বায়ান্ন বাজার তেপান্ন গলি by মোরসালিন মিজান
একাত্তর সাল। বাঁচা মরার লড়াই। স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালী। সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। ছেলে-বুড়ো নেই, এমনকি নারীরা লড়েছিল অস্ত্র হাতে।
এই যখন বাস্তবতা তখন শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের ঝা-া হাতে গো. আযম, নিজামী, সাকা, সাঈদী, মুজাহিদরা দিব্যি দাঁড়িয়ে যায়! ইসলাম রক্ষার নামে এরা মুক্তিযোদ্ধাদের, সাধারণ নারী-পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করে। ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটের মতো ঘটনা ঘটায়। আর স্বাধীনতার পর সেই তারা দাড়িতে লাল মেহেদী মেখে আলেম, অধ্যাপক, মৌলানা, ইসলামী চিন্তাবিদ ইত্যাদি বনে যায়! একাত্তরের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে পুনর্জন্ম হয় এই নপুংশকদের। পাকিস্তানে পালিয়ে বাঁচা নরপশুরা একে একে দেশে প্রবেশ করে। নিজেদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করার কাজ শুরু হয়। তবে এ মাটি যে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা! এখানে কী করে দাঁড়াতে পারে বিশ্বাস ঘাতক! আর তাই খসে পড়েছে। একচল্লিশ বছর পর হলেও বিচারের মুখোমুখি হয়েছে রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা। আর সর্বশেষ, একজনের বিরুদ্ধে এসেছে মৃত্যুদ-ের রায়। হ্যাঁ, যার বিরুদ্ধে রায় সেই বাচ্চু রাজাকার ইতোমধ্যে পালিয়েছে। পিতৃভূমি পাকিস্তানে এখন সে। একাত্তরের এই নরপশুকে কবে কোন্ কালে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে, মৃত্যুদ- কার্যকর করা যাবে কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এর পরও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের রায়ে দারুণ খুশি সাধারণ মানুষ। কারণ এটি প্রথম রায়। ঐতিহাসিক এ রায় শোনার জন্য প্রতীক্ষা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। অবশেষে তাঁরা আশ্বস্ত হয়েছেন, কোন অবস্থাতেই যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করা হবে না। আটক অন্য যুদ্ধাপরাধীদের পরিণতি সম্পর্কেও একটি ধারণা এখান থেকে পেয়েছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, এ রায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার অপেক্ষাকে আরও তীব্র করেছে। এখন দেশজুড়ে আলোচনা হচ্ছে বিষয়টি। আর রাজধানী ঢাকার কথা তো বলাই বাহুল্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এখানেই সবচেয়ে বেশি আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। সেই আন্দোলকারীরা এখন মাঠে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা সভা- সমাবেশ, মানববন্ধন, শোভাযাত্রা ইত্যাদি করছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাঠে থাকার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা।সর্বশেষ বৃহস্পতিবার জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করে জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অভিভাবক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এর আগে কাক্সিক্সক্ষত রায়কে স্বাগত জানিয়ে টিএসসি থেকে আনন্দ শোভাযাত্র বের করা হয়। এতে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, ম. হামিদ, আয়োজক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সহসভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল ঝুনা চৌধুরীসহ এক ঝাঁক সংস্কৃতিকর্মী অংশ নেন। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের পশু মুখ দেখিয়ে তাদের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্নের দাবি জানান তাঁরা। পরে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ঠাঁই হবে না। এদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। বাচ্চু রাজাকারের মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে তা আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তাঁরা বলেন, এটি শুভসূচনা। আমরা একে স্বাগত জানাই। তবে যত দ্রুত সম্ভব শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর করতে হবে। বিচার বানচালে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র দিন-রাত কাজ করছে জানিয়ে তাঁরা বলেন, আমাদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সজাগ থাকতে হবে। মানববন্ধনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলা হয়, বিবিসি, এএফপি, এপি, ভোয়াসহ বেশ কিছু বিদেশী মিডিয়া ভুল সংবাদ প্রচার করছে। আমরা এর নিন্দা জানাই। বক্তারা বলেন, বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে অপরাধের সকল প্রমাণ মজুদ আছে। কিন্তু কোন কোন মিডিয়ার সে সবে কোন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। আর তাই বাচ্চু রাজাকারকে ধর্মযাজক, ইসলাম প্রচারক ইত্যাদি বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। এটি সত্যি লজ্জার। মিডিয়াগুলোকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জেনে সংবাদ পরিবেশনের পরামর্শ দেন জোট নেতারা। মানববন্ধন থেকে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া এবং ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করারও দাবি জানানো হয়।
No comments