পাহাড়ের সমস্যার সমাধানে ॥ চাই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি by মোয়াজ্জেমুল হক ,জিতেন বড়ুয়া
ভূমি সমস্যাই পাহাড়ে আবার অশান্তির আগুন জ্বালাতে চলেছে। ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির পর সৃষ্ট শান্তির বাতাবরণ এখন রীতিমতো হুমকির মুখে। যে চুক্তিটি ঐতিহাসিক, বিশ্বজুড়ে যে চুক্তি হয়েছে প্রশংসিত,
যে চুক্তির ফলে অবসান ঘটেছে দীর্ঘ দু'দশকেরও বেশি সময়ের গেরিলা যুদ্ধের, সে অনবদ্য পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর আবারও অশান্তির ব্যাপ্তি ঘটে চলেছে অফুরান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার পার্বত্য চট্টগ্রামে। ফলে সর্বণিক অজানা শঙ্কার কবলে নিপতিত হয়েছে পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় সকল সমপ্রদায়ের জনগোষ্ঠী। এ শঙ্কা ও উৎকণ্ঠার কবল থেকে পরিত্রাণে সর্বাগ্রে ভূমি সমস্যার সমাধান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বলে পাহাড় নিয়ে ওয়াকিফহাল সংশ্লিষ্ট সকলের অভিমত। অথচ এ সমস্যার সমাধানের পথ অত্যন্ত বন্ধুর হয়ে আছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্যের সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াতসহ স্বার্থান্বেষী মহলের সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে সাড়া জাগানো এ চুক্তি সম্পাদনের পরও এর মৌলিক কিছু ধারা অকার্যকর হয়ে থাকায় অরণ্যঘেরা পাহাড়ে এ অশানত্মির ডালপালা আবারও বিসত্মার লাভ করেছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার মতায় আসার পর পরই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিরসনে তৎপর হলেও অন্যতম সমস্যা পাহাড়ী-বাঙালীদের মাঝে ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধের সামান্যতম অগ্রগতিও আসেনি। এ পর্যনত্ম উলেস্নখযোগ্য কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি ২০০১ সালের ১২ জুলাই সংসদে পাস হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। আর এ কারণে পাহাড়ে আদিবাসী পাহাড়ী ও অভিবাসিত (সেটেলার) বাঙালীদের মাঝে অশানত্মির দাবানল ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে ইতোমধ্যেই বিশেস্নষক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, শানত্মি চুক্তি সম্পাদনের ঐতিহাসিক এ সফলতা কি মস্নান হয়ে যাবে?পার্বত্য অঞ্চলে এখনও অব্যাহতভাবে কখনও সামপ্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। কখনও সংগঠনগত হিংসা বিদ্বেষ ও গ্রম্নপিংয়ের ছোবলে জ্বলে উঠছে। পড়ছে লাশ, জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রামজুড়ে সাধারণ মানুষের গড়ে তোলা বসতভিটা, দোকানপাট, শিা প্রতিষ্ঠান। এমনকি রেহাই পাচ্ছে না উপাসনালয় থেকে শুরম্ন করে সংরতি বনাঞ্চলও।
আদিবাসী পাহাড়ী ও বাঙালীদের মাঝে সৌহার্দমূলক যে পরিবেশ ছিল অটুট বন্ধনে তা '৭৯ সালে ঐ সময়ের সরকারী সিদ্ধানত্মে আসা অভিবাসিত বাঙালীদের নিয়ে পাহাড়ীদের মাঝে সৃষ্টি হয়ে আছে চরম আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কট। বছরের পর বছর ধরে একে অপরের প্রতিপ হয়ে আছে। বাঙালী জনগোষ্ঠী চায় সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার হলে তাদের প েঐ অঞ্চলে বাস করা সম্ভব নয়। অপরদিকে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী মনে করে সেনাবাহিনী তাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণে লিপ্ত। পাহাড়ী-বাঙালীদের মাঝে সৃষ্ট এ দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। সুযোগ সন্ধানী ও স্বার্থান্বেষী মহল অব্যাহতভাবে লুটছে ফায়দা। দ্বন্দ্ব, বিরোধ, অশানত্মিসহ সবকিছুর মূলে রয়েছে জমি নিয়ে বিরোধ। ভূমির মালিকানা নিয়ে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে বর্তমানে ১০ হাজারেরও বেশি মামলা রয়েছে ফাইলবন্দী। এ বিরোধ নিষ্পত্তিতে শানত্মি চুক্তির অন্যতম প্রধান মৌলিক শর্ত অনুযায়ী ভূমি কমিশন আইন অকার্যকর হয়েই আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দীর্ঘদিন পরও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির কোন জরিপ কাজ হয়নি। এছাড়া ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন তিন পার্বত্য জেলার ১৯০০ সালের শাসনবিধি অনুযায়ী ভূমি বন্দোবসত্ম কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে স্বারিত শানত্মি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী '৯৯ সালের ৩ জুন গঠন হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। ২০০১ সালের ১২ জুন ভূমি কমিশন আইন সংসদে পাস হয়। কিন্তু চুক্তি মোতাবেক ল্যান্ড কমিশন গঠিত না হওয়ার আপত্তি উত্থাপন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প থেকে। এ কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ারম্নল হক চৌধুরী। '৯৯ সালের ৬ ডিসেম্বর দায়িত্ব গ্রহণের আগেই মারা যান আনোয়ারম্নল হক চৌধুরী। ২০০০ সালের ৫ এপ্রিল কমিশনের দ্বিতীয় চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল করিম। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি পদত্যাগ করেন। ২০০৪ সালের ১ নবেম্বর তৃতীয় চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএম মাসুদুর রহমান। এর পর কমিশন আবারও পুনর্গঠন করে ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই চতুর্থ চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী। নিযুক্তি লাভের পর এ পর্যনত্ম কয়েকদফায় তিনি তিন পার্বত্য জেলা সফর করেছেন। বৈঠক করেছেন সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও সংশিস্নষ্ট পগুলোর সঙ্গে। কিন্তু এ পর্যনত্ম সমাধানের কোন পথে এগুতে পারেননি। এ কমিশনের স্থায়ী কোন অফিসও প্রতিষ্ঠা পায়নি। তিন জেলায় গড়ে ওঠেনি কোন সাব-অফিসও।
এদিকে শানত্মি চুক্তির বিভিন্ন ধারা বাসত্মবায়নে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। চুক্তির আগে বিএনপি-জামায়াত এটিকে কালো চুক্তি হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু মতায় এসে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার এ চুক্তি বাতিল যেমন করেনি, তেমনি চুক্তি বাসত্মবায়নে সামান্যতম কোন পদপেও গ্রহণ করেনি। অপরদিকে আদিবাসী পাহাড়ীদের প েজনসংহতি সমিতি (জেএসএস) যা বলে তার বিরোধিতা করে প্রতিপ ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট)। এছাড়া পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালী জনগোষ্ঠীও চুক্তির বিভিন্ন শর্তের চরম বিরোধী। এভাবেই শানত্মি চুক্তি পরিপূর্ণভাবে বাসত্মবায়নের পথে অনত্মরায় হয়ে আছে পাহাড়ের বিভিন্ন মহল।
পাহাড়ের বিভিন্ন সূত্রে বারবার বলা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির মালিকানা সংক্রানত্ম বিরোধের জের ধরেই বার বার ঘটছে পাহাড়ী-বাঙালী দাঙ্গা হাঙ্গামা। এ ভূমি সমস্যাকে সামনে রেখে একশ্রেণীর উপজাতীয়দের উগ্র মনোভাব, বিভিন্ন সময় মতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী উপজাতি ও বাঙালী নেতৃবৃন্দের অপকৌশলে শানত্মি চুক্তির পরও শানত্মির পরিবর্তে অশানত্মির রেশ রয়ে গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক দশমাংশ এলাকা। এ অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। ঐতিহাসিককাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অনিয়ন্ত্রিত, অরতি ও অশানত্ম এলাকা হিসাবে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশপরবর্তী সময়ে পাকিসত্মান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও পার্বত্যবাসী ও পার্বত্য অঞ্চলের বাইরের মানুষ এ অঞ্চল নিয়েছিল পুরো অন্ধকারে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাপরবর্তীতে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে সম হয়।
১৯৭২ সালে সংবিধানে নিজস্ব জাতীয় সত্তার স্বীকৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে তৎকালীন উপজাতীয় সংসদ সদস্য প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। বঙ্গবন্ধু সরকার সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটি রাজ্য সৃষ্টিতে মত দেয়নি। পরে তারা জনসংহতি সমিতি নামে সংগঠনের মাধ্যমে পাহাড়ে সশস্ত্র আন্দোলন শুরম্ন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান সরকার জনসংহতি সমিতির স্বাধিকারের সংগ্রামকে স্থবির করে দিতে পাহাড়ে পাহাড়ী-বাঙালী সমতা অনার উদ্যোগ নেন। সে ল্যে উপজাতীয় অধু্যষিত পার্বত্য অঞ্চলে ১৯৭৯-৮০ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নদী ভাঙ্গনকবলিত, দরিদ্র উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করেন। তখন সরকার পরিত্যক্ত অনাবাদী পাহাড়ী টিলায় প্রতি পরিবারকে ৪-৫ একর করে ভূমি বন্দোবসত্ম দেয়। তখন থেকে পাহাড়ে স্বাধিকার আন্দোলনকারীরা ভূমি বেদখলের দাবিতে আন্দোলন তীব্রতর করে। শুরম্ন হয় উপজাতীয় গেরিলা শানত্মিবাহিনী বনাম সেনাবাহিনী ও বাঙালীর ত্রিমুখী সংঘর্ষ। সংঘর্ষে বাঙালীরা অভ্যনত্মরীণ উদ্বাস্তু হয়ে গুচ্ছগ্রামের বন্দিশিবিরে ও উপজাতীয়দের একটি অংশ ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করে।
শানত্মি চুক্তির পর ভারত থেকে উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের এনে পুনর্বাসন করার পর পাহাড়ে শানত্মি ফিরে আসতে শুরম্ন করে। কিন্তু শানত্মি প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় উদ্বাস্তু বাঙালী-পাহাড়ী পুনর্বাসন ও ভূমি সমস্যা। শানত্মি চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যে যে ক'টি দাঙ্গার ঘটনা হয়েছে তার মূলেই ছিল ভূমি বিরোধ। বর্তমান সময়ে পার্বত্য অঞ্চলের খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি এলাকায় ভূমি সমস্যা ও ভূমি সমস্যা নিয়ে সামপ্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সূত্রমতে, এ পর্যনত্ম রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ির সাজেক, বাঘাইহাট, লংগদু, বরকল, নারিয়ারচর, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, বাবুছড়া, সোনামিয়া টিলা প্রকাশ সাধন টিলা, মহালছড়ির, মাইছছড়ি, করলস্নাছড়ি, পানছড়ির শানত্মিপুর, ফাতেমানগর, শনটিলা, গুইমারার বড়পিলাক, সিন্দুকছড়ি, সদরের কেয়াংঘাট, ভুয়াছড়ি ও বান্দরবানের লামা, রম্নমা, নাই্যংছড়িসহ একাধিক এলাকায় দফায় দফায় ভূমি সমস্যা নিয়ে পাহাড়ী-বাঙালী সহিংস ঘটনা ঘটেছে। শুধু খাগড়াছড়িতেই জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে এ পর্যনত্ম ১১টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত শুক্র ও শনিবার রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাটের ঘটনায় দু'জন নিহতসহ গত একযুগের অধিক সময়ে পাহাড়ী বাঙালী মিলে ৩০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে সহস্রাধিক সাধারণ পাহাড়ী-বাঙালী। অগি্নকা-ে তিগ্রসত্ম হয়েছে দু'সহস্রাধিক বাড়িঘর। এসব ঘটনায় একদিকে যেমন পাহাড়ীরা তিগ্রসত্ম হয়েছে, তেমনি তিগ্রসত্ম হয়েছে বাঙালীরাও। সরকারীভাবে এসব ঘটনায় কে কেমন তিগ্রসত্ম হয়েছে তা নিরূপণ করা না গেলেও কেবল ভুক্তভুগীরাই জানেন তাদের তির পরিমাণ।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল বাঘাইহাট এলাকার গংগারামমুখ ও নার্সারি এলাকায় ৭টি গ্রামে আগুন দিয়ে ১৩২টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। এতে ধ্বংস হয় বাঙালীদের ৭৯টি এবং পাহাড়ীদের ৫৩টি বাড়িঘর। ২০০৬ সালের ৩ এপ্রিল মমালছড়ির মাইছছড়ি এলাকায় প্রায় এক শ'টি বাড়িঘর লুটপাট ও তছনছ করা হয়। ২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট মহালছড়িতে নিহত হয় ২ পাহাড়ী, আহত হয় ৫০ জন। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ১০ নারী। এছাড়া অগি্নকা-ে তিগ্রসত্ম হয় পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর। ২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল জেলা সদরের ভুয়াছড়ি, ২০০২ সালের ১০ অক্টোবর রাজভিলা, ২০০১ সালের ১৮ মে দীঘিনালার বোয়ালখালী ও মেরম্নং, একই বছরের রামগড়ে, ১৯৯৯ সালের ১৬ অক্টোবর বাবুছড়া, ১৯৯৯ সালের ৪ এপ্রিল বাঘাইহাটে ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যে সামপ্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। শানত্মি চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা ভূমি জটিলতা নিরসনের ল্যে সরকার ভূমি কমিশন গঠন করে কয়েক দফা পুনর্গঠন করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং ভূমি কমিশনের আইনী জটিলতায় কমিশন কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জটিল এ ভূমি সমস্যাটির ব্যাপারে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে পাহাড়ে শানত্মি প্রক্রিয়া থমকে গিয়েছিল। পরে ঘটতে থাকে একের পরর এক সহিংস ঘটনা। এর দায়ভার বর্তাচ্ছে বর্তমান মহাজোট সরকারের ওপর।
