কণ্ঠস্বর-ঝাণ্ডা উঁচা রহেগা by রাহাত খান
ভারতবিরোধিতা ত্যাগ করা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। আর হুজুর-মওদুদী জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে তো নয়ই। কথাটা আচমকা বলায় কেউ কেউ বিস্মিত হতে পারেন। তবে কথাটা প্রমাণসিদ্ধ। সূর্যালোকের মতো পরিষ্কার।
গত ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলনের বিষয়টিই উল্লেখ করা যাক। এবারের ভারত সফর থেকে ফিরে আসার পর কয়েকটি পর্যবেক্ষক মহল মন্তব্য করেছিল_ বাংলাদেশে আসন্ন ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে বিএনপি বোধহয় তাদের চিরাচরিত ভারতবিরোধী কার্ড খেলা থেকে বিরত থাকবে। বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা নাকি বিএনপি বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে, পশ্চিমা শক্তিগুলো ২০০৭ সাল থেকে তাদের কূটনীতি ও বাণিজ্যিক ফোকাস পয়েন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়াকে, যেখানে ভারত শুধু আয়তনের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর প্রত্যেকটির চেয়ে বড়ই নয়; সমরশক্তি এবং উন্নত দেশ হিসেবেও সারাবিশ্বে বৃহৎ শক্তি হিসেবে বিবেচিত। পরাশক্তির অধিকারী পাকিস্তান এবং অন্য দু'একটি মার্কিনবিরোধী শক্তির সমর্থনে এতদিন বিএনপি এবং তথাকথিত ইসলামী দলগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক অপপ্রচারে ভারতবিরোধিতা করে গেলেও এবার সেই অবস্থান নেওয়া বিএনপির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ; এমনকি বিপজ্জনক। কারণ পরাশক্তির অধিকারী হলেও পাকিস্তানের 'স্বাস্থ্য' ইদানীং খুবই খারাপ যাচ্ছে। অধুনা পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ইমরান খান, পাকিস্তানের পরমাণু বোমার মূল কারিগর আবদুল কাদির খান প্রমুখ হাইপ্রোফাইল ব্যক্তি ইদানীং প্রবন্ধ লিখে, বক্তৃতা দিয়ে পরিষ্কারভাবেই বলছেন, পাকিস্তানে এখন ১৯৭১ সালের চেয়েও ভয়াবহ দুর্দিন চলছে। বেলুচদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া এখন সামান্য কিছুটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অবস্থাও অগি্নগর্ভ। কখন যে তারা পাক-তুনিস্তান নামে পৃথক রাষ্ট্রের পক্ষে পাঞ্জাবশাসিত পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেলে_ এই আশঙ্কায় কেন্দ্র ও সেনাবাহিনী শঙ্কিত।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশে পাকিস্তান সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত বিএনপি (জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দল নয়) এবার ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে তাদের নির্বাচনী প্রচারে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসতেও পারে। বিশেষ করে এবারের ভারত সফরের পর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার হাবভাব দেখে সেরকমই মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী মিডিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষণেও এ রকম আশাব্যঞ্জক মন্তব্য করা হয়েছিল। খালেদা জিয়া তথা বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে বাংলাদেশজুড়ে। তাই ক্ষমতায় যেতে 'অধীর অস্থির' বিএনপি ভারত ও মার্কিনবিরোধিতা থেকে বহুলাংশে সরে আসবে। এই ছিল ভারত সফরের পর বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে দেশের প্রভাবশালী কয়েকটি মিডিয়া এবং কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর অভিমত।
ভারতবিরোধিতা এবং মার্কিনবিরোধিতা কি একই সূত্রে গ্রথিত? আমার বক্তব্য থেকে এ রকম প্রশ্ন উঠতেই পারে। এ প্রশ্নে অনেকের মতো আমারও পর্যবেক্ষণ :পাকিস্তানি রাজনীতি তো বটেই, বাংলাদেশেও পাকিস্তান সমর্থনপুষ্ট রাজনীতির রকম-সকম এক। ভারত শত্রুরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাই। শত্রুর বন্ধুকে তো শত্রুরূপেই গণ্য করতে হয়। নাকি?
