প্রেমের গল্প by রকিব হাসান
একসময় পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটি বাড়িতে একটি ছেলে বাস করত। কুকুর ভালোবাসত সে, ঘোড়া ভালোবাসত, সংগীতের ভক্ত আর স্পোর্টস কারের পাগল ছিল। গাছে চড়ত, সাঁতার কাটত, ফুটবল খেলত, সুন্দরী মেয়েদের পেছনে লাগত। সুন্দর উদ্দাম জীবন।
একদিন এক দরবেশকে পেয়ে বলল ছেলেটি, ‘বড় হয়ে কী কী পেতে চাই আমি ঠিক করে ফেলেছি। আপনি কি আমাকে সেসব দেবেন?’
‘কী কী চাও?’ দরবেশ জানতে চাইলেন।
‘অনেক বড় একটা বাড়ি হবে আমার, সামনে থাকবে ছড়ানো বারান্দা। দুটো অনেক দামি কুকুর পুষব। পেছনে থাকবে একটা সুন্দর ফুলের বাগান। দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল থাকবে তাতে। খুব সুন্দরী একটি মেয়েকে বিয়ে করব। টানা টানা গভীর কালো চোখ হবে ওর, মেঘের মতো চুল, লম্বা শরীর আর সুন্দর ফিগার। সেতার বাজাতে পারবে, ভালো গান গাইতে পারবে।
‘তিনটে ছেলে হবে আমার, ভালো বল খেলতে পারবে ওরা। একজন হবে বিজ্ঞানী, একজন পলিটিশিয়ান, আরেকজন নামকরা খেলোয়াড়।
‘আমি হব একজন অ্যাডভেঞ্চারার। সাগরে সাগরে কাটাব, কখনো একাই জাহাজ নিয়ে ভেসে পড়ব, উঁচু উঁচু পাহাড়ে চড়ব, পর্বতে চড়ব, বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করব। লাল একটা ফেরারি গাড়ি থাকবে আমার। সুন্দর জীবন, তবে বড় বেশি উদ্দাম আর অগোছালো, কারণ সাজানো জীবন আমার সহ্য হবে না।’
মৃদু হাসলেন দরবেশ। ‘খুব সুন্দর একটা সুখ-স্বপ্ন। দোয়া করি, তুমি সুখী হও।’
একদিন, বল খেলতে গিয়ে হাঁটু ভেঙে ফেলল ছেলেটি। পুরোপুরি আর ঠিক হলো না। পাহাড়ে ওঠা বন্ধ হলো, গাছেও চড়তে পারে না। সাগরে জাহাজ ভাসানোর স্বপ্ন শেষ। মার্কেটিংয়ের ছাত্র হয়ে ভালোভাবেই পাস করল, শুরু করল ওষুধ আর ডাক্তারি যন্ত্রপাতির ব্যবসা।
সুন্দরী একটা মেয়েকে বিয়ে করল। স্বভাব খুব ভালো মেয়েটির। লম্বা চুল আছে, তবে শরীরটা লম্বা নয়, বেঁটেই বলা যায়। চোখও কালো নয়, বাদামি। পিয়ানো বাজানো তো দূরের কথা, গানই গাইতে পারে না। তবে রান্নার হাত খুব ভালো। দেশি-বিদেশি অনেক ধরনের খাবার চমৎকার রাঁধতে পারে। আরও একটা জিনিস পারে, ছবি আঁকতে।
ব্যবসার কাজে শহরে চলে আসতে হয়েছে ছেলেটিকে। থাকে ফ্ল্যাটবাড়ির ওপরতলার একটা ফ্ল্যাটে। জানালা দিয়ে নদী দেখা যায়, নৌকা-লঞ্চ চোখে পড়ে, চাঁদনি রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে আর চাঁদ থাকলে নদীর অপরূপ শোভা দেখে সময় কাটাতে পারে। কুকুর পোষার জায়গা নেই, তবে বারান্দায় একটা তোতাপাখির খাঁচা ঝোলাতে পেরেছে। বাগানও নেই, টবে কয়েকটা লাল গোলাপের গাছ। প্রজাপতির ঢল নামে না সে বাগানে, ভোমরারা গুঞ্জন তোলে না। তবে এক শীতে কোথা থেকে যেন কয়েকটা মৌমাছি উড়ে এসে বসেছিল ফুলে।
তিন মেয়ে তার, তিনজনই খুব সুন্দরী। ছোট মেয়েটা সবচেয়ে সুন্দরী, কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পা ভাঙল। পঙ্গু হয়ে গেল। হুইলচেয়ার ছাড়া আর গতি নেই। বাবাকে সাংঘাতিক ভালোবাসে তিনজনেই। বল খেলতে পারে না ওরা, তবে বেশ গুণী। বড়টি ভালো রাঁধতে পারে, মেজোটি ছবি আঁকতে পারে, আর ছোটটি চমৎকার গিটার বাজায়, গলাও ভালো। গভীর রাতে নিঝুম হয়ে আসে যখন ব্যস্ত শহর, কোথাও কোনো শব্দ নেই, পাহারাঅলার বাঁশি আর থামের গায়ে লাঠি ঠোকার আওয়াজে চমকে ঘুম ভেঙে যায় ছেলেটির, তখন মাঝেমধ্যে কানে আসে পাশের ঘর থেকে অপূর্ব সুরের মূর্ছনা। তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে কখন আবার ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় সে।
সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট আয় করে ছেলেটি, কিন্তু ফেরারি গাড়ি কেনার টাকা ওর জমে না। বেশির ভাগ সময় রিকশাতেই চলাচল করতে হয়। হাঁটার শখ হয় মাঝেসাঝে। ফুটপাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে আলগোছে তুলে পাশের ডাস্টবিনে রেখে দেয় অসাবধানি খামখেয়ালি মানুষের ফেলে যাওয়া কলার খোসা, রাস্তা পার করে অন্ধ মানুষকে।
একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো ভোর থেকেই। ঝমঝম ঝমঝম একটানা বর্ষণ, ঝরেই চলে ঝরেই চলে, থামে না আর। রাস্তাঘাট সব ডুবে গেল পানিতে। সারাটা দিন ঘরে আটকে থাকতে হলো ছেলেটিকে, কাজে বেরোতে পারল না। বিকেলের দিকে বিরক্ত হয়ে দুত্তেরি ছাই বলে ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ঝিরঝির করে তখনো বৃষ্টি পড়ছে, আকাশের গোমড়া মুখে হাসি ফোটার কোনো লক্ষণই নেই। ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেলরে দিন বয়ে’ গুন গুন করে গেয়ে উঠেছিল, পেছনে গাড়ির হর্নের তীক্ষ শব্দে চমকে গেল, লাফিয়ে সরে না গেলে যেন তাকে চাপা দিয়েই চলে যেত বেপরোয়া ড্রাইভার। ছলাক করে কাদাপানি ছিটিয়ে জামাকাপড় নষ্ট করে দিয়ে গেল ছেলেটির।
বন্ধুর বাড়িতে এল সে। বলল, ‘আমার মনে বড় দুঃখ।’
‘কেন?’
‘আমার স্বপ্ন ছিল অন্য রকম। ভেবেছিলাম বিয়ে করব লম্বা একটি মেয়েকে, যার হবে মেঘের মতো চুল, গভীর কালো চোখ, পিয়ানো বাজাতে পারবে, গান গাইতে পারবে। কিন্তু যাকে করলাম সে লম্বাও না, চোখও কটা। বাজাতেও পারে না, গাইতেও পারে না।’
‘কিন্তু খুবই সুন্দরী,’ বোঝানোর চেষ্টা করল বন্ধু। ‘নরম মেজাজ, ফুঁসে ওঠে না, ঝগড়া করে না। ভালো রাঁধতে পারে, ছবি আঁকতে পারে।’
বন্ধুর কথায় কান দিল না ছেলেটি।
একদিন স্ত্রীকে বলল, ‘আমার মনে বড় দুঃখ।’
‘কেন?’ স্ত্রী অবাক।
‘আমি চেয়েছিলাম বড় একটা বাড়ি হবে আমার, প্রকৃতির কাছাকাছি, সেখানে পাহাড় থাকবে, বন থাকবে, ঝরনা থাকবে বাড়ির পেছনে, বাগান থাকবে। দুটো কুকুর পুষব। কিছুই হলো না। পেলাম কি? দশতলার ওপরে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি।’
‘তাতে কী? অনেক সুন্দর আমাদের ঘর। নদী দেখা যায়, ওপারের গ্রাম দেখা যায়। টাকা-পয়সার অভাব নেই, পাখি পুষছি, টবে ফুল আছে, দরকার হলে আরও লাগাব। তিন-তিনটি এত ভালো মেয়ে আছে আমাদের। সুখেই তো আছি আমরা।’
‘তুমি যা-ই বলো, আমার মনে বড় দুঃখ,’ ছেলেটি জবাব দিল।
ডাক্তারের কাছে গেল সে। মানসিক রোগের চিকিৎসক।
‘আমার মনে বড় দুঃখ,’ ছেলেটি বলল।
‘কেন?’ ডাক্তারের কণ্ঠে সহানুভূতির সুর।
‘মনে করেছিলাম বড় হয়ে অ্যাডভেঞ্চারার হব। হলাম ওষুধের ব্যবসায়ী। টাকমাথা, তার ওপর ল্যাংড়া!’
‘এই বয়সে অনেকের মাথায়ই চুল থাকে না। ল্যাংড়া বলল কে? হাঁটেন তো ঠিকই। ক্রাচ লাগে না। আর ওষুধের ব্যবসা, এ তো ভালো কাজ। অসুস্থ মানুষের সেবা করছেন।’
ডাক্তারের কথা পছন্দ হলো না ছেলেটির। মুখ বেজার করে বেরিয়ে এল।
‘আমার মনে বড় দুঃখ,’ নিজের ম্যানেজারকে একদিন বলল ছেলেটি।
‘কেন, স্যার?’
‘আমি চেয়েছিলাম লাল রঙের একটা ফেরারি গাড়ি কিনব। উদ্দাম জীবন যাপন করব। কিছুই হলো না। রোজ শেভ করে, গোসল করে, টেবিলে বসে নাশতা খেয়ে রিকশায় করে অফিসে আসতে হয়।’
‘ভালোই তো, স্যার? কটা লোক এমন সুযোগ পায়। কতজনে তো রিকশায়ও চড়তে পারে না। বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে প্রাণটা হাতে নিয়ে চলাফেরা করে, অফিসের দেরি হয়, বসের বকা শোনে। আপনার ওসব কিছুই করতে হয় না। ওরা টিফিন ক্যারিয়ারে করে আনা ঠান্ডা ভাত খায়, আপনি দামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ খান...’
ম্যানেজারের কথা ভালো লাগল না ছেলেটির। বলল, ‘যান, কাজ করুনগে।’
ছেলেটির মামা শিক্ষকতা করেন। তাঁর কাছে গিয়ে বলল, ‘মামা, আমার মনে বড়ই দুঃখ।’
‘কেন রে?’ অবাক হলেন মামা।
‘আমি চেয়েছিলাম, আমার তিন ছেলে হবে। একজন বিজ্ঞানী হবে, একজন পলিটিশিয়ান, আরেকজন খেলোয়াড়। হলো তিনটি মেয়ে। ছোটটি হাঁটতেও পারে না।’
‘তাতে কী? তিনজনই সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। একজন ডাক্তার হয়েছে, একজন টিচার, আরেকজন গায়িকা। খারাপটা কোথায়? কজনের এ রকম হয়?’
নাহ্, কেউ তার কথা বুঝতে পারে না, বুঝতে চায় না! বিরক্ত হয়ে চলে এল ছেলেটি। দুঃখ বেড়েই চলল তার। যতই ভাবে জীবনটা বিফলে গেল, ততই আরও বাড়ে দুঃখ, আরও, আরও। অসুস্থ হয়ে শেষে বিছানাতেই পড়ে গেল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। স্যালাইন দেওয়া হলো, রোগ নির্ণয়ে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলেন ডাক্তাররা, তার কয়েকটি ছেলেটারই সরবরাহ করা।
অসুস্থ হয়ে আরও বিষণ্ন হয়ে গেছে ছেলেটি। মনের কষ্ট তার অপরিসীম। পরিবার-পরিজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা এসে ঘিরে থাকে বিছানার পাশে। তার মন খারাপ দেখে ওদেরও মন খারাপ। কেউই বুঝতে পারে না কী হয়েছে তার।
গভীর রাতে হাসপাতাল যখন নীরব, ছেলেটি কেবিনে একা, ঘর অন্ধকার, এই সময় আবার দেখা দিলেন ছেলেবেলার সেই দরবেশ। ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, ‘কেন এসেছেন?’
‘তোমাকে দেখতে।’
‘আমাকে দেখে আর কী হবে? আমি শেষ হয়ে গেছি। ছেলেবেলায় অনেক আশা করে আপনার কাছে কয়েকটা জিনিস চেয়েছিলাম। মনে আছে?’
‘আছে। খুব সুন্দর স্বপ্ন ছিল তোমার।’
‘ইচ্ছে করলে কি আপনি আমাকে ওসব জিনিস পাইয়ে দিতে পারতেন না?’
‘পারতাম।’
‘তাহলে দিলেন না কেন?’
‘আমি চেয়েছিলাম যেসব জিনিসের স্বপ্ন তুমি দেখো না ওসব দিয়েই তোমাকে সুখ দিতে। অনেক কিছুই তো দেওয়া হয়েছে তোমাকে: সুন্দরী স্ত্রী, স্ত্রীর প্রেম, ভালো ব্যবসা, আরামে থাকার মতো একটা বাড়ি, তিনটে চমৎকার মেয়ে...’
বাধা দিয়ে ছেলেটি বলল, ‘কিন্তু আমি ভেবেছিলাম যা যা চাইব ঠিক তা-ই দেবেন।’
‘আর আমি ভেবেছিলাম আল্লাহকে তুমি ঠিক তা-ই দেবে তিনি যা চান।’
‘আল্লাহ আমার কাছে কী চান?’ ভেবে পায় না ছেলেটি, আল্লাহ তার মতো একজন সাধারণ মানুষের কাছে কী চাইতে পারেন? কী দিতে পারে সে?
‘আল্লাহ চান, তিনি যা দিয়েছেন তা-ই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো। সুখের প্রচুর উপকরণ দিয়েছেন তিনি তোমাকে, চেষ্টা আর ইচ্ছে থাকলে সেসব নিয়ে সুখে থাকতে পারো।’
অন্ধকারে সারাটা রাত জেগে রইল ছেলেটি, শুয়ে শুয়ে ভাবল। দুঃখ ভুলে গেল। সুখে কী করে থাকতে হয় বুঝে গেছে। পরদিন সকালে ডাক্তাররা এসে দেখেন রাতারাতি অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে রোগীর। পরিজনের মুখে আবার হাসি ফুটল। ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে এল সে। আবার অফিসে যাতায়াত শুরু করল।
স্ত্রীর বাদামি চোখকেই এখন প্রচণ্ড ভালোবাসে ছেলেটি, রান্না খেয়ে তৃপ্ত হয়, দেয়ালে ঝোলানো ছবির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়। মেয়ের গান শোনে। তোতাটাকে খাবার খাওয়ায়, ফুলগাছের মরাপাতা ছেঁটে দেয়। গভীর রাতে খোলা জানালায় বসে তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। অন্ধকার রাতে দেখে আকাশে তারার মিটিমিটি, দেখে শেষরাতের হেলে যাওয়া ক্ষয়া চাঁদ। পাশে শোয়া ঘুমন্ত স্ত্রীর নিঃশ্বাসের শব্দকে মনে হয় সংগীত। আহ্, জীবন বড়ই মধুর, বড়ই সুখের, ভাবে ছেলেটি। ভাবে, তার মানে এত দিনে সত্যিকারের প্রেমে পড়েছি আমি।
‘কী কী চাও?’ দরবেশ জানতে চাইলেন।
‘অনেক বড় একটা বাড়ি হবে আমার, সামনে থাকবে ছড়ানো বারান্দা। দুটো অনেক দামি কুকুর পুষব। পেছনে থাকবে একটা সুন্দর ফুলের বাগান। দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল থাকবে তাতে। খুব সুন্দরী একটি মেয়েকে বিয়ে করব। টানা টানা গভীর কালো চোখ হবে ওর, মেঘের মতো চুল, লম্বা শরীর আর সুন্দর ফিগার। সেতার বাজাতে পারবে, ভালো গান গাইতে পারবে।
‘তিনটে ছেলে হবে আমার, ভালো বল খেলতে পারবে ওরা। একজন হবে বিজ্ঞানী, একজন পলিটিশিয়ান, আরেকজন নামকরা খেলোয়াড়।
‘আমি হব একজন অ্যাডভেঞ্চারার। সাগরে সাগরে কাটাব, কখনো একাই জাহাজ নিয়ে ভেসে পড়ব, উঁচু উঁচু পাহাড়ে চড়ব, পর্বতে চড়ব, বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করব। লাল একটা ফেরারি গাড়ি থাকবে আমার। সুন্দর জীবন, তবে বড় বেশি উদ্দাম আর অগোছালো, কারণ সাজানো জীবন আমার সহ্য হবে না।’
মৃদু হাসলেন দরবেশ। ‘খুব সুন্দর একটা সুখ-স্বপ্ন। দোয়া করি, তুমি সুখী হও।’
একদিন, বল খেলতে গিয়ে হাঁটু ভেঙে ফেলল ছেলেটি। পুরোপুরি আর ঠিক হলো না। পাহাড়ে ওঠা বন্ধ হলো, গাছেও চড়তে পারে না। সাগরে জাহাজ ভাসানোর স্বপ্ন শেষ। মার্কেটিংয়ের ছাত্র হয়ে ভালোভাবেই পাস করল, শুরু করল ওষুধ আর ডাক্তারি যন্ত্রপাতির ব্যবসা।
সুন্দরী একটা মেয়েকে বিয়ে করল। স্বভাব খুব ভালো মেয়েটির। লম্বা চুল আছে, তবে শরীরটা লম্বা নয়, বেঁটেই বলা যায়। চোখও কালো নয়, বাদামি। পিয়ানো বাজানো তো দূরের কথা, গানই গাইতে পারে না। তবে রান্নার হাত খুব ভালো। দেশি-বিদেশি অনেক ধরনের খাবার চমৎকার রাঁধতে পারে। আরও একটা জিনিস পারে, ছবি আঁকতে।
ব্যবসার কাজে শহরে চলে আসতে হয়েছে ছেলেটিকে। থাকে ফ্ল্যাটবাড়ির ওপরতলার একটা ফ্ল্যাটে। জানালা দিয়ে নদী দেখা যায়, নৌকা-লঞ্চ চোখে পড়ে, চাঁদনি রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে আর চাঁদ থাকলে নদীর অপরূপ শোভা দেখে সময় কাটাতে পারে। কুকুর পোষার জায়গা নেই, তবে বারান্দায় একটা তোতাপাখির খাঁচা ঝোলাতে পেরেছে। বাগানও নেই, টবে কয়েকটা লাল গোলাপের গাছ। প্রজাপতির ঢল নামে না সে বাগানে, ভোমরারা গুঞ্জন তোলে না। তবে এক শীতে কোথা থেকে যেন কয়েকটা মৌমাছি উড়ে এসে বসেছিল ফুলে।
তিন মেয়ে তার, তিনজনই খুব সুন্দরী। ছোট মেয়েটা সবচেয়ে সুন্দরী, কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পা ভাঙল। পঙ্গু হয়ে গেল। হুইলচেয়ার ছাড়া আর গতি নেই। বাবাকে সাংঘাতিক ভালোবাসে তিনজনেই। বল খেলতে পারে না ওরা, তবে বেশ গুণী। বড়টি ভালো রাঁধতে পারে, মেজোটি ছবি আঁকতে পারে, আর ছোটটি চমৎকার গিটার বাজায়, গলাও ভালো। গভীর রাতে নিঝুম হয়ে আসে যখন ব্যস্ত শহর, কোথাও কোনো শব্দ নেই, পাহারাঅলার বাঁশি আর থামের গায়ে লাঠি ঠোকার আওয়াজে চমকে ঘুম ভেঙে যায় ছেলেটির, তখন মাঝেমধ্যে কানে আসে পাশের ঘর থেকে অপূর্ব সুরের মূর্ছনা। তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে কখন আবার ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় সে।
সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট আয় করে ছেলেটি, কিন্তু ফেরারি গাড়ি কেনার টাকা ওর জমে না। বেশির ভাগ সময় রিকশাতেই চলাচল করতে হয়। হাঁটার শখ হয় মাঝেসাঝে। ফুটপাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে আলগোছে তুলে পাশের ডাস্টবিনে রেখে দেয় অসাবধানি খামখেয়ালি মানুষের ফেলে যাওয়া কলার খোসা, রাস্তা পার করে অন্ধ মানুষকে।
একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো ভোর থেকেই। ঝমঝম ঝমঝম একটানা বর্ষণ, ঝরেই চলে ঝরেই চলে, থামে না আর। রাস্তাঘাট সব ডুবে গেল পানিতে। সারাটা দিন ঘরে আটকে থাকতে হলো ছেলেটিকে, কাজে বেরোতে পারল না। বিকেলের দিকে বিরক্ত হয়ে দুত্তেরি ছাই বলে ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ঝিরঝির করে তখনো বৃষ্টি পড়ছে, আকাশের গোমড়া মুখে হাসি ফোটার কোনো লক্ষণই নেই। ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেলরে দিন বয়ে’ গুন গুন করে গেয়ে উঠেছিল, পেছনে গাড়ির হর্নের তীক্ষ শব্দে চমকে গেল, লাফিয়ে সরে না গেলে যেন তাকে চাপা দিয়েই চলে যেত বেপরোয়া ড্রাইভার। ছলাক করে কাদাপানি ছিটিয়ে জামাকাপড় নষ্ট করে দিয়ে গেল ছেলেটির।
বন্ধুর বাড়িতে এল সে। বলল, ‘আমার মনে বড় দুঃখ।’
‘কেন?’
‘আমার স্বপ্ন ছিল অন্য রকম। ভেবেছিলাম বিয়ে করব লম্বা একটি মেয়েকে, যার হবে মেঘের মতো চুল, গভীর কালো চোখ, পিয়ানো বাজাতে পারবে, গান গাইতে পারবে। কিন্তু যাকে করলাম সে লম্বাও না, চোখও কটা। বাজাতেও পারে না, গাইতেও পারে না।’
‘কিন্তু খুবই সুন্দরী,’ বোঝানোর চেষ্টা করল বন্ধু। ‘নরম মেজাজ, ফুঁসে ওঠে না, ঝগড়া করে না। ভালো রাঁধতে পারে, ছবি আঁকতে পারে।’
বন্ধুর কথায় কান দিল না ছেলেটি।
একদিন স্ত্রীকে বলল, ‘আমার মনে বড় দুঃখ।’
‘কেন?’ স্ত্রী অবাক।
‘আমি চেয়েছিলাম বড় একটা বাড়ি হবে আমার, প্রকৃতির কাছাকাছি, সেখানে পাহাড় থাকবে, বন থাকবে, ঝরনা থাকবে বাড়ির পেছনে, বাগান থাকবে। দুটো কুকুর পুষব। কিছুই হলো না। পেলাম কি? দশতলার ওপরে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি।’
‘তাতে কী? অনেক সুন্দর আমাদের ঘর। নদী দেখা যায়, ওপারের গ্রাম দেখা যায়। টাকা-পয়সার অভাব নেই, পাখি পুষছি, টবে ফুল আছে, দরকার হলে আরও লাগাব। তিন-তিনটি এত ভালো মেয়ে আছে আমাদের। সুখেই তো আছি আমরা।’
‘তুমি যা-ই বলো, আমার মনে বড় দুঃখ,’ ছেলেটি জবাব দিল।
ডাক্তারের কাছে গেল সে। মানসিক রোগের চিকিৎসক।
‘আমার মনে বড় দুঃখ,’ ছেলেটি বলল।
‘কেন?’ ডাক্তারের কণ্ঠে সহানুভূতির সুর।
‘মনে করেছিলাম বড় হয়ে অ্যাডভেঞ্চারার হব। হলাম ওষুধের ব্যবসায়ী। টাকমাথা, তার ওপর ল্যাংড়া!’
‘এই বয়সে অনেকের মাথায়ই চুল থাকে না। ল্যাংড়া বলল কে? হাঁটেন তো ঠিকই। ক্রাচ লাগে না। আর ওষুধের ব্যবসা, এ তো ভালো কাজ। অসুস্থ মানুষের সেবা করছেন।’
ডাক্তারের কথা পছন্দ হলো না ছেলেটির। মুখ বেজার করে বেরিয়ে এল।
‘আমার মনে বড় দুঃখ,’ নিজের ম্যানেজারকে একদিন বলল ছেলেটি।
‘কেন, স্যার?’
‘আমি চেয়েছিলাম লাল রঙের একটা ফেরারি গাড়ি কিনব। উদ্দাম জীবন যাপন করব। কিছুই হলো না। রোজ শেভ করে, গোসল করে, টেবিলে বসে নাশতা খেয়ে রিকশায় করে অফিসে আসতে হয়।’
‘ভালোই তো, স্যার? কটা লোক এমন সুযোগ পায়। কতজনে তো রিকশায়ও চড়তে পারে না। বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে প্রাণটা হাতে নিয়ে চলাফেরা করে, অফিসের দেরি হয়, বসের বকা শোনে। আপনার ওসব কিছুই করতে হয় না। ওরা টিফিন ক্যারিয়ারে করে আনা ঠান্ডা ভাত খায়, আপনি দামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ খান...’
ম্যানেজারের কথা ভালো লাগল না ছেলেটির। বলল, ‘যান, কাজ করুনগে।’
ছেলেটির মামা শিক্ষকতা করেন। তাঁর কাছে গিয়ে বলল, ‘মামা, আমার মনে বড়ই দুঃখ।’
‘কেন রে?’ অবাক হলেন মামা।
‘আমি চেয়েছিলাম, আমার তিন ছেলে হবে। একজন বিজ্ঞানী হবে, একজন পলিটিশিয়ান, আরেকজন খেলোয়াড়। হলো তিনটি মেয়ে। ছোটটি হাঁটতেও পারে না।’
‘তাতে কী? তিনজনই সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। একজন ডাক্তার হয়েছে, একজন টিচার, আরেকজন গায়িকা। খারাপটা কোথায়? কজনের এ রকম হয়?’
নাহ্, কেউ তার কথা বুঝতে পারে না, বুঝতে চায় না! বিরক্ত হয়ে চলে এল ছেলেটি। দুঃখ বেড়েই চলল তার। যতই ভাবে জীবনটা বিফলে গেল, ততই আরও বাড়ে দুঃখ, আরও, আরও। অসুস্থ হয়ে শেষে বিছানাতেই পড়ে গেল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। স্যালাইন দেওয়া হলো, রোগ নির্ণয়ে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলেন ডাক্তাররা, তার কয়েকটি ছেলেটারই সরবরাহ করা।
অসুস্থ হয়ে আরও বিষণ্ন হয়ে গেছে ছেলেটি। মনের কষ্ট তার অপরিসীম। পরিবার-পরিজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা এসে ঘিরে থাকে বিছানার পাশে। তার মন খারাপ দেখে ওদেরও মন খারাপ। কেউই বুঝতে পারে না কী হয়েছে তার।
গভীর রাতে হাসপাতাল যখন নীরব, ছেলেটি কেবিনে একা, ঘর অন্ধকার, এই সময় আবার দেখা দিলেন ছেলেবেলার সেই দরবেশ। ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, ‘কেন এসেছেন?’
‘তোমাকে দেখতে।’
‘আমাকে দেখে আর কী হবে? আমি শেষ হয়ে গেছি। ছেলেবেলায় অনেক আশা করে আপনার কাছে কয়েকটা জিনিস চেয়েছিলাম। মনে আছে?’
‘আছে। খুব সুন্দর স্বপ্ন ছিল তোমার।’
‘ইচ্ছে করলে কি আপনি আমাকে ওসব জিনিস পাইয়ে দিতে পারতেন না?’
‘পারতাম।’
‘তাহলে দিলেন না কেন?’
‘আমি চেয়েছিলাম যেসব জিনিসের স্বপ্ন তুমি দেখো না ওসব দিয়েই তোমাকে সুখ দিতে। অনেক কিছুই তো দেওয়া হয়েছে তোমাকে: সুন্দরী স্ত্রী, স্ত্রীর প্রেম, ভালো ব্যবসা, আরামে থাকার মতো একটা বাড়ি, তিনটে চমৎকার মেয়ে...’
বাধা দিয়ে ছেলেটি বলল, ‘কিন্তু আমি ভেবেছিলাম যা যা চাইব ঠিক তা-ই দেবেন।’
‘আর আমি ভেবেছিলাম আল্লাহকে তুমি ঠিক তা-ই দেবে তিনি যা চান।’
‘আল্লাহ আমার কাছে কী চান?’ ভেবে পায় না ছেলেটি, আল্লাহ তার মতো একজন সাধারণ মানুষের কাছে কী চাইতে পারেন? কী দিতে পারে সে?
‘আল্লাহ চান, তিনি যা দিয়েছেন তা-ই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো। সুখের প্রচুর উপকরণ দিয়েছেন তিনি তোমাকে, চেষ্টা আর ইচ্ছে থাকলে সেসব নিয়ে সুখে থাকতে পারো।’
অন্ধকারে সারাটা রাত জেগে রইল ছেলেটি, শুয়ে শুয়ে ভাবল। দুঃখ ভুলে গেল। সুখে কী করে থাকতে হয় বুঝে গেছে। পরদিন সকালে ডাক্তাররা এসে দেখেন রাতারাতি অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে রোগীর। পরিজনের মুখে আবার হাসি ফুটল। ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে এল সে। আবার অফিসে যাতায়াত শুরু করল।
স্ত্রীর বাদামি চোখকেই এখন প্রচণ্ড ভালোবাসে ছেলেটি, রান্না খেয়ে তৃপ্ত হয়, দেয়ালে ঝোলানো ছবির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়। মেয়ের গান শোনে। তোতাটাকে খাবার খাওয়ায়, ফুলগাছের মরাপাতা ছেঁটে দেয়। গভীর রাতে খোলা জানালায় বসে তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। অন্ধকার রাতে দেখে আকাশে তারার মিটিমিটি, দেখে শেষরাতের হেলে যাওয়া ক্ষয়া চাঁদ। পাশে শোয়া ঘুমন্ত স্ত্রীর নিঃশ্বাসের শব্দকে মনে হয় সংগীত। আহ্, জীবন বড়ই মধুর, বড়ই সুখের, ভাবে ছেলেটি। ভাবে, তার মানে এত দিনে সত্যিকারের প্রেমে পড়েছি আমি।
No comments