সময়ের প্রেক্ষিত- জাপানে জাতীয়তাবাদী চেতনার পুনরুত্থান by মনজুরুল হক
জাপানের গত মাসের সংসদ নির্বাচন নানা দিক থেকে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। প্রায় সাড়ে তিন বছর ক্ষমতাসীন গণতন্ত্রী দলের পরাজয় যে প্রায় নিশ্চিত হয়ে দেখা দিয়েছিল, ভোট গ্রহণের আগেই তার কিছু আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।
তবে সেই পরাজয় কতটা ব্যাপক হবে এবং কতটা ব্যাপক রদবদল দেশের অনুসৃত নীতিমালায় তা নিয়ে আসতে পারে, সেই প্রশ্নে অনেকেই অবশ্য নিশ্চিত ছিলেন না। যদিও গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হলে জাতীয়তাবাদী চেতনার সুপ্ত ধারায় নতুন প্রাণের সঞ্চার হওয়া বেশ ভালোভাবেই লক্ষ করা যাচ্ছিল। এ নির্বাচনের ফলাফল সেই আলোকে দেখা অনেক বেশি যুক্তিসংগত হতে পারে।
নির্বাচনী ফলাফলে গণতন্ত্রী দলের ভরাডুবি চমকের একটা দিক। অন্যদিকে, ১৯৫৫ সালে জাপানের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে ২০০৯ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো বিপর্যয়ের মুখোমুখি উদার গণতন্ত্রীরা নিম্নকক্ষের ৪৮০টি আসনের মধ্যে একাই পেয়েছে ২৯৪টি। আর সেই হিসাবের সঙ্গে দলের নির্বাচনী শরিক কোমেই পার্টির জেতা ৩১টি আসন যোগ করা হলে দুই-তৃতীয়াংশের হিসাব আমরা সহজেই পেয়ে যাই, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের যাবতীয় সংশয় আর দুশ্চিন্তা এখন যে হিসাবকে ঘিরে আবর্তিত। বিশাল এ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও তাঁর নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যরা জাতীয়তাবাদী চেতনার পালে লাগা নতুন হাওয়ায় অনুপ্রাণিত হয়ে যেসব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন, দেশের ভেতরে এবং বিদেশে অনেকেই তাতে উদ্বিগ্ন।
প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে অবশ্য নববর্ষের প্রাক্কালে দায়িত্ব গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে নতুন এক দৃষ্টান্ত জাপানের জন্য স্থাপন করলেন। সেটা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইয়োশিদার পর একমাত্র তিনিই দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন। এর আগে, ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে বছর না ঘুরতেই অসুস্থতার কারণে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া তাঁর জন্য ছিল বড় ধরনের এক রাজনৈতিক বিপর্যয়। রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকেই সেটাকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি হিসেবে গণ্য করলেও গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে উদার গণতন্ত্রী দলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের আসনে আবারও ফিরে আসার পথ তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন। এটা শেষ পর্যন্ত তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। তবে এত বড় বিজয় সত্ত্বেও সামনের পথ তাঁর জন্য খুব একটা মসৃণ হবে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, উদার গণতন্ত্রীদের বিজয়ের পেছনে দলের ঘোষিত নীতিমালার প্রতি জনসমর্থন যতটা কাজ করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল সাড়ে তিন বছরের চূড়ান্ত ব্যর্থতার জন্য গণতন্ত্রী দলকে শায়েস্তা করার মানসিকতা। তাই উদার গণতন্ত্রীদের এ বিজয়কে তাদের ঘোষিত নীতিমালার বিজয় হিসেবে গণ্য করা মস্ত বড় ভুল হবে। সে ভুল বিজয়ী দলের নেতৃত্ব ইতিমধ্যে করতে শুরু করেছেন।
জাপানের ভোটাররা যে আশা-প্রত্যাশা নিয়ে ২০০৯ সালে গণতন্ত্রী দলকে ক্ষমতাসীন করেছিলেন, দলটি সে আশা-প্রত্যাশাকে কার্যত পদদলিত করায় এর পরিণাম দলটিকে এখন ভোগ করতে হচ্ছে। জনগণ তখন আসলেই বিকল্প এক শক্তিকে ক্ষমতাসীন দেখতে চেয়েছিল, যারা সরকার গঠন করে জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। তবে ক্ষমতা গ্রহণের সূচনালগ্ন থেকে ক্রমেই উদার গণতন্ত্রীদের দেখিয়ে দেওয়া পথে দলটির পদচারণ এমন এক গন্তব্যে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রী দলকে নিয়ে যায়, যেখানে কি না উদার গণতন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের আদর্শগত কোনো রকম ব্যবধান আর লক্ষ করা যায়নি। শুধু তা-ই নয়, একই পথে পদচারণ করা সত্ত্বেও সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চূড়ান্ত ব্যর্থতা ও সিদ্ধান্তহীনতা ভোটারদের এটাও বুঝিয়ে দেয় যে সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞতার অভাব কোনো অবস্থাতেই কার্যকর বিকল্প হয়ে দেখা দিতে পারে না। ফলে উদার গণতন্ত্রীদের ক্ষমতায় ফিরে আসা অনেকটাই যেন ছিল খুব স্বাভাবিক এক পরিণতি। তা সত্ত্বেও দলটির এত বড় বিজয় বেশ কিছু অস্বাভাবিকতার জন্ম এখন দিয়েছে, যার শুরুতেই আছে দেশের সংবিধানের ভবিষ্যৎ ঘিরে দেখা দেওয়া অনিশ্চয়তা।
জাতীয়তাবাদী চেতনার পালে নতুন করে হাওয়া লাগার যে কথা শুরুতেই বলা হয়েছে, সংবিধানকে ঘিরে দেখা দেওয়া অনিশ্চয়তা তার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। প্রধানমন্ত্রী আবে ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অনেকেই যে জাপানের সংবিধান, বিশেষ করে এর নবম ধারা নিয়ে খুবই অস্বস্তিতে ভুগছেন, সে কথা তাঁরা কখনোই গোপন রাখেননি। সংবিধানের নবম ধারাটি নতুন করে সমরশক্তি হিসেবে জাপানের আবির্ভাবের পথে বাধা। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে সেখানে সামরিক বাহিনী রাখাও নিষিদ্ধ করা হয়; যদিও নানা রকম ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে জাপান সে রকম একটি বাহিনীই কেবল গড়েনি, সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে বিশ্বের পঞ্চম রাষ্ট্রেও পরিণত হয়েছে। তবু সংবিধানের এ ধারাটি জাপানকে নব্য সামরিক শক্তি হয়ে ওঠার পক্ষের রাজনীতিকদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে আছে। বিপুল জনসমর্থন ঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে তাঁরা সে সেই অস্বস্তি দূর করতে চাইবেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে রকম ইঙ্গিত দিয়েছেন, অস্বস্তিকর আরও কিছু বিষয় থেকে মুক্ত হতে পারার কথাও বলছেন, জাপানের কলঙ্কিত কিছু অতীতকে অস্বীকার করার প্রয়াস যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
এর সবটার মূলেই অবশ্য আছে পূর্ব এশিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি হঠাৎ করে কিছুটা সংঘাতময় হয়ে ওঠা। পূর্ব চীন সাগরে চীনা রণতরির বলিষ্ঠ পদচারণ এবং জাপান সাগরের বিতর্কিত একটি দ্বীপের ওপর দক্ষিণ কোরিয়ার আধিপত্য তুলে ধরার প্রয়াস জাপানকে হঠাৎ করেই যেন অঞ্চলজুড়ে কিছুটা একঘরে করে তুলেছে। সেই সঙ্গে দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার ব্যর্থতার ফলেও রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে, বাড়ছে জাতীয়তাবাদী সস্তা আবেগ। ওসাকায় তরুণ জাতীয়তাবাদী নেতা তোরু হাশিমোতোর আবির্ভাব এবং শিনজো আবের নেতৃত্বে উদার গণতন্ত্রীদের আরও বেশি করে জাতীয়তাবাদী পথে পদচারণ সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন। এটা জাপানকে ক্রমেই নিয়ে যাচ্ছে আরও বেশি সংঘাতময় পথে।
তবে বিরাট বিজয় সত্ত্বেও সাংবিধানিক পরিবর্তনের পথ তৈরি করা জাপানের নতুন নেতৃত্বের জন্য ততটা সহজ না-ও হতে পারে। কারণ, সংবিধান সংশোধনের পথটি জটিল। জাপানের সংবিধানের ছিয়ানব্বইতম ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানের যেকোনো রদবদলের আলোচনা শুরু করতে হলে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন দরকার। উদার গণতন্ত্রীরা নির্বাচনী শরিকের সঙ্গে মিলে নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করলেও উচ্চকক্ষে তারা সংখ্যালঘু। এ ছাড়া তাদের শরিক কোমেই পার্টি বরাবরই সংবিধানের নবম ধারা পরিবর্তনের বিরোধী। ফলে সাংবিধানিক সংস্কার প্রশ্নে তারা যে উদার গণতন্ত্রীদের সমর্থন দেবে, তা নিশ্চিত ধরে নেওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই বিকল্প পথের খোঁজ করা থেকেও উদার গণতন্ত্রীরা এখন পিছিয়ে নেই। সে পথ হচ্ছে ওসাকার মেয়রের কট্টর দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া। তবে এর সবটাই অবশ্য নির্ভর করবে আগামী গ্রীষ্মে নির্ধারিত উচ্চকক্ষের অর্ধেক সংখ্যক আসনের জন্য গ্রহণ করা ভোটের ফলাফলের ওপর।
জাপানের ভোটদাতাদের এই একটি বিষয়ে অতীতে সব সময় অনেক বেশি সংযম প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। নিম্নকক্ষে বিজয়ী দলকে উচ্চকক্ষের নির্বাচনে ঢালাওভাবে ভোট দেওয়া থেকে অধিকাংশ সময়ই তাঁরা বিরত থেকেছেন। ফলে অনেকেই এখন আশা করছেন, আগামী গ্রীষ্মে সেই একই হিসাবের পুনরাবৃত্তি হয়তো লক্ষ করা যাবে। সেটা সাময়িকভাবে হলেও উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঠেকাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে বাস্তবে কী ঘটে, তা দেখার জন্য আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।
টোকিও থেকে
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
নির্বাচনী ফলাফলে গণতন্ত্রী দলের ভরাডুবি চমকের একটা দিক। অন্যদিকে, ১৯৫৫ সালে জাপানের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে ২০০৯ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো বিপর্যয়ের মুখোমুখি উদার গণতন্ত্রীরা নিম্নকক্ষের ৪৮০টি আসনের মধ্যে একাই পেয়েছে ২৯৪টি। আর সেই হিসাবের সঙ্গে দলের নির্বাচনী শরিক কোমেই পার্টির জেতা ৩১টি আসন যোগ করা হলে দুই-তৃতীয়াংশের হিসাব আমরা সহজেই পেয়ে যাই, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের যাবতীয় সংশয় আর দুশ্চিন্তা এখন যে হিসাবকে ঘিরে আবর্তিত। বিশাল এ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও তাঁর নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যরা জাতীয়তাবাদী চেতনার পালে লাগা নতুন হাওয়ায় অনুপ্রাণিত হয়ে যেসব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন, দেশের ভেতরে এবং বিদেশে অনেকেই তাতে উদ্বিগ্ন।