ইদানীং অবশ্য পাকিস্তানি রাজনীতির মূলধারা আগের তীব্র ভারতবিরোধিতা থেকে কিছুটা সরে এসেছে, যা কায়েম হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে খণ্ডিত হওয়া দুই রাষ্ট্রের পত্তন হওয়ার পরপরই। পাকিস্তান এখন সেই মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে ভারতের সঙ্গে। ভারতও 'চিরবৈরী' পশ্চিম সীমান্তের দেশটিকে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ করতে আগ্রহী। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ভারতকে তিন তিনবার আক্রমণ করা দেশটি পারস্পরিক মৈত্রী স্থাপনে একটু বেশি দেরি করে ফেলেছে। মৈত্রী-মৈত্রী খেলা চলতে পারে দুই দেশের মূলধারার রাজনীতির মধ্যে। কিন্তু তালেবান ও জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া ঘোর ভারতবিরোধী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভেতর বিরোধিতার বিপক্ষে গিয়ে পাকিস্তানের রক্তহীন ফ্যাকাসে ও দুর্বল রাজনীতি কি তা ইচ্ছে করলেও পারবে? এই প্রশ্ন অতিশয় বাস্তব।
যা হোক, এবারের ভারত সফরের পর বিএনপি রাজনীতিতে ভারতবিরোধিতা সর্বাংশে না হলেও বহুলাংশে লোপ পাবে_ এ রকমটা আশা করা গিয়েছিল। কিছুদিন বিএনপি তথা খালেদা জিয়া তার কয়েকটি বৃহৎ জনসভায় ভারতবিরোধী কোনো বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরতও ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ভারতবিরোধী সেই ভূমিকা পরিত্যাগ করা বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। গত ১৯ ডিসেম্বর বিএনপি আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে তার বক্তৃতায় খালেদা জিয়া পরিষ্কার বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় না এলে বাংলাদেশের মানচিত্র বদলে যাবে। বলেছেন, সামনে আর একটা যুদ্ধ। সেটা হচ্ছে দেশ রক্ষার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শামিল হতে হবে 'দেশ বাঁচাতে' হলে।
২০০৫ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় বেগম খালেদা জিয়া (তথা বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী) বলতেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে ফেনী পর্যন্ত চলে যাবে ভারতের অধিকারে। বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়বে ভারতীয় সৈন্য। তারা বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্য বানিয়ে ছাড়বে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু ফেনী ভারত দ্বারা অধিকৃত হয়নি। ভারতীয় সেনাবাহিনীও ঘাঁটি গাড়েনি বাংলাদেশে! এবার খালেদা জিয়া বলছেন :২০১৪ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের মানচিত্রই বদলে যাবে। বঙ্গোপসাগর তো নয়, মিয়ানমারও নয়। তাহলে বাংলাদেশের মানচিত্র বদলে দেওয়ার শক্তি রাখে ভারত। অর্থাৎ 'ভাশুরের' নাম মুখে না নিয়েও খালেদা জিয়া বাংলাদেশের মানচিত্র বদলে যাওয়ার পেছনে যে ভারতকেই দায়ী করতে চাইছেন_ এই বক্তব্য অতি পরিষ্কার।
বিএনপি তার ভারতবিরোধী ভূমিকা কোনোদিন ত্যাগ করতে পারবে বলে মনে হয় না। অনেকের মতে, বিএনপির ভেতরে ভারতবিরোধী অংশটি উপেক্ষার বিষয় নয়। ভাসানী ন্যাপ, ইউপিপি, মুসলিম লীগ, হক-তোয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিনের দল থেকে কৌশলগত কারণে বিএনপিতে যোগ দেওয়া ভারতবিরোধী অংশটি কার্যত এখন খালেদা জিয়াকে সামনে রেখে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিএনপির পক্ষে তাই ভারতবিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে আসা বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাস্তবতায় অসম্ভব বলেই মনে হয়। দ্বিতীয় যে কারণটি এক্ষেত্রে বর্তায়, তাও উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বিএনপির পক্ষে হয়তো কোনোদিনই নয়। সেটা হচ্ছে, বিএনপির জামায়াত-সম্পৃক্ততা। এটা তো রাজনীতিতে ওপেন সিক্রেট যে, বিএনপি চলে জামায়াত এবং ভঙ্গুরপ্রায়, তবে জেদি-গোঁয়ার একটি বিদেশি রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে, তাদের পরামর্শে এবং নির্দেশে।
মূলত, এই দুটি কারণে বিএনপির ভারত-মার্কিনবিরোধী ভূমিকা নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। গতি নেই বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা নেওয়া ছাড়া। বিএনপি আড়ালে ও প্রকাশ্যে কার্যত সেই রাজনীতিই করে চলেছে। দেশ রক্ষার 'যুদ্ধের' নামে খালেদা জিয়া যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করতে চাইছেন_ এতে সন্দেহের কারণ নেই। একদা যারা চাপিয়ে দেওয়া গণহত্যা ও বাংলাদেশ ধ্বংসের বিপক্ষে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর বিপক্ষে বীরোচিত লড়াই চালিয়ে বাংলাদেশ মুক্ত ও স্বাধীন করেছিলেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে পাকিস্তানপন্থি, বাংলাদেশবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ডাকা সমাবেশে যোগ দেন_ সেটা ভেবে আশ্চর্য হই! খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা কখনও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সমর্থন দিতে পারেন না। অনেকে বলছেন, ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলনে যোগ দেওয়া ৯৯ পার্সেন্টই 'জামায়াতের মুক্তিযোদ্ধা'। জামায়াতের তো একটি 'মুক্তিযোদ্ধা' ফ্রন্ট আছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে তারা একাধিকবার মিটিংও করেছে। তবে জ্ঞানপাপী ছাড়া এ বিষয়ে সবাই নিশ্চিত হবেন যে, 'জামায়াতের মুক্তিযোদ্ধা'রা ১৯৭১ সালে বাঙালি ও বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিল 'পাকিস্তান রক্ষা'র জন্য। বিএনপির গত ১৯ ডিসেম্বরের 'মুক্তিযোদ্ধা' সম্মেলনে তাদের সংখ্যাই বেশি ছিল। তাদের নিয়েই বেগম জিয়া দেশপ্রেমিক বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশের বিপক্ষে 'দেশ রক্ষা'র যুদ্ধ করতে চাইছেন!
না, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বিএনপি-জামায়াত এখন রাজনীতিতে পরস্পরের আত্মার আত্মীয়। তাদের বর্তমান অবস্থাটা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রেম-সৌহার্দ্যের তুরীয় অবস্থা। 'যেন বা দুহু কোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।' তবে যতদিন স্বাধীন বাংলাদেশ-বিরোধিতা এবং 'ভারত-মার্কিন' বিরোধিতা কায়েম আছে এবং থাকবে, ততদিন বিএনপি-জামায়াতের বিচ্ছিন্ন হওয়ার হেতু নেই। প্রকাশ্যে না হলেও অন্তরে তাদের মধ্যে পাক ওয়াতানকা 'ঝাণ্ডা উঁচা রