এলডিসির কলঙ্ক মোচন ও অর্থনীতির ঝুঁকি-অবলোকন by মাসুম খলিলী
চার বছর আগে বিপুল বিজয় নিয়ে সরকারের যাত্রা শুরুর সময় জাতিকে শোনানো হয়েছিল রূপকল্প ২০২১ সালের কথা।
বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকবে না, ২০২১
সালের মধ্যে পরিণত হবে মধ্যম আয়ের দেশে। আরেক ধাপ এগিয়ে কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের গভর্নর জানান, বাংলাদেশ ২০৫০ সাল নাগাদ চলে যাবে বিশ্বের উন্নত
অর্থনীতির দেশের কাতারে। এসব আশাবাদের কথা শুধু আমাদের প্রধানমন্ত্রী,
অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের কাছ থেকেই শুনছি না; আশাবাদের গল্প জাতিসঙ্ঘের
মহাসচিব, বাংলাদেশ সফরকারী গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বনেতা ও এখানে দায়িত্ব পালনরত
গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্রদূতদের কাছেও শুনছি। সর্বশেষ আমেরিকান ওয়াল
স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকা জানিয়েছে, বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা
থেকে বাদ দেয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়া হতে পারে।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে, এমন কথা বিদেশীদের কাছে শুনতে ভালোই লাগে; কিন্তু এ আনন্দের খবরের অন্তরালে যে বেদনার বার্তা আছে সে বিষয়টি কদাচিত সামনে আসে আমাদের। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় এখন সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের কথা নিয়ে বড় বড় ব্যানার ঝুলছে। মতিঝিলের একটি ব্যানারে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ১২ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় ২০১২ সালে ২৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তিন বছরে দ্বিগুণ রফতানি আয়। সত্যিই বিশাল সাফল্য। মধ্য আয়ের দেশ হতে গিয়ে এ সাফল্যে কি আবার নিম্নযাত্রা ঘটবে? এ ধরনের নানা প্রশ্ন কিন্তু সামনে আসতে পারে।
বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি তুলে ধরার জন্য বিশ্বের দেশগুলোকে নানা বলয়ে ভাগ করা হয়। উন্নত অর্থনীতির দেশ, উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ ও স্বল্পোন্নত অর্থনীতির দেশ। আবার নিম্ন আয় , নিম্ন-মধ্য আয়, উচ্চ-মধ্য আয় ও উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবেও বিভাজন করা হয়। বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে এক হাজার ২৫ ডলারের নিচের মাথাপিছু আয়ের দেশগুলো হলো নিম্ন আয় বা স্বল্পোন্নত দেশ। আর এক হাজার ২৬ থেকে চার হাজার ৩৫ পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের দেশগুলো হলো নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ। চার হাজার ৩৬ থেকে ১২ হাজার ৪৭৫ ডলার পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের দেশ হলো উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ। আর ১২ হাজার ৪৭৬ ডলারের বেশি আয়ের দেশগুলো হলো উচ্চ আয়ের দেশ।
১৯৭১ সালে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা তৈরি করা হয়, যদিও এ ধারণার উৎপত্তি হয়েছিল ষাটের দশকে। এ সময় ঠিক হয়Ñ যেসব দেশের তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে তাদেরই স্থান হবে এ তালিকায়। সল্পোন্নত দেশ হওয়ার প্রথম শর্তটি হলো দারিদ্র্র্যÑ দেশটির তিন বছরের গড় মাথাপিছু জাতীয় আয় অবশ্যই ৯০৫ ডলারের কম হতে হবে আর এলডিসি থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীলের তালিকায় যেতে অতিক্রম করতে হবে গড় মাথাপিছু এক হাজার ৮৬ মার্কিন ডলার আয়।
এলডিসির দ্বিতীয় শর্তটি হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন দুর্বলতা। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্বাক্ষরতাÑ এ ক’টি সূচকের ভিত্তিতে মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার তৃতীয় ও সর্বশেষ শর্তটি হলো অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। এটি বিবেচনা করা হয় কৃষি উৎপাদনে অস্থিরতা, অটেকসই রফতানিপণ্য ও সেবা আয়, অনানুষ্ঠানিক তৎপরতার ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা, বাণিজ্যিক পণ্যে রফতানি কেন্দ্রীভূত থাকা, অর্থনৈতিক বিকাশে অবরুদ্ধতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া জনসংখ্যার হারের ওপর। তিন বছর পর পর জাতিসঙ্ঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের (ইকোসোক) কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসির শর্তগুলো পর্যালোচনা করে। ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি সর্বশেষ পর্যালোচনার পর ৪৮টি জাতিসঙ্ঘ সদস্যদেশকে এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হলো একটি। এ পর্যন্ত চারটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেছে, যার মধ্যে ১৯৭৫ সালে সিকিম দখলের পর ভারতের সাথে একীভূত হয়ে গেলে দেশটি এ তালিকা থেকে প্রথম বাদ পড়ে যায়। ১৯৯৪ সালে বের হয় আফ্রিকান দেশ বৎসোয়ানা। ২০০৭ সালে বের হয় ক্যাপে ভারডে। আর সর্বশেষ ২০১১ সালে বের হয় মালদ্বীপ। এলডিসি থেকে উন্নয়ন ঘটলে একটি দেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়। ২০১১ সালের এলডিসি সম্মেলনে ইকুয়েটরিয়াল গিনি, সামোয়া, টুবালু ও ভানুয়াতুকে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করার পরামর্শ আসে। এ সম্মেলনে পরবর্তী ১০ বছরের অর্ধেক এলডিসি দেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলেও অভিমত দেয়া হয়।
আগামী বছর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পরবর্তী সম্মেলনে যেসব দেশের পদোন্নতি ঘটতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশও থাকতে পারে। বাংলাদেশ ক্রয়ক্ষমতার সমানুপাত বা পিপিপি বিচেনায় বিশ্বের ৪৪ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আর বিনিময় হার বিবেচনায় বৃহৎ অর্থনীতির ক্রমতালিকায় বাংলাদেশের স্থান ৫৭ নম্বরে। সর্বশেষ ২০১১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল বিনিময় হার অনুসারে ৮৪২ মার্কিন ডলার। এটাকে পিপিপি হিসেবে ফেললে দাঁড়াবে দুই হাজার ১৪৫ ডলারের মতো। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে জাতীয় অর্থনীতির এ হিসাব করা হয়। এখন ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ভিত্তি বছর ধরে নতুন হিসাব করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। নতুন হিসাব পদ্ধতি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে আগামী অর্থবছরে নতুন ভিত্তি বছরের হিসাব প্রকাশ করা হতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কারিগরি কমিটির এক সভায় খসড়া উপস্থাপন করা হয়েছে সম্প্রতি। এতে স্থূল দেশজ উৎপাদনের খাত থেকে বাদ পড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার পর জিডিপির আকার ১৫ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। ওই সভায় নতুন হিসাবকে আরো পর্যালোচনা করার জন্য বলা হয়েছে। পর্যালোচনার পর মাথাপিছু জাতীয় আয় কম হলেও ১০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। ফলে বিগত অর্থবছরে ১০ ভাগ আয় বাড়লে মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০১১-১২ অর্থবছরে উন্নীত হয়ে দাঁড়াবে ৯৩৩ ডলারে । এর সাথে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হিসাব যোগ করা হলে হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায় মাথাপিছু জাতীয় আয়।
এ হিসেবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের প্রথম শর্তটি বাংলাদেশের জন্য পূরণ হয়ে যায়। দ্বিতীয় সামাজিক উন্নয়নের যে সূচক রয়েছে তা-ও উত্তরণ রেখার কাছাকাছি। ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য যে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে উন্নয়ন দারিদ্র্য রেখার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা ১৯৯০-৯১ সালের ভিত্তি বছরের ৫৬.৬ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালে ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল; বর্তমানে তা ৩১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২৯ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে যাবে ২০১৫ সালের মধ্যে। দ্বিতীয়টি ছিল দারিদ্র্য ব্যবধান অনুপাত ১৭ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা। এই অনুপাত এখনই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার নিচে সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ৫ বছরের কম বয়সী নিম্ন ওজনের শিশুসংখ্যা ভিত্তিবছরের ৬৬ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালে ৩৩ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ২০০৯ সালের জরিপে এটি ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। এটিও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। এ ছাড়া ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম ক্যালরি গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ২৮ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ২০০৫ সালে এটি সাড়ে ১৯ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। নির্দিষ্ট সময়ে এ লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের অন্য সামাজিক সূচকগুলোর অগ্রগতিও ভালো। ফলে স্বল্পোন্নত দেশের তলিকা থেকে বেরিয়ে আসার শর্ত এ ক্ষেত্রেও পূরণ হয়ে যেতে পারে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের তৃতীয় শর্ত অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতাও বাংলাদেশে বেশ খানিকটা হ্রাস পেয়েছে। এক দশক ধরে কৃষি উৎপাদনে মোটামুটি স্থিতিশীলতা ছিল। সমুদ্রোপকূলের দেশ হিসেবে জলোচ্ছ্বাস-বন্যার দুর্যোগ অবশ্য কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা বাংলাদেশের সামনে নেই। তবে নৃতাত্ত্বি¡ক সঙ্ঘাত এখন উল্লেখযোগ্য নয়। রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা অবশ্য অসহিষ্ণু রাজনীতির কারণে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভেতরে ভেতরে অসন্তোষকে উসকে তোলার একটি চেষ্টাও রয়েছে। এর পরও আফ্রিকার দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে বিপর্যস্ত এলডিসি দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ইতিবাচক।
এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ -এ মধ্য আয়ের এবং ২০৫০ সালে অগ্রসর অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বাংলাদেশের নেইÑ এ কথা বলা যাবে না। উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, সেটি সঙ্গতভাবেই আমরা সবাই প্রত্যাশা করতে পারি। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থেকে বাংলাদেশ যেসব বাণিজ্য ও রেয়াতি ঋণ সুবিধা পাচ্ছে, সেটি ছাড়াও এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি এ দেশের রয়েছে কি না এটাই বিরাট প্রশ্ন।
বাংলাদেশ এখন যে ২৪.২৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করছে তার প্রায় অর্ধেকটা যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে। এসব দেশে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধার প্রায় পুরোটা পায় স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে। এ সুবিধা না থাকলে ৯ শতাংশের মতো শুল্ক দিয়ে পোশাক রফতানি করতে হবে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে মুক্ত প্রতিযোগিতায় ইউরোপের বাজারে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে পোশাকের দর নিয়ে প্রতিযোগিতা অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ যে পণ্য রফতানি করে, তাতে লাভ বেশি থাকায় জিএসপি বা অগ্রাধিকার সুবিধা ছাড়াও বাংলাদেশ টিকে থাকতে পেরেছে। যেটি সম্ভবত ইইউ’র বাজারে সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের রফতানি বাজারের এ বাস্তবতার বিষয়টি এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দোহা রাউন্ড আলোচনায় বিশ্ব গণমাধ্যমে এলডিসি দেশগুলো যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। ডব্লিউটিওর হংকং মিনিস্ট্রিয়াল বৈঠকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শত ভাগ শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার দেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। কিন্তু দোহা রাউন্ডের নিষ্ফল সমাপ্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার পায়নি এসব দেশ। অবশ্য কিছু পর্যবেক্ষক এসংক্রান্ত যে দলিলপত্র তৈরি হয় তার কিছু বিচ্যুতির কথাও বলেছিলেন বাজারসুবিধা না পাওয়ার জন্য। সে যা-ই হোক, বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বাজারে যে অগ্রাধিকার বাণিজ্যসুবিধা পাচ্ছে, তার পেছনে প্রধান কারণই হলো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকা।
বাণিজ্যসুবিধা ছাড়াও বিভিন্ন অগ্রসর অর্থনীতির দেশ ও বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো রেয়াতি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশের পরিচিতি বড়ভাবে সহায়তা করে। বাংলাদেশ নামমাত্র সুদের যে উন্নয়ন অনুদান ও ঋণ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো উন্নয়নশীল দেশ ততটা পায়নি।
নিজস্ব অর্থনীতির উন্নয়ন ও বিকাশ ঠেকিয়ে রেখে স্বল্পোন্নত দেশের বাজার ও ঋণসহায়তা পাওয়ার চেষ্টা কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না, তবে বাংলাদেশকে অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসার পর দেশ কী কী ধরনের অগ্রাধিকার সুবিধা হারাবে এবং এসব সুবিধা হারানোর কারণে যে চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির সামনে হাজির হবে, সেটাকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উত্থান- পতনের কারণে অনেক সময় আন্তর্জাতিক সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে হয়। বাংলাদেশ এখন আগ্রাসী ধরনের নীতি অনুসরণ করছে বিভিন্ন ইস্যুতে। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের সাথে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে ব্যাপক টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের সাথে যেভাবে আচরণ করা হয়েছে, তাতেও বাংলাদেশকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। বাংলাদেশের যেখানে ভারসাম্যমূলক আন্তর্জাতিক নীতি ও সম্পর্ক বজায় রেখে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার প্রয়োজন ছিল তার ব্যত্যয় ঘটছে নানা ক্ষেত্রে। গত কয়েক দশকে সামাজিক খাতগুলোকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার কারণে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। এখন এক দিকে বিলাসবহুল প্রতিরক্ষা কেনাকাটিতে বেশি ব্যয় করা হচ্ছে। অন্য দিকে বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো শিল্পায়নের প্রাথমিক জ্বালানি সঙ্কটের টেকসই সমাধানের পরিবর্তে দুর্নীতিযুক্ত সাময়িক সমাধানে অগ্রসর হয়ে জাতীয় সম্পদের অপচয় করা হচ্ছে। এটি কোনোভাইে ২০২১ সালের মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশকে নির্ধারিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন শিল্পায়নের বিকাশ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানমুখী দারিদ্র্য হ্রাসে ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া। আর সেই সাথে দেশে রাজনৈতিক স্থিতি, সহিষ্ণুতা ও সামাজিক ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টি করা। তা না হলেও অগ্রসর অর্থনীতির দেশ কেন, মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার বিষয়টিও কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।
mrkmmb@gmail.com
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে, এমন কথা বিদেশীদের কাছে শুনতে ভালোই লাগে; কিন্তু এ আনন্দের খবরের অন্তরালে যে বেদনার বার্তা আছে সে বিষয়টি কদাচিত সামনে আসে আমাদের। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় এখন সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের কথা নিয়ে বড় বড় ব্যানার ঝুলছে। মতিঝিলের একটি ব্যানারে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ১২ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় ২০১২ সালে ২৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তিন বছরে দ্বিগুণ রফতানি আয়। সত্যিই বিশাল সাফল্য। মধ্য আয়ের দেশ হতে গিয়ে এ সাফল্যে কি আবার নিম্নযাত্রা ঘটবে? এ ধরনের নানা প্রশ্ন কিন্তু সামনে আসতে পারে।
বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি তুলে ধরার জন্য বিশ্বের দেশগুলোকে নানা বলয়ে ভাগ করা হয়। উন্নত অর্থনীতির দেশ, উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ ও স্বল্পোন্নত অর্থনীতির দেশ। আবার নিম্ন আয় , নিম্ন-মধ্য আয়, উচ্চ-মধ্য আয় ও উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবেও বিভাজন করা হয়। বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে এক হাজার ২৫ ডলারের নিচের মাথাপিছু আয়ের দেশগুলো হলো নিম্ন আয় বা স্বল্পোন্নত দেশ। আর এক হাজার ২৬ থেকে চার হাজার ৩৫ পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের দেশগুলো হলো নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ। চার হাজার ৩৬ থেকে ১২ হাজার ৪৭৫ ডলার পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের দেশ হলো উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ। আর ১২ হাজার ৪৭৬ ডলারের বেশি আয়ের দেশগুলো হলো উচ্চ আয়ের দেশ।
