শতবর্ষের বেদে ঐতিহ্য, নৌকা ছেড়ে শহরে by হাসান শাহরিয়ার হৃদয়
নদীতেই তাদের বাস, নদীতেই ঘর সংসার। নদীরকে ঘিরেই বেঁচে থাকেন তারা। আর থাকার জায়গা বলতে কেবল নদীর উপর ভাসমান ছোট্ট নৌকা।
এমনই এক সংসারের বাসিন্দা হালিমা পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসিমুখে জানালেন, “নৌকাই আমার বসতবাড়ি। অনেক নদী পাড়ি দিয়েছি এ নৌকায় করে।”
নিজের অতীতকে মনে করে যেমন মাঝে মাঝে গর্বে ভরে ওঠে হালিমার মন, তেমনি পরমুহূর্তে ভরে যায় বিষাদে।
দেশের
দশ লাখ বেদের একজন তিনি। কয়েকশ’ বছর ধরে নদীকেই ঘরবাড়ি করে নিয়েছেন।
জীবিকা নির্বাহের জন্য বেছে নিয়েছেন সাপের খেলা দেখানো, বানরের নাচ দেখানো,
জাদু দেখানো, তাবিজ বিক্রি, কবিরাজি চিকিৎসার মতো অদ্ভুত অনেক পেশা।
তাদের
এমন জীবনযাপনও অবশ্য এখন পুরনো হয়ে গেছে। আর কেউ তাদের দেখে অবাক হয় না।
এমনকি এর ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের শত বছরের ঐতিহ্য, নিজস্ব সংস্কৃতি।
দীর্ঘদিনের
ব্যবহারে যখন নৌকায় ফাটল ধরে, বড় বড় ফুটো তৈরি হয়, তখনও এর মেরামত করার
সামর্থ্য থাকে না হালিমাদের। তাই তিনি এখন বাধ্য হয়ে মেঘনা নদীর এক খাঁড়িতে
দুটি ভাঙা নৌকা গুঁজে দিন পার করছেন।
তার মতোই আরও
ডজনখানেক নৌকা বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা রয়েছে। হালিমার এক কামরার নৌকায় রয়েছে
টিনের ছাদ, দুটি দরজা, দুটি ছোট্ট জানালা। ভেতরে ছোট্ট মাটির চুলা,
পরিচ্ছন্নভাবে কাপড়চোপড়, বাসনকোসন সাজানো। সেখানে গাদাগাদি করে ঘুমায়
হালিমার পাঁচ নাতি। পাশেই আরেকটি ছোট্ট নৌকায় থাকে হালিমার বউ ও ছেলে।
পানির
উপরের জীবন সম্পর্কে হালিমা বলেন, “নদীর পানি দিয়েই আমরা পরিচ্ছন্ন হই,
রান্না করি, গোসল করি, এই পানিই খাই। আর কোথায় যাবো? কোনো জমিজমা নেই
আমাদের।”
আরেক বেদে মুহম্মদ আবু কালাম বলেন, “আমরা
বিশ্বাস করি, আমাদের পূর্বপুরুষরা আরবের বেদুইন ছিলেন, যে কারণে আমাদের নাম
হয়েছে বেদে। যখন তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তখন তাদের বাধ্য করা
হয়েছিল অন্য কোথাও বসতি স্থাপন করতে।”
হাতে তৈরি বিড়িতে
টান দিয়ে তিনি আরও জানান, কেউ বলে তারা সাঁওতালদের বংশধর, কেউ বলে
মিয়ানমার, কেউ বলে হিমালয় থেকে এসেছেন। কোনটি সঠিক, কেউ জানে না।
প্রতি
বছরের প্রায় দশ মাস দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায় বেদেরা। পথে পথে থামে প্রায়
৯০টি গ্রামে। অবশিষ্ট দুই মাস তারা বিশ্রাম নেয়, বিয়েশাদীসহ বিভিন্ন
অনুষ্ঠান উদযাপন করে, নতুন বছরের পরিকল্পনা নেয়।
প্রতিটি গোত্রেরই নিজস্ব পেশা আছে। সন্দর গোত্র চুড়ি-ফিতা বিক্রি করে করে, মালবৈধ্যরা কবিরাজি করে, আর সাপুড়েরা সাপের খেলা দেখায়।
মুকসেদ
মুহম্মদ নামে এক বেদে জানালেন তার বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশল শেখার
স্মৃতি। বললেন, “আমার মূল দক্ষতা হচ্ছে পুকুর বা নদীতে দামি কিছু হারিয়ে
গেলে ডুব দিয়ে সেগুলো উদ্ধার করা।”
তিনি একজন চিকিৎসকও
বটে। তার সংগ্রহে আছে বিচিত্র রকম পাখির পালক, হাড়গোড়, শিকড়বাকড়, শামুক,
ঝিনুক, পাথর ইত্যাদি। এগুলোর মিশ্রণে মোটামুটি সব রকম রোগের ওষুধই তিনি
দ্রুত তৈরি করতে পারেন। যেমন, পুরাতন, হলদেটে মাছে কাঁটা দিয়ে উচ্চ রক্তচাপ
মুহূর্তে কমিয়ে ফেলতে পারেন। বললেন, “ব্যাপারটা প্রাকৃতিক জ্ঞান ও
আধ্যাত্মবাদের মিশ্রণ।”
কয়েকটি শামুকের খোল তুলে নিয়ে
সেগুলোয় চুমু খেয়ে বললেন, “বাহুতে বা হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি বেঁধে রাখলে
এগুলো আপনাকে সব অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করবে।”
অ্যাজমার
জন্যও তার একটি চমৎকার চিকিৎসা আছে। এর জন্য হাঁসের খাদ্যনালী ও ফাঁসির দড়ি
ব্যবহার করতে হবে। অবশ্য যে কোনো দড়ি হলে হবে না, এমন দড়ি হতে হবে, যাতে
কেউ ফাঁসিতে ঝুলেছে।
চিকিৎসা করে কেমন আয় হয়, এমন
প্রশ্নের জবাবে বললেন, “আগে যখন গ্রামেগঞ্জে ডাক্তার ছিল না, তখন ভালোই আয়
হতো। কিন্তু মানুষজন এখন আর কবিরাজি বা ঝাঁড়ফুকে বিশ্বাস করতে চায় না। আগে
যেখানে দৈনিক ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা কামাতাম, সেখানে এখন কামাই ৫০ থেকে ১০০
টাকা।”
ঐতিহ্য অনুযায়ী অবশ্য বেদে নারীরাই পরিবারের
ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। পুরুষরা সাধারণত ঘর-সংসার দেখে। কিন্তু ধীরে ধীরে এ
নীতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। অভাবের তাড়নায় দুইজনকেই জীবিকার সন্ধানে নামতে
হচ্ছে।
খাদিজার বয়স মাত্র চল্লিশ বছর, কিন্তু দেখলে মনে হয় তার চেয়েও অনেক বেশি। বয়স আর কঠোর জীবনযাপনের ছাপ পড়েছে তার চোখেমুখে।
তিনি বললেন, “যখন বয়স কম ছিল, তখন দারুণ সাপের খেলা দেখাতাম। মানুষজন হাততালি দিতো, খাওয়া, জামাকাপড়, টাকাপয়সাও দিতো।”
জানালেন, তার ছদ্মনাম ছিল জোছনা, যা ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ চলচ্চিত্রটির কল্যাণে এখনও বেদেদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় নাম।
এখন
আরও অনেক বেদে নারীর মতোই খাদিজাও ঢাকার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বাসনকোসন
বিক্রি করেন। এছাড়া ছোটখাটো ডাক্তারি, দাঁত তোলা, চোখ-কান পরিষ্কার করার
মতো কাজও করে থাকেন।
খাদিজার মা তাকে শিখিয়েছিলেন কিভাবে
শিঙ্গা বা গরুর শিং ব্যবহার করে কারও কোমর থেকে রক্ত শুষে নিয়ে ব্যাথা
কমাতে হয়। কিন্তু তার ১৮ বছর বয়সী কন্যা সিলভীই এ পদ্ধতিতে চিকিতসা করতে
নারাজ। সিলভী তার মাকে বলে, “শিঙ্গা স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই ভালো নয়। আমি
কখনও আমার উপর এসব ব্যবহার করতে দেবো না।”
বেদেদের
পরিস্থতি কিন্তু কখনোই সমাজে এমন ছিল না। একসময় তাদের মর্যাদা সাধারণ
মানুষের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গত ৬০ বছরে
বাংলাদেশও অনেক আধুনিক হয়েছে, যার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে কমেছে বেদে সমাজের
মর্যাদা।
তবে সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থা বেদে শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০০৮ সালে সরকার বেদেদের ভোটাধিকার দিয়েছে।
গ্রামবাংলা
উন্নয়ন কমিটি নামে একটি অলাভজনক সংস্থার নির্বাহী একেএম মাকসুদের মতে,
অনেকেই যদিও বলেন বেদেরা হারিয়ে গেছে, তা মোটেই ঠিক নয়। বরং ৯৮ শতাংশেরও
বেশি বেদে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তাদের ৯৫ শতাংশ অশিক্ষিত, তাদের
বিয়ে হয় ১১ বছর বয়সে। বাংলাদেশের প্রতি পরিবারে যেখানে গড় সদস্য ৪ দশমিক ৪
জন, সেখানে প্রতিটি বেদে পরিবারের গড় সদস্য সাড়ে ৭ জন।
বর্তমানে
বেদেরা ঐতিহ্য আর দারিদ্র্যের দ্বন্দ্বের মধ্যে আছে বলে জানান তিনি।
দারিদ্র্যকে দূর করতে হলে তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে আধুনিকতার
স্রোতে যোগ দিতে হবে। আর ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে থাকলে দারিদ্র্য তাদের পিছু
ছাড়বে না।
দ্বন্দ্বের একটি বাস্তব উদাহরণ দেখা যাক।
সুবর্ণগ্রাম
ফাউন্ডেশন নামে স্থানীয় একটি সংস্থা বেদেদের জন্য নৌকার উপরই একটি ছোট্ট
স্কুল তৈরি করেছে। সেখানে ১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত ইংরেজি, অংক ও বাংলা
শিখছে।
সেখানেরই ছাত্র ১০ বছর বয়সী রানা। জিজ্ঞাসা করতেই সে হেসে জানায়, “আমি পড়াশোনা করে পুলিশ অফিসার হতে চাই।”
তার
বাবা মোহাম্মদ আব্বাসের মত ঠিক এর বিপরীত। তিনি বললেন, “যদি আমি আমাদের
চিকিৎসাবিদ্যার রহস্য সন্তানদের শিখিয়ে না দিই, তাহলে সেগুলো হারিয়ে যাবে।
পড়াশোনা নয়, নদীতে ভেসে বেড়ানোর জন্যই আমাদের জন্ম।”
বিদেশী পত্রিকা অবলম্বনে বাংলানিউজ ফিচার
No comments