রাজপথে ফাঁসি
সূর্য উঠতে তখনও কিছু সময় বাকি। আবছা
আলো-আঁধারিতে ভুতুড়ে পরিবেশ। এ অবস্থায় চোখে-মুখে ভয় ও আতঙ্কের ছাপ নিয়ে
সুনসান নীরবতায় তেহরানের আর্টিস্ট পার্কে দাঁড়িয়ে আছেন ৩শ’র বেশি মানুষ।
অপেক্ষা
করছিলেন দুই তরুণের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া দেখার জন্য। আর
মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা আলী রেজা মাফিহা (২৩) ও
মোহাম্মদ আলী সাভারি (২০)? তারাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছেন
দু’টি পুলিশ ট্রাকের ক্রেনের ১৫ ফুট উচ্চতা থেকে ঝুলিয়ে রাখা ফাঁসির দড়ির
সামনে। দৃষ্টিতে কোন অভিব্যক্তি নেই। নেই কোন ধরনের আতঙ্ক। সামনেই
চিরপরিচিত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের উৎকণ্ঠিত চেহারা। স্বজনরা উৎকণ্ঠিত
হলেও তারা ভাবলেশহীন। রিমোট কন্ট্রোল ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় কালো
পোশাকের জল্লাদরা অপেক্ষমাণ। এটি ছিল রোববার সকালে তেহরানের পার্কটিতে এক
ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাত ও তার ২০ ডলার মূল্যের জিনিসপত্র ছিনতাই করার অভিযোগে
দুই যুবকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার গল্প। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে
বলা হয়, ইরানে প্রতি বছর শ’ শ’ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এসব ঘটনায়
আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার ঝড়ও উঠে। তবে প্রকাশ্য জনসমক্ষে এমন ফাঁসি
কার্যকর করার ঘটনা বিরল। কর্তৃপক্ষ এমনটি করেছে চুরি ও ছিনতাই’র মতো অপরাধ
বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে। এতে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অপরাধ দমন করতে চায়
দেশটি। ইরানের শিয়া আইনে ছুরিকাঘাত, ডাকাতি ও ছিনতাইকে ‘মোহারেব’ হিসেবে
বিবেচনা করা হয়। মোহারেব হচ্ছে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ও আল্লাহর
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। প্রশ্ন হচ্ছে লঘু পাপে
গুরুদণ্ডের বিধান ও ইরানের মতো কট্টরপন্থি দেশে বিষয়টি জেনেও কেন এমন
অপবাদে জড়িয়ে পড়ছে তরুণরা। এজন্য পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য কর্মকর্তারা একে
দেখছেন সরকারের ভুল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ফল হিসেবে। ভুল অর্থনৈতিক
অবস্থাপনার কারণে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলেছে। এতে করে ‘অভাবে
স্বভাব নষ্ট’-এর মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। বেড়ে গেছে চুরি-ডাকাতি ও
ছিনতাইর মতো ঘটনাগুলো। তরুণেরা অর্থ ও দামি জিনিস কেড়ে নেয়ার জন্য
ছুরিকাঘাত করতে পিছপা হচ্ছে না। মানুষের বাড়িঘরে হানা দিচ্ছে। মানুষ
বিরক্ত হয়ে বাঁচার জন্য এমন প্রকাশ্য শাস্তি দাবি করছেন। মানিজা (৫৪) নামের
এক গৃহিণীর ঘরে ঢুকে দুই তরুণ তাকে বেঁধে রেখে ও ছুরিকাঘাত করে সবকিছু
নিয়ে যায়। তিনি এজন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন। একই কথা বলেছেন
আরমিন (৩০)। আর তাই আলী রেজা ও মোহাম্মদ আলীর সাজায় অনেকেই খুশি। বিষয়টি
দেখা গেছে মৃত্যুদণ্ড দেখতে আসা অনেকের অভিব্যক্তি ও কথাবার্তায়। প্রশ্ন
হচ্ছে এমন গুরুদণ্ডের পর এ ধরনের অপরাধ কতটুকু কমবে। সমাজ বিজ্ঞানী
আমানুল্লাহ বলছেন, এটা স্পষ্ট অর্থনৈতিক অব্যবস্থার পরিবর্তন ও উন্নতি না
হলে এমন অপরাধ কমবে না। কারণ আলী রেজা ও মোহাম্মদ আলীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে,
আলী রেজার মায়ের অপারেশনের জন্য টাকার অনেক প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া, তারা
দু’জনই ছোটকাল থেকে এতিম। অনেকে অবশ্য বলছেন তাদের দুর্ভাগ্য যে, তাদের
অপরাধের চিত্র ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যথায় এমনভাবে তাদের মৃত্যুদণ্ড হতো
না।
No comments