রাজনীতিতে শিক্ষা দিতে নেই, শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের এখন বড় দুর্দিন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে তারা একবারও ভাবেননি 'এয়সা দিন নেহি রহেগা।' পাঁচ বছর চুটিয়ে লুটপাট করেছেন।
বিরোধী দলকে কথায় কথায় ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করেছেন। জাতির জনকের অবমাননা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যবোধগুলোর উৎপাটন ছিল তাদের রাজনীতির নিত্য নৈমিত্তিক খেলা। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরব দেশে হেন্দা নামের এক হিংসুক মহিলা যেমন রসুলুলস্নাহ (দ) সহ নওমুসলিমদের নানাভাবে হেনেস্থা করে, নির্যাতন করে এক ধরনের স্যাডিস্টিক আনন্দ পেতেন, আমার মনে হয়, বিএনপি-নেত্রী খালেদা জিয়া তেমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে নানাভাবে অসম্মান দেখিয়ে, তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করে এবং আওয়ামী লীগের বর্তমান নেত্রী শেখ হাসিনাকে গণতন্ত্রের সব রীতিনীতি অমান্য করে প্রতিকাজে অপদসত্ম করার চেষ্টা চালিয়ে সেই একই স্যাডিস্টিক পেস্নজার অনুভব করতেন।আগেই বলেছি, ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। বিএনপি-জামায়াতের এখন এই পাটকেল খাওয়ার পালা। এখন হাসিনা সরকার ৰমতায় বসে ঢাকা বিমানবন্দরের মাথায় অন্যায়ভাবে বসানো জেনারেল জিয়ার নামটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধানত্ম নিতেই বেগম জিয়া এবং তার চ্যালাবেলারা জিগির তুলেছেন। এটা মহা অন্যায়, মহা অন্যায়। কিন্তু তারা ৰমতায় থাকতে কী মহা ন্যায় কাজটি করেছিলেন? তাঁরা যা করেছিলেন, এখন তাই তো তাদের দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে।
বিএনপি-জামায়াতের অসংখ্য অপরাধের মধ্যে একটি অপরাধের উদাহরণ দেই। নব্বইয়ের দশক শেষ হওয়ার দিকে (১৯৯৬-২০০১) তৎকালীন হাসিনা সরকারের চেষ্টায় একুশে ফেব্রম্নয়ারি আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করে। হাসিনা সরকার ঢাকায় একটি আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই সময় জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান ঢাকা সফরে আসেন এবং শেখ হাসিনা কফি আনানকে নিয়ে যুক্তভাবে এই ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রসত্মর স্থাপন করেন। ইনস্টিটিউটটির নির্মাণ কাজও শুরম্ন হয়েছিল।
কতটা হিংসুক, দুবর্ৃত্ত এবং গণতন্ত্রের সব রকম নিয়মকানুনবিরোধী লোক হলে এই ভিত্তিপ্রসত্মর ভেঙে ফেলা এবং ইনস্টিটিউটটির নির্মাণ বন্ধ করে দেয়া যায়, তা কি ভাবা চলে ? এ তো আধুনিক যুগের হেন্দা চরিত্র। ২০০১ সালে ৰমতায় এসেই খালেদা জিয়া জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান ও শেখ হাসিনার নামাঙ্কিত আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রসত্মর ভেঙ্গে ফেলেন এবং তার নতুন শিৰামন্ত্রী ওসমান ফারম্নকের নামে ভিত্তিপ্রসত্মর স্থাপন করা হয়। হাসিনার প্রতি বিদ্বেষের দরম্নন যে ভিত্তিপ্রসত্মরে জাতিসংঘের মহাসচিবের নাম যুক্ত ছিল তাকেও উপড়ে ফেলা হলো এবং সেখানে বসানো হলো এক হ্যান্ডপিকড অখ্যাত মন্ত্রীর নাম। এটা কি কোনো সুস্থবুদ্ধির মানুষের দ্বারা সম্ভব ?
এই অখ্যাত মন্ত্রীটিরও বা পরিচয় কি ছিল? আইয়ুব-মোনেমের আমলে তার বাবা ড. ওসমান গনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দালাল শিৰক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দালালির পুরস্কার হিসেবে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরও করা হয়েছিল। এই সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য পুত্রই ওসমান ফারম্নক। ওয়াশিংটনে থাকার সময় বিএনপির ভাড়াটিয়া লবিয়িস্ট হিসেবে তার প্রধান পরিচয় ছিল। খালেদা জিয়া ৰমতায় এসে তাকে দেশে এনে শিৰামন্ত্রী পদে বসিয়ে পুরস্কৃত করেন।
এই ওসমান ফারম্নকই শিৰামন্ত্রী থাকাকালে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে বার্ষিকসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে গিয়ে মঞ্চে বসা অবস্থায় ইউনিভার্সিটির ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের উলেস্নখ আছে দেখে ম্যাগাজিনটি মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেন এবং ম্যাগাজিনের ছাত্রী সম্পাদককে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে এই শিৰামন্ত্রীর বিরম্নদ্ধে প্রচ- বিৰোভ-আন্দোলন হয়েছিল।
যা হোক, গর্হিতভাবে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তুর বদলানো সত্ত্বেও এই আনত্মর্জাতিক ইনস্টিটিউটটির নির্মাণ কাজ যদি শেষ করা হতো, তাহলে দেশ, জাতি, সবের্াপরি বাংলাভাষাসহ ছোট-বড় বহু ভাষা উপকৃত হতো। কিন্তু খালেদা-নিজামী সরকারের কালো কুৎসিত হাত এর নির্মাণ কাজও বন্ধ করে দেয়। আশার কথা, বাংলার ইতিহাসের এই কালো অধ্যায় শেষ হয়েছে। গণতান্ত্রিক আওয়ামী সরকার আবার ৰমতায় ফিরে এসেছে। ৰমতায় ফের এসেই শেখ হাসিনা আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের বন্ধ করে দেয়া নির্মাণ কাজ আবার শুরম্ন করার নির্দেশ দেন এবং এবারের একুশে ফেব্রম্নয়ারিতে শেখ হাসিনা নিজেই ইনস্টিটিউটের উদ্বোধন করেছেন। আমি জানি না, খালেদা জিয়ার পোষ্য শিৰামন্ত্রীর নামাঙ্কিত ভিত্তিপ্রসত্মরটিকে কি করা হয়েছে। ওটি অাঁসত্মাকুড়ে ফেলে দিয়ে কফি আনান ও হাসিনার নামাঙ্কিত ভিত্তিপ্রসত্মর পুনর্স্থাপনই হবে এই আনত্মর্জাতিক ইনস্টিটিউটের মর্যাদা উদ্ধারের প্রকৃষ্ট ব্যবস্থা। এটা হয়ে না থাকলে এখনই হওয়া উচিত।
আগেই বলেছি, খালেদা-নিজামী আমলের সব অপকর্ীতি, দুবর্ৃত্তপনা এখন বুমেরাং হয়ে তাদের দিকেই ফিরে আসছে। তারা ৰমতায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তো অশস্নীল খিসত্মিখেউর করে বলেছিলেন, শেখ মুজিব কি যমুনা সেতুর স্বপ্ন দেখেছিলেন নাকি যে তার নামে সেতু করতে হবে? আমি তাৎৰণিকভাবে আমার এক কলামে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া সেতুর পাশে নতুন হাওড়া সেতুর নাম বিদ্যাসাগর সেতু। বিদ্যাসাগর কি এই সেতুর স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তার নামে সেতুটি করা হয়েছে ?
এর পর হামলা চলে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের (সাবেক শাহবাগ হোটেল) ওপর। অন্ধকার রাতে হাসপাতালের সাইনবোর্ড থেকে বঙ্গবন্ধুর নামটি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কে বা কারা করেছিল তা পুলিশ ধরতে না পারলেও জনগণ ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। ঢাকার সাবেক দ্বিতীয় রাজধানী এলাকায় সোহরাওয়াদর্ী পঙ্গু হাসপাতালের সাইনবোর্ডে মেডিক্যাল কলেজের নাম যুক্ত করার নামে সোহরাওয়াদর্ীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার নাম যুক্ত করার ধৃষ্টতাও দেখানো হয়েছিল। এ ধরনের আরও অপকীর্তি তারা করেছেন।
জেনারেল এরশাদ স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন এ কথা ঠিক। কিন্তু তিনি দেশের রাসত্মাঘাটের উন্নয়ন, বিশেষ করে ঢাকা শহরের সম্প্রসারণে অনেক কাজ করেছেন। তার তুলনায় বিএনপি সরকার কোন কাজই করেনি। অথচ খালেদা সরকারের আমলে দেখা গেছে, এরশাদের তৈরি করা রাসত্মাঘাট, সেতু ইত্যাদির ভিত্তিপ্রসত্মর থেকে এরশাদের নাম সরিয়ে খালেদা জিয়ার নাম বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের নির্লজ্জ দুবর্ৃত্তপনার নজির সভ্য জগতে নেই।
কথায় বলে 'চোরের সাতদিন, গৃহস্থের একদিন।' বাংলাদেশের গৃহস্থের সেই 'একদিন' এখন এসেছে। বিএনপি-জামায়াতের পাঁচ বছরের অপকীর্তি এখন তাদের দিকেই বুমেরাং হয়ে ছুটছে। দেশের প্রধান বিমানবন্দর থেকে জিয়াউর রহমানের নাম অপসারিত হতে যাচ্ছে। ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা চালু থাকাকালেই জিয়ার নাম অপসারিত হয়েছিল অথবা হতে যাচ্ছিল। সোহরাওয়াদর্ী হাসপাতাল-কলেজের নাম থেকে খালেদার নাম সম্ভবত বাদ পড়েছে অথবা বাদ পড়তে যাচ্ছে। উচ্চ আদালতের রায়ে জিয়াউর রহমানসহ সকল সামরিক শাসকের শাসনামল যেমন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে, তেমনি খালেদা জিয়ার অনৈতিকভাবে ক্যান্টনমেন্টে বসে রাজনীতি করাও শীঘ্রই অবৈধ ঘোষিত হবে বলে দেশের মানুষের আশা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগের কথাটি আর এই তালিকায় আনলাম না। সেটি জাতীয় দাবি। কেবল আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের কর্মসূচী নয়।
এ জন্যই এই নিবন্ধের শুরম্নতেই বলেছি, বিএনপি-জামায়াতের এখন বড় দুর্দিন। পাঁচ বছর ধরে যে অপকর্ম তারা করেছেন, তার তীর তাদের বুক লৰ্য করেই ছুটে আসছে। তারা ভাবতেও পারেননি, তাদের এত সাধের জিয়া আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দর নামটি এত শীঘ্র পাল্টে যাবে অথবা পাল্টে ফেলার সাহস আওয়ামী লীগ দেখাবে। শেখ হাসিনা সেই সাহস দেখাতেই বিএনপি-জামায়াত শিবিরে হা মাতম উঠেছে। আন্দোলনের হুমকি দেখানো হচ্ছে। রাজপথে মহড়াও দেখানো হচ্ছে। কিন্তু পাশে জনগণ নেই। জনসমর্থন কই? ঢাকার এক বন্ধু আমাকে বলেছেন, মতিউর রহমান নিজামীরা এখন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারে সোপর্দ হওয়ার ভয়ে কেবল ব্যারিস্টার খুঁজছেন, দু'হাতে বিখ্যাত আইনজীবীদের টাকা অফার করছেন। এখন আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়ে ভাবার সময় কোথায় তাদের? সবই এখন হুমকিধমকি।
বিএনপি-জামায়াত শিবিরকে এই কোণঠাসা অবস্থায় ফেলতে পেরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়ত বলেছেন, 'ওদের একটা শিৰা দিলাম' কথাটা তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে মনে হয়। নতুবা তিনি বলতেন না। বলা উচিত নয়। চার্চিল বলেছেন, "রাজনীতিতে কেউ কাউকে শিৰা দিতে পারে না। শিৰা গ্রহণ করতে হয়। আমি হিটলারের ভুল থেকে শিৰা গ্রহণ করেছি। আমি হিটলার হলে ডানকার্কের যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজিত করার পর ইংল্যান্ড আক্রমণ করার বদলে রাশিয়ায় আক্রমণ চালাতাম না।" মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসেরও বলেছেন এই কথা। তিনি বলেছেন, "আমি এন্থনি ইডেনকে (তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) কোন শিৰা দিতে চাইনি। বরং তার পতন থেকে শিৰা গ্রহণ করেছি। আমি নিজেকে ইডেনের স্থানে বসিয়ে অনেক ভেবে দেখেছি, তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেন সুয়েজে (১৯৫৬) হামলা চালাতে গেলেন, তা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।"
বাংলাদেশেও খালেদা-নিজামী সরকার পাঁচ বছরের জন্য ৰমতায় বসে যে অন্যায় ও অবৈধ কাজগুলো করেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার তার অনুকরণ করে তাদের শিৰা দিতে চাইলে ভুল করবেন। সেটা হবে প্রতিশোধের রাজনীতি এবং বিএনপির অপকর্মগুলোকে অনুসরণ করে বৈধতা দান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসি দেয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া বা ঢাকা বিমানবন্দরের নাম বদল করা কোন প্রতিশোধাত্মক কাজ নয়। বরং খালেদা-নিজামী সরকারের এসব অন্যায় ও অবৈধ কাজের প্রতিকার। জনগণের দাবি ছিল এবং মহাজোটের নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতিই ছিল_ তারা খালেদা-নিজামী সরকারের অবৈধ ও অন্যায় কাজগুলো সংশোধন করবেন। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করবেন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দ- কার্যকর করে জাতিকে এই সরকার কলঙ্কমুক্ত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়ে দেশের মানুষকে দেয়া অঙ্গীকার পূরণ করতে যাচ্ছেন। এমনকি ঢাকা বিমানবন্দরের নাম বদলও প্রতিশোধ গ্রহণের কোন কাজ নয়। বিএনপির একটি একতরফা এবং অন্যায় কাজের প্রতিবিধান। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে বলতে পারেন, আমি আপনাদের কোন শিৰা দিতে চাই না। বরং আপনারা যে ভুল ও অন্যায় কাজগুলো করে গেছেন, জনগণের দাবি অনুযায়ী তার প্রতিকার করছি, পরিবর্তন আনছি। আপনারা এ কাজের বিরোধিতা না করে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করম্নন।'
এটাই হচ্ছে এ যুগের গণতন্ত্রের ভাষা। 'শিৰা দিলাম' গণতন্ত্রের ভাষা নয়। প্রধানমন্ত্রী দয়া করে এ ধরনের ভাষা পরিহার করম্নন। এ ধরনের ভাষা ব্যবহার তার সরকারের ভাল কাজগুলোরও উল্টো অর্থ দাঁড় করাবে।
লন্ডন, ২৪ ফেব্রম্নয়ারি, বুধবার ২০১০
No comments