২০৩০ সালের বিকল্প বিশ্ব- মধ্যপ্রাচ্য এখন প্রান্ত বিন্দুতে by মাসুমুর রহমান খলিলী
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স
কাউন্সিল পাঁচ বছর পরপর বিশ্ব পরিস্থিতির প্রবণতা বিশ্লেষণ করে ১৫ বা ২০
বছর পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর কী দৃশ্যপট সৃষ্টি হতে পারে তার চিত্র তুলে ধরে।
বিশ্বব্যাপী নানা স্থানের বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা, মতবিনিময়,
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ ভবিষ্যৎ কল্পচিত্র আঁকা হয়। ২০১৫ সালের
কল্পচিত্র বছর দশেক আগে তুলে ধরা হয়েছিল। সে প্রতিবেদনে যে সম্ভাব্য
দৃশ্যপটের ধারণা ছিল, তার কিছু কিছু আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। আবার কিছু
ধারণা বাস্তবতার সাথে এখনো মিলছে না। এরপর ২০২০ ও ২০২৫ সালের সম্ভাব্য
বিশ্ব নিয়ে আরো দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। কয়েক দিন আগে ২০৩০ সালের
প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল (এনআইসি)। বিশ্বের
ভবিষ্যৎ প্রবণতা বোঝার জন্য এনআইসি’র এই ‘গ্লোবাল ট্রেন্ড ২০৩০ :
অলটারনেটিভ ওয়ার্ল্ডস’ বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে। এই প্রতিবেদনের
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দেশ মহাদেশের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। ২০৩০
সালের মধ্যপ্রাচ্য হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক স্থান। তবে ভঙ্গুর প্রবৃদ্ধি,
অব্যাহত অস্থিরতা ও সম্ভাব্য আঞ্চলিক সঙ্ঘাত ব্যাপক ব্যাপ্তি পেতে পারে।
জনসংখ্যামিতির দিক থেকে প্রজনন উর্বরতার ক্রমহ্রাস প্রবণতার কারণে
সাম্প্রতিক আরব বসন্তের চালিকাশক্তি যুব স্ফীতি ক্রমেই বয়সীস্ফীতি হয়ে
উঠবে। তেল-গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি উৎসের নতুন বিকল্প প্রযুক্তি উদ্ভাবনের
প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য
আনতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য উদীয়মান শক্তির মতো উচ্চ জনসংখ্যাবহুল
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব বাড়াতে
সচেষ্ট হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে প্রাথমিকভাবে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক উন্নয়নের ওপর। ইরানের ক্ষমতায় যদি ইসলামি প্রজাতন্ত্রবাদীরা থাকেন আর পারমাণবিক শক্তি অর্জনে দেশটি সমর্থ হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্য একেবারে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে। সৌদি রাজতন্ত্র ভেঙে পড়লে আঞ্চলিক অর্থনীতিতে ধস নামতে পারে। আর মিসরে আমূল পরিবর্তনকামী ইসলামি সরকার হলে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে। নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় উপাদান ভিত্তিতে বিভাজন ইরাক ও সিরিয়ার বর্তমান সীমানায় পরিবর্তন আনতে পারে। অন্য দিকে এসব দেশে মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় গেলে অথবা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের সমাধানে সমঝোতায় সাফল্য এলে তা ইতিবাচক পরিবেশ নিয়ে আসতে পারে।
এ অঞ্চলে ভবিষ্যৎ সম্পাদনার ক্ষেত্রে ছয়টি মুখ্য নির্ধারক বিষয় রয়েছে। এগুলো নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো।
এক. রাজনৈতিক ইসলাম ক্ষমতায় গিয়ে কি মধ্যপন্থা গ্রহণ করবে?
২০ বছর আগে আলজেরিয়ার নির্বাচনে ইসলামি স্যালভেশন ফ্রন্টের ব্যর্থ বিজয়ের পর ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ সুন্নি বিশ্বে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখা যায়। তুরস্কে জাস্টিজ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি (একেপি), মিসরের ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিজ পার্টি, তিউনিশিয়ায় আননেহদা, গাজায় হামাস এবং লিবিয়া ও সিরিয়ায় ইসলামপন্থীদের সম্ভাব্য বিজয় মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনীতিতে গভীর পরিবর্তন নিয়ে আসছে। মিসরের মতো দেশে ইসলামি দলগুলো নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত করতে চাইছে; সরকারি খাতে হাজার হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি করছে, খাদ্য ও জ্বালানিতে ভর্তুকি বজায় রাখছে। এসব নীতি দীর্ঘ দিন বজায় রাখা সম্ভব হয় না। ক্ষমতাসীন ইসলামি দলগুলোকে অধিকতর বাজারমুখী হতে হবে। তাদের মুসলিম ব্রাদারহুডের যুবকদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে হবে, যাতে এসব ‘নিউ গার্ড’ ও অন্যরা অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারে।
সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক বাস্তববাদিতা আদর্শকে ছাড়িয়ে যেতে পারে যা একটি সুশীলসমাজ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। এটি বাস্তববাদী, উদ্যোগী ও সমাজ নেতাদের নতুন এক শ্রেণী তৈরি করবে। একনায়কতান্ত্রিক শাসকেরা এটি অব্যাহতভাবে ঠেকিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
ইসলামি গণতন্ত্র অনিবার্যভাবেই বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজনৈতিক আভা সৃষ্টি করবে। তিউনিশিয়ায় ইসলামি দলগুলো একটি থেকে আরেকটি আলাদা। তবে এর সব ক’টি নতুন একনায়ক-উত্তর শাসনব্যবস্থায় তাদের আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। আসাদ-উত্তর সিরিয়ায় নগরকেন্দ্রিক সুন্নিদের একটি কোয়ালিশন ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে, যার মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড, ধর্মীয় সংখ্যালঘু দ্রুজ কুর্দ এবং অন্যরাও থাকবে। ৪০ বছর আগে হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতা গ্রহণের আগে বারবার নগরকেন্দ্রিক সুন্নিরা দামেস্ক শাসন করেছে, আর সরকারে সৃষ্টি হয়েছে অস্থিরতা। ১৯৬০-এর দশকের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে সিরিয়া। ইরাকে সরকার ইতোমধ্যে বর্ণগত বিভাজনের ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে শিয়ারা সুন্নি আরব ও কুর্দিদের সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে চায়।
দুর্নীতি এবং অব্যাহত বেকারত্ব চলতে থাকলে অথবা সমাজের কর্মজীবী শ্রেণীর বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি মনে করতে থাকেন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারে তাদের জীবনমান কোনোভাবেই উন্নত হচ্ছে না, তাহলে এটি আমূল পরিবর্তনকামী রাজনীতিবিদদের প্রতি তাদের ঝোঁক সৃষ্টি করতে পারে। কট্টর ইসলামপন্থীরা পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের সুস্পষ্ট বিকল্প হিসেবে রক্ষণশীল ধর্মীয় নীতিমালাভিত্তিক বিকল্প শাসনে জনগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে।
দুই. রূপান্তরকালে সরকার গণবিভাজন কি দূর করতে পারবে?
রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা আর বর্ণ, সম্প্রদায় ও গোত্রবাদ বেড়ে যাওয়ায় অব্যাহত অস্থিরতা এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতে পারে। ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়ায় এ ধরনের গোত্র ও সম্প্রদায়গত উত্তেজনা বেশি দেখা দিতে পারে। যেমন দেশে সংখ্যালঘুদের সাথে নিয়ে একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলো আগে দমন-পীড়নের মাধ্যমে এ ধরনের বর্ণগত বিরোধকে দমন করেছে।
ইরাক ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে এটি ছিল আরো বেশি মাত্রায় সত্য। কুর্দ এলাকার বাস্তবতা হলো কুর্দিস্তান সৃষ্টি করার মতো নয়। ইয়েমেন একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে আগের মতো আবারো ভাগ হয়ে যেতে পারে। যেকোনো দৃশ্যপটেই দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সাথে নিরাপত্তা সঙ্কটটিও সেখানে থেকে যাবে। বিশাল যুবশক্তির (যা এখনকার দুই কোটি ৮০ লাখ থেকে ২০২৫ সালে পাঁচ কোটিতে উন্নীত হবে) দেশে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বড় সঙ্কট তৈরি করবে। বাহরাইন সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের একটি ক্ষেত্র হয়ে থাকবে, যেটি উপসাগরীয় অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে রাখবে।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে চলমান সহিংসতা গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি সমর্থনকে কমিয়ে আনতে পারে আর লৌহমানব ধরনের একনায়কের উত্থানে এসব দেশ থেকে আবার উদার গণতন্ত্র বিদায় নিতে পারে। আঞ্চলিকভাবে দুর্বল সরকার অভ্যন্তরীণ সহিংসতার চক্র তৈরি করতে পারে। আর জনগণের মধ্যে বিরোধের কারণে তারা শক্তিমান ভূমিকা রাখতে পারবে না। এতে অনারব শক্তিগুলো বিশেষত তুরস্ক, ইরান, ইসরাইল এ অঞ্চলে বড় খেলোয়াড়ে পরিণত হতে পারে।
তিন. মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কি অর্থনীতিতে স্থিতি ও বিশ্বায়নের ঢেউয়ে আরোহণ করতে পারবে?
