কালান্তরের কড়চা-বাংলাদেশে মানবতার শত্রুদের শেষ আশাও চূর্ণ হলো by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রথম রায়টি ঘোষিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। ফরিদপুরের নগরকান্দার এই কুখ্যাত অপরাধী মানবতাবিরোধী আটটি জঘন্য অপরাধের জন্য অভিযুক্ত হয়েছিল।
একটি ব্যতীত সাতটি অপরাধেই সে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। এই নরপশু এখন অবশ্য পলাতক। কিন্তু পালিয়ে থেকে সে বিচারের দণ্ড শেষ পর্যন্ত এড়াতে পারবে কি? এই রায় রাহুর মতো সর্বত্র তার পশ্চাদ্ধাবন করবে।
লক্ষ করার বিষয়, এই বাচ্চু রাজাকারও নিজ এলাকায় জামায়াত নেতা ছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের যে সংশ্লিষ্টতা ছিল, তা আদালতের বিচারের আগেই দেশবাসীর জানা থাকা সত্ত্বেও এই বিচার ঠেকানোর জন্য জামায়াত প্রচুর অর্থ ব্যয়ে সারা বিশ্বে প্রচার চালিয়ে বিশ্ববাসীর মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে এবং সেই চেষ্টা এখনো চালাচ্ছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার ঠেকানোর কাজে বিএনপির সহযোগিতা ও সমর্থন সবচেয়ে দুঃখ ও হতাশাজনক ব্যাপার। বিএনপির এই একটি মাত্র অপরাধের জন্যই ভবিষ্যতে যদি এই দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল দেশের মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয় তাহলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
ভারতে এককালে হিন্দু মহাসভা নামে একটি শক্তিশালী ও বিশাল দল ছিল। গান্ধী-হত্যায় এই দলটির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ার পর ভারতের নেহরু সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করে এবং জনগণও এই দলটিকে প্রত্যাখ্যান করায় হিন্দু মহাসভা ভারতের মাটি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য এই দলের নেতারা পরে আরএসএস, শিবসেনা ও সর্বশেষে বিজেপি গঠন করে নতুন নামে সংগঠিত হয়।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাচ্চু রাজাকারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ায় মেসেজ হলো, এই মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীরা আগেই ইতিহাসের দণ্ডে তো দণ্ডিত হয়েছেই, এখন মানুষের আদালতের রায়েও দণ্ডিত হতে যাচ্ছে। বাচ্চু রাজাকার না হয় পালিয়ে আছে, কিন্তু অন্য যেসব শীর্ষ অভিযুক্ত পালাতে চায়নি বা পালানো প্রয়োজন হবে মনে করেনি, সেই গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী প্রমুখ জামায়াতনেতা এখন বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে বসে সম্ভবত কবিতার সেই লাইনটির কথা ভাবছে, 'শেষের সেদিন বড়ই ভয়ংকর।'
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের শেষ ভরসা ছিল সৌদি আরবের চাপ, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য, তুরস্কের মতো কোনো কোনো মুসলিম দেশের সমর্থন, দেশে তাদের হতাশ কর্মীদের আন্দোলনের নামে চোরাগোপ্তা হামলা, বিএনপির মতো বড় দলের তাতে সমর্থন, ইউরোপ-আমেরিকায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রচারণা চালিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বিভ্রান্তি সৃষ্টি দ্বারা তারা হয়তো এই বিচার ব্যর্থ ও বানচাল করতে পারবে। এই প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পালের গোদারাও করেছিল। বিএনপি ক্ষমতায় বসে বহুকাল তাদের সেই বিচার ও শাস্তি ঠেকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বিচার ও দণ্ড এড়াতে পারেনি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেও আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদণ্ডাদেশ প্রমাণ করল, অবশিষ্ট বিচারাধীন পালের গোদারা অপরাধী প্রমাণিত হলে তারাও দণ্ড এড়াতে পারবে না। এখন বিচার শেষ হওয়ার অপেক্ষা মাত্র।
বাচ্চু রাজাকারের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায়ের খবর শুনে কবি ইকবালের একটি কবিতার লাইনের বাংলা তরজমা মনে পড়ছে- 'ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান।' বাচ্চু রাজাকারের দণ্ডাদেশের খবরে নিশ্চয়ই ঊর্ধ্বাকাশে ন্যায়বিচারের দণ্ডধারী (ভগবান) হাসছেন; আর কারাবন্দি শিশুঘাতী, নারীঘাতী একদল মানবতার শত্রু (শয়তান) ত্রাস ও শঙ্কায় কাঁপছে।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে দেশ, জাতি ও মানবতার বিরুদ্ধে যারা জঘন্য ও নৃশংস অপরাধ করার জন্য দায়ী, তাদের বিচার ও দণ্ড যাতে না হয়, সে জন্য দেশের একটি রাজনৈতিক দল, এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী ও মিডিয়া যে সক্রিয় হতে পারে এবং অসত্য প্রচার চালাতে পারে, তা ভেবে আমি অবাক হই। যুদ্ধাপরাধীদের এই সমর্থকরা (তাদের মধ্যে অনেকই ভাড়াটে) এক সময় যুক্তি খাড়া করেছিল, '৯০ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে (১৯৭১ সালে ধৃত, আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈন্য) ছেড়ে দিয়ে দেশের একদল মানুষকে বিচার করা কেন?'
এই গোয়েবলসীয় প্রতারণার জবাবে বলা হলো, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যেসব পাকিস্তানি সৈন্য তাদের সরকারের আদেশে যুদ্ধ করেছে এবং পরাজিত হয়ে বন্দি হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেই তারা যুদ্ধাপরাধী নয়। তারা যুদ্ধবন্দি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরও ন্যুরেমবার্গ আদালতে যুদ্ধবন্দিদের বিচার হয়নি; হয়েছে যুদ্ধের আদেশদাতা ও যুদ্ধ পরিচালনাকারী পালের গোদাদের। বাংলাদেশেও যারা স্বেচ্ছায় যুদ্ধাপরাধ করেছে, দেশ, স্বজাতি, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করেছে, মানবতার শত্রু ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বিচার ও দণ্ড হবে না, তো কাদের হবে?
এই প্রচারণায় ব্যর্থ হয়ে নতুন প্রচার শুরু করা হয়েছিল যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায়। এর একটি মাত্র জবাব হলো, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীরা অপরাধ করেছে গোটা জাতির বিরুদ্ধে, কেবল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয়। তাদের বিচার করার দায়িত্ব ছিল বিএনপি নামক দেশের বৃহত্তম দলটিরও। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে তাদের ক্ষমতায় পার্টনার করেছে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে পুনর্বাসিত করেছে। সেই বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হতেই চিৎকার শুরু করে, এই বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে বিএনপির এই 'মাসির দরদে'র আসল কারণটা কী? সেই কারণও দেশবাসীর কাছে ধরা পড়ে গেছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য আরো যেসব প্রচার ও চক্রান্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা নিয়ে আজ আর বিশদ আলোচনায় গেলাম না। সব শেষে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের প্রোপাগান্ডা ছিল, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অভিযুক্ত মানবতার শত্রুদের বিচার শেষ করতে পারবে না এবং দণ্ড দিতেও পারবে না। এই ধরনের প্রোপাগান্ডা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের সময়ও করা হয়েছিল। এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও করা হচ্ছে।
বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেওয়ায় এই প্রোপাগান্ডাকারীদের থোঁতা মুখ আরেকবার ভোঁতা হলো। বাংলাদেশের রাজনীতির সীমাবদ্ধ পরিসরে শেখ হাসিনাও যে একজন লৌহমানবী- এ কথাটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদণ্ডাদেশ দ্বারা ১৯৭১ সালের অপরাধীদের বিচার শেষে দণ্ডদানের পর্যায় শুরু হলো। এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার বাকি মেয়াদকালেই যে শীর্ষ অভিযুক্ত তথা জামায়াতের পালের গোদাদের বিচার শেষ ও দণ্ডাদেশ ঘোষিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই বিচার ও দণ্ডাদেশ যথাসময়ে শেষ হলে বর্তমান হাসিনা সরকার জাতিকে দেওয়া তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতিটি পূর্ণ করতে পারবে। যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার ও দণ্ড দ্বারা জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে, মানবতার জয় হবে। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া লাখ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে; হাজার হাজার নির্যাতিত বীরাঙ্গনা হারানো আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে পাবেন।
বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদণ্ডাদেশ ঘোষণার দিনটি অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনটি জাতিকে উপহার দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য অবশ্যই জাতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারকে অভিনন্দন জানাবে। সেই সঙ্গে স্মরণ করবে ও শ্রদ্ধা জানাবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে, যিনি বিরাট বাধা-বিপত্তির মুখে অসীম সাহসে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এই আন্দোলনের বর্তমান নেতা-কর্মীদের কাছেও মানুষ কৃতজ্ঞ এ জন্য যে সাবেক বিএনপি-জামায়াত সরকারের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হয়েও তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণ-আদালত তৈরি করেছেন, গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছেন এবং বর্তমানেও সেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আন্দোলন হাসিনা সরকারকে মানবতার শত্রুদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণে শক্তি জুগিয়েছে।
মানবতাবাদী শিবিরে কিছু কিছু দুর্বলচিত্ত মানুষ আছেন, যাঁরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, বর্তমান বিশ্বে যখন মৃত্যুদণ্ডাদেশ রহিত হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া সঠিক হচ্ছে কি? এই বক্তব্যের জবাবে বলা যায়, ১৯৭১ সালে মানবতার এই শত্রুরা হত্যা, ধর্ষণ, অগি্নকাণ্ড, নারী ও শিশু হত্যার মধ্য দিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধ করেছে, তার তুলনায় মৃত্যুদণ্ড কোনো দণ্ডই নয়। আরো বড় কোনো দণ্ড থাকলে তা দেওয়া উচিত হতো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়,
'ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।'
লন্ডন, ২১ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১৩
লক্ষ করার বিষয়, এই বাচ্চু রাজাকারও নিজ এলাকায় জামায়াত নেতা ছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের যে সংশ্লিষ্টতা ছিল, তা আদালতের বিচারের আগেই দেশবাসীর জানা থাকা সত্ত্বেও এই বিচার ঠেকানোর জন্য জামায়াত প্রচুর অর্থ ব্যয়ে সারা বিশ্বে প্রচার চালিয়ে বিশ্ববাসীর মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে এবং সেই চেষ্টা এখনো চালাচ্ছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার ঠেকানোর কাজে বিএনপির সহযোগিতা ও সমর্থন সবচেয়ে দুঃখ ও হতাশাজনক ব্যাপার। বিএনপির এই একটি মাত্র অপরাধের জন্যই ভবিষ্যতে যদি এই দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল দেশের মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয় তাহলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
ভারতে এককালে হিন্দু মহাসভা নামে একটি শক্তিশালী ও বিশাল দল ছিল। গান্ধী-হত্যায় এই দলটির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ার পর ভারতের নেহরু সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করে এবং জনগণও এই দলটিকে প্রত্যাখ্যান করায় হিন্দু মহাসভা ভারতের মাটি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য এই দলের নেতারা পরে আরএসএস, শিবসেনা ও সর্বশেষে বিজেপি গঠন করে নতুন নামে সংগঠিত হয়।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাচ্চু রাজাকারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ায় মেসেজ হলো, এই মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীরা আগেই ইতিহাসের দণ্ডে তো দণ্ডিত হয়েছেই, এখন মানুষের আদালতের রায়েও দণ্ডিত হতে যাচ্ছে। বাচ্চু রাজাকার না হয় পালিয়ে আছে, কিন্তু অন্য যেসব শীর্ষ অভিযুক্ত পালাতে চায়নি বা পালানো প্রয়োজন হবে মনে করেনি, সেই গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদী প্রমুখ জামায়াতনেতা এখন বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে বসে সম্ভবত কবিতার সেই লাইনটির কথা ভাবছে, 'শেষের সেদিন বড়ই ভয়ংকর।'
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের শেষ ভরসা ছিল সৌদি আরবের চাপ, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য, তুরস্কের মতো কোনো কোনো মুসলিম দেশের সমর্থন, দেশে তাদের হতাশ কর্মীদের আন্দোলনের নামে চোরাগোপ্তা হামলা, বিএনপির মতো বড় দলের তাতে সমর্থন, ইউরোপ-আমেরিকায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রচারণা চালিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বিভ্রান্তি সৃষ্টি দ্বারা তারা হয়তো এই বিচার ব্যর্থ ও বানচাল করতে পারবে। এই প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পালের গোদারাও করেছিল। বিএনপি ক্ষমতায় বসে বহুকাল তাদের সেই বিচার ও শাস্তি ঠেকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বিচার ও দণ্ড এড়াতে পারেনি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেও আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদণ্ডাদেশ প্রমাণ করল, অবশিষ্ট বিচারাধীন পালের গোদারা অপরাধী প্রমাণিত হলে তারাও দণ্ড এড়াতে পারবে না। এখন বিচার শেষ হওয়ার অপেক্ষা মাত্র।
বাচ্চু রাজাকারের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায়ের খবর শুনে কবি ইকবালের একটি কবিতার লাইনের বাংলা তরজমা মনে পড়ছে- 'ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান।' বাচ্চু রাজাকারের দণ্ডাদেশের খবরে নিশ্চয়ই ঊর্ধ্বাকাশে ন্যায়বিচারের দণ্ডধারী (ভগবান) হাসছেন; আর কারাবন্দি শিশুঘাতী, নারীঘাতী একদল মানবতার শত্রু (শয়তান) ত্রাস ও শঙ্কায় কাঁপছে।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে দেশ, জাতি ও মানবতার বিরুদ্ধে যারা জঘন্য ও নৃশংস অপরাধ করার জন্য দায়ী, তাদের বিচার ও দণ্ড যাতে না হয়, সে জন্য দেশের একটি রাজনৈতিক দল, এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী ও মিডিয়া যে সক্রিয় হতে পারে এবং অসত্য প্রচার চালাতে পারে, তা ভেবে আমি অবাক হই। যুদ্ধাপরাধীদের এই সমর্থকরা (তাদের মধ্যে অনেকই ভাড়াটে) এক সময় যুক্তি খাড়া করেছিল, '৯০ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে (১৯৭১ সালে ধৃত, আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈন্য) ছেড়ে দিয়ে দেশের একদল মানুষকে বিচার করা কেন?'
এই গোয়েবলসীয় প্রতারণার জবাবে বলা হলো, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যেসব পাকিস্তানি সৈন্য তাদের সরকারের আদেশে যুদ্ধ করেছে এবং পরাজিত হয়ে বন্দি হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেই তারা যুদ্ধাপরাধী নয়। তারা যুদ্ধবন্দি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরও ন্যুরেমবার্গ আদালতে যুদ্ধবন্দিদের বিচার হয়নি; হয়েছে যুদ্ধের আদেশদাতা ও যুদ্ধ পরিচালনাকারী পালের গোদাদের। বাংলাদেশেও যারা স্বেচ্ছায় যুদ্ধাপরাধ করেছে, দেশ, স্বজাতি, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করেছে, মানবতার শত্রু ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বিচার ও দণ্ড হবে না, তো কাদের হবে?
এই প্রচারণায় ব্যর্থ হয়ে নতুন প্রচার শুরু করা হয়েছিল যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায়। এর একটি মাত্র জবাব হলো, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীরা অপরাধ করেছে গোটা জাতির বিরুদ্ধে, কেবল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নয়। তাদের বিচার করার দায়িত্ব ছিল বিএনপি নামক দেশের বৃহত্তম দলটিরও। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে তাদের ক্ষমতায় পার্টনার করেছে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে পুনর্বাসিত করেছে। সেই বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হতেই চিৎকার শুরু করে, এই বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে বিএনপির এই 'মাসির দরদে'র আসল কারণটা কী? সেই কারণও দেশবাসীর কাছে ধরা পড়ে গেছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য আরো যেসব প্রচার ও চক্রান্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা নিয়ে আজ আর বিশদ আলোচনায় গেলাম না। সব শেষে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের প্রোপাগান্ডা ছিল, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অভিযুক্ত মানবতার শত্রুদের বিচার শেষ করতে পারবে না এবং দণ্ড দিতেও পারবে না। এই ধরনের প্রোপাগান্ডা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের সময়ও করা হয়েছিল। এবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও করা হচ্ছে।
বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেওয়ায় এই প্রোপাগান্ডাকারীদের থোঁতা মুখ আরেকবার ভোঁতা হলো। বাংলাদেশের রাজনীতির সীমাবদ্ধ পরিসরে শেখ হাসিনাও যে একজন লৌহমানবী- এ কথাটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদণ্ডাদেশ দ্বারা ১৯৭১ সালের অপরাধীদের বিচার শেষে দণ্ডদানের পর্যায় শুরু হলো। এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার বাকি মেয়াদকালেই যে শীর্ষ অভিযুক্ত তথা জামায়াতের পালের গোদাদের বিচার শেষ ও দণ্ডাদেশ ঘোষিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই বিচার ও দণ্ডাদেশ যথাসময়ে শেষ হলে বর্তমান হাসিনা সরকার জাতিকে দেওয়া তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতিটি পূর্ণ করতে পারবে। যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচার ও দণ্ড দ্বারা জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে, মানবতার জয় হবে। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া লাখ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে; হাজার হাজার নির্যাতিত বীরাঙ্গনা হারানো আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে পাবেন।
বাচ্চু রাজাকারের প্রাণদণ্ডাদেশ ঘোষণার দিনটি অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনটি জাতিকে উপহার দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য অবশ্যই জাতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারকে অভিনন্দন জানাবে। সেই সঙ্গে স্মরণ করবে ও শ্রদ্ধা জানাবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে, যিনি বিরাট বাধা-বিপত্তির মুখে অসীম সাহসে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এই আন্দোলনের বর্তমান নেতা-কর্মীদের কাছেও মানুষ কৃতজ্ঞ এ জন্য যে সাবেক বিএনপি-জামায়াত সরকারের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হয়েও তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণ-আদালত তৈরি করেছেন, গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছেন এবং বর্তমানেও সেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আন্দোলন হাসিনা সরকারকে মানবতার শত্রুদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণে শক্তি জুগিয়েছে।
মানবতাবাদী শিবিরে কিছু কিছু দুর্বলচিত্ত মানুষ আছেন, যাঁরা যুক্তি দেখাচ্ছেন, বর্তমান বিশ্বে যখন মৃত্যুদণ্ডাদেশ রহিত হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া সঠিক হচ্ছে কি? এই বক্তব্যের জবাবে বলা যায়, ১৯৭১ সালে মানবতার এই শত্রুরা হত্যা, ধর্ষণ, অগি্নকাণ্ড, নারী ও শিশু হত্যার মধ্য দিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধ করেছে, তার তুলনায় মৃত্যুদণ্ড কোনো দণ্ডই নয়। আরো বড় কোনো দণ্ড থাকলে তা দেওয়া উচিত হতো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়,
'ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।'
লন্ডন, ২১ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১৩
No comments