প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১৮ নিয়ে বিশেষ আয়োজনসৃজনশীল শাখা- গল্প শুধু গল্প নয় by মশিউল আলম
কালাশনিকভের গোলাপ ওয়াসি আহমেদ প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১২, প্রকাশক: শুদ্ধস্বর দাম: ১৫০ টাকা জীবনের উপরিতলের বাস্তবতায় যে ব্যক্তিমানুষকে দেখা যায়, সে সম্পূর্ণরূপে সে নয়। তার প্রকৃত সত্তার পূর্ণতর ছবি পেতে হলে প্রবেশ করতে হয় তার অন্তরের গহিনে।
সেই কাজটি করেন কথাসাহিত্যিক। পাশের মানুষটির কথায়, কাজে ও ব্যবহারে আমরা যা দেখতে পাই না, তিনি তা আমাদের দেখিয়ে দেন। যা দেখতে পাই, তিনি উন্মোচন করেন তাঁর গূঢ়তম অর্থ। কালাশনিকভের গোলাপ গল্পগ্রন্থের লেখক ওয়াসি আহমেদ তেমনই একজন কথাসাহিত্যিক, দৃশ্যমান বাস্তবের গভীরে ডুব দিয়ে যিনি তুলে আনেন সত্তার রূপ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের সোভিয়েত সৈনিক মিখাইল কালাশনিকভের নকশায় নির্মিত অটোম্যাটিক অ্যাসল্ট রাইফেল আফতোমাত কালাশনিকভ-৪৭ (একে-৪৭) নিয়ে যে গল্প ওয়াসি আহমেদ ফেঁদেছেন, সেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতার অন্যতম আলোচিত প্রসঙ্গ ‘ক্রসফায়ার’ আছে। কিন্তু সত্যি সত্যি কোনো ক্রসফায়ার এই গল্পে ঘটে না, যদিও ঘটে যেতে পারত বলে পাঠকের মনে হবে, অথবা মনে হবে ঘটার সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি, অচিরেই ঘটবে। কিন্তু গল্পকার পাঠককে নিয়ে সেই দৃশ্য পর্যন্ত পৌঁছার আগেই থেমে যাবেন। কারণ, ক্রসফায়ারের গল্প বলা তাঁর উদ্দেশ্য নয়।
একটি একে-৪৭ কম্বলে মুড়িয়ে দিনাজপুর থেকে বাসযোগে ঢাকা পৌঁছার পর একটা লোক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। এতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, লেখকের দৃষ্টি সেই দিকে। কিন্তু দৃশ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ লোকটির মানসিক অবস্থার প্রতি, যে লোক ক্রসফায়ারের আশঙ্কায় ভুগতে আরম্ভ করে, কিন্তু ক্রসফায়ার ঘটল না দেখে ভাবে, বাকি জীবন কারাগারে পচে মরার চেয়ে বুক বরাবর গুলি খেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল, অথবা এই ভাবনাও তার নিশ্চিত, দৃঢ়মূল নয়—বরং রাইফেলটা নিয়ে দিনাজপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসার পথের কথা তার স্মরণে আসে, তার চেতনাপ্রবাহ ঘটে। এরই মধ্যে লেখক ছোটেন স্বয়ং মিখাইল কালাশনিকভের পেছনে, যিনি আসলে একজন কবি, গোলাপ যাঁর প্রিয় ফুল, যিনি লিখেছেন ‘এ রোজ ইজ এ রেডিয়েন্ট রোজ,’ যিনি রাইফেলের নকশা করতে চাননি, চেয়েছিলেন একটি যুগান্তকারী কৃষিযন্ত্রের নকশা করতে, ‘ক্ষুধা-দারিদ্র্যের পৃথিবীতে যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।’ অবৈধ অস্ত্র বহনকারী লোকটি, যে পেশাদার সন্ত্রাসী, না চরমপন্থী বাম রাজনীতিক, নাকি ইসলামপন্থী জঙ্গি, তাতে যেন লেখকের কিছু যায়-আসে না, যেন তিনি তার গল্প বলতে চাননি, চেয়েছেন আসলে কবি কালাশনিকভের গল্প বলতে, যাঁর প্রিয় ফুল গোলাপ।
যেন সেই একই সূত্র কাজ করে ‘নিরাপদ সন্ত্রাস’ শিরোনামের গল্পটির আলী নেওয়াজের বেলায়ও, যে আর্মড পুলিশের একজন এসআই, প্রতিদিন মানুষ ঠেঙানো যার কাজ, যে কাজে তাকে উৎসাহ জোগায় তার স্ত্রী শান্তাও। কিন্তু তার নিত্যদিনের এই কর্তব্য পালন ও জীবন যাপনের দৃশ্যপটে পুরোপুরি চেনা যাবে না সত্যিকারের মানুষটাকে। একবার এক হাঙ্গামায় পাবলিক পেটাতে গিয়ে আলী নেওয়াজ লাথি মেরেছিল এক গর্ভবতী নারীর পেটে; সেই ঘটনার অভিঘাতে তার সেই আঘাতকারী বাঁ পা ঘুমের ঘোরে মাঝেমধ্যেই অস্বাভাবিক আচরণ করে—লেখকের বয়ানে আমরা এই কাহিনি জানার এক ফাঁকে এ-ও জানতে পাই যে আলী নেওয়াজ ও শান্তার বিয়ের পরে পেরিয়ে গেছে সাতটা বছর, কিন্তু তাদের কোনো সন্তান নেই। সন্তানহীন দম্পতিদের সম্পর্কে আর দশটি গল্পের মতো উচ্চকিত হাহাকার নেই এই গল্পে, বরং আপাতদৃশ্যে এরা সুখী বলেই মনে হয়। আবার, পাবলিক পেটানো এই লোকটি হঠাৎ একটা নভেল পড়ে কাঁদে—এমন অস্বাভাবিক কাণ্ডও আমরা দেখতে পাই। আলী নেওয়াজ সম্পর্কে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক খবর হলো, একদিন সে ‘কামের ডায়েরি’তে লিখবে: ‘জীবনে কত কিছুই না মানুষের অনুভব করার আছে—কত বেদনা, কত কান্না!’
কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে উত্তম পুরুষে লেখা গল্পটি মনে হয় যেন ইলিয়াসের মুখের কথা, টেপরেকর্ডার থেকে হুবহু নামানো হয়েছে। কিন্তু আসলে যে তা নয়, এতেই কথাশিল্পী হিসেবে ওয়াসি আহমেদের মুনশিয়ানা।
নিরক্ষর রিকশাচালক শিক্ষিত ভদ্রলোকের চড় খেয়ে তাঁকে ‘মূর্খ’ বলে গালি দেওয়ার পর থেকে পুরো জনপদে গালি হিসেবে ‘মূর্খ’ শব্দটির ব্যবহার মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে, অথবা জুয়েল আইচের মতো কোনো ম্যাজিকওয়ালা এক ফুৎকারে বাঙালির গৌরবের ধন শহীদ মিনারকে গায়েব করে দিলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে? সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন কথাশিল্পী ওয়াসি আহমেদ তাঁর পাঠককে এ রকম মুহূর্তের সামনেও দাঁড় করিয়ে দেন। স্মৃতি জাগাতে তিনি ওস্তাদ, তার একটি উত্তম দৃষ্টান্ত এ বইয়ের ‘একটি প্রত্যাবর্তনের রূপরেখা’ শিরোনামের গল্পটি। তাঁর গল্পের বিষয় ও চরিত্রের বৈচিত্র্য তাঁর বিশদ অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর। আখ্যানের ভাষা ও কুশীলবের সংলাপে যে বহুস্বর শোনা যায়, তাতে ফুটে ওঠে কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর মুনশিয়ানা।
ওয়াসি আহমেদ সেই প্রস্তুত কথাসাহিত্যিক, যাঁর হাতে যেকোনো মুহূর্ত বা ঘটনা গল্প হয়ে ওঠে। তাঁর গল্প পাঠককে একই সঙ্গে আনন্দ দেয়, বিষণ্ন করে এবং ভাবায়। জীবনের আটপৌরে প্রাত্যহিকতার মধ্যে বিরল একেকটা মুহূর্ত আসে, যখন ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত হয়—ওয়াসি আহমেদ সেই মুহূর্তের ছবি আঁকেন নিপুণ কথাশিল্পীর দক্ষতায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের সোভিয়েত সৈনিক মিখাইল কালাশনিকভের নকশায় নির্মিত অটোম্যাটিক অ্যাসল্ট রাইফেল আফতোমাত কালাশনিকভ-৪৭ (একে-৪৭) নিয়ে যে গল্প ওয়াসি আহমেদ ফেঁদেছেন, সেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতার অন্যতম আলোচিত প্রসঙ্গ ‘ক্রসফায়ার’ আছে। কিন্তু সত্যি সত্যি কোনো ক্রসফায়ার এই গল্পে ঘটে না, যদিও ঘটে যেতে পারত বলে পাঠকের মনে হবে, অথবা মনে হবে ঘটার সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি, অচিরেই ঘটবে। কিন্তু গল্পকার পাঠককে নিয়ে সেই দৃশ্য পর্যন্ত পৌঁছার আগেই থেমে যাবেন। কারণ, ক্রসফায়ারের গল্প বলা তাঁর উদ্দেশ্য নয়।
একটি একে-৪৭ কম্বলে মুড়িয়ে দিনাজপুর থেকে বাসযোগে ঢাকা পৌঁছার পর একটা লোক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। এতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, লেখকের দৃষ্টি সেই দিকে। কিন্তু দৃশ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ লোকটির মানসিক অবস্থার প্রতি, যে লোক ক্রসফায়ারের আশঙ্কায় ভুগতে আরম্ভ করে, কিন্তু ক্রসফায়ার ঘটল না দেখে ভাবে, বাকি জীবন কারাগারে পচে মরার চেয়ে বুক বরাবর গুলি খেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল, অথবা এই ভাবনাও তার নিশ্চিত, দৃঢ়মূল নয়—বরং রাইফেলটা নিয়ে দিনাজপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসার পথের কথা তার স্মরণে আসে, তার চেতনাপ্রবাহ ঘটে। এরই মধ্যে লেখক ছোটেন স্বয়ং মিখাইল কালাশনিকভের পেছনে, যিনি আসলে একজন কবি, গোলাপ যাঁর প্রিয় ফুল, যিনি লিখেছেন ‘এ রোজ ইজ এ রেডিয়েন্ট রোজ,’ যিনি রাইফেলের নকশা করতে চাননি, চেয়েছিলেন একটি যুগান্তকারী কৃষিযন্ত্রের নকশা করতে, ‘ক্ষুধা-দারিদ্র্যের পৃথিবীতে যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।’ অবৈধ অস্ত্র বহনকারী লোকটি, যে পেশাদার সন্ত্রাসী, না চরমপন্থী বাম রাজনীতিক, নাকি ইসলামপন্থী জঙ্গি, তাতে যেন লেখকের কিছু যায়-আসে না, যেন তিনি তার গল্প বলতে চাননি, চেয়েছেন আসলে কবি কালাশনিকভের গল্প বলতে, যাঁর প্রিয় ফুল গোলাপ।