১৯৭১ সালে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা তৈরি করা হয়, যদিও এ ধারণার উৎপত্তি হয়েছিল ষাটের দশকে। এ সময় ঠিক হয়Ñ যেসব দেশের তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে তাদেরই স্থান হবে এ তালিকায়। সল্পোন্নত দেশ হওয়ার প্রথম শর্তটি হলো দারিদ্র্র্যÑ দেশটির তিন বছরের গড় মাথাপিছু জাতীয় আয় অবশ্যই ৯০৫ ডলারের কম হতে হবে আর এলডিসি থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীলের তালিকায় যেতে অতিক্রম করতে হবে গড় মাথাপিছু এক হাজার ৮৬ মার্কিন ডলার আয়।
এলডিসির দ্বিতীয় শর্তটি হলো মানবসম্পদ উন্নয়ন দুর্বলতা। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্বাক্ষরতাÑ এ ক’টি সূচকের ভিত্তিতে মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার তৃতীয় ও সর্বশেষ শর্তটি হলো অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। এটি বিবেচনা করা হয় কৃষি উৎপাদনে অস্থিরতা, অটেকসই রফতানিপণ্য ও সেবা আয়, অনানুষ্ঠানিক তৎপরতার ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা, বাণিজ্যিক পণ্যে রফতানি কেন্দ্রীভূত থাকা, অর্থনৈতিক বিকাশে অবরুদ্ধতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া জনসংখ্যার হারের ওপর। তিন বছর পর পর জাতিসঙ্ঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের (ইকোসোক) কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসির শর্তগুলো পর্যালোচনা করে। ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি সর্বশেষ পর্যালোচনার পর ৪৮টি জাতিসঙ্ঘ সদস্যদেশকে এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হলো একটি। এ পর্যন্ত চারটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেছে, যার মধ্যে ১৯৭৫ সালে সিকিম দখলের পর ভারতের সাথে একীভূত হয়ে গেলে দেশটি এ তালিকা থেকে প্রথম বাদ পড়ে যায়। ১৯৯৪ সালে বের হয় আফ্রিকান দেশ বৎসোয়ানা। ২০০৭ সালে বের হয় ক্যাপে ভারডে। আর সর্বশেষ ২০১১ সালে বের হয় মালদ্বীপ। এলডিসি থেকে উন্নয়ন ঘটলে একটি দেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা পায়। ২০১১ সালের এলডিসি সম্মেলনে ইকুয়েটরিয়াল গিনি, সামোয়া, টুবালু ও ভানুয়াতুকে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করার পরামর্শ আসে। এ সম্মেলনে পরবর্তী ১০ বছরের অর্ধেক এলডিসি দেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলেও অভিমত দেয়া হয়।
আগামী বছর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পরবর্তী সম্মেলনে যেসব দেশের পদোন্নতি ঘটতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশও থাকতে পারে। বাংলাদেশ ক্রয়ক্ষমতার সমানুপাত বা পিপিপি বিচেনায় বিশ্বের ৪৪ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আর বিনিময় হার বিবেচনায় বৃহৎ অর্থনীতির ক্রমতালিকায় বাংলাদেশের স্থান ৫৭ নম্বরে। সর্বশেষ ২০১১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল বিনিময় হার অনুসারে ৮৪২ মার্কিন ডলার। এটাকে পিপিপি হিসেবে ফেললে দাঁড়াবে দুই হাজার ১৪৫ ডলারের মতো। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে জাতীয় অর্থনীতির এ হিসাব করা হয়। এখন ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ভিত্তি বছর ধরে নতুন হিসাব করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। নতুন হিসাব পদ্ধতি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে আগামী অর্থবছরে নতুন ভিত্তি বছরের হিসাব প্রকাশ করা হতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কারিগরি কমিটির এক সভায় খসড়া উপস্থাপন করা হয়েছে সম্প্রতি। এতে স্থূল দেশজ উৎপাদনের খাত থেকে বাদ পড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার পর জিডিপির আকার ১৫ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। ওই সভায় নতুন হিসাবকে আরো পর্যালোচনা করার জন্য বলা হয়েছে। পর্যালোচনার পর মাথাপিছু জাতীয় আয় কম হলেও ১০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। ফলে বিগত অর্থবছরে ১০ ভাগ আয় বাড়লে মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০১১-১২ অর্থবছরে উন্নীত হয়ে দাঁড়াবে ৯৩৩ ডলারে । এর সাথে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হিসাব যোগ করা হলে হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায় মাথাপিছু জাতীয় আয়।
এ হিসেবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের প্রথম শর্তটি বাংলাদেশের জন্য পূরণ হয়ে যায়। দ্বিতীয় সামাজিক উন্নয়নের যে সূচক রয়েছে তা-ও উত্তরণ রেখার কাছাকাছি। ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য যে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে উন্নয়ন দারিদ্র্য রেখার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা ১৯৯০-৯১ সালের ভিত্তি বছরের ৫৬.৬ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালে ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল; বর্তমানে তা ৩১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২৯ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে যাবে ২০১৫ সালের মধ্যে। দ্বিতীয়টি ছিল দারিদ্র্য ব্যবধান অনুপাত ১৭ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা। এই অনুপাত এখনই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার নিচে সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ৫ বছরের কম বয়সী নিম্ন ওজনের শিশুসংখ্যা ভিত্তিবছরের ৬৬ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালে ৩৩ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ২০০৯ সালের জরিপে এটি ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। এটিও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। এ ছাড়া ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম ক্যালরি গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ২৮ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ২০০৫ সালে এটি সাড়ে ১৯ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। নির্দিষ্ট সময়ে এ লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের অন্য সামাজিক সূচকগুলোর অগ্রগতিও ভালো। ফলে স্বল্পোন্নত দেশের তলিকা থেকে বেরিয়ে আসার শর্ত এ ক্ষেত্রেও পূরণ হয়ে যেতে পারে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের তৃতীয় শর্ত অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতাও বাংলাদেশে বেশ খানিকটা হ্রাস পেয়েছে। এক দশক ধরে কৃষি উৎপাদনে মোটামুটি স্থিতিশীলতা ছিল। সমুদ্রোপকূলের দেশ হিসেবে জলোচ্ছ্বাস-বন্যার দুর্যোগ অবশ্য কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা বাংলাদেশের সামনে নেই। তবে নৃতাত্ত্বি¡ক সঙ্ঘাত এখন উল্লেখযোগ্য নয়। রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা অবশ্য অসহিষ্ণু রাজনীতির কারণে কিছুটা দেখা যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভেতরে ভেতরে অসন্তোষকে উসকে তোলার একটি চেষ্টাও রয়েছে। এর পরও আফ্রিকার দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে বিপর্যস্ত এলডিসি দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ইতিবাচক।
এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ -এ মধ্য আয়ের এবং ২০৫০ সালে অগ্রসর অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বাংলাদেশের নেইÑ এ কথা বলা যাবে না। উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, সেটি সঙ্গতভাবেই আমরা সবাই প্রত্যাশা করতে পারি। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থেকে বাংলাদেশ যেসব বাণিজ্য ও রেয়াতি ঋণ সুবিধা পাচ্ছে, সেটি ছাড়াও এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি এ দেশের রয়েছে কি না এটাই বিরাট প্রশ্ন।
বাংলাদেশ এখন যে ২৪.২৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করছে তার প্রায় অর্ধেকটা যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে। এসব দেশে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধার প্রায় পুরোটা পায় স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে। এ সুবিধা না থাকলে ৯ শতাংশের মতো শুল্ক দিয়ে পোশাক রফতানি করতে হবে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে মুক্ত প্রতিযোগিতায় ইউরোপের বাজারে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে পোশাকের দর নিয়ে প্রতিযোগিতা অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ যে পণ্য রফতানি করে, তাতে লাভ বেশি থাকায় জিএসপি বা অগ্রাধিকার সুবিধা ছাড়াও বাংলাদেশ টিকে থাকতে পেরেছে। যেটি সম্ভবত ইইউ’র বাজারে সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের রফতানি বাজারের এ বাস্তবতার বিষয়টি এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দোহা রাউন্ড আলোচনায় বিশ্ব গণমাধ্যমে এলডিসি দেশগুলো যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। ডব্লিউটিওর হংকং মিনিস্ট্রিয়াল বৈঠকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শত ভাগ শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার দেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। কিন্তু দোহা রাউন্ডের নিষ্ফল সমাপ্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার পায়নি এসব দেশ। অবশ্য কিছু পর্যবেক্ষক এসংক্রান্ত যে দলিলপত্র তৈরি হয় তার কিছু বিচ্যুতির কথাও বলেছিলেন বাজারসুবিধা না পাওয়ার জন্য। সে যা-ই হোক, বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বাজারে যে অগ্রাধিকার বাণিজ্যসুবিধা পাচ্ছে, তার পেছনে প্রধান কারণই হলো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকা।
বাণিজ্যসুবিধা ছাড়াও বিভিন্ন অগ্রসর অর্থনীতির দেশ ও বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো রেয়াতি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশের পরিচিতি বড়ভাবে সহায়তা করে। বাংলাদেশ নামমাত্র সুদের যে উন্নয়ন অনুদান ও ঋণ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো উন্নয়নশীল দেশ ততটা পায়নি।
নিজস্ব অর্থনীতির উন্নয়ন ও বিকাশ ঠেকিয়ে রেখে স্বল্পোন্নত দেশের বাজার ও ঋণসহায়তা পাওয়ার চেষ্টা কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না, তবে বাংলাদেশকে অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসার পর দেশ কী কী ধরনের অগ্রাধিকার সুবিধা হারাবে এবং এসব সুবিধা হারানোর কারণে যে চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির সামনে হাজির হবে, সেটাকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উত্থান- পতনের কারণে অনেক সময় আন্তর্জাতিক সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে হয়। বাংলাদেশ এখন আগ্রাসী ধরনের নীতি অনুসরণ করছে বিভিন্ন ইস্যুতে। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের সাথে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে ব্যাপক টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের সাথে যেভাবে আচরণ করা হয়েছে, তাতেও বাংলাদেশকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। বাংলাদেশের যেখানে ভারসাম্যমূলক আন্তর্জাতিক নীতি ও সম্পর্ক বজায় রেখে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার প্রয়োজন ছিল তার ব্যত্যয় ঘটছে নানা ক্ষেত্রে। গত কয়েক দশকে সামাজিক খাতগুলোকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার কারণে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। এখন এক দিকে বিলাসবহুল প্রতিরক্ষা কেনাকাটিতে বেশি ব্যয় করা হচ্ছে। অন্য দিকে বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো শিল্পায়নের প্রাথমিক জ্বালানি সঙ্কটের টেকসই সমাধানের পরিবর্তে দুর্নীতিযুক্ত সাময়িক সমাধানে অগ্রসর হয়ে জাতীয় সম্পদের অপচয় করা হচ্ছে। এটি কোনোভাইে ২০২১ সালের মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশকে নির্ধারিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন শিল্পায়নের বিকাশ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানমুখী দারিদ্র্য হ্রাসে ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া। আর সেই সাথে দেশে রাজনৈতিক স্থিতি, সহিষ্ণুতা ও সামাজিক ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টি করা। তা না হলেও অগ্রসর অর্থনীতির দেশ কেন, মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার বিষয়টিও কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।
mrkmmb@gmail.com
No comments