বইমেলা কেমন লাগছে by সুলতানা আজীম
বইমেলা কেমন লাগছে_এটি একটি প্রচলিত প্রশ্ন এবং এর প্রচলিত উত্তর আছে। আমি এই প্রশ্নটির উত্তরে একটি প্রশ্ন করতে চাচ্ছি। বইমেলাটি কি উদ্দেশ্যে করা হয়? যদি ধরে নিই, পাঠককে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং পাঠকের পরিমাণ বাড়ানো।
তাহলে একটি প্রশ্ন আসে, কি ধরনের বই পাঠকের কাছে পেঁৗছে দেয়া দরকার? যদি মনে করি পাঠকের হাতে সে সব বই বেশি পেঁৗছে দেয়া দরকার, যা তাদের চিনত্মা, চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা, আচরণকে সঠিকভাবে পরিচালিত করবে, তাদের বিকাশ ঘটাবে, তাহলেও একটি প্রশ্ন আসে; বইমেলা সেটা কতটা করতে পারছে? এই মেলায় কতভাগ পাঠক গুরম্নত্বপূর্ণ বইগুলো কিনছেন, তাহলে বলতে হবে এই মেলা পাঠককে শুদ্ধতার পথে সেভাবে পরিচালিত করতে পারছে না।দেশ স্বাধীন হবার পরে রাষ্ট্র পরিচালকদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল শুরম্ন থেকেই একটি প্রগতিশীল, মানবিক, সৎ, শুদ্ধ, সচেতন, দায়িত্ববোধের কাছে আবদ্ধ জাতি গড়ে তোলা এবং এই প্রক্রিয়াটি প্রজন্মানত্মরে ধারাবাহিকভাবে কার্যকর করা। কিনত্ম আমাদের রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্র পরিচালকরা কি এরকম কোন উদ্যোগ নিয়েছেন? যদি নিতেন তাহলে একটি দেশের চেহারা এত কুৎসিত হতো না। জাতি সঠিকভাবে গড়ে না উঠলে দেশ গড়ে ওঠে না। সেটা এদেশে প্রমাণিত।
আমি অবশ্যই মনে করি না যে, পনেরো অথবা কুড়ি কোটি মানুষের সবাই সঠিক মানুষ হবে, সেটা সম্ভব নয়। কিনত্মু বেশির' ভাগ মানুষ যদি মানবিক গুণগুলোর চর্চা করে এবং তা প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডে কার্যকর করে; তাহলে যে কোন দেশ মানবিক চেহারা পেতে বাধ্য। দেশের ৭০/৮০ ভাগ মানুষকে যে দেশে ভোট দেয়া ছাড়া মানুষের কোন একটি অধিকার এবং সম্মান দেয়া হয় না। তাদের মানুষ মনে করা হয় না, সে দেশ যে অবস্থায় আছে তার চেয়ে ভিন্ন কিছু হতে পারে না।
বইমেলা যে 'বাণিজ্যিক বইমেলা' হয়ে উঠছে এর পেছনে যাঁরা আছেন তাঁরা কেবল প্রকাশক এবং লেখক নন, পাঠকও। বাণিজ্যিক বইয়ের পাঠক হচ্ছে অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী এবং তরম্নণ। অভিভাবকরা তাদের সনত্মানদের বিকাশের পথ রম্নদ্ধ করে দিচ্ছেন টাকার বিনিময়ে। কিনছেন তি। একটি বাচ্চা দু'একদিন যদি কিছু খেতে না চায় তখন তার অভিভাবকরা চিনত্মিত হন, বাচ্চাটি যদি তার সামনে চানাচুর, কোকাকোলা এবং মিষ্টি দেখে তা খেতে শুরম্ন করে তখন তার বাবা যদি খুশি হয়ে বলেন, তবু তো খাচ্ছে। এই ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। এ ধরনের মা-বাবা বলেন, তবুতা পড়ছে। কিনত্মু এসব বই পড়ে বাচ্চাদের সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই হয় না। যেমন চানাচুর, মিষ্টি বা কোক খেলে এটি বাচ্চার বা যে কোন মানুষের কি হয়?
বাণিজ্যিক বই 'বস্টসেলার' হওয়া থেকেই একটি দেশের পাঠকদের চিনত্মাচেতনার সত্মরটা বোঝা যায়। দেশের বেশিরভাগ পাঠককে সেখানে স্থির রাখার কাজটি সচেতনভাবে করে যাচ্ছে বইমেলা।
জনপ্রিয় আর গুরম্নত্বপূর্ণ, দু'ধরনের লেখক আছেন। জনপ্রিয়রা গুরম্নত্বপূর্ণ হতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ জনপ্রিয় ছিলেন না, নিহাররঞ্জন রায় জনপ্রিয় ছিলেন। এখন কি তেমন কেউ নিহাররঞ্জন রায়ের লেখা বই পড়েন? জনপ্রিয়রা বেঁচে থাকতে পারেন না। কেন? তা ভেবে দেখা দরকার। জনপ্রিয়রা কি দেন, সেটা ভাবতে হবে তার চেয়ে বেশি।
বইমেলার যে জিনিসগুলো নেগেটিভ তা হচ্ছে পুরো এলাকা তবিত ধূলোময়। একটু বৃষ্টি হলে হাঁটার মতো অবস্থা থাকে না। মোড়ক উন্মোচন করার যে ব্যবস্থা তাও যথাযথ নয়। মোড়ক উন্মোচন যদি হয় বইটির প্রচার করা, তাহলে তা বিন্দুমাত্রও সফল হচ্ছে না। গোটা মেলাটাই শব্দ দূষণে দূষিত। শব্দের জন্য মোড়ক উন্মোচনের সময় বই সম্পর্কে কথাগুলো শোনা যায় না। মেলায় পাঠকের চেয়ে বেড়াতে আসা মানুষ বেশি থাকে বলে ছুটির দিনগুলোতে হাঁটাও কঠিন হয়।
আমাদের দেশজুড়ে যে বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা, অব্যবস্থা বইমেলা তার ব্যতিক্রম নয়। সমস্যাময় বইমেলার এই সমস্যাগুলো কি সত্যিই সমাধান করা যায় না? নাকি এই সমস্যাগুলোকে কোন সমস্যাই মনে করেন না কতর্ৃপ।
No comments