উলেস্নখ্য, পার্বত্য শানত্মি চুক্তির আলোকে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়। পার্বত্য শানত্মি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ৯ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হচ্ছেন সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। এ কমিশনের অপর সদস্যরা হচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, তিন পার্বত্য জেলার ৩ রাজা ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের প্রতিনিধি। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পরও প্রতিষ্ঠানটির কার্যকর ভূমিকা না থাকায় কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যই ভেসত্মে যেতে বসেছে। সরকার পাহাড়ের জয়গাজমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যেই এ কমিশন গঠন করেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভূমি সমস্যা সমাধানে এ কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী-বাঙালী সমপ্রদায়ের বর্তমান দখলস্বত্ব ভূমির মালিকানা নিশ্চিত না হওয়া সঙ্কটের উত্তরণ ঘটছে না। এদিকে শানত্মি চুক্তির পর ১৯৭৯-৮০ সালের হিসাব মতে, খাগড়াছড়ির ৭৮টি গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত ২৬ হাজার ২২০ বাঙালী অভ্যনত্মরীণ উদ্বাস্তু পরিবার সরকার প্রদত্ত বন্দোবসত্মপ্রাপ্ত জমিতে নিজ নিজ উদ্যোগে বাড়িঘর নির্মাণ করতে গেলেই ভূমি বিরোধ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শুরম্ন হয় সহিংস ঘটনা। এ েেত্র একশ্রেণীর উগ্র বাঙালী যেমন ঘটনাকে উস্কে দেয়, তেমনি উপজাতীয়দের একটি অংশের অতি বাড়াবাড়িও থাকে। আর এ কারণেই পাহাড়ে ঝরছে তাজা রক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যবেক মহলের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার অতি বীরত্ব জাহির বা বাড়াবাড়ি, পাহাড়ে অবস্থানরত উপজাতীয় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর স্বার্থ উদ্ধার ও আনত্মর্জাতিক এবং দেশীয় কতিপয় দাতা সংস্থা ও এনজিওর অপতৎপরতা এবং মিশনারিদের ধর্মানত্মরের বাণিজ্যই পার্বত্য সমস্যাকে জিইয়ে রেখে সহিংস ঘটনাবলীর উস্কানি দিচ্ছে।
গত জানুয়ারি মাসে ভূমি কমিশনের সর্বশেষ বৈঠক অংশগ্রহণ শেষে আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান সন্তু লারমা সাংবাদিকদের কাছে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধন জরম্নরী। এ আইন সংশোধন ছাড়া কমিশনের প েকাজ শুরম্ন করা সম্ভব নয়। সন্তু লারমার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন কমিটির প্রভাবশালী সদস্য চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ও। ঐ সময় ভূমি কমিশন চেয়ারম্যান বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই আনত্মরিকতার সঙ্গে কমিশনের কাজ দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। তবে আইনগত কিছু সমস্যা রয়েছে তা সংশোধন করা হলে কাজ ত্বরিত হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু আইনগত সমস্যার সংশোধন বা সমাধান সবই রয়ে গেছে শূন্যের কোটায়। যার ফলে হচ্ছে সংঘর্ষ, ঝরছে রক্ত, অস্বাভাবিক মৃতু্যকে আলিঙ্গন করছে সাধারণ পাহাড়ী-বাঙালী। আর ফায়দা লুটছে স্বার্থান্বেষীরা। পর্যবেক মহলের মতে, বর্তমান সরকারকে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের ল্যে প্রথমে ভূমি সমস্যাকে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রম্নত তা সমাধান করতে হবে। তা না হলে আরও কত পাহাড়বাসীর তাজা রক্ত ঝরবে_ তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
No comments