সাক্ষাৎকার-প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও নীতি ধনীদের পক্ষে by ড. মুহাম্মদ ইউনূস
অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি নোবেল বিজয়ী। ক্ষুদ্রঋণ ধারণার এই প্রবর্তক 'ব্যাংকার অব দ্য পুওর' হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি র্যামন ম্যাগসেসে পদক (১৯৮৪), স্বাধীনতা পদক (১৯৮৭), বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ (১৯৯৪) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় ড. ইউনূস ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। ১৯৭২ সালে তিনি সেখানে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন। ১৯৬৯ থেকে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করতেন। চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ১৯৬৫ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম ১৯৪০ সালে ওই জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে। সম্প্রতি নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে জিয়ানু অধিকারী মুহাম্মদ ইউনূসের এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সোমবারের কাঠমান্ডু পোস্ট থেকে
ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর শেখ রোকন
কাঠমান্ডু পোস্ট :কী উপলক্ষে কাঠমান্ডুতে আপনার আগমন?
মুহাম্মদ ইউনূস :আমি এখানে এসেছি একটি সামাজিক ব্যবসা তহবিলের উদ্বোধন করতে। যাকে আমি সামাজিক ব্যবসা বলছি, যে বিষয়ে আমি এখন খুবই আগ্রহী, সেটা হচ্ছে_ সংকট মোচনের জন্য ব্যবসা; নিছক অর্থ কামানোর জন্য নয়। আজকের বিশ্বে, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থায় ব্যবসা হচ্ছে মুনাফাকেন্দ্রিক। প্রত্যেকে পয়সা কামানোর জন্য ছুটছে। মানুষ অর্থের প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
কাঠমান্ডু পোস্ট : এ জন্যই আপনি মুনাফাহীন বা নন-প্রফিট ব্যবসার কথা বলছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস :এ ব্যবসাতেও মুনাফা আছে। কোম্পানি মুনাফা করে; কিন্তু মালিকরা এই মুনাফা নিজের ঘরে নিতে আগ্রহী নয়। ওই মুনাফা আবার ব্যবসাতেই পুনর্বিনিয়োগ হয়। এ ব্যবসায় ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্য থাকে না। যে জনগোষ্ঠীর জন্য আপনি কাজ করছেন, তাদের কল্যাণই হচ্ছে মুখ্য। ফলে যে কোনোখানেই এটা শুরু করা যেতে পারে। বাংলাদেশ, ভারত, জার্মানি, জাপান, ব্রাজিলে এখন সামাজিক ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছে।
কাঠমান্ডু পোস্ট :ঠিক কী ধরনের পণ্য বা সেবা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে আপনি বিক্রি করতে চান_ এ ব্যাপারে কি আমাদের ধারণা দিতে পারেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:যেমন ধরুন, বাংলাদেশে আমরা বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিক্রির জন্য একটি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলেছি। কারণ আমাদের গ্রামাঞ্চলে (পর্যাপ্ত) বিদ্যুৎ নেই।
কাঠমান্ডু পোস্ট :একই ধরনের ব্যবসা কি নেপালেও চালু করা যেতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস :আপনি যখন এক দেশে এটা চালু করেন, তখন অন্যান্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য। এটা অভিন্ন ব্যবস্থা। বিশ্বের সব সমস্যাই এক ধরনের_ যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ বা নেপাল; আপনি যে দেশের কথাই বলুন না কেন।
কাঠমান্ডু পোস্ট :কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যদি কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকে, সরকার সে পর্যন্ত বৈদ্যুতিক গ্রিড ব্যবস্থা পেঁৗছে দেয়। আপনি কি মনে করেন যে, নেপাল ও বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্র সমাধানের দিকে না গিয়ে বরং আমাদেরও লক্ষ্য হওয়া উচিত গ্রামাঞ্চলে বরং বৈদ্যুতিক গ্রিডই সম্প্রসারিত করা?
মুহাম্মদ ইউনূস : গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিক গ্রিড সম্প্রসারণের বিরোধিতা করছি না আমরা। কিন্তু যেহেতু বিদ্যুৎ সংযোগ সর্বত্র নেই, আপনি যদি বলেন যে এটা কোনো একদিন আসবে; তাহলে সেটা আসতে আসতে আমার জীবনও পার হয়ে যেতে পারে। আমি এখনই একটা সমাধান দেখতে চাই। এ ছাড়া আপনি যখন বিদ্যুতের জন্য জাতীয় গ্রিডের কথা বলছেন, আপনি তখন কিন্তু জৈব-জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের কথা বলছেন। তার বদলে আমি যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে এটা জলবায়ুর জন্য সুবিধাজনক হবে। সুতরাং সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে আমি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার জন্যও কাজ করে যাচ্ছি। আমি তো মনে করি, কাঠমান্ডুতেও পরিবর্তন হওয়া উচিত। বর্তমান বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বদলে সৌরবিদ্যুতের দিকে যাওয়া দরকার।
কাঠমান্ডু পোস্ট :ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে উদ্ভাবনীর জন্য আপনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এ ব্যবস্থা সম্পর্কে কি আমাদের বলবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস :প্রথম কথা হচ্ছে, (প্রচলিত) আর্থিক ব্যবস্থা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে না। তারা কোনো ব্যাংকে গিয়ে ঋণ পায় না। এ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে তাদের জন্য, যাদের আগে থেকে অনেক অর্থ রয়েছে। আমাদের দরকার ছিল এমন একটি ব্যবস্থার, যা গরিবের জন্য প্রযোজ্য। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে তারা ঋণ নিতে পারে এবং একটি ব্যবসা শুরু করতে পারে। এই ঋণ ব্যবস্থা স্বকর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি করে। আমি যদি কোথাও কাজ না পাই, তাহলে নিজেই নিজের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারি। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমি একটি ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারি। তার মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। নারীদের জন্য এ ঋণ ব্যবস্থা চমৎকারভাবে কাজ করে। কারণ এ ব্যবস্থায় তাকে কারখানায় যেতে হয় না; তাকে শহরে যেতে হয় না। শহরে যাওয়া একজন নারীর জন্য কঠিন ব্যাপার। তিনি বাড়িতেই অবস্থান করেন এবং মুরগি পালন, নকশিকাঁথার মতো হস্তশিল্পের কাজ করে তা বিক্রি করতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নও হয়। এগুলো হচ্ছে ইতিবাচক দিক। কিন্তু ফাঁকটা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার এখনও ক্ষুদ্রঋণকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। উপযুক্ত বিধিবিধান তৈরি করছে না। ফলে অনেক সময় ক্ষুদ্রঋণের ধারণার অপব্যবহার হয় এবং কিছু মানুষ এটাকে নিজেদের অর্থ বানানোর জন্য ব্যবহার করে।
কাঠমান্ডু পোস্ট :বৃহৎ ব্যাংকগুলো কি ক্ষুদ্রঋণের ব্যাপারে আগ্রহী?
মুহাম্মদ ইউনূস :বৃহৎ ও প্রচলিত ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে একেবারে আগ্রহী নয়। তারা কখনও কখনও ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দু'চার কথা বলে; কিন্তু বাস্তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সেবা দেয় না। নেপালের একজন গরিব মানুষ কোনো ব্যাংকে গিয়ে ঋণ নিতে পারে না।
কাঠমান্ডু পোস্ট : কত সময় পর ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক ব্যবসা বৃহৎ ব্যবসায় পরিণত হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস :এর উত্তর নির্ভর করছে আপনি 'বৃহৎ' বলতে কী বোঝাচ্ছেন। যদি আপনি কয়েক মিলিয়ন রুপি বুঝিয়ে থাকেন_ না, ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক ব্যবসা কখনোই ওই আকার ধারণ করবে না। এ ব্যবসা শুরু হয় মাত্র দুই-তিন হাজার টাকা দিয়ে। ১০ হাজার তাদের জন্য একটা বড় সংখ্যা। ৫০ হাজার হচ্ছে তাদের জন্য চমৎকার অগ্রগতির লক্ষণ। এই হচ্ছে ব্যাপার। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এগুলো বড় অঙ্ক; কিন্তু ধনী ব্যক্তিদের জন্য এটা এখনও সামান্য সংখ্যা ছাড়া কিছু নয়।
কাঠমান্ডু পোস্ট :আপনি কি মনে করেন, ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি স্থায়ী সমাধান?
মুহাম্মদ ইউনূস :সামাজিক বৈষম্য তো একটি বিরাট ইস্যু। কারণ সব প্রতিষ্ঠান ও নীতি ধনীদের সমর্থন করে থাকে। ধনীরা সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পায়। ফলে দারিদ্র্য থেকে অদারিদ্র্যে উত্তরণের যে গতি; ধনীদের গতি তার থেকে বেশি। দরিদ্রদের ক্ষেত্রে তাদের সামর্থ্য শ্লথ, তাদের গতি শ্লথ। তাদের সুযোগ-সুবিধার গতিও শ্লথ। যতদিন পর্যন্ত গরিবের গতি শ্লথ থাকবে এবং ধনীদের গতি উচ্চ থাকবে; দুই জনগোষ্ঠীর ব্যবধান বাড়তেই থাকবে।
এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয়_ আমি আপনাকে বলব না যে, শীর্ষ জনগোষ্ঠীর যে গতি রয়েছে, সেটাকে থামিয়ে দিন। কারণ গোটা অর্থনীতির জন্য ওই গতি প্রয়োজন। কিন্তু আমরা কি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারি না? যাতে তারা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে? ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান আরও প্রসারিত হওয়া উচিত নয়। আর এটা কমাতে আপনার অনেক কিছু প্রয়োজন হবে_ প্রযুক্তি, প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ব্যবসা ইত্যাদি।
কাঠমান্ডু পোস্ট :বিষয় পরিবর্তন করি। জীবনের এক পর্যায়ে আপনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন। আপনি কি মনে করেন, ক্ষুদ্র-সমাধান সাধারণ মানুষকে বেশি বিরাজনৈতিক করে তোলে? কারণ এর মধ্য দিয়ে যে সমাধান পাওয়া যায়, তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকতে সহায়তা করে; কিন্তু প্রকৃত অর্থে সমাজকে আরও বৈষম্যহীন করে তোলে না। কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি যেমন অভিযোগ করে থাকেন_ এটা কি রাজনীতিবিরোধী কোনো ব্যবস্থা?
মুহাম্মদ ইউনূস :মানুষ কেন রাজনীতিতে আগ্রহী হয়? আপনাকে সেই কারণ খুঁজে বের করতে হবে। আমি রাজনীতিতে আগ্রহী হয়েছিলাম। কারণ আমি সরকারের মাধ্যমে কিছু করতে চেয়েছিলাম। আমি যত অগ্রগতি লাভ করি, আমি ততই আমার সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হই এবং (রাজনীতিতে) আরও বেশি জড়িত হই। কিন্তু আপনি যখন খুবই দরিদ্র, আমার মধ্যে এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা আসে যে, ভাগ্যের দোষেই আপনি গরিব। আপনার জন্য শিক্ষা ও অর্থের যত ব্যবস্থা করা হবে, আপনি ততই সচেতন হবেন। ক্ষুদ্রঋণ মানুষকে রাজনীতির ব্যাপারে নির্লিপ্ত করে তোলে_ এ কথা আমার কাছে সঠিক মনে হয় না। আমি যত তৎপর হবো, ততই জানব যে, আমি আরও বেশি কাজ করতে পারি।
কাঠমান্ডু পোস্ট :আপনি কি (এ কারণেই) রাজনীতি করার কথা বিবেচনা করেছিলেন?
মুহাম্মদ ইউনূস : হ্যাঁ। কিন্তু সেটা খুবই ভিন্ন পরিস্থিতিতে। মনে রাখবেন, ২০০৭-০৮ সাল বাংলাদেশের জন্য খুবই ভয়াবহ সময় ছিল। তখন আমাদের দেশে সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। সব রাজনীতিক জেলে ছিলেন। আর নেতারা জেলে থাকার কারণে রাজনৈতিক দলগুলো অকার্যকর ছিল। তার ওপর আবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা চলছিল। সাধারণ মানুষ বলছিল, এটা কেমন ধরনের পরিস্থিতি! রাজনৈতিক দল যদি না থাকে, মানুষ নির্বাচন দিয়ে কী করবে? রাজনৈতিক দল হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান। আপনি যদি এটা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাধারণ মানুষ যদি আপনার ওপর ভরসা করে, নির্বাচনে তারা ওই দলের জন্য ভোট দেবে। ফলে অনেক চাপের পর_ কারণ আমি রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলাম না_ আমি হ্যাঁ বলেছিলাম। কারণ মানুষ আমাকে দোষারোপ করছিল যে, আমি তাদের সমস্যার প্রতি নজর দিচ্ছি না।
কাঠমান্ডু পোস্ট :সাম্প্রতিককালে নেপালে 'নিরপেক্ষ' প্রধানমন্ত্রী নিয়ে কথা হচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মধ্য থেকে কাউকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে একমত হতে পারছে না। এটাকে কি ভালো ধারণা বলে মনে করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস : এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হতে পারে। বাংলাদেশে এর মেয়াদ ছিল ৯০ দিন। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান। কারণ আমরা স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে রাজনীতিকদের ওপর ভরসা করতে পারছিলাম না। আবার এটাও বলে রাখা দরকার, অরাজনৈতিক ব্যক্তি বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হওয়ার ধারণা ভালো নয়। দেশ চালাতে আপনাদের দরকার একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি।
ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর শেখ রোকন
কাঠমান্ডু পোস্ট :কী উপলক্ষে কাঠমান্ডুতে আপনার আগমন?
মুহাম্মদ ইউনূস :আমি এখানে এসেছি একটি সামাজিক ব্যবসা তহবিলের উদ্বোধন করতে। যাকে আমি সামাজিক ব্যবসা বলছি, যে বিষয়ে আমি এখন খুবই আগ্রহী, সেটা হচ্ছে_ সংকট মোচনের জন্য ব্যবসা; নিছক অর্থ কামানোর জন্য নয়। আজকের বিশ্বে, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থায় ব্যবসা হচ্ছে মুনাফাকেন্দ্রিক। প্রত্যেকে পয়সা কামানোর জন্য ছুটছে। মানুষ অর্থের প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
কাঠমান্ডু পোস্ট : এ জন্যই আপনি মুনাফাহীন বা নন-প্রফিট ব্যবসার কথা বলছেন?
মুহাম্মদ ইউনূস :এ ব্যবসাতেও মুনাফা আছে। কোম্পানি মুনাফা করে; কিন্তু মালিকরা এই মুনাফা নিজের ঘরে নিতে আগ্রহী নয়। ওই মুনাফা আবার ব্যবসাতেই পুনর্বিনিয়োগ হয়। এ ব্যবসায় ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্য থাকে না। যে জনগোষ্ঠীর জন্য আপনি কাজ করছেন, তাদের কল্যাণই হচ্ছে মুখ্য। ফলে যে কোনোখানেই এটা শুরু করা যেতে পারে। বাংলাদেশ, ভারত, জার্মানি, জাপান, ব্রাজিলে এখন সামাজিক ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছে।
কাঠমান্ডু পোস্ট :ঠিক কী ধরনের পণ্য বা সেবা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে আপনি বিক্রি করতে চান_ এ ব্যাপারে কি আমাদের ধারণা দিতে পারেন?
মুহাম্মদ ইউনূস:যেমন ধরুন, বাংলাদেশে আমরা বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিক্রির জন্য একটি সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলেছি। কারণ আমাদের গ্রামাঞ্চলে (পর্যাপ্ত) বিদ্যুৎ নেই।
কাঠমান্ডু পোস্ট :একই ধরনের ব্যবসা কি নেপালেও চালু করা যেতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস :আপনি যখন এক দেশে এটা চালু করেন, তখন অন্যান্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য। এটা অভিন্ন ব্যবস্থা। বিশ্বের সব সমস্যাই এক ধরনের_ যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ বা নেপাল; আপনি যে দেশের কথাই বলুন না কেন।
কাঠমান্ডু পোস্ট :কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যদি কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকে, সরকার সে পর্যন্ত বৈদ্যুতিক গ্রিড ব্যবস্থা পেঁৗছে দেয়। আপনি কি মনে করেন যে, নেপাল ও বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্র সমাধানের দিকে না গিয়ে বরং আমাদেরও লক্ষ্য হওয়া উচিত গ্রামাঞ্চলে বরং বৈদ্যুতিক গ্রিডই সম্প্রসারিত করা?
মুহাম্মদ ইউনূস : গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিক গ্রিড সম্প্রসারণের বিরোধিতা করছি না আমরা। কিন্তু যেহেতু বিদ্যুৎ সংযোগ সর্বত্র নেই, আপনি যদি বলেন যে এটা কোনো একদিন আসবে; তাহলে সেটা আসতে আসতে আমার জীবনও পার হয়ে যেতে পারে। আমি এখনই একটা সমাধান দেখতে চাই। এ ছাড়া আপনি যখন বিদ্যুতের জন্য জাতীয় গ্রিডের কথা বলছেন, আপনি তখন কিন্তু জৈব-জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের কথা বলছেন। তার বদলে আমি যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে এটা জলবায়ুর জন্য সুবিধাজনক হবে। সুতরাং সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে আমি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার জন্যও কাজ করে যাচ্ছি। আমি তো মনে করি, কাঠমান্ডুতেও পরিবর্তন হওয়া উচিত। বর্তমান বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বদলে সৌরবিদ্যুতের দিকে যাওয়া দরকার।
কাঠমান্ডু পোস্ট :ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে উদ্ভাবনীর জন্য আপনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এ ব্যবস্থা সম্পর্কে কি আমাদের বলবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস :প্রথম কথা হচ্ছে, (প্রচলিত) আর্থিক ব্যবস্থা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে না। তারা কোনো ব্যাংকে গিয়ে ঋণ পায় না। এ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে তাদের জন্য, যাদের আগে থেকে অনেক অর্থ রয়েছে। আমাদের দরকার ছিল এমন একটি ব্যবস্থার, যা গরিবের জন্য প্রযোজ্য। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে তারা ঋণ নিতে পারে এবং একটি ব্যবসা শুরু করতে পারে। এই ঋণ ব্যবস্থা স্বকর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি করে। আমি যদি কোথাও কাজ না পাই, তাহলে নিজেই নিজের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারি। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমি একটি ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারি। তার মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। নারীদের জন্য এ ঋণ ব্যবস্থা চমৎকারভাবে কাজ করে। কারণ এ ব্যবস্থায় তাকে কারখানায় যেতে হয় না; তাকে শহরে যেতে হয় না। শহরে যাওয়া একজন নারীর জন্য কঠিন ব্যাপার। তিনি বাড়িতেই অবস্থান করেন এবং মুরগি পালন, নকশিকাঁথার মতো হস্তশিল্পের কাজ করে তা বিক্রি করতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নও হয়। এগুলো হচ্ছে ইতিবাচক দিক। কিন্তু ফাঁকটা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার এখনও ক্ষুদ্রঋণকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। উপযুক্ত বিধিবিধান তৈরি করছে না। ফলে অনেক সময় ক্ষুদ্রঋণের ধারণার অপব্যবহার হয় এবং কিছু মানুষ এটাকে নিজেদের অর্থ বানানোর জন্য ব্যবহার করে।
কাঠমান্ডু পোস্ট :বৃহৎ ব্যাংকগুলো কি ক্ষুদ্রঋণের ব্যাপারে আগ্রহী?
মুহাম্মদ ইউনূস :বৃহৎ ও প্রচলিত ব্যাংকগুলো এ ব্যাপারে একেবারে আগ্রহী নয়। তারা কখনও কখনও ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দু'চার কথা বলে; কিন্তু বাস্তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সেবা দেয় না। নেপালের একজন গরিব মানুষ কোনো ব্যাংকে গিয়ে ঋণ নিতে পারে না।
কাঠমান্ডু পোস্ট : কত সময় পর ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক ব্যবসা বৃহৎ ব্যবসায় পরিণত হতে পারে?
মুহাম্মদ ইউনূস :এর উত্তর নির্ভর করছে আপনি 'বৃহৎ' বলতে কী বোঝাচ্ছেন। যদি আপনি কয়েক মিলিয়ন রুপি বুঝিয়ে থাকেন_ না, ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক ব্যবসা কখনোই ওই আকার ধারণ করবে না। এ ব্যবসা শুরু হয় মাত্র দুই-তিন হাজার টাকা দিয়ে। ১০ হাজার তাদের জন্য একটা বড় সংখ্যা। ৫০ হাজার হচ্ছে তাদের জন্য চমৎকার অগ্রগতির লক্ষণ। এই হচ্ছে ব্যাপার। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এগুলো বড় অঙ্ক; কিন্তু ধনী ব্যক্তিদের জন্য এটা এখনও সামান্য সংখ্যা ছাড়া কিছু নয়।
কাঠমান্ডু পোস্ট :আপনি কি মনে করেন, ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি স্থায়ী সমাধান?