এসব দেশের জন্ম হার কমলেও ২০৩০ সাল পর্যন্ত যুবস্ফীতি অব্যাহত থাকবে। সেই সাথে ২০৩০ সাল নাগাদ বয়স্ক মানুষগুলো ভালো কল্যাণ ব্যবস্থা না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা সঙ্কটে পড়বে। বিশ্ব প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) মাত্র দুই শতাংশ এখন যায় মধ্যপ্রাচ্যে। আর এ অঞ্চলে জ্বালানি, পর্যটন ও আবাসনের বাইরে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয় একেবারে সামান্য। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। আর এই অঞ্চলটি হলো বাণিজ্য ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে একেবারে স্বল্প সমন্বিত একটি এলাকা। মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যগত বাণিজ্য অংশীদার হলো ইউরোপ, যেটি এখন শ্লথ প্রবৃদ্ধির সঙ্কটে নিপতিত। যদিও অন্য বাণিজ্য অংশীদার সাব সাহারা অঞ্চলের অর্থনীতি এখন বিকশিত হচ্ছে এবং তাদের সুবিধা আরো বাড়তে পারে।
ধনী উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদভুক্ত (জিসিসি) দেশগুলো এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। জিসিসির ‘সভরেন ওয়েলথ ফান্ড’ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য তহবিল ও সম্পদ সৃষ্টি করেছে। আর জিসিসির জ্বালানি বিক্রির অর্থকড়িও মিসর, লিবিয়া ও তিউনিসিয়াসহ স্থানীয় ও আঞ্চলিক বাজারে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। জিসিসি দেশগুলো এখন অধিক মূল্যসংযোজনের পণ্য সৃষ্টির জন্য তাদের তেলকে পরিশোধিত ও পেট্টো কেমিক্যাল করে রফতানি করছে। উপসগারীয় দেশগুলো এশিয়া, ইউরোপ বা অন্য এলাকার বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণ কেন্দ্র। তবে এখনো পর্যন্ত উপসাগরীয় দেশগুলোর অবস্থা হলো মজুত গ্যাস ও তেল ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ালে তাদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। জ্বালানির উচ্চমূল্যকে এটি নিচে নামিয়ে আনে। সৌদি আরবের তেলের জন্য রাজস্ব ব্রেকইভেন মূল্য বিবেচনায় প্রতি ব্যারেলের দাম ৬৭ ডলার থেকে বাড়িয়ে সম্প্রতি ১০০ ডলারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নির্দেশিত বাজেট ব্যয়ের চক্রবৃদ্ধি জ্বালানি তেলের দাম বাড়াচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ব্যবহার সঙ্কুুচিত করতে পারে বলে নিজস্ব বাজারে তেল দাম বাড়ানো হচ্ছে না। এর পরও সৌদি আরব ২০৩৭ সালে নিট জ্বালানি আমদানিকারকে পরিণত হতে পারে।
চার. আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে ইরান কিভাবে ব্যবহার করবে?
ইরানের প্রভাব দেশটির পারমাণবিক শক্তি অর্জনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। আমাদের অনেক আলোচকই মনে করেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের কাজ বন্ধ করবে। তবে এ ধরনের অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের পর্যায়ের পৌঁছবে। এ দৃশ্যপটে পারমাণবিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার ভঙ্গ হওয়াটি নিশ্চিত হবে এটি। সৌদি আরব নিজেরা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে অথবা পাকিস্তানের কাছ থেকে তা পেতে চাইবে। পারমাণবিক ইরানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তুরস্কও নিজস্ব পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করতে চাইবে অথবা ন্যাটোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পেতে চাইবে। ইরান সৌদি আরব বা এ অঞ্চলের অন্য কেউ পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে চাইলে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও সম্ভবত জর্ডান জ্বালানি খাতে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা শুরু করতে পারে। এটি হয়ে থাকলে এই অঞ্চলটি অব্যাহত সঙ্কট দেখা দেবে আর শিয়া-সুন্নি ও আরব-পারস্য সঙ্ঘাত বাড়বে। এ অঞ্চলের বাইরেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দ্বিতীয় দৃশ্যপটটি ইরানি শাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট। জনগণের মধ্য থেকে এ মর্মে চাপ আসতে পারে যে, পারমাণবিক অস্ত্রের পরিবর্তে অর্থনৈতিক অগ্রগতিই তাদের অধিক কাম্য। এ কারণে তারা আর আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মূল্য দিতে চায় না। এমনকি অভ্যন্তরীণ এলিট সঙ্ঘাত ও জনবিস্ফোরণে শাসকদের পতনও ঘটতে পারে। এ দৃশ্যপটে তেহরান অর্থনৈতিক আধুনিকায়ন, অধিক পশ্চিমাপন্থী গণতান্ত্রিক ইরানের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেবে।
পাঁচ. ইরসাইল-ফিলিস্তিন কি সমঝোতায় পৌঁছতে পারবে, যা আঞ্চলিক স্থিতি সম্ভাবনাকে এগিয়ে নেবে?