যেন সেই একই সূত্র কাজ করে ‘নিরাপদ সন্ত্রাস’ শিরোনামের গল্পটির আলী নেওয়াজের বেলায়ও, যে আর্মড পুলিশের একজন এসআই, প্রতিদিন মানুষ ঠেঙানো যার কাজ, যে কাজে তাকে উৎসাহ জোগায় তার স্ত্রী শান্তাও। কিন্তু তার নিত্যদিনের এই কর্তব্য পালন ও জীবন যাপনের দৃশ্যপটে পুরোপুরি চেনা যাবে না সত্যিকারের মানুষটাকে। একবার এক হাঙ্গামায় পাবলিক পেটাতে গিয়ে আলী নেওয়াজ লাথি মেরেছিল এক গর্ভবতী নারীর পেটে; সেই ঘটনার অভিঘাতে তার সেই আঘাতকারী বাঁ পা ঘুমের ঘোরে মাঝেমধ্যেই অস্বাভাবিক আচরণ করে—লেখকের বয়ানে আমরা এই কাহিনি জানার এক ফাঁকে এ-ও জানতে পাই যে আলী নেওয়াজ ও শান্তার বিয়ের পরে পেরিয়ে গেছে সাতটা বছর, কিন্তু তাদের কোনো সন্তান নেই। সন্তানহীন দম্পতিদের সম্পর্কে আর দশটি গল্পের মতো উচ্চকিত হাহাকার নেই এই গল্পে, বরং আপাতদৃশ্যে এরা সুখী বলেই মনে হয়। আবার, পাবলিক পেটানো এই লোকটি হঠাৎ একটা নভেল পড়ে কাঁদে—এমন অস্বাভাবিক কাণ্ডও আমরা দেখতে পাই। আলী নেওয়াজ সম্পর্কে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক খবর হলো, একদিন সে ‘কামের ডায়েরি’তে লিখবে: ‘জীবনে কত কিছুই না মানুষের অনুভব করার আছে—কত বেদনা, কত কান্না!’
কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে উত্তম পুরুষে লেখা গল্পটি মনে হয় যেন ইলিয়াসের মুখের কথা, টেপরেকর্ডার থেকে হুবহু নামানো হয়েছে। কিন্তু আসলে যে তা নয়, এতেই কথাশিল্পী হিসেবে ওয়াসি আহমেদের মুনশিয়ানা।
নিরক্ষর রিকশাচালক শিক্ষিত ভদ্রলোকের চড় খেয়ে তাঁকে ‘মূর্খ’ বলে গালি দেওয়ার পর থেকে পুরো জনপদে গালি হিসেবে ‘মূর্খ’ শব্দটির ব্যবহার মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে, অথবা জুয়েল আইচের মতো কোনো ম্যাজিকওয়ালা এক ফুৎকারে বাঙালির গৌরবের ধন শহীদ মিনারকে গায়েব করে দিলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে? সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন কথাশিল্পী ওয়াসি আহমেদ তাঁর পাঠককে এ রকম মুহূর্তের সামনেও দাঁড় করিয়ে দেন। স্মৃতি জাগাতে তিনি ওস্তাদ, তার একটি উত্তম দৃষ্টান্ত এ বইয়ের ‘একটি প্রত্যাবর্তনের রূপরেখা’ শিরোনামের গল্পটি। তাঁর গল্পের বিষয় ও চরিত্রের বৈচিত্র্য তাঁর বিশদ অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর। আখ্যানের ভাষা ও কুশীলবের সংলাপে যে বহুস্বর শোনা যায়, তাতে ফুটে ওঠে কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর মুনশিয়ানা।
ওয়াসি আহমেদ সেই প্রস্তুত কথাসাহিত্যিক, যাঁর হাতে যেকোনো মুহূর্ত বা ঘটনা গল্প হয়ে ওঠে। তাঁর গল্প পাঠককে একই সঙ্গে আনন্দ দেয়, বিষণ্ন করে এবং ভাবায়। জীবনের আটপৌরে প্রাত্যহিকতার মধ্যে বিরল একেকটা মুহূর্ত আসে, যখন ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত হয়—ওয়াসি আহমেদ সেই মুহূর্তের ছবি আঁকেন নিপুণ কথাশিল্পীর দক্ষতায়।
No comments