শ্রদ্ধাঞ্জলি- মাদার বখ্শ by ড. তসিকুল ইসলাম রাজা
রাজশাহীতে সমাজসেবার পটভূমিকায় অন্যতম পথিকৃৎ, রাজনৈতিক অঙ্গনে আপোসহীন ব্যক্তিত্ব, উত্তরাঞ্চলে শিা বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রধানতম অগ্রদূত ও মানবপ্রেমিক জননেতা মাদার বখ্শ একটি নাম একটি ইতিহাস।
আমরা জানি, প্রতিটি মানুষ তার নিজ জীবনকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। কিন্তু ব্যতিক্রমধর্মী দেশনন্দিত মানুষ যারা, তারা তাঁদের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ খুঁজে পান। এমনি ধরনের একজন নিবেদিতপ্রাণ, মহৎ ও হৃদয়বান মানুষ ছিলেন সমাজসেবক যশস্বী আইনজীবী জননেতা মাদার বখ্শ।নিভৃত পল্লী অঞ্চলের অজ পাড়াগায়ে জন্মগ্রহণ করেও নিজের অবিচল শ্রম, সাধনা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা সমাজ ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন স্তরে কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় তার উজ্জ্বল নিদর্শন মাদার বখ্শের সংগ্রামী জীবন।
তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিার আলো ছাড়া চির অবহেলিত পশ্চাৎপদ রাজশাহী তথা উত্তরাঞ্চলের মানুষকে জাগরণের গান শুনানো যাবে না। আর তাই তিনি আমাদের মৌলিক অধিকার আদায়ের ল্যে আধুনিক শিা গ্রহণ করে প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শিা ছাড়া কোন জাতির মুক্তি নেই এবং শিাই জাতির মেরুদণ্ড_ এই চিন্তা-চেতনায় লালিত জীবনবোধকে সামনে রেখে তাঁরই ঐকান্তিক আগ্রহ ও নায়কত্বে উত্তরবঙ্গ-দণিবঙ্গ অর্থাৎ রাজশাহী বিভাগ ও খুলনা বিভাগের একমাত্র উচ্চ শিার পাদপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষের অবদান রয়েছে। তবে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজের তৎকালীন অধ্য ডক্টর ইতরাৎ হোসেন জুবেরীর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। তিনি ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই এই পদে যোগদান করেন।
মাদার বখ্শ শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেই ান্ত হননি, রাজশাহীতে আরও বেশ কয়েকটি শিা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৫৪ সালে রাজশাহী শহরের পশ্চিম উপকণ্ঠে সোবহানিয়া হাই স্কুল (বর্তমানে তা রাজশাহী কোর্ট একাডেমী নামে পরিচিত), ১৯৬০ সালে লক্ষ্মীপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় তাঁরই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর রাজশাহী মুসলিম হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ১৯৬৭ সালে তাঁর জীবনের শেষ প্রচেষ্টার ফসল রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
মাদার বখ্শের প্রস্তাবক্রমে রাজশাহী শহরে ১৯৪৯ সালে সর্বপ্রথম চিকিৎসা সেবাদানের নিমিত্তে একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলটি সরকার ১৯৫৫ সালে গ্রহণ করার পর ১৯৫৮ সালে তা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পরিণত হয়। তিনি ১৯৫০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৪ সালের ২২ জুন পর্যন্ত রাজশাহী পৌর সভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অকান্ত শ্রম ও সাধনায় পৌর সভার তৎকালীন সীমিত আয় দিয়েই পৌর এলাকার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তিনিই প্রথম ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী নিউমার্কেট নির্মাণে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে সর্বপ্রথম রাজশাহী শহরে রিক্সা চালু করেন এবং তিনি প্রথম সুইপারদের রেশন প্রদানসহ বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। এসব ছাড়াও শাহ মখদুম ইন্সটিটিউট, মুসলিম গোরস্থান কমিটি, রিফু্যজিদের বাসস্থান ব্যবস্থা, পদ্মার বাঁধ নির্মাণ (পুল সংস্কার) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অসামান্য অবদান ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে।
মাদার বখশ ১৯০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) সিংড়া থানার স্থাপনদীঘি নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯২২ সালে সিংড়ার চৌগ্রাম উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণীতে ম্যাট্রিক, রাজশাহী কলেজ হতে ১৯২৪ সালে আইএ, ১৯২৬ সালে বিএ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯২৮ সালে ইতিহাসে এমএ এবং কলকাতা রিপন কলেজ হতে ১৯২৯ সালে বিএল ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি রাজশাহী জেলার পোরসার হাই মাদ্রাসায় এবং মুর্শিদাবাদের সালার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিকতা করেন। দুই বছর শিকতার পর তিনি ১৯৩৪ সালে রাজশাহী জজকোর্টে আইন ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন।
তিনি ১৯৪৬ সালে আত্রাই, বাগমারা ও মান্দা থানার নির্বাচনী এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ আইন সভার সদস্য ছিলেন। সেই সময় উত্তরাঞ্চলের জনগণের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ ও বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে তিনি সর্বপ্রথম উত্তরবঙ্গ প্রদেশ গঠনের আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। তাই ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সম্মতিদানে তিনি সরকারকে বাধ্য করেছিলেন।
তাঁর জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্মরণীয় ঘটনা হলো ঢাকায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে ছাত্র জনতার মিছিলে মুসলিম লীগ সরকার কতর্ৃক গুলিবর্ষণের নিন্দা ও তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি।
তাঁর সংগ্রামী জীবন ও প্রতিভার মূল্যায়ন করতে গিয়ে তারই প্রিয় বন্ধু প্রখ্যাত পণ্ডিত ও গবেষক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক ১৯৭৮ সালে এই নিবন্ধ লেখককে এক পত্রে জানান যে, 'মাদার বখশ ছিলেন আমার কলকাতার কারমাইকেল ছাত্রাবাসের এককী বন্ধু (উদলব)। তিনি পড়তেন ইতিহাস ও আইন আর আমি পড়তাম বাংলা সাহিত্য। বন্ধুত্ব ছিল গলায় গলায়। আমি হব শিক আর তিনি হবেন উকিল তা কখনও ভাবিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাপি্নক ও শ্রষ্ঠা, চলনবিল আমাদের অকান্ত কমর্ী, উত্তরবঙ্গ প্রদেশ গঠনের ভাবুক, মিউনিসিপ্যালিটি পরিচালনার মধ্য দিয়ে নিবেদিতপ্রাণ জনসেবক মাদার বখ্শ পশ্চাতে মহিমার রথ রেখে সম্মুখ পানে চলে গেছেন। তাঁর ওপর আল্লার করুণা বর্ষিত হোক'।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান ১৯৮১ সালে মাদার বখ্শ স্মৃতি পদক প্রদান উপল েপ্রকাশিত স্মরণিকায় এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, 'মাদার বখ্শের মতো এরকম মহাপুরুষ আরও পাঁচজন হলে দেশের অনেক অভাব পূর্ণ হতো, শিল্প সংস্কৃতির ত্রে অনেক উপকৃত হতো এবং গুণী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সমাজসেবীদের মর্যাদা হতো। দেশের শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতির েেত্র নতুন কিছু অনুভব করতে পারতাম'।
রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষের পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রাণপ্রিয় মানুষ এবং মূলত শিা বিস্তারের েেত্র অন্যতম অগ্রদূত, দেশনন্দিত সমাজসেবক, জননেতা মাদার বখ্শ দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬৭ সালের ২০ জানুয়ারি (৬ মাঘ ১৩৭৩) শুক্রবার বিকেল ৩টায় পরলোকগমন করেন।
মাদার বখ্শের একমাত্র কন্যা বেগম মনোয়ারা রহমান (রাজশাহী মহিলা শিল্প প্রতিষ্ঠানের সম্পাদিকা) পিতার আদর্শকে সামনে রেখে এবং স্বামী প্রখ্যাত রাজনীতিক ও বাংলাদেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার অন্যতম পথিকৃৎ জননেতা এম আতাউর রহমানের অনুপ্রেরণাকে সঞ্চয় করে সমাজ সেবার পটভূমিকায় অসুস্থ শরীরে নিবেদিতপ্রাণ কমর্ী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। পিতার মতোই তাঁর নিরলস শ্রম ও সাধনা সুধীমহলে প্রশংসার দাবি রাখে।
ণজন্মা পুরুষ মাদার বখ্শের আদর্শমণ্ডিত অনুকরণীয় জীবন ও সাধনা বিষয়ে রাজশাহীসহ জাতীয় পর্যায়ে আরও মূল্যায়ন হোক এবং তাঁর সম্পর্কে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণের জন্য তাঁরই প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিকবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পরিশেষে সৎ, সংগ্রামী ও আপোসহীন জননেতা মাদার বখ্শের কৃতিময় সাফল্যমণ্ডিত জীবন ও সাধনা আজকের রাজনীতিবিদ ও তরুণ ছাত্র সমাজের জীবন চলার পথে পাথেয় এবং অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস হোক_ আজ এই মাত্র প্রার্থনা।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত অধ্য, শাহ মখদুম কলেজ, রাজশাহী
No comments