প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে অবশ্য নববর্ষের প্রাক্কালে দায়িত্ব গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে নতুন এক দৃষ্টান্ত জাপানের জন্য স্থাপন করলেন। সেটা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইয়োশিদার পর একমাত্র তিনিই দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন। এর আগে, ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে বছর না ঘুরতেই অসুস্থতার কারণে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া তাঁর জন্য ছিল বড় ধরনের এক রাজনৈতিক বিপর্যয়। রাজনীতি বিশ্লেষকদের অনেকেই সেটাকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি হিসেবে গণ্য করলেও গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে উদার গণতন্ত্রী দলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের আসনে আবারও ফিরে আসার পথ তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন। এটা শেষ পর্যন্ত তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। তবে এত বড় বিজয় সত্ত্বেও সামনের পথ তাঁর জন্য খুব একটা মসৃণ হবে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, উদার গণতন্ত্রীদের বিজয়ের পেছনে দলের ঘোষিত নীতিমালার প্রতি জনসমর্থন যতটা কাজ করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল সাড়ে তিন বছরের চূড়ান্ত ব্যর্থতার জন্য গণতন্ত্রী দলকে শায়েস্তা করার মানসিকতা। তাই উদার গণতন্ত্রীদের এ বিজয়কে তাদের ঘোষিত নীতিমালার বিজয় হিসেবে গণ্য করা মস্ত বড় ভুল হবে। সে ভুল বিজয়ী দলের নেতৃত্ব ইতিমধ্যে করতে শুরু করেছেন।
জাপানের ভোটাররা যে আশা-প্রত্যাশা নিয়ে ২০০৯ সালে গণতন্ত্রী দলকে ক্ষমতাসীন করেছিলেন, দলটি সে আশা-প্রত্যাশাকে কার্যত পদদলিত করায় এর পরিণাম দলটিকে এখন ভোগ করতে হচ্ছে। জনগণ তখন আসলেই বিকল্প এক শক্তিকে ক্ষমতাসীন দেখতে চেয়েছিল, যারা সরকার গঠন করে জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। তবে ক্ষমতা গ্রহণের সূচনালগ্ন থেকে ক্রমেই উদার গণতন্ত্রীদের দেখিয়ে দেওয়া পথে দলটির পদচারণ এমন এক গন্তব্যে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রী দলকে নিয়ে যায়, যেখানে কি না উদার গণতন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের আদর্শগত কোনো রকম ব্যবধান আর লক্ষ করা যায়নি। শুধু তা-ই নয়, একই পথে পদচারণ করা সত্ত্বেও সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চূড়ান্ত ব্যর্থতা ও সিদ্ধান্তহীনতা ভোটারদের এটাও বুঝিয়ে দেয় যে সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞতার অভাব কোনো অবস্থাতেই কার্যকর বিকল্প হয়ে দেখা দিতে পারে না। ফলে উদার গণতন্ত্রীদের ক্ষমতায় ফিরে আসা অনেকটাই যেন ছিল খুব স্বাভাবিক এক পরিণতি। তা সত্ত্বেও দলটির এত বড় বিজয় বেশ কিছু অস্বাভাবিকতার জন্ম এখন দিয়েছে, যার শুরুতেই আছে দেশের সংবিধানের ভবিষ্যৎ ঘিরে দেখা দেওয়া অনিশ্চয়তা।
জাতীয়তাবাদী চেতনার পালে নতুন করে হাওয়া লাগার যে কথা শুরুতেই বলা হয়েছে, সংবিধানকে ঘিরে দেখা দেওয়া অনিশ্চয়তা তার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। প্রধানমন্ত্রী আবে ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অনেকেই যে জাপানের সংবিধান, বিশেষ করে এর নবম ধারা নিয়ে খুবই অস্বস্তিতে ভুগছেন, সে কথা তাঁরা কখনোই গোপন রাখেননি। সংবিধানের নবম ধারাটি নতুন করে সমরশক্তি হিসেবে জাপানের আবির্ভাবের পথে বাধা। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে সেখানে সামরিক বাহিনী রাখাও নিষিদ্ধ করা হয়; যদিও নানা রকম ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে জাপান সে রকম একটি বাহিনীই কেবল গড়েনি, সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে বিশ্বের পঞ্চম রাষ্ট্রেও পরিণত হয়েছে। তবু সংবিধানের এ ধারাটি জাপানকে নব্য সামরিক শক্তি হয়ে ওঠার পক্ষের রাজনীতিকদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে আছে। বিপুল জনসমর্থন ঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে তাঁরা সে সেই অস্বস্তি দূর করতে চাইবেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে রকম ইঙ্গিত দিয়েছেন, অস্বস্তিকর আরও কিছু বিষয় থেকে মুক্ত হতে পারার কথাও বলছেন, জাপানের কলঙ্কিত কিছু অতীতকে অস্বীকার করার প্রয়াস যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
এর সবটার মূলেই অবশ্য আছে পূর্ব এশিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি হঠাৎ করে কিছুটা সংঘাতময় হয়ে ওঠা। পূর্ব চীন সাগরে চীনা রণতরির বলিষ্ঠ পদচারণ এবং জাপান সাগরের বিতর্কিত একটি দ্বীপের ওপর দক্ষিণ কোরিয়ার আধিপত্য তুলে ধরার প্রয়াস জাপানকে হঠাৎ করেই যেন অঞ্চলজুড়ে কিছুটা একঘরে করে তুলেছে। সেই সঙ্গে দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার ব্যর্থতার ফলেও রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে, বাড়ছে জাতীয়তাবাদী সস্তা আবেগ। ওসাকায় তরুণ জাতীয়তাবাদী নেতা তোরু হাশিমোতোর আবির্ভাব এবং শিনজো আবের নেতৃত্বে উদার গণতন্ত্রীদের আরও বেশি করে জাতীয়তাবাদী পথে পদচারণ সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন। এটা জাপানকে ক্রমেই নিয়ে যাচ্ছে আরও বেশি সংঘাতময় পথে।
তবে বিরাট বিজয় সত্ত্বেও সাংবিধানিক পরিবর্তনের পথ তৈরি করা জাপানের নতুন নেতৃত্বের জন্য ততটা সহজ না-ও হতে পারে। কারণ, সংবিধান সংশোধনের পথটি জটিল। জাপানের সংবিধানের ছিয়ানব্বইতম ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানের যেকোনো রদবদলের আলোচনা শুরু করতে হলে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন দরকার। উদার গণতন্ত্রীরা নির্বাচনী শরিকের সঙ্গে মিলে নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করলেও উচ্চকক্ষে তারা সংখ্যালঘু। এ ছাড়া তাদের শরিক কোমেই পার্টি বরাবরই সংবিধানের নবম ধারা পরিবর্তনের বিরোধী। ফলে সাংবিধানিক সংস্কার প্রশ্নে তারা যে উদার গণতন্ত্রীদের সমর্থন দেবে, তা নিশ্চিত ধরে নেওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই বিকল্প পথের খোঁজ করা থেকেও উদার গণতন্ত্রীরা এখন পিছিয়ে নেই। সে পথ হচ্ছে ওসাকার মেয়রের কট্টর দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া। তবে এর সবটাই অবশ্য নির্ভর করবে আগামী গ্রীষ্মে নির্ধারিত উচ্চকক্ষের অর্ধেক সংখ্যক আসনের জন্য গ্রহণ করা ভোটের ফলাফলের ওপর।
জাপানের ভোটদাতাদের এই একটি বিষয়ে অতীতে সব সময় অনেক বেশি সংযম প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। নিম্নকক্ষে বিজয়ী দলকে উচ্চকক্ষের নির্বাচনে ঢালাওভাবে ভোট দেওয়া থেকে অধিকাংশ সময়ই তাঁরা বিরত থেকেছেন। ফলে অনেকেই এখন আশা করছেন, আগামী গ্রীষ্মে সেই একই হিসাবের পুনরাবৃত্তি হয়তো লক্ষ করা যাবে। সেটা সাময়িকভাবে হলেও উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঠেকাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে বাস্তবে কী ঘটে, তা দেখার জন্য আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।
টোকিও থেকে
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments