অভিমতঃ ঘটনাটা এখনও কোথাও পাইনি by আবদুস সালাম
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ দেশপ্রেমমূলক নানা ঘটনা-উপঘটনায় সমৃদ্ধ। ২৪ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের ইতিহাসে সময়ের বাঁকে বাঁকে ক্ষুদ্র থেকে বৃহদাকার অসংখ্য তত্পরতায় লিপ্ত ছিলাম আমরা। সব তত্পরতার একটাই লক্ষ্য ছিল—স্বাধীনতা।
একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাড়িত করত আমাদের সর্বক্ষণ। স্বাধীনতা অর্জনের পর এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সিনেমা, নাটক, কবিতা, সাহিত্যকর্ম, পত্রিকায় লেখালেখি, গবেষণাপত্র ইত্যাদিতে ফোটানোর চেষ্টা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের যে বিশাল ক্যানভাস, সেই ক্যানভাসের পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকা খুব সহজ নয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খণ্ডের যে ইতিহাস বেরিয়েছে, তাতেও ইতিহাসকে সবদিক বিস্তৃতভাবে তুলে আনা সম্ভব হয়নি। দেশজুড়ে ছোট ছোট যে লাখো ঘটনা, তা তুলে আনা আসলে সম্ভবও নয়। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সবাই যদি ঘটনার বিবরণ দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তাহলেই কেবল তা সম্ভব হতে পারে।মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্মৃতিতে ভেসে আসে অসংখ্য ঘটনা। অবশ্য স্মৃতি মলিন হতে হতে এখন বিস্মৃত প্রায়; কিন্তু একটি ঘটনা এখনও জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিতে। ঘটনা হিসেবে তা হয়েতো বেশি বড় নয়; কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে তা অসামান্য। একটা ছোট্ট ঘটনা যে উজ্জীবিত করতে পারে গোটা জাতিকে, এ ঘটনাটি তার সাক্ষী। কোনো ঐতিহাসিক, কোনো সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা কিংবা গবেষক এখন পর্যন্ত ঘটনাটিকে স্পর্শ করেননি। সেই ঘটনাটির কথাই বলব এখন।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বয়ে গেছে প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাস। নিমিষেই বিশেষত চট্টগ্রাম অঞ্চলে মারা গেছেন ৫ লাখেরও অধিক মানবসন্তান। শোষণ, বঞ্চনা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালির জীবনে এ এক বাড়তি দুর্ভোগ। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো। পাকিস্তান সরকারের বিশেষ কোনো দৃষ্টি নেই এ দুর্ভোগে। ভাবখানা বাঙালি মরেছে মানে কিছু আপদ গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মওলানা ভাসানী পাকিস্তান সরকারের এই নিশ্চুপতার কড়া সমালোচনা করলেন। ভাসানী বললেন, ওরা আসে নাই। ওদের ওয়ালাইকুম সালাম। দুর্গতদের পাশে দাঁড়াল বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ। যে যেভাবে পারছে সাহায্য করেছে।
আমি তখন নটর ডেম কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একজন কর্মী এবং ছাত্রলীগ, ফকিরেরপুল আঞ্চলিক ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে আমাদের আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকেও ত্রাণ তত্পরতায় অংশ নিয়েছি আমরা। এরই মধ্যে ঘটল মেজাজ খারাপ করা সেই ঘটনা।
পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতের নায়ক-নায়িকা, পরিচালক, প্রযোজকদের একটা অংশের মানবিকতায় স্পর্শ করেছিল এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি। তারা একটা তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিল। কিন্তু চিত্রনায়ক কামাল এ উদ্যোগের বিরোধিতা করে মন্তব্য করল যে পূর্ব পাকিস্তানে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, তাতে আমাদের কী! বাঙালির জন্য এত দরদ কেন? খবরটি ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপা হলো গুরুত্বের সঙ্গেই। এ খবর পাঠ করার পর পূর্ব বাংলায় কার মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল জানি না, ব্যক্তিগতভাবে আমি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলাম। এত বড় অপমান সহ্য করার মতো নয়। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম এর বিরুদ্ধে একটা কিছু করতে হবে। কমিটির সভা আহ্বান করে সিদ্ধান্ত নিলাম, এই বাংলায় কামালের কোনো ছবি প্রদর্শিত হতে পারবে না।
জোনাকি সিনেমা হলটি আমাদের ফকিরেরপুল থেকে আধ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত। এই প্রেক্ষাগৃহে তখন কামাল অভিনিত রোড টু সোয়াত ছবিটি প্রদর্শিত হচ্ছে। আমি মাহবুব কামাল, ওয়াজেদসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী এবং সাধারণ ছাত্রসহ ছুটে গেলাম জোনাকি প্রেক্ষাগৃহে। প্রথমেই ইট-পাটকেল ছুঁড়ে হলের সামনে ঝোলানো বিলবোর্ড ভেঙে ফেলা হলো। তারপর সবাই মিলে ঢুকলাম ম্যানেজারের রুমে। তাকে বললাম, হল থেকে রোড টু সোয়াত নামিয়ে ফেলেন। এই ছবি আর প্রদর্শিত হতে পারবে না। ছবিটি আর প্রদর্শিত হতে পারল না। পরদিন পত্রিকায় এই খবর বেরুনোর পর সারা পূর্ব পাকিস্তান তত্কালীন থেকে কামাল অভিনীত সব ছবি নামিয়ে ফেলা হলো। সারা দেশের মানুষের মধ্যে কামালের প্রতি সে কী ঘৃণা! সামনে পেলে খুন করে ফেলে আর কি!
এখন মনে পড়ে নিজের মধ্যে কী এক অপরিসীম জাত্যভিমান কাজ করেছিল তখন। এই জাত্যভিমান পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি। কামাল অভিনীত ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে সেই জাত্যভিমানের কিছুটা প্রশমন ঘটিয়েছিলাম এবং সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে নতুন করে আরেকবার জাত্যভিমান তৈরি করতে পেরে আনন্দও পেয়েছিলাম সীমাহীন।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর বিএনপি
No comments