মুহাম্মদ ইউনূস :সামাজিক বৈষম্য তো একটি বিরাট ইস্যু। কারণ সব প্রতিষ্ঠান ও নীতি ধনীদের সমর্থন করে থাকে। ধনীরা সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পায়। ফলে দারিদ্র্য থেকে অদারিদ্র্যে উত্তরণের যে গতি; ধনীদের গতি তার থেকে বেশি। দরিদ্রদের ক্ষেত্রে তাদের সামর্থ্য শ্লথ, তাদের গতি শ্লথ। তাদের সুযোগ-সুবিধার গতিও শ্লথ। যতদিন পর্যন্ত গরিবের গতি শ্লথ থাকবে এবং ধনীদের গতি উচ্চ থাকবে; দুই জনগোষ্ঠীর ব্যবধান বাড়তেই থাকবে।
এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয়_ আমি আপনাকে বলব না যে, শীর্ষ জনগোষ্ঠীর যে গতি রয়েছে, সেটাকে থামিয়ে দিন। কারণ গোটা অর্থনীতির জন্য ওই গতি প্রয়োজন। কিন্তু আমরা কি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারি না? যাতে তারা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে? ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান আরও প্রসারিত হওয়া উচিত নয়। আর এটা কমাতে আপনার অনেক কিছু প্রয়োজন হবে_ প্রযুক্তি, প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ব্যবসা ইত্যাদি।
কাঠমান্ডু পোস্ট :বিষয় পরিবর্তন করি। জীবনের এক পর্যায়ে আপনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন। আপনি কি মনে করেন, ক্ষুদ্র-সমাধান সাধারণ মানুষকে বেশি বিরাজনৈতিক করে তোলে? কারণ এর মধ্য দিয়ে যে সমাধান পাওয়া যায়, তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকতে সহায়তা করে; কিন্তু প্রকৃত অর্থে সমাজকে আরও বৈষম্যহীন করে তোলে না। কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি যেমন অভিযোগ করে থাকেন_ এটা কি রাজনীতিবিরোধী কোনো ব্যবস্থা?
মুহাম্মদ ইউনূস :মানুষ কেন রাজনীতিতে আগ্রহী হয়? আপনাকে সেই কারণ খুঁজে বের করতে হবে। আমি রাজনীতিতে আগ্রহী হয়েছিলাম। কারণ আমি সরকারের মাধ্যমে কিছু করতে চেয়েছিলাম। আমি যত অগ্রগতি লাভ করি, আমি ততই আমার সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হই এবং (রাজনীতিতে) আরও বেশি জড়িত হই। কিন্তু আপনি যখন খুবই দরিদ্র, আমার মধ্যে এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা আসে যে, ভাগ্যের দোষেই আপনি গরিব। আপনার জন্য শিক্ষা ও অর্থের যত ব্যবস্থা করা হবে, আপনি ততই সচেতন হবেন। ক্ষুদ্রঋণ মানুষকে রাজনীতির ব্যাপারে নির্লিপ্ত করে তোলে_ এ কথা আমার কাছে সঠিক মনে হয় না। আমি যত তৎপর হবো, ততই জানব যে, আমি আরও বেশি কাজ করতে পারি।
কাঠমান্ডু পোস্ট :আপনি কি (এ কারণেই) রাজনীতি করার কথা বিবেচনা করেছিলেন?
মুহাম্মদ ইউনূস : হ্যাঁ। কিন্তু সেটা খুবই ভিন্ন পরিস্থিতিতে। মনে রাখবেন, ২০০৭-০৮ সাল বাংলাদেশের জন্য খুবই ভয়াবহ সময় ছিল। তখন আমাদের দেশে সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। সব রাজনীতিক জেলে ছিলেন। আর নেতারা জেলে থাকার কারণে রাজনৈতিক দলগুলো অকার্যকর ছিল। তার ওপর আবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা চলছিল। সাধারণ মানুষ বলছিল, এটা কেমন ধরনের পরিস্থিতি! রাজনৈতিক দল যদি না থাকে, মানুষ নির্বাচন দিয়ে কী করবে? রাজনৈতিক দল হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান। আপনি যদি এটা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাধারণ মানুষ যদি আপনার ওপর ভরসা করে, নির্বাচনে তারা ওই দলের জন্য ভোট দেবে। ফলে অনেক চাপের পর_ কারণ আমি রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলাম না_ আমি হ্যাঁ বলেছিলাম। কারণ মানুষ আমাকে দোষারোপ করছিল যে, আমি তাদের সমস্যার প্রতি নজর দিচ্ছি না।
কাঠমান্ডু পোস্ট :সাম্প্রতিককালে নেপালে 'নিরপেক্ষ' প্রধানমন্ত্রী নিয়ে কথা হচ্ছে। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মধ্য থেকে কাউকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে একমত হতে পারছে না। এটাকে কি ভালো ধারণা বলে মনে করেন?
মুহাম্মদ ইউনূস : এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হতে পারে। বাংলাদেশে এর মেয়াদ ছিল ৯০ দিন। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান। কারণ আমরা স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে রাজনীতিকদের ওপর ভরসা করতে পারছিলাম না। আবার এটাও বলে রাখা দরকার, অরাজনৈতিক ব্যক্তি বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হওয়ার ধারণা ভালো নয়। দেশ চালাতে আপনাদের দরকার একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি।
No comments