নবায়নযোগ্য জ্বালানি
নবায়নযোগ্য জ্বালানি শুধু জার্মানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গোটা বিশ্বেই বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার মূল স্রোতের অংশ হয়ে উঠছে। ‘ গ্লোবাল ফিউচার রিপোর্ট’-এ বিশেষজ্ঞরা এই প্রবণতার একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরেছেন।
কয়লা বা তেলের মতো জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি অথবা পরমাণু শক্তির ভবিষ্যত যে অন্ধকার, গোটা বিশ্বেই ক্রমশ সেই উপলব্ধি ছড়িয়ে পড়ছে। হাতেনাতে তার ফলও পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবছর বিকল্প জ্বালানির ক্ষেত্রে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা হচ্ছে, তার অঙ্ক সংখ্যা কয়লা ও পরমাণুভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর জন্য সম্মিলিত বিনিয়োগের তুলনায় বেশি। এই প্রবণতা আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।ক্রিস্টিনে লিন্স-এর মতে, গোটা বিশ্বে বিদ্যুত সরবরাহের ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানির মাত্রা ইতোমধ্যেই প্রায় ২৫ শতাংশ ছুঁয়েছে। তিনি একবিংশ শতাব্দীর নবায়নযোগ্য জ্বালানি নেটওয়ার্কের প্রধান। ‘রেন২১’ নামের এই সংস্থা তাদের বার্ষিক রিপোর্টে গোটা বিশ্বের প্রবণতা তুলে ধরে এবং জ্বালানি ব্যবস্থায় পরিবর্তনের বিষয়ে শলা-পরামর্শ দেয়। সম্প্রতি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্বাভাষ দিয়ে তারা এক বিশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে ক্রিস্টিনে লিন্স বললেন, ‘‘নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের ক্ষেত্রে জার্মানির ভূমিকা নেতৃস্থানীয় । আমরা এটাও লক্ষ্য করছি যে উদীয়মান শক্তিধর ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ ঘটছে সবচেয়ে বেশি মাত্রায়। ইতোমধ্যে প্রায় ১২০টিরও বেশি দেশে বিকল্প জ্বালানির বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রস্তুত। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি উন্নয়নশীল দেশ। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, এশিয়া এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে।” ‘গ্লোবাল ফিউচার রিপোর্ট’ অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রশ্নে চীনের অবস্থান শীর্ষে। আগামী দশকগুলোতেও এর কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে বায়ু ও সৌর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে তারা বিশাল অঙ্কের অর্থ ঢালছে। শহরাঞ্চল ও ছোট এলাকায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানির সরবরাহের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। গোটা বিশ্বে এমন প্রায় ৪,৫০০ শহর ও জনপদ চিহ্নিত করা গেছে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে তারা অগ্রসর হচ্ছে। ঘরবাড?িতে জ্বালানি সাশ্রয় থেকে শুরু করে সাইকেল, পথচারী ও জন পরিবহনকে গাড়ির তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারও বাড়াচ্ছে তারা। ‘রেন২১’-এর প্রধান ক্রিস্টিনে লিন্স মনে করেন, এর ফলে শহর কর্তৃপক্ষ ও নাগরিকদের অনেক সুবিধা হচ্ছে। তাঁর মতে, ‘‘প্রথমত জ্বালানি আমদানির ওপর শহরগুলোর নির্ভরতা অনেক কমে আসছে। স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান বাড়ছে। এর ফলে পরিবেশ সংরক্ষণও হচ্ছে। প্রায় সব সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মানুষ এমন বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার চান। শহর ও আঞ্চলিক পর্যায়ে জ্বালানি সংক্রান্ত পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এমন মনোভাবের প্রতিফলন ঘটছে।” বিদ্যুত, বাড়িঘর গরম রাখার জন্য উত্তাপ, শিল্পক্ষেত্র ও পরিবহন – গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে এই সব ক্ষেত্রে প্রায় ১৭ শতাংশ জ্বালানির চাহিদা মেটাচ্ছে বিকল্প জ্বালানি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে এই অনুপাত আরও অনেক বেড়ে যাবে।
গ্রিনপিস ইন্টারন্যাশানাল-এর সেভন টেস্কে ভবিষ্যতের এক রূপরেখা তুলে ধরতে গিয়ে বললেন, ‘‘সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তির অনুপাত হবে বিশাল–দুটি উৎস থেকেই ২০ থেকে ২৫ শতাংশ করে জ্বালানি পাওয়া যাবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাকিটা আসবে বায়ো মাস, জলশক্তি, জিও থার্মাল উৎস থেকে। আমাদের বিশ্বাস, ২০৫০ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ চাহিদা মেটাবে বিকল্প জ্বালানি।” জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে, এই প্রবণতার সপক্ষে আর্থিক সুবিধাও একটা বড় ভূমিকা পালন করছে। গত কয়েক বছরে বিশেষ করে সৌরশক্তি ও বায়ুশক্তি থেকে জ্বালানির মূল্য অনেক কমে গেছে। এমনকি জীবাশ্মভিত্তিক ও পরমাণু জ্বালানির তুলনায় এর মূল্য এখনই অনেক কম। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক দশকে বিকল্প জ্বালানি আরও সস্তা হয়ে যাবে। তা সত্ত্বেও কিছু বাধা দূর করতে হবে। যেমন অনেক দেশে বিকল্প জ্বালানির সপক্ষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এখনো তৈরি হয়নি।
তাছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপযুক্ত অবকাঠামো, তার বাজার তৈরি করতে হবে। এখনো পর্যন্ত বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রেই বিকল্প জ্বালানির সাফল্য সবচেয়ে বেশি। বাড়িঘর গরম রাখার জন্য উত্তাপ এবং পরিবহন ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ এখনো সীমিত। ভবিষ্যতে নতুন ঘরবাড়িতে জ্বালানির চাহিদা হবে অনেক কম। ছাদের উপর সৌর প্যানেল থেকেই সেই চাহিদার সিংহভাগ মেটানো যাবে। আগামী দশক থেকে পরিবহন ক্ষেত্রেও ইলেকট্রিক যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন। চীন ও ভারতের মতো বাজারে এমন গাড়ির চাহিদা এখনই তৈরি হয়েছে।
জুবায়ের আব্দুল বারি
No comments