পুলিশের পিপার স্প্রে ব্যবহার সংবিধানপরিপন্থী অপরাধ by ডক্টর তুহিন মালিক

বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অংশে ৩৫(৫) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না, কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না,
কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না। এমনকি কোনো মানুষ যদি অপরাধীও হয় এবং সেই অপরাধে আদালতে দোষী প্রমাণিত হলেও আমাদের সংবিধানে তাকে কোনোভাবেই লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা আর নিষ্ঠুর অমানুষিক দণ্ড দেয়া যাবে না।' কিন্তু কোনো প্রকার অপরাধ প্রমাণ তো দূরের কথা, এ দেশে কোনো প্রকার অভিযোগ-আদালত-মামলা-সাক্ষী-প্রমাণ অর্থাৎ কোনো রকম বিচারপ্রক্রিয়া ছাড়াই পুলিশ যখন-তখন যে কাউকে নির্বিচারে শাস্তি দিচ্ছে, তা-ও আবার লাঞ্ছনা, যন্ত্রণা আর নিষ্ঠুর অমানুষিক শাস্তি! যেখানে নিষ্ঠুর শাস্তি দেওয়াটাই সংবিধানে নিষিদ্ধ, সেখানে পুলিশের এই নিষ্ঠুর আচরণ শুধু সংবিধানপরিপন্থীই নয় বরং চরম মানবতাবিরোধী গর্হিত একটি অপরাধ।
আমাদের পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, 'আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা। যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাম্য ও স্বাধীনতার সুবিচার নিশ্চিত করিবে।' মানুষের সামাজিক সাম্য, শোষণ এবং মুক্তির কথা যে সংবিধান নিশ্চয়তা দিচ্ছে, সেখানে আমাদের পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে সংবিধানপরিপন্থী কাজ করানো যেমন মৌলিক মানবাধিকারের জন্য হুমকিস্বরূপ, তেমনি এটি রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রের জন্যও ভয়ংকর বিপজ্জনক বটে। যে রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, স্বাধীন রাষ্ট্রের নিজেদেরই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের হাতে সেই নিপীড়ন থেকে আজও আমরা মুক্তি পাইনি। ২০০ বছর আগের ইংরেজদের ঔপনিবেশিক পুলিশের মতো আমাদের স্বাধীন দেশের পুলিশ কেন একই আচরণ করবে- এটার একটা বিহিত হওয়া একান্ত জরুরি। আমাদের জাতির সব ভালো অর্জনকে এভাবে অশুভ শক্তির হাতে আর পরাস্ত হতে দিতে চাই না আমরা।
কোনো হানাদার দানবের অমানবিক আচরণকে মেনে নেওয়ার জন্য আমাদের সংবিধান, আমাদের আইন রচনা করা হয়নি। আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে তাই বলা হয়েছে, 'এই প্রজাতন্ত্র হইবে একটা গণতন্ত্র। যেখানে মৌলিক মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধার নিশ্চয়তা থাকিবে। অথচ আজকে প্রশ্ন উঠছে মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কোন পর্যায়ে দৃশ্যমান তা নিয়ে। এটাও প্রশ্ন উঠছে, কে নিশ্চিত করবে এই মূল্যবোধকে? যেখানে জাতির সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের যেভাবে পাগলা কুকুর নিধনের রাসায়নিক পদার্থ পিপার স্প্রে দিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেখানে মানুষের মর্যাদা আর মূল্যবোধ নিশ্চিতকরণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে নিশ্চিতভাবে। যাঁরা প্রতিনিয়ত জ্ঞানের আলো জ্বেলে আলোকিত করছেন জাতিকে, তাঁদের প্রতি পুলিশের এহেন অমানবিক আচরণ বর্বর যুগেও কোনো সমাজে খুব একটা দেখা যায়নি।
আসলে বহুল আলোচিত পিপার গ্যাস এক ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র। এটা মরিচের ঝাঁজযুক্ত এক প্রকার তরল গ্যাস। ভয়ংকর জীবজন্তু অথবা পাগলা কুকুরের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এটা ব্যবহার হয়ে থাকে। এতে রয়েছে ক্লোরিপিক্রিন নামে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ।
বিক্ষোভ সমাবেশ দমনে তো নয়ই, এমনকি যুদ্ধের সময়ও এটা ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। জাতিসংঘের চার্টার, সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র, আন্তর্জাতিক বিল অব রাইটস, মানুষের অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন, চুক্তি, প্রটোকল এমনকি আন্তর্জাতিক কেমিক্যাল ওয়েপন কনভেনশনের ১.৫ অনুচ্ছেদে এগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল অপশন অ্যাসেসমেন্ট (এসটিওএ) ১৯৯৮ সালে প্রণীত প্রতিবেদনে পিপার স্প্রে প্রয়োগে মৃত্যুর ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। এই ভয়ংকর মানবতাবিরোধী পিপার স্প্রে ব্যবহারে ১৯৯০ সালের পর থেকে আমেরিকাতে ৬১ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আমেরিকান সিভিল লিবারটিস ইউনিয়নের (এসিএলইউ) তথ্যমতে, ১৯৯৩ সাল থেকে পুলিশ হেফাজতে ক্যালিফোর্নিয়ায় পিপার স্প্রে প্রয়োগে ২৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ স্প্রে পিপার বা ওসি (অলিয়রিসিন ক্যাপসিকাম গ্যাস) স্প্রে হিসেবে পরিচিত। পিপার স্প্রে কারো ওপর নিক্ষেপ করলে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ধরে কষ্টদায়ক পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। শুধু সাময়িক যন্ত্রণাই নয়, চিরস্থায়ী শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, স্ট্রোকের ঝুঁকি এবং স্থায়ীভাবে ত্বক ও চোখের রোগে আক্রান্ত করতে পারে এ পিপার স্প্রে। কেবল আক্রান্ত ব্যক্তিই নন, এ স্প্রের ক্ষতিকর রাসায়নিকে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। পিপার স্প্রে ব্যবহারে ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। এটি চোখে লাগলে কর্নিয়ার ক্ষতি হতে পারে। এমনকি চোখ স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। মার্কিন সেনাবাহিনীর পৃথক দুটি গবেষণায় বলা হয়েছে, পিপার স্প্রের প্রতিক্রিয়ায় দেহে ক্যান্সারও হতে পারে। এর ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করেই প্রায় ২৫ বছর আগে এসব গ্যাস ছোড়া বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ। আন্তর্জাতিক কেমিক্যাল অস্ত্র কনভেনশন অনুযায়ী, যেকোনো বিক্ষোভ আন্দোলন দমনে এই অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ। ১৯৯৩ সালে ৮৮টি দেশের মতো বাংলাদেশও এ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। উন্নত বিশ্বে ভয়াবহ এ অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত জাতিসংঘও। আর কেবল একমত নয় আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ভয়ংকর এই কেমিক্যাল স্প্রে প্রথম ছোড়া হয়েছে বেসরকারি শিক্ষকদের ওপর। অর্থাৎ স্প্রে কার্যক্ষম কি না, তা পরীক্ষার জন্য গিনিপিগ হতে হলো শিক্ষকসমাজকে। পুলিশের এই পরীক্ষা যথারীতি সফল হলো। প্রথম ব্যবহারেই এই স্প্রেতে এক শিক্ষকের মৃত্যু ঘটে। এরপর গত ১৬ জানুয়ারি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বাম দলগুলোর ডাকা হরতালের দিনে পুলিশ এটা ব্যবহার করে। এদিন বাসদ এবং সিপিবির সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী এবং সাংবাদিক আক্রান্ত হন। নিরস্ত্র শিক্ষক, সাংবাদিক আর দুর্বল বাম দলের ওপর ভয়ংকর এই স্প্রে প্রয়োগ না করলে কি সেদিন সরকারের পতন হতো? কিংবা দেশে গুরুতর রাজনৈতিক গোলযোগে জনজীবন বিপর্যস্ত হতো? এমনটা কিন্তু এ দেশে কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে নতুন এই অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণে পুলিশের হাত পাকানোর জন্যই নিরীহ শিক্ষকদের বেছে নেওয়া হলো। প্রত্যাশা করি, আমার এ ধারণা যেন সঠিক না হয়।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, আদালত ছাড়া অন্য কারোরই এ দেশে বিচার করার কোনো অধিকার নেই। অপরাধ সংঘটিত হলে তার বিচার করবে তো আদালত। পুলিশ কখনো বিচার করতে পারবে না। শাস্তি দেওয়ার তো এ ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, পুলিশ জনগণকে পেটাচ্ছে। নিরীহ গরিব রিকশাওয়ালাদের পর্যন্ত পুলিশ দ্বারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে যত্রতত্র জনসম্মুখে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা আমাদের রাস্তায় বেরোলেই অবলোকন করতে হয়। জনগণকে কথায় কথায় মারধর, দুর্ব্যবহার, হেনস্থা করতে করতে এমনকি শাস্তি পর্যন্ত দিতে দিতে এখন পুলিশের মধ্যে একটা শাস্তি প্রদানের বর্বর মানসিকতার জন্ম হয়েছে। পুলিশের অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণে দলীয় ও সরকারি আনুকূল্য প্রদান এই অপরাধকে আরো ভয়ংকর করে তুলছে দিন দিন। পিপার স্প্রে প্রয়োগের মতো অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ এ প্রক্রিয়ারই সর্বশেষ সংস্করণ। তাই আমাদের দানবীয় পুলিশের বিপরীতে মানবীয় পুলিশের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে নিশ্চিত করতে হবে সর্বাগ্রে। পুলিশে চাকরিরত আমাদের সন্তানদের আমরা বন্ধু হিসেবেই পেতে চাই। তারা কি কখনো সাড়া দেবেন আমাদের?

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.