মুন্সীগঞ্জে গুলিবিদ্ধ ৩ রহস্যময় লাশ by মাসুদ খান ও আলতাফ হোসেন মিন্টু
পুলিশ সপ্তাহের তৃতীয় দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার মুন্সীগঞ্জে মাথায় গুলিবিদ্ধ তিন ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দুজনের চোখ-মুখ এবং একজনের দুই হাত পিঠমোড়া করে নতুন গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল।
সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া ব্রিজের নিচে দুটি এবং ২০ কিলোমিটার দূরে শ্রীনগর উপজেলার শ্রীধরপুরে রাস্তার পাশ থেকে অন্য লাশটি উদ্ধার করা হয়। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পাওয়া তিন যুবকের লাশ ও গুলির ধরন দেখে পুলিশ মনে করছে, তিনটি হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই যোগসূত্র রয়েছে এবং বুধবার গভীর রাতে অন্য জায়গায় হত্যা করার পর লাশগুলো এ দুটি স্থানে ফেলে রাখা হয়। নিহতদের দুজন কেরানীগঞ্জের একই গ্রামের বাসিন্দা এবং তাঁরা ১৪ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। অন্যজন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার মো. ইব্রাহিম নিখোঁজ হন ৯ দিন আগে।
নিহত ইব্রাহিমের পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ, তাঁকে হত্যার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন জড়িত থাকতে পারে। এ ছাড়া গতকাল মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে এক গৃহবধূকে চিকিৎসা করাতে এনে তিনি বেঁচে নেই শুনে লাশ ফেলে পালিয়ে যায় তাঁর স্বামী। এটিও হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিরাজদিখানের এক গ্রামে আরো এক ব্যক্তির লাশ গতকাল গাছ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এটি আত্মহত্যা বলে মনে করছে পুলিশ।
প্রথম লাশ : সকাল ৯টার দিকে রশুনিয়া বেইলি ব্রিজের নিচ থেকে উদ্ধার করা প্রথম মৃতদেহটি হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার নওপাড়া গ্রামের খোরশেদ আলমের ছেলে মো. ইব্রাহিমের (২০)। তাঁর মাথায় তিনটি গুলির চিহ্ন রয়েছে। গলায় একটি নতুন গামছা বাঁধা ছিল। ইব্রাহিম ঢাকার পূর্ব জুরাইনে তাঁর মামা আবদুস ছাত্তার মিয়ার বাড়িতে থাকতেন।
পরিবার সূত্র জানায়, কাতার যাওয়ার জন্য গত ১৬ জানুয়ারি ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য বনানী যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে তিনি নিখোঁজ হন। পরের দিন ১৭ জানুয়ারি তাঁর মা নাজমা বেগম ঢাকার কদমতলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। মামা আবদুস ছাত্তার কালের কণ্ঠকে জানান, নয়াবাজারের আবুলের গ্রিলের দোকানে কাজ করতেন ইব্রাহিম। তাঁর বাবা কুয়েতপ্রবাসী। বর্তমানে ছুটিতে দেশে থাকা অবস্থায় বড় ছেলের এমন মৃত্যুর খবরে এখন তিনি পাগলপ্রায়। ইব্রাহিমের মামা নাসির মিয়া ও আবদুস ছাত্তার বলেন, 'আমাদের ভাগ্নে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না, তাকে হয়তো গুম করার পর পরিকল্পিতভাবে কথিত ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে।'
সিরাজদিখান থানার ওসি শেখ মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাকার কদমতলী এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা ইসমাইল হত্যা মামলার আসামি ছিলেন ইব্রাহিম। একই মামলায় আটক সজীব পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ইব্রাহিমের নাম প্রকাশ করে। মামারা জানান, দুই ভাইয়ের মধ্যে ইব্রাহিম বড়। ছোট ভাই ইয়াসিন ঢাকার জুরাইনে একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।
দ্বিতীয় লাশ : রশুনিয়া বেইলি ব্রিজের অদূরে ইমামগঞ্জ গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে সকাল সাড়ে ১১টায় উদ্ধার করা হয় মাথায় ও বুকে গুলিবিদ্ধ আবদুল কুদ্দুসের (৪২) লাশ। তিনি কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা গ্রামে বসবাস করতেন। তবে তাঁর বাবা আবদুল খালেক ব্যাপারীর বাড়ি মাদারীপুর জেলার গোগলী গ্রামে। আবদুল কুদ্দুসের বড় ভাই সারোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, ১৪ দিন ধরে তাঁর ভাই নিখোঁজ ছিলেন। কেরানীগঞ্জের আমবাগিচার পানাকা মার্কেটের এক পোশাকের দোকানের মালিক ছিলেন তাঁর ভাই। দোকান থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার পথে ১১ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে তিনি নিখোঁজ হন। কুদ্দুস তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তাঁর স্ত্রী সোহাদা বেগম শোকে এখন পাগলপ্রায়।
তৃতীয় লাশ : রশুনিয়া থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে শ্রীনগর উপজেলার শ্রীধরপুর সড়কের পাশে দুপুর সাড়ে ১২টায় মাসুদ হোসেন ওরফে রাঢ়ী মাসুদের (৩২) লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি কেরানীগঞ্জে নিজের বাড়িতে থাকতেন। বাবার নাম মিজান খান। তাঁর স্নেহা নামের আড়াই বছরের এক কন্যাসন্তান রয়েছে। তাঁর স্ত্রী শায়লা বেগম ৯ মাসের গর্ভবতী। মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে লাশ শনাক্তের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সঙ্গে থাকা তাঁর ভাবি নূরজাহান বেগম জানান, মাসুদ ঢাকার সোয়ারীঘাটের খেয়া পারাপারের টোল আদায় করতেন। ১১ জানুয়ারি বিকেলে তিনি বাসা থেকে পোস্তগোলার উদ্দেশে যাত্রা করেন পাওনা ২০ হাজার টাকা আনতে।
নূরজাহান বেগম বলেন, মাসুদ জমির একটি প্লট বিক্রি করেছিলেন নাজমুল নামের এক ব্যক্তির কাছে। ওই ব্যক্তি সেখানে একতলা ভবন তৈরি করে। তিনি বেশি জমি দখলে রাখায় বাড়ি ভাড়া তুলতেন মাসুদ। এ নিয়ে নাজমুলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। নাজমুল অতিরিক্ত জমি বাবদ ২০ হাজার টাকা দেবে শুনে সেই টাকা আনতেই তিনি পোস্তগোলার উদ্দেশে রওনা হন। কালের কণ্ঠের কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি মাসুদের পরিবার সূত্রে জানান, টাকা আনতে তিনি সঙ্গে নেন প্রতিবেশী কুদ্দুসকে। এর পর থেকে তাঁরা নিখোঁজ ছিলেন।
শ্রীনগর থানার ওসি মো. মিজানুর রহমান জানান, এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করা হয়। স্বজনরা লাশ শনাক্ত করেছে। তিনটি হত্যার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। তবে কিভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা নিশ্চিত করা যায়নি। মাসুদের মাথায় ও গলায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া দুটি নতুন গামছা দিয়ে তাঁর চোখ বাঁধা ছিল।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি শাখাওয়াৎ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার জানামতে এদের (মাসুদ ও কুদ্দুস) নামে কোনো মামলা নেই।' কালের কণ্ঠের প্রতিনিধি গত রাতে মাসুদের বাড়িতে গেলে তাঁর স্ত্রী শায়লা বেগম (৩০) কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, সাত বছর আগে তাঁর স্বামী পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকায় পৌনে এক শতাংশ জমি বিক্রি করেন এলাকায় ঘরজামাই থাকা বরিশালের নাজমুলের কাছে। ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার পর নাজমুল মাঝে মাঝে ৫-১০ হাজার করে টাকা দিচ্ছিল। নিখোঁজ হওয়ার দিন নাজমুলের ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে এক যুবক মাসুদকে পোস্তগোলায় গিয়ে ২০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলে। রাত ৮টার দিকে মাসুদ প্রতিবেশী কুদ্দুসকে সঙ্গে নিয়ে পোস্তগোলায় রওনা হয়ে আর ফেরেননি। শায়লা বেগম ১৪ জানুয়ারি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি জিডি করেন।
রাতে নাজমুলের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। সে কয়েক দিন হলো বরিশাল গেছে বলে জানায় বাড়ির লোকজন। কুদ্দুসের ঘরে গিয়ে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। প্রতিবেশীরা জানান, তাঁর স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে গেছেন। আর ভাইয়েরা লাশ শনাক্তের জন্য মুন্সীগঞ্জে গিয়ে তখনো ফেরেননি।
মুন্সীগঞ্জে এ রকম লাশ উদ্ধারের ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটছে। এক দিন আগেই সিরাজদিখানে একটি আলুক্ষেত থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় কী মনে করা যায়, এই জেলাকে অপরাধীরা ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে বেছে নিয়েছে_কালের কণ্ঠের এ প্রশ্নের জবাবে জেলার পুলিশ সুপার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, 'ঠিক এমনটা নয়, অন্যান্য স্থানেও লাশ পাওয়া যায়। তবে মুন্সীগঞ্জের ওপর দিয়ে দুটি হাইওয়ে ও নদীপথ থাকায় এটা হচ্ছে।'
নিহত একজনের স্বজনরা তাঁকে হত্যার পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থাকার যে সন্দেহ করছেন, সে প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, 'আমরা প্রাথমিকভাবে এমনটা মনে করছি না। তদন্তেই বেরিয়ে আসবে সঠিক ঘটনা।'
স্ত্রীর লাশ রেখে পলায়ন : এদিকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এনে স্ত্রী শিরীন আক্তারের (২০) লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে স্বামী। টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দীঘিরপাড় ইউনিয়নের সরিষাবন গ্রামের নূর আলম স্ত্রী শিরীন আক্তারকে নিয়ে গতকাল সকাল ১০টায় এক প্রতিবেশীসহ মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় তাঁর স্বামী নূর আলম লাশ হাসপাতালে ফেলে রেখে লাপাত্তা হয়ে যায়। শিরীনের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি। সদর থনার ওসি আবুল বাশার জানান, মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
গাছে ঝুলন্ত লাশ : সিরাজদিখান উপজেলার শিয়ালদি গ্রামের নিজ বাড়ির লিচুগাছ থেকে আল আমিন (৩৫) নামের এক ব্যক্তির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি মোখলেছ চৌকিদারের ছেলে। পারিবারিক সূত্রের বরাত দিয়ে সিরাজদিখান থানার ওসি বলেন, বাবার সঙ্গে অভিমান করে রাতে নিজের মাফলার গলায় পেঁচিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সকালে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর লাশ দেখা যায়। দুই সন্তানের জনক আল আমিন আত্মহত্যা করেছেন, নাকি তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, তা নিরূপণে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ গতকাল সকালে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
স্ত্রীর লাশ রেখে স্বামীর পালিয়ে যাওয়া এবং গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা লাশ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার মোটরসাইকেলে করে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে নিয়ে দুই যুবককে গুলি করে হত্যা করে তাঁদের দুই সঙ্গী। নিহত দুজনের বাড়ি ঢাকার সাভার উপজেলায়। ধলেশ্বরীর পাড়ে তাঁদের হত্যা করে মোটরসাইকেলে ফিরে যায় খুনিরা।
নিহত ইব্রাহিমের পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ, তাঁকে হত্যার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন জড়িত থাকতে পারে। এ ছাড়া গতকাল মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে এক গৃহবধূকে চিকিৎসা করাতে এনে তিনি বেঁচে নেই শুনে লাশ ফেলে পালিয়ে যায় তাঁর স্বামী। এটিও হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিরাজদিখানের এক গ্রামে আরো এক ব্যক্তির লাশ গতকাল গাছ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এটি আত্মহত্যা বলে মনে করছে পুলিশ।
প্রথম লাশ : সকাল ৯টার দিকে রশুনিয়া বেইলি ব্রিজের নিচ থেকে উদ্ধার করা প্রথম মৃতদেহটি হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার নওপাড়া গ্রামের খোরশেদ আলমের ছেলে মো. ইব্রাহিমের (২০)। তাঁর মাথায় তিনটি গুলির চিহ্ন রয়েছে। গলায় একটি নতুন গামছা বাঁধা ছিল। ইব্রাহিম ঢাকার পূর্ব জুরাইনে তাঁর মামা আবদুস ছাত্তার মিয়ার বাড়িতে থাকতেন।
পরিবার সূত্র জানায়, কাতার যাওয়ার জন্য গত ১৬ জানুয়ারি ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য বনানী যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে তিনি নিখোঁজ হন। পরের দিন ১৭ জানুয়ারি তাঁর মা নাজমা বেগম ঢাকার কদমতলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। মামা আবদুস ছাত্তার কালের কণ্ঠকে জানান, নয়াবাজারের আবুলের গ্রিলের দোকানে কাজ করতেন ইব্রাহিম। তাঁর বাবা কুয়েতপ্রবাসী। বর্তমানে ছুটিতে দেশে থাকা অবস্থায় বড় ছেলের এমন মৃত্যুর খবরে এখন তিনি পাগলপ্রায়। ইব্রাহিমের মামা নাসির মিয়া ও আবদুস ছাত্তার বলেন, 'আমাদের ভাগ্নে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না, তাকে হয়তো গুম করার পর পরিকল্পিতভাবে কথিত ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে।'
সিরাজদিখান থানার ওসি শেখ মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাকার কদমতলী এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা ইসমাইল হত্যা মামলার আসামি ছিলেন ইব্রাহিম। একই মামলায় আটক সজীব পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ইব্রাহিমের নাম প্রকাশ করে। মামারা জানান, দুই ভাইয়ের মধ্যে ইব্রাহিম বড়। ছোট ভাই ইয়াসিন ঢাকার জুরাইনে একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।
দ্বিতীয় লাশ : রশুনিয়া বেইলি ব্রিজের অদূরে ইমামগঞ্জ গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে সকাল সাড়ে ১১টায় উদ্ধার করা হয় মাথায় ও বুকে গুলিবিদ্ধ আবদুল কুদ্দুসের (৪২) লাশ। তিনি কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা গ্রামে বসবাস করতেন। তবে তাঁর বাবা আবদুল খালেক ব্যাপারীর বাড়ি মাদারীপুর জেলার গোগলী গ্রামে। আবদুল কুদ্দুসের বড় ভাই সারোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, ১৪ দিন ধরে তাঁর ভাই নিখোঁজ ছিলেন। কেরানীগঞ্জের আমবাগিচার পানাকা মার্কেটের এক পোশাকের দোকানের মালিক ছিলেন তাঁর ভাই। দোকান থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার পথে ১১ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে তিনি নিখোঁজ হন। কুদ্দুস তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তাঁর স্ত্রী সোহাদা বেগম শোকে এখন পাগলপ্রায়।
তৃতীয় লাশ : রশুনিয়া থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে শ্রীনগর উপজেলার শ্রীধরপুর সড়কের পাশে দুপুর সাড়ে ১২টায় মাসুদ হোসেন ওরফে রাঢ়ী মাসুদের (৩২) লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি কেরানীগঞ্জে নিজের বাড়িতে থাকতেন। বাবার নাম মিজান খান। তাঁর স্নেহা নামের আড়াই বছরের এক কন্যাসন্তান রয়েছে। তাঁর স্ত্রী শায়লা বেগম ৯ মাসের গর্ভবতী। মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে লাশ শনাক্তের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সঙ্গে থাকা তাঁর ভাবি নূরজাহান বেগম জানান, মাসুদ ঢাকার সোয়ারীঘাটের খেয়া পারাপারের টোল আদায় করতেন। ১১ জানুয়ারি বিকেলে তিনি বাসা থেকে পোস্তগোলার উদ্দেশে যাত্রা করেন পাওনা ২০ হাজার টাকা আনতে।
নূরজাহান বেগম বলেন, মাসুদ জমির একটি প্লট বিক্রি করেছিলেন নাজমুল নামের এক ব্যক্তির কাছে। ওই ব্যক্তি সেখানে একতলা ভবন তৈরি করে। তিনি বেশি জমি দখলে রাখায় বাড়ি ভাড়া তুলতেন মাসুদ। এ নিয়ে নাজমুলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। নাজমুল অতিরিক্ত জমি বাবদ ২০ হাজার টাকা দেবে শুনে সেই টাকা আনতেই তিনি পোস্তগোলার উদ্দেশে রওনা হন। কালের কণ্ঠের কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি মাসুদের পরিবার সূত্রে জানান, টাকা আনতে তিনি সঙ্গে নেন প্রতিবেশী কুদ্দুসকে। এর পর থেকে তাঁরা নিখোঁজ ছিলেন।
শ্রীনগর থানার ওসি মো. মিজানুর রহমান জানান, এলাকাবাসীর কাছ থেকে খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করা হয়। স্বজনরা লাশ শনাক্ত করেছে। তিনটি হত্যার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। তবে কিভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা নিশ্চিত করা যায়নি। মাসুদের মাথায় ও গলায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া দুটি নতুন গামছা দিয়ে তাঁর চোখ বাঁধা ছিল।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি শাখাওয়াৎ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার জানামতে এদের (মাসুদ ও কুদ্দুস) নামে কোনো মামলা নেই।' কালের কণ্ঠের প্রতিনিধি গত রাতে মাসুদের বাড়িতে গেলে তাঁর স্ত্রী শায়লা বেগম (৩০) কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, সাত বছর আগে তাঁর স্বামী পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকায় পৌনে এক শতাংশ জমি বিক্রি করেন এলাকায় ঘরজামাই থাকা বরিশালের নাজমুলের কাছে। ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার পর নাজমুল মাঝে মাঝে ৫-১০ হাজার করে টাকা দিচ্ছিল। নিখোঁজ হওয়ার দিন নাজমুলের ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে এক যুবক মাসুদকে পোস্তগোলায় গিয়ে ২০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলে। রাত ৮টার দিকে মাসুদ প্রতিবেশী কুদ্দুসকে সঙ্গে নিয়ে পোস্তগোলায় রওনা হয়ে আর ফেরেননি। শায়লা বেগম ১৪ জানুয়ারি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি জিডি করেন।
রাতে নাজমুলের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। সে কয়েক দিন হলো বরিশাল গেছে বলে জানায় বাড়ির লোকজন। কুদ্দুসের ঘরে গিয়ে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। প্রতিবেশীরা জানান, তাঁর স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে গেছেন। আর ভাইয়েরা লাশ শনাক্তের জন্য মুন্সীগঞ্জে গিয়ে তখনো ফেরেননি।
মুন্সীগঞ্জে এ রকম লাশ উদ্ধারের ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটছে। এক দিন আগেই সিরাজদিখানে একটি আলুক্ষেত থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় কী মনে করা যায়, এই জেলাকে অপরাধীরা ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে বেছে নিয়েছে_কালের কণ্ঠের এ প্রশ্নের জবাবে জেলার পুলিশ সুপার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, 'ঠিক এমনটা নয়, অন্যান্য স্থানেও লাশ পাওয়া যায়। তবে মুন্সীগঞ্জের ওপর দিয়ে দুটি হাইওয়ে ও নদীপথ থাকায় এটা হচ্ছে।'
নিহত একজনের স্বজনরা তাঁকে হত্যার পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থাকার যে সন্দেহ করছেন, সে প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, 'আমরা প্রাথমিকভাবে এমনটা মনে করছি না। তদন্তেই বেরিয়ে আসবে সঠিক ঘটনা।'
স্ত্রীর লাশ রেখে পলায়ন : এদিকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এনে স্ত্রী শিরীন আক্তারের (২০) লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে স্বামী। টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দীঘিরপাড় ইউনিয়নের সরিষাবন গ্রামের নূর আলম স্ত্রী শিরীন আক্তারকে নিয়ে গতকাল সকাল ১০টায় এক প্রতিবেশীসহ মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় তাঁর স্বামী নূর আলম লাশ হাসপাতালে ফেলে রেখে লাপাত্তা হয়ে যায়। শিরীনের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি। সদর থনার ওসি আবুল বাশার জানান, মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
গাছে ঝুলন্ত লাশ : সিরাজদিখান উপজেলার শিয়ালদি গ্রামের নিজ বাড়ির লিচুগাছ থেকে আল আমিন (৩৫) নামের এক ব্যক্তির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি মোখলেছ চৌকিদারের ছেলে। পারিবারিক সূত্রের বরাত দিয়ে সিরাজদিখান থানার ওসি বলেন, বাবার সঙ্গে অভিমান করে রাতে নিজের মাফলার গলায় পেঁচিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সকালে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর লাশ দেখা যায়। দুই সন্তানের জনক আল আমিন আত্মহত্যা করেছেন, নাকি তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, তা নিরূপণে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ গতকাল সকালে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
স্ত্রীর লাশ রেখে স্বামীর পালিয়ে যাওয়া এবং গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা লাশ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার মোটরসাইকেলে করে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে নিয়ে দুই যুবককে গুলি করে হত্যা করে তাঁদের দুই সঙ্গী। নিহত দুজনের বাড়ি ঢাকার সাভার উপজেলায়। ধলেশ্বরীর পাড়ে তাঁদের হত্যা করে মোটরসাইকেলে ফিরে যায় খুনিরা।
No comments