মননশীল শাখা- গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নরত্ন by সিরাজুল ইসলাম
উয়ারী-বটেশ্বর শেকড়ের সন্ধানে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান মাটির ক্ষমতা অসীম। মাটি শুধু শস্যই দেয় না, মাটি শুধু সোনা-হীরা-মুক্তা-জহরতই সযতনে লুকিয়ে রাখতে পারে না এর পেটে; মাটি মানুষের সভ্যতা-কীর্তিতেও পুঁটুলি বানিয়ে লুকিয়ে রাখতে পারে হাজার বছর ধরে।
এর সাক্ষ্য মায়া, মিসরীয়, সিন্ধুর মতো আরও অগণিত মানব-সভ্যতা। মাটির এ মায়া থেকে বঞ্চিত হয়নি বাংলাদেশও। এ পর্যন্ত এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নরত্ন। বাংলাদেশে প্রত্নরত্ন আবিষ্কারের সর্বশেষ উপমা নরসিংদী জেলার উয়ারী-বটেশ্বর গ্রাম। এ আবিষ্কারের অগ্রদূত ওই গ্রামেরই দুই প্রত্নপ্রেমিক-হানীফ পাঠান (১৯০১-৮৯) ও তাঁর ছেলে মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। ১৯৩৩ সালে উয়ারী গ্রামে মাটি খননকালে শ্রমিকেরা রৌপ্যমুদ্রায় ভর্তি একটি মৃৎপাত্র আবিষ্কার করেন। শ্রমিকেরা প্রত্নপ্রেমিক নন। স্বাভাবিকভাবেই মুদ্রাগুলো বিভিন্ন হাতে চলে যায়। ভাগ্যক্রমে হানীফ পাঠান কিছু মুদ্রা রক্ষা করতে সক্ষম হন। এ থেকেই উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক যাত্রা শুরু। বাবার অনুসন্ধানী দৃষ্টি ছেলে হাবিবুল্লা পাঠানও লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে বটেশ্বর গ্রামে হাবিবুল্লা পাঠান মাঠের জমিতে আবিষ্কার করেন ভারী দুটি লৌহ বস্তু। পরে প্রমাণিত হয়, এগুলো প্রাচীনকালে ব্যবহূত হতো লৌহকুঠার হিসেবে। হানীফ পাঠান ১৯৫৫ সালের ৩০ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার ‘রবিবাসরীয়’ সংখ্যায় উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভাবনার ওপর একটি প্রবন্ধ লেখেন। শিরোনাম ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা’। তখন তাঁর প্রস্তাবকে হাস্যরস বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সমকালীন প্রত্নসমাজ। তবে এখন উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নসমাজে স্বীকৃতি লাভ করেছে। দেশের ও বিদেশের প্রত্নতত্ত্ববিদেরা স্বীকার করছেন, আড়াই হাজার বছর আগে পূর্ব ভারতে যে সভ্যতা গড়ে ওঠে, উয়ারী-বটেশ্বর এর একটি বড় অংশীদার বটে!
পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড়ে প্রাচীন-সভ্যতার আবিষ্কারের সার্বিক কৃতিত্ব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের। জাতি এ বিভাগের কাছে ঋণী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখন প্রত্ন বিভাগ আগের মতো নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। এর কারণ যা-ই হোক, এটা জাতির জন্য হতাশাব্যঞ্জক বটে! উয়ারী-বটেশ্বর এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রত্নস্থান। প্রাথমিক স্তরে এ সংস্কৃতির তাত্ত্বিক আবিষ্কারক হানীফ পাঠান ও তাঁর ছেলে মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। এর প্রকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক বিকাশধারার কৃতিত্ব দিতে হবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাঁর সহকর্মীদের। ১৯৯৬ সাল থেকে তাঁরা পেশাগতভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে যান এবং নানা আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ২০০০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর খননকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব খননকার্যের কারণে আমরা এখন মোটামুটি জানতে পারি, প্রাচীনকালে উয়ারী-বটেশ্বর ছিল প্রাচীন বাংলার পূর্বাঞ্চলের একটি বড় মাপের বন্দর নগর ও জনপদ।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান তাঁদের ও তাঁদের দলের হালনাগাদ খনন এবং উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে রচনা করেছেন আলোচ্য গ্রন্থ উয়ারী-বটেশ্বর: শেকড়ের সন্ধানে। ২৬টি অধ্যায়ে বিস্তৃত গ্রন্থটিতে তুলে ধরা হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক উয়ারী-বটেশ্বরের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জনপদ, স্থাপত্য, মৃৎপাত্র, লৌহ-হস্তকুঠার, মুদ্রা, নানা মাধ্যমের পুঁতি, বাটখারা ও মাপ-পরিমাপ ধাতব প্রত্নবস্তু ইত্যাদি। পৃথকভাবে উভয় লেখকই উয়ারী-বটেশ্বরের ওপর বিস্তর লেখালেখি করেছেন। উয়ারী-বটেশ্বর থেকে খননে পাওয়া বস্তুগুলোর অধিকাংশ নামসহ প্রদর্শিত হয়েছে। এগুলো থেকে পাঠক নিজে আন্দাজ করতে পারেন উয়ারী-বটেশ্বর বন্দর নগরের আমদানি-রপ্তানির ধারা ও এর সাংস্কৃতিক-প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য। প্রাপ্ত বস্তু থেকে এখন ধারণা করা সম্ভব, উয়ারী-বটেশ্বর কেন্দ্র করে একটি সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল; যেমনটি আমরা লক্ষ করি উপমহাদেশের অন্যান্য নগর বা জনপদ সম্পর্কে।
প্রাপ্ত উপাদানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে জানতে পারি, সমকালীন উপমহাদেশীয় পরিস্থিতিতে বাংলার অবস্থান। যেহেতু উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া বস্তুগুলোর সঙ্গে সমকালীন ভারতের প্রত্নবস্তুগুলো তুলনীয় ও সাদৃশ্যপূর্ণ, সেহেতু আমরা অবশ্যই অনুমান করতে পারি যে, বাংলা উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে হয়তো এগিয়েই ছিল, কিন্তু মোটেই পিছিয়ে ছিল না। বিভিন্ন অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ পুঁতির আবিষ্কার প্রমাণ করে, বাংলা অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। এর আরেকটি প্রমাণ, বিপুল পরিমাণ রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কার। লেখকদ্বয় ঠিকই মন্তব্য করেছেন, যদি মুদ্রাগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়ে থাকে, তবে মুদ্রা তৈরির প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জাতি হিসেবে তাদের অবস্থান ছিল মর্যাদাকর। তবে এগুলো বিদেশ থেকে পাওয়া গেলে মনে করার কারণ আছে যে, এ দেশ থেকে পণ্যের রপ্তানি হয়েছে ব্যাপকভাবে।
সবশেষে, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার। কিন্তু এ বইয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সরকার থেকে তেমন কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি। তাঁরা বিভিন্ন প্রাইভেট সূত্র থেকে সাহায্য নিয়ে খননকার্য পরিচালনা করেছেন। এ তথ্যটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হেন পরিস্থিতির যথার্থতা মেনে নেওয়া যায় না।
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১২, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, দাম: ৬০০ টাকা
পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড়ে প্রাচীন-সভ্যতার আবিষ্কারের সার্বিক কৃতিত্ব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের। জাতি এ বিভাগের কাছে ঋণী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখন প্রত্ন বিভাগ আগের মতো নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। এর কারণ যা-ই হোক, এটা জাতির জন্য হতাশাব্যঞ্জক বটে! উয়ারী-বটেশ্বর এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রত্নস্থান। প্রাথমিক স্তরে এ সংস্কৃতির তাত্ত্বিক আবিষ্কারক হানীফ পাঠান ও তাঁর ছেলে মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান। এর প্রকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক বিকাশধারার কৃতিত্ব দিতে হবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাঁর সহকর্মীদের। ১৯৯৬ সাল থেকে তাঁরা পেশাগতভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে যান এবং নানা আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ২০০০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর খননকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব খননকার্যের কারণে আমরা এখন মোটামুটি জানতে পারি, প্রাচীনকালে উয়ারী-বটেশ্বর ছিল প্রাচীন বাংলার পূর্বাঞ্চলের একটি বড় মাপের বন্দর নগর ও জনপদ।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ও মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান তাঁদের ও তাঁদের দলের হালনাগাদ খনন এবং উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে রচনা করেছেন আলোচ্য গ্রন্থ উয়ারী-বটেশ্বর: শেকড়ের সন্ধানে। ২৬টি অধ্যায়ে বিস্তৃত গ্রন্থটিতে তুলে ধরা হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক উয়ারী-বটেশ্বরের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জনপদ, স্থাপত্য, মৃৎপাত্র, লৌহ-হস্তকুঠার, মুদ্রা, নানা মাধ্যমের পুঁতি, বাটখারা ও মাপ-পরিমাপ ধাতব প্রত্নবস্তু ইত্যাদি। পৃথকভাবে উভয় লেখকই উয়ারী-বটেশ্বরের ওপর বিস্তর লেখালেখি করেছেন। উয়ারী-বটেশ্বর থেকে খননে পাওয়া বস্তুগুলোর অধিকাংশ নামসহ প্রদর্শিত হয়েছে। এগুলো থেকে পাঠক নিজে আন্দাজ করতে পারেন উয়ারী-বটেশ্বর বন্দর নগরের আমদানি-রপ্তানির ধারা ও এর সাংস্কৃতিক-প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য। প্রাপ্ত বস্তু থেকে এখন ধারণা করা সম্ভব, উয়ারী-বটেশ্বর কেন্দ্র করে একটি সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল; যেমনটি আমরা লক্ষ করি উপমহাদেশের অন্যান্য নগর বা জনপদ সম্পর্কে।
প্রাপ্ত উপাদানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে জানতে পারি, সমকালীন উপমহাদেশীয় পরিস্থিতিতে বাংলার অবস্থান। যেহেতু উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া বস্তুগুলোর সঙ্গে সমকালীন ভারতের প্রত্নবস্তুগুলো তুলনীয় ও সাদৃশ্যপূর্ণ, সেহেতু আমরা অবশ্যই অনুমান করতে পারি যে, বাংলা উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে হয়তো এগিয়েই ছিল, কিন্তু মোটেই পিছিয়ে ছিল না। বিভিন্ন অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ পুঁতির আবিষ্কার প্রমাণ করে, বাংলা অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। এর আরেকটি প্রমাণ, বিপুল পরিমাণ রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কার। লেখকদ্বয় ঠিকই মন্তব্য করেছেন, যদি মুদ্রাগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়ে থাকে, তবে মুদ্রা তৈরির প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জাতি হিসেবে তাদের অবস্থান ছিল মর্যাদাকর। তবে এগুলো বিদেশ থেকে পাওয়া গেলে মনে করার কারণ আছে যে, এ দেশ থেকে পণ্যের রপ্তানি হয়েছে ব্যাপকভাবে।
সবশেষে, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার। কিন্তু এ বইয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সরকার থেকে তেমন কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি। তাঁরা বিভিন্ন প্রাইভেট সূত্র থেকে সাহায্য নিয়ে খননকার্য পরিচালনা করেছেন। এ তথ্যটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হেন পরিস্থিতির যথার্থতা মেনে নেওয়া যায় না।
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১২, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, দাম: ৬০০ টাকা
No comments