বসন্ত উসব- সুব্রতা রায় ত্রিবেদী
উৎসব-প্রিয় বাঙালীর এক প্রাণের উৎসব এই বসন্ত-উৎসব। আমাদের ঋতুচক্রকে ঘিরে কত উৎসব, কত মেলা! তাই গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ঋতুকে ঘিরে নানা উৎসব ও অনুষ্ঠানের আয়োজন।
আমাদের জীবনে একটা ভিন্নমাত্রা নিয়ে আসে এ উৎসব। শীতের রুক্ষ্ম, শুষ্ক ও বিবর্ণ প্রকৃতির বুকে সজীবতার পরশ। দখিনা মাতাল সমীরণে প্রস্ফুটিত ফুলের মিষ্টি মধুর সুবাস, বিহঙ্গের কূজন, মধুপের গুঞ্জনে বসন্ত অপূর্ব বর্ণিল হয়ে ওঠে। বনে বনে বিচিত্র পু্ি#৬৩৭৪৩;ত ফুলের বর্ণে, গন্ধে ও রূপে প্রকৃতি অপরূপা। বসন্ত ঋতু জীবন ও যৌবনের জয়গানে মুখর।বসন্তের রূপ দর্শনে বিমুগ্ধ কবিচিত্তে ধ্বনিত হয় :
আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে
এত বাঁশী বাজে
এত পাখি গায়
আহা আজি এ বসন্তে
চারুকলা, ছায়ানট, বাংলা একাডেমী, রমনার বটমূলে ও শান্তি-নিকেতনের বৃকুঞ্জে আয়োজিত হয় ঋতুবরণ অনুষ্ঠান। গানে, কবিতায়, নৃত্যে হিল্লোলিত হয় আমাদের হৃদয়। তখন বঙ্গললনার পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, কপোলে বড় লাল টিপ, খোঁপায় লাল ও হলুদ ফুল-মালা। আমাদের সংস্কৃতির এ এক অপরূপ রূপ। আকাশে বাতাসে তারই প্রতিধ্বনি। প্রতি ঋতু আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সরস ও জীবন্ত হয়ে ওঠে। হঁ্যা, বাঙালীর এ এক বড় প্রাণের উৎসব।
বসন্ত আমাদের কাছে শুধু প্রাণেরই উৎসব নয়, ফাল্গুনের আগুনঝরা, রক্তলাল বসন্ত এত আলো, হাসি, গান, সৌন্দর্যের পাশাপাশি একটি বিষাদের রাগিণী যেন সমান্তরালভাবে আমাদের চেতনায় প্রবাহিত। আমাদের কাছে ফাল্গুন আসে রক্তস্নাত '৫২'র ভাষা-আন্দোলনের প্রতীক হয়ে। তাই বসন্তের আবেদন আমাদের হৃদয়ের গভীরে। চেতনার মর্মমূলে।
প্রাচীন ভারতে 'সুবসন্তক' ও 'মদনোৎসব' জনপ্রিয় উৎসব ছিল। সংস্কৃত সাহিত্যে বসন্ত ঋতুর একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। সেখানে যে কোন কাব্য, নাটক, আখ্যায়িকার মধ্যেই বসন্ত-উৎসবের কথা থাকবেই। কালিদাদের 'মেঘদূত' যদিও বর্ষার কাব্য তবুও বসন্তের বর্ণনায় ঋদ্ধ। যপ্রিয়ার উদ্যান বর্ণনায়, প্রিয়ার নূপুরযুক্ত রাম চরণ স্পর্শে অশোক ফুলের প্রস্ফুটন এবং মুখমদিরা সিঞ্চনে বকুল ফুলের প্রস্ফুটন উৎসব আমরা দেখতে পাই। এসব উৎসব বসন্তকালেই অনুষ্ঠিত হতো। কামসূত্রের মধ্যে যেসব উৎসবের উল্লেখ আছে তার মধ্যে 'সুবসন্তক' ও 'মদনোৎসব' দু'টি উৎসবই প্রসিদ্ধ। কামসূত্রের টীকাকার যশোধরের মতে দু'টি একই কিন্তু অন্য গ্রন্থসমূহে দেখতে পাই যে দু'টি উৎসব পৃথক দিবসেই অনুষ্ঠিত হতো। ভোজ দেবের মতে সুবসন্তক হলো বসন্ত অবতারের উৎসব, যা আজ 'বসন্ত পঞ্চমী উৎসব' বলে পরিচিত। এই তিথিতে মদন-উৎসবও হতো। উত্তর ভারতে এই উৎসবগুলো আজও প্রচলিত।
প্রাচীনকালে ফসল ঘরে তোলার সময়, বসন্তে আমের মঞ্জুরী দেখা গেলে এবং চৈত্রে শুকা অষ্টমীতে অশোক গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে গেলেই উৎসবের শুরু হতো। তখন ফাল্গুনের শুরু থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত বসন্ত উৎসব বিভিন্ন রূপে পালিত হতো। একটি ছিল জনসাধারণের আনন্দ-উৎসব আর অন্যটি হলো কাম বা মদনদেবের পূজা বা উৎসব। সম্রাট হর্ষদেবের 'রত্নাবলী' নাটকের দু'রকম উৎসবেরই সরস বর্ণনা পাওয়া যায়। রাজা তাঁর সুউচ্চ রাজপ্রাসাদের চন্দ্রশালায় বসে নগরবাসীদের আমোদ-প্রমোদে শরিক হতেন। এই মধুমাসে সুললিত সঙ্গীত ও মৃদঙ্গের ধ্বনিতে নগর মুখরিত হতো। সুবাসিত আবিরে চারদিক রঙিনময় হয়ে উঠত। ভবভূতির মালতী মাধব গ্রন্থে মদন উৎসবের প্রাণবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়।
মদন বা কামদেব প্রেম ও কামের দেবতা। ব্রহ্মার মন হতে যাঁর সৃষ্টি। সুন্দর এক আকর্ষণীয় পুরুষ। এই অপরূপ পুরুষ পু্#৬৩৭৪৩;ময় পঞ্চশরে স্ত্রী পুরুষকে মোহিত করেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও এ প্রক্রিয়ার অধীন। পৌরানিক কাহিনী অনুসারে দ যজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করেন। পরজন্মে সতী পার্বতী রূপে জন্মলাভ করে মহাদেবকে পতিরূপে পাবার বাসনায় কঠোর ধ্যানে নিমগ্ন হন। আর মহাদেব তো সদা সর্বদাই গভীর ধ্যানে মগ্ন। এদিকে দেবতাদের অনুরোধে মদন মহাদেবকে পঞ্চশর নিপে করতে গিয়ে মহাদেবের তৃতীয় নেত্রের তীব্রদহনে ভস্মীভূত হয়। পরে অবশ্য পার্বতীর বিবাহের পর মদন পুনরায় পূর্বদেহ ফিরে পায়।
কামদেবের পুজো করা হয় এ কারণে বা সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় কামের প্রয়োজন। সৃষ্টি রচনার অনুকূল কামকেই শিব এবং বিষ্ণুর সাাত রূপ বলা হয়। এজন্যেই মন্দিরে কামদেবের যে আরাধনা তা প্রকৃতপ েসত্য, শিব ও সুন্দরেরই আরাধনা। স্ত্রী-পুরুষ সবাই একত্রে এমন কি অভিজাত পরিবারের রমণীরাও এ মন্দিরে পুজো করত। 'মালতী-মাধব' গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, অমাত্য ভুরি বসুর কন্যা মালতীও কামদেবের পুজো করেছিল। কালক্রমে এই মদন-উৎসব রূপান্তরিত হয়ে একসময় জনপ্রিয় হোলি বা হোলাক উৎসবে পরিণত হয়। বাৎসায়নের কামসূত্রে এর উল্লেখ আছে। সেই আদি স্মৃতিবাহী লৌকিক উৎসব হোলাক বা হোলি আমাদের সুপরিচিত দোল। হোলির বিবর্তনের ধারায় আমরা দেখতে পাই যে হোলি বা হোলাক উৎসব বা বসন্ত উৎসব বা কাম বা মদন উৎসব নামে সুপরিচিত ছিল।
ডা. নীহার রঞ্জন রায়ের মতে, আদিতে হোলি ছিল কৃষি সমাজের পুজো। সুশস্য উৎপাদন কামনায় নরবলি ও যৌন লীলাময় নৃত্যগীত উৎসব ছিল এর প্রধান অঙ্গ। পরবতর্ীকালে এই কাম বা মদন উৎসবই হোলিতে বিলীন হয়ে যায়। আরও পরে এই হোলিই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে দোল নামে অভিহিত হয় এবং এ ধারা এখনও বহমান। সুকুমার সেনের মতে, দোলযাত্রা আসলে ধর্মঘটিত কোন অনুষ্ঠানই নয়। এ ছিল জনসাধারণের বসন্তের উৎসব ও হৈ-হুল্লোড়। সবকিছু ছাপিয়ে এ উৎসব আজ আমাদের কাছে বসন্ত উৎসব হিসেবে বিশেষভাবে গৌরবান্বিত হয়ে উঠেছে। একটা হলো বসন্ত উৎসবের ধমর্ীয় দিক আর অন্যটা হলো জনসাধারণের আনন্দ-উচ্ছ্বাস। শৈশবের দেখা অনেক উৎসব পার্বণই আজ বিলুপ্ত হয়েছে_ কিছু বিলুপ্ত হবার পথে। কিছু কিছু ধিকি ধিকি জ্বলছে অনেকটা ীণ দীপশিখার মতোই। শৈশবের স্মৃতির ডালাখানি অমলিন। বাহারি ফুলে ফুলে সাজানো। একবার সেখানে ফিরে যাওয়া যাক। আমাদের কুমিল্লা শহরে দোল হতো খুব ঘটা করে। রাধা-কৃষ্ণের দোলমঞ্চ সজ্জিত করে আবির দিয়ে রাঙ্গানো হতো। ভোগ, আরতি, পুজো শাখর ও কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজে আকাশ-বাতাস মুখরিত হতো। ছোট-বড় সবাই মিলে রঙ খেলতে পাড়ায় চলে যেতাম। খেলা শেষে রঙ মেখে ভূত সেজে বাড়িতে ফিরতাম। এই হোলিকে ঘিরে কত মেলা কত অনুষ্ঠান! আমাদের সাদামাটা আটপৌরে একঘেয়ে জীবনে আনন্দের আবির ছড়িয়ে দিত হোলি।
শ্রী চৈতন্য দেবের আমলে বসন্তকালের পঞ্চমী তিথিতে জগন্নাথ দেবের এমনি হুল্লোড়ময় বসন্ত উৎসব হতো। এটাই হোরা পঞ্চমী। শ্রী চৈতন্যদেবের প্রভাবেই এই দোলযাত্রা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ঝুলন উৎসবে পরিণত হয়েছে। কালে এই রাধা-কৃষ্ণকে ঘিরে কত কাব্য কত আখ্যায়িকারই না জন্ম হয়েছে। উল্লেখ্য, রাধা-কৃষ্ণের লীলাবিষয়ক কাব্য বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
আমাদের বসন্ত উৎসব আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। প্রাচীন বসন্ত উৎসবে যে যৌনতা ছিল তা আজ আর নেই। আনন্দের বিষয় এই যে, আজ আমাদের বসন্ত উৎসব অনেক পরিশীলিত, রুচিস্নিগ্ধ, সুন্দর ও শিল্প সুষমামণ্ডিত।
আজ আমাদের এই উৎসব শুধুমাত্র ধমর্ীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা রূপ নিয়েছে সর্বজনীন কল্যাণমুখী আনন্দ উৎসবে।
No comments