ইসরাইলে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিভাজন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এর এক দিকে রয়েছে তারা যারা ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্প্রদায়গত উদার প্রজাতন্ত্র চায় আর যারা ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল উগ্র হেয়ারডিম ও অভিবাসী আন্দোলনে ধারক ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আলোকে তারা বৃহত্তর ইসরাইল দেখতে চায়। এনআইসি’র সাথে আলোচনাকারী বিশ্লেষকদের ধারণা অনুযায়ী, এ বিভাজন ২০৩০ সালের আগে চরম রূপ নেবে। ইসরাইল সামরিক শক্তি হিসেবে শক্তিমান থাকবে, তবে ইরানের পারমাণবিক হুমকির সাথে সাথে স্বল্প মাত্রার যুদ্ধাস্ত্রের হুমকির মধ্যেও থাকবে দেশটি। আরবদের জনমত ক্রমেই এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যে, সেসব দেশের সাথে ইসরাইলের কৌশলী দেনদরবারের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে। তবে দেশটি আরব প্রতিপক্ষের সাথে সঙ্ঘাত উসকে ওঠার বিষয়টি এড়িয়ে চলবে।
আগামী দুই দশকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাত নিরসনে পদক্ষেপ এই অঞ্চলে নাটকীয় অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। ইসরাইলের জন্য সঙ্ঘাতের স্থায়ী সমাধান আঞ্চলিক সম্পর্কে এমন সুযোগ খুলে দেবে যা আজকের দিনে কল্পনাও করা যায় না। ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের পরিসমাপ্তি ইরান ও এর প্রতিবেশী শিবিরের জন্য কৌশলগত বিপত্তি নিয়ে আসবে। আর সময়ের আবর্তনে হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো গ্রুপগুলোর প্রতি জনসমর্থন কমে যাবে। কোনো ধরনের সমাধান না হলে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের সীমিত রাজনৈতিক অধিকার দান ও গাজার অস্থিতিশীলতা নিরসনে দরকষাকষিকে নিজের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবে।
আলোচনাকারীদের অনেকে মনে করেন, আরব-ইসরাইল বিরোধে কান্তি, ইসরাইলের অনীহা ও ফিলিস্তিনিদের ইতিহীন সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ার অবস্থা থেকে ফিলিস্তিনিরা সামনে এগুতে চাইতে পারে। প্রত্যাবর্তনের অধিকার অসামরিকীকরণ ও জেরুসালেমের মতো ইস্যু ২০৩০ সালের মধ্যে পুরোপুরি নিষ্পত্তি হবে না। তবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রগতি হবে। সমন্বিত একপাক্ষিকতার মতো অনানুষ্ঠানিক স্বাধীনতার তৎপরতার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পথে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাবে। হামাস ইরান ও সিরিয়ার বলয় থেকে বেরিয়ে সুন্নি আরব বলয়ে চলে আসায় রামাল্লার ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও গাজার হামাসের মধ্যে ঐক্য-সম্ভাবনা বাড়বে। কিছুটা বিন্যাস ও ভূমি বিনিময়সহ ১৯৬৭ সালের সীমানার সবুজ রেখা বরাবর হবে ফিলিস্তিনের সীমান্ত। তবে অন্য ইস্যুগুলো অনিষ্পন্ন থেকে যেতে পারে।
ছয়. বাহরাইনের বাইরে সৌদি আরব ও অন্য উপসাগরীয় রাজতান্ত্রিক দেশগুলো আরব বিশ্বে পরিবর্তন ও শাসন পাল্টানোর আন্দোলন থেকে মুক্ত থাকবে কি?
সৌদি আরবের রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে অন্যত্র ছড়িয়ে দেবে। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলো ক্ষমতার প্রতিযোগিতার মধ্যে জড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সংশ্লিষ্ট গ্রুপ, আমূল পরিবর্তনকামী ইসলামি চরমপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও শিয়া গ্রুপগুলোও থাকবে। মিসরে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপান্তর জটিল ও অস্পষ্ট হয়ে থাকতে পারে। অন্য সুন্নি রাজতান্ত্রিক দেশগুলো রাজনৈতিক সংস্কার দাবি বা অভ্যন্তরীণ জাগরণের মতো ঘটনার চাপে থাকতে পারে। লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক ও অন্য অঞ্চলে সৌদি আরব তার সুন্নি মিত্রদের সমর্থনে তার প্রভাবকে কাজে লাগাবে। তবে এ ধরনের সমর্থনের ওপর গ্রুপগুলোর দীর্ঘ নির্ভরতা তাদের দুর্বল করবে আর এর সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে শিয়া ও ইরানপন্থী বিদ্রোহীদের।
উপসাগরীয় দেশগুলো আরব জাগরণের ঢেউ সাফল্যের সাথে পার করতে পারলে এ অঞ্চলে এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবে জর্ডান ও মরক্কো। এ দেশ দুটোকে সবচেয়ে ভঙ্গুর রাজতন্ত্র মনে করা হয়। এর ফলে উপসাগরীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক প্রভাবও নিশ্চিত হবে আর মিসর ও আসাদ পতন-পরবর্তী সিরিয়ার মতো পরিবর্তনের ক্রান্তিকালে থাকা দেশগুলো তাদের কাছ থেকে অব্যাহত অর্থনৈতিক সহায়তা পাবে। চূড়ান্তভাবে স্থিতাবস্থার দৃশ্যপট উপসাগরীয় দেশ ও ইরানের মধ্যকার ঠাণ্ডা লড়াই অব্যাহত থাকা ও তাকে আরো ঘনীভূত করার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষভাবে ইরান পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করলে উত্তেজনা বাড়বে।
mrkmmb@gmail.com
মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে প্রাথমিকভাবে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক উন্নয়নের ওপর। ইরানের ক্ষমতায় যদি ইসলামি প্রজাতন্ত্রবাদীরা থাকেন আর পারমাণবিক শক্তি অর্জনে দেশটি সমর্থ হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্য একেবারে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে। সৌদি রাজতন্ত্র ভেঙে পড়লে আঞ্চলিক অর্থনীতিতে ধস নামতে পারে। আর মিসরে আমূল পরিবর্তনকামী ইসলামি সরকার হলে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে। নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় উপাদান ভিত্তিতে বিভাজন ইরাক ও সিরিয়ার বর্তমান সীমানায় পরিবর্তন আনতে পারে। অন্য দিকে এসব দেশে মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় গেলে অথবা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের সমাধানে সমঝোতায় সাফল্য এলে তা ইতিবাচক পরিবেশ নিয়ে আসতে পারে।
এ অঞ্চলে ভবিষ্যৎ সম্পাদনার ক্ষেত্রে ছয়টি মুখ্য নির্ধারক বিষয় রয়েছে। এগুলো নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো।
এক. রাজনৈতিক ইসলাম ক্ষমতায় গিয়ে কি মধ্যপন্থা গ্রহণ করবে?
২০ বছর আগে আলজেরিয়ার নির্বাচনে ইসলামি স্যালভেশন ফ্রন্টের ব্যর্থ বিজয়ের পর ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ সুন্নি বিশ্বে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখা যায়। তুরস্কে জাস্টিজ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি (একেপি), মিসরের ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিজ পার্টি, তিউনিশিয়ায় আননেহদা, গাজায় হামাস এবং লিবিয়া ও সিরিয়ায় ইসলামপন্থীদের সম্ভাব্য বিজয় মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনীতিতে গভীর পরিবর্তন নিয়ে আসছে। মিসরের মতো দেশে ইসলামি দলগুলো নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত করতে চাইছে; সরকারি খাতে হাজার হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি করছে, খাদ্য ও জ্বালানিতে ভর্তুকি বজায় রাখছে। এসব নীতি দীর্ঘ দিন বজায় রাখা সম্ভব হয় না। ক্ষমতাসীন ইসলামি দলগুলোকে অধিকতর বাজারমুখী হতে হবে। তাদের মুসলিম ব্রাদারহুডের যুবকদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে হবে, যাতে এসব ‘নিউ গার্ড’ ও অন্যরা অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারে।
সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক বাস্তববাদিতা আদর্শকে ছাড়িয়ে যেতে পারে যা একটি সুশীলসমাজ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। এটি বাস্তববাদী, উদ্যোগী ও সমাজ নেতাদের নতুন এক শ্রেণী তৈরি করবে। একনায়কতান্ত্রিক শাসকেরা এটি অব্যাহতভাবে ঠেকিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
ইসলামি গণতন্ত্র অনিবার্যভাবেই বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজনৈতিক আভা সৃষ্টি করবে। তিউনিশিয়ায় ইসলামি দলগুলো একটি থেকে আরেকটি আলাদা। তবে এর সব ক’টি নতুন একনায়ক-উত্তর শাসনব্যবস্থায় তাদের আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। আসাদ-উত্তর সিরিয়ায় নগরকেন্দ্রিক সুন্নিদের একটি কোয়ালিশন ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে, যার মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড, ধর্মীয় সংখ্যালঘু দ্রুজ কুর্দ এবং অন্যরাও থাকবে। ৪০ বছর আগে হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতা গ্রহণের আগে বারবার নগরকেন্দ্রিক সুন্নিরা দামেস্ক শাসন করেছে, আর সরকারে সৃষ্টি হয়েছে অস্থিরতা। ১৯৬০-এর দশকের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে সিরিয়া। ইরাকে সরকার ইতোমধ্যে বর্ণগত বিভাজনের ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে শিয়ারা সুন্নি আরব ও কুর্দিদের সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে চায়।
দুর্নীতি এবং অব্যাহত বেকারত্ব চলতে থাকলে অথবা সমাজের কর্মজীবী শ্রেণীর বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি মনে করতে থাকেন নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারে তাদের জীবনমান কোনোভাবেই উন্নত হচ্ছে না, তাহলে এটি আমূল পরিবর্তনকামী রাজনীতিবিদদের প্রতি তাদের ঝোঁক সৃষ্টি করতে পারে। কট্টর ইসলামপন্থীরা পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের সুস্পষ্ট বিকল্প হিসেবে রক্ষণশীল ধর্মীয় নীতিমালাভিত্তিক বিকল্প শাসনে জনগণকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে।
দুই. রূপান্তরকালে সরকার গণবিভাজন কি দূর করতে পারবে?
রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা আর বর্ণ, সম্প্রদায় ও গোত্রবাদ বেড়ে যাওয়ায় অব্যাহত অস্থিরতা এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতে পারে। ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়ায় এ ধরনের গোত্র ও সম্প্রদায়গত উত্তেজনা বেশি দেখা দিতে পারে। যেমন দেশে সংখ্যালঘুদের সাথে নিয়ে একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলো আগে দমন-পীড়নের মাধ্যমে এ ধরনের বর্ণগত বিরোধকে দমন করেছে।
ইরাক ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে এটি ছিল আরো বেশি মাত্রায় সত্য। কুর্দ এলাকার বাস্তবতা হলো কুর্দিস্তান সৃষ্টি করার মতো নয়। ইয়েমেন একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে আগের মতো আবারো ভাগ হয়ে যেতে পারে। যেকোনো দৃশ্যপটেই দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সাথে নিরাপত্তা সঙ্কটটিও সেখানে থেকে যাবে। বিশাল যুবশক্তির (যা এখনকার দুই কোটি ৮০ লাখ থেকে ২০২৫ সালে পাঁচ কোটিতে উন্নীত হবে) দেশে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বড় সঙ্কট তৈরি করবে। বাহরাইন সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের একটি ক্ষেত্র হয়ে থাকবে, যেটি উপসাগরীয় অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে রাখবে।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে চলমান সহিংসতা গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি সমর্থনকে কমিয়ে আনতে পারে আর লৌহমানব ধরনের একনায়কের উত্থানে এসব দেশ থেকে আবার উদার গণতন্ত্র বিদায় নিতে পারে। আঞ্চলিকভাবে দুর্বল সরকার অভ্যন্তরীণ সহিংসতার চক্র তৈরি করতে পারে। আর জনগণের মধ্যে বিরোধের কারণে তারা শক্তিমান ভূমিকা রাখতে পারবে না। এতে অনারব শক্তিগুলো বিশেষত তুরস্ক, ইরান, ইসরাইল এ অঞ্চলে বড় খেলোয়াড়ে পরিণত হতে পারে।
তিন. মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কি অর্থনীতিতে স্থিতি ও বিশ্বায়নের ঢেউয়ে আরোহণ করতে পারবে?
এসব দেশের জন্ম হার কমলেও ২০৩০ সাল পর্যন্ত যুবস্ফীতি অব্যাহত থাকবে। সেই সাথে ২০৩০ সাল নাগাদ বয়স্ক মানুষগুলো ভালো কল্যাণ ব্যবস্থা না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা সঙ্কটে পড়বে। বিশ্ব প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) মাত্র দুই শতাংশ এখন যায় মধ্যপ্রাচ্যে। আর এ অঞ্চলে জ্বালানি, পর্যটন ও আবাসনের বাইরে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয় একেবারে সামান্য। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। আর এই অঞ্চলটি হলো বাণিজ্য ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে একেবারে স্বল্প সমন্বিত একটি এলাকা। মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যগত বাণিজ্য অংশীদার হলো ইউরোপ, যেটি এখন শ্লথ প্রবৃদ্ধির সঙ্কটে নিপতিত। যদিও অন্য বাণিজ্য অংশীদার সাব সাহারা অঞ্চলের অর্থনীতি এখন বিকশিত হচ্ছে এবং তাদের সুবিধা আরো বাড়তে পারে।
ধনী উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদভুক্ত (জিসিসি) দেশগুলো এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। জিসিসির ‘সভরেন ওয়েলথ ফান্ড’ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য তহবিল ও সম্পদ সৃষ্টি করেছে। আর জিসিসির জ্বালানি বিক্রির অর্থকড়িও মিসর, লিবিয়া ও তিউনিসিয়াসহ স্থানীয় ও আঞ্চলিক বাজারে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। জিসিসি দেশগুলো এখন অধিক মূল্যসংযোজনের পণ্য সৃষ্টির জন্য তাদের তেলকে পরিশোধিত ও পেট্টো কেমিক্যাল করে রফতানি করছে। উপসগারীয় দেশগুলো এশিয়া, ইউরোপ বা অন্য এলাকার বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণ কেন্দ্র। তবে এখনো পর্যন্ত উপসাগরীয় দেশগুলোর অবস্থা হলো মজুত গ্যাস ও তেল ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ালে তাদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। জ্বালানির উচ্চমূল্যকে এটি নিচে নামিয়ে আনে। সৌদি আরবের তেলের জন্য রাজস্ব ব্রেকইভেন মূল্য বিবেচনায় প্রতি ব্যারেলের দাম ৬৭ ডলার থেকে বাড়িয়ে সম্প্রতি ১০০ ডলারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নির্দেশিত বাজেট ব্যয়ের চক্রবৃদ্ধি জ্বালানি তেলের দাম বাড়াচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ব্যবহার সঙ্কুুচিত করতে পারে বলে নিজস্ব বাজারে তেল দাম বাড়ানো হচ্ছে না। এর পরও সৌদি আরব ২০৩৭ সালে নিট জ্বালানি আমদানিকারকে পরিণত হতে পারে।
চার. আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে ইরান কিভাবে ব্যবহার করবে?
ইরানের প্রভাব দেশটির পারমাণবিক শক্তি অর্জনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। আমাদের অনেক আলোচকই মনে করেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের কাজ বন্ধ করবে। তবে এ ধরনের অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের পর্যায়ের পৌঁছবে। এ দৃশ্যপটে পারমাণবিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার ভঙ্গ হওয়াটি নিশ্চিত হবে এটি। সৌদি আরব নিজেরা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে অথবা পাকিস্তানের কাছ থেকে তা পেতে চাইবে। পারমাণবিক ইরানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তুরস্কও নিজস্ব পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করতে চাইবে অথবা ন্যাটোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পেতে চাইবে। ইরান সৌদি আরব বা এ অঞ্চলের অন্য কেউ পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে চাইলে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও সম্ভবত জর্ডান জ্বালানি খাতে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা শুরু করতে পারে। এটি হয়ে থাকলে এই অঞ্চলটি অব্যাহত সঙ্কট দেখা দেবে আর শিয়া-সুন্নি ও আরব-পারস্য সঙ্ঘাত বাড়বে। এ অঞ্চলের বাইরেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দ্বিতীয় দৃশ্যপটটি ইরানি শাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট। জনগণের মধ্য থেকে এ মর্মে চাপ আসতে পারে যে, পারমাণবিক অস্ত্রের পরিবর্তে অর্থনৈতিক অগ্রগতিই তাদের অধিক কাম্য। এ কারণে তারা আর আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মূল্য দিতে চায় না। এমনকি অভ্যন্তরীণ এলিট সঙ্ঘাত ও জনবিস্ফোরণে শাসকদের পতনও ঘটতে পারে। এ দৃশ্যপটে তেহরান অর্থনৈতিক আধুনিকায়ন, অধিক পশ্চিমাপন্থী গণতান্ত্রিক ইরানের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেবে।
পাঁচ. ইরসাইল-ফিলিস্তিন কি সমঝোতায় পৌঁছতে পারবে, যা আঞ্চলিক স্থিতি সম্ভাবনাকে এগিয়ে নেবে?
ইসরাইলে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিভাজন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এর এক দিকে রয়েছে তারা যারা ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্প্রদায়গত উদার প্রজাতন্ত্র চায় আর যারা ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল উগ্র হেয়ারডিম ও অভিবাসী আন্দোলনে ধারক ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আলোকে তারা বৃহত্তর ইসরাইল দেখতে চায়। এনআইসি’র সাথে আলোচনাকারী বিশ্লেষকদের ধারণা অনুযায়ী, এ বিভাজন ২০৩০ সালের আগে চরম রূপ নেবে। ইসরাইল সামরিক শক্তি হিসেবে শক্তিমান থাকবে, তবে ইরানের পারমাণবিক হুমকির সাথে সাথে স্বল্প মাত্রার যুদ্ধাস্ত্রের হুমকির মধ্যেও থাকবে দেশটি। আরবদের জনমত ক্রমেই এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যে, সেসব দেশের সাথে ইসরাইলের কৌশলী দেনদরবারের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে। তবে দেশটি আরব প্রতিপক্ষের সাথে সঙ্ঘাত উসকে ওঠার বিষয়টি এড়িয়ে চলবে।
আগামী দুই দশকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাত নিরসনে পদক্ষেপ এই অঞ্চলে নাটকীয় অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। ইসরাইলের জন্য সঙ্ঘাতের স্থায়ী সমাধান আঞ্চলিক সম্পর্কে এমন সুযোগ খুলে দেবে যা আজকের দিনে কল্পনাও করা যায় না। ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের পরিসমাপ্তি ইরান ও এর প্রতিবেশী শিবিরের জন্য কৌশলগত বিপত্তি নিয়ে আসবে। আর সময়ের আবর্তনে হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো গ্রুপগুলোর প্রতি জনসমর্থন কমে যাবে। কোনো ধরনের সমাধান না হলে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের সীমিত রাজনৈতিক অধিকার দান ও গাজার অস্থিতিশীলতা নিরসনে দরকষাকষিকে নিজের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবে।
আলোচনাকারীদের অনেকে মনে করেন, আরব-ইসরাইল বিরোধে কান্তি, ইসরাইলের অনীহা ও ফিলিস্তিনিদের ইতিহীন সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ার অবস্থা থেকে ফিলিস্তিনিরা সামনে এগুতে চাইতে পারে। প্রত্যাবর্তনের অধিকার অসামরিকীকরণ ও জেরুসালেমের মতো ইস্যু ২০৩০ সালের মধ্যে পুরোপুরি নিষ্পত্তি হবে না। তবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রগতি হবে। সমন্বিত একপাক্ষিকতার মতো অনানুষ্ঠানিক স্বাধীনতার তৎপরতার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পথে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাবে। হামাস ইরান ও সিরিয়ার বলয় থেকে বেরিয়ে সুন্নি আরব বলয়ে চলে আসায় রামাল্লার ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও গাজার হামাসের মধ্যে ঐক্য-সম্ভাবনা বাড়বে। কিছুটা বিন্যাস ও ভূমি বিনিময়সহ ১৯৬৭ সালের সীমানার সবুজ রেখা বরাবর হবে ফিলিস্তিনের সীমান্ত। তবে অন্য ইস্যুগুলো অনিষ্পন্ন থেকে যেতে পারে।
ছয়. বাহরাইনের বাইরে সৌদি আরব ও অন্য উপসাগরীয় রাজতান্ত্রিক দেশগুলো আরব বিশ্বে পরিবর্তন ও শাসন পাল্টানোর আন্দোলন থেকে মুক্ত থাকবে কি?
সৌদি আরবের রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে অন্যত্র ছড়িয়ে দেবে। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলো ক্ষমতার প্রতিযোগিতার মধ্যে জড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সংশ্লিষ্ট গ্রুপ, আমূল পরিবর্তনকামী ইসলামি চরমপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও শিয়া গ্রুপগুলোও থাকবে। মিসরে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপান্তর জটিল ও অস্পষ্ট হয়ে থাকতে পারে। অন্য সুন্নি রাজতান্ত্রিক দেশগুলো রাজনৈতিক সংস্কার দাবি বা অভ্যন্তরীণ জাগরণের মতো ঘটনার চাপে থাকতে পারে। লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক ও অন্য অঞ্চলে সৌদি আরব তার সুন্নি মিত্রদের সমর্থনে তার প্রভাবকে কাজে লাগাবে। তবে এ ধরনের সমর্থনের ওপর গ্রুপগুলোর দীর্ঘ নির্ভরতা তাদের দুর্বল করবে আর এর সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে শিয়া ও ইরানপন্থী বিদ্রোহীদের।
উপসাগরীয় দেশগুলো আরব জাগরণের ঢেউ সাফল্যের সাথে পার করতে পারলে এ অঞ্চলে এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবে জর্ডান ও মরক্কো। এ দেশ দুটোকে সবচেয়ে ভঙ্গুর রাজতন্ত্র মনে করা হয়। এর ফলে উপসাগরীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক প্রভাবও নিশ্চিত হবে আর মিসর ও আসাদ পতন-পরবর্তী সিরিয়ার মতো পরিবর্তনের ক্রান্তিকালে থাকা দেশগুলো তাদের কাছ থেকে অব্যাহত অর্থনৈতিক সহায়তা পাবে। চূড়ান্তভাবে স্থিতাবস্থার দৃশ্যপট উপসাগরীয় দেশ ও ইরানের মধ্যকার ঠাণ্ডা লড়াই অব্যাহত থাকা ও তাকে আরো ঘনীভূত করার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষভাবে ইরান পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করলে উত্তেজনা বাড়বে।
mrkmmb@gmail.com
No comments