীয় ঐক্যের প্রতি বেশি আগ্রহী হওয়ার জন্য। বাংলাদেশের প্রথম সারির অসংখ্য নেতা বাপ-দাদার পরিচয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। দোষটা শুধু খালেদা-হাসিনার হবে কেন! বণিকের পুত্র বণিক হয়, ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার, গায়কের ছেলে গায়ক হয়, নায়কের ছেলে নায়ক। রাজনীতিবিদের ঘরে রাজনীতির উত্তর পুরুষের উপস্থিতি দোষের কেন। আওয়ামী লীগ বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে বিতর্কিত করে উপস্থাপন করবেই। বিএনপিও চাইবে সেই বক্তব্যের শোধ দিতে। রাজনীতির এ কুজ্ঝটিকা থেকেই তো গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। ললিপপ চুষতে চুষতে রাজনীতিতে আসার দিন শেষ। প্রয়োজন এ যুগের রাজনীতি। যারা ভাঙার চেয়ে গড়বেন বেশি তারাই সমর্থন কুড়াবেনÑ সে ক্ষেত্রেও নির্বাচনের স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জনগণের পছন্দটাই মুখ্য। তবে গুণগত পরিবর্তনের অঙ্গীকার, সততা ও দেশপ্রেমের সবক যাদের নেই তাদের জন্য কোনো শুভকামনা নেই। জনগণের বোধ-বিশ্বাসের বিপরীতে যাদের অবস্থান, তাদেরকেও বন্ধু ভাবার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মাটি-মানুষ ও এই মানচিত্র রক্ষার শপথ যাদের আছে তাদের কোনো সুহৃদের অভাব হবে না। অতীতেও হয়নি।
বাংলাদেশ কারো করুণার ফসল নয়। এই মাটি স্বর্ণ ফলায়। শহীদ-গাজীর রক্তধারা বহন করে। এ জাতি জ্বলেপুড়ে ছারখার হবে কিন্তু কোনো আধিপত্যের কাছে মাথা নত করবে না।
digantaeditorial@gmail.com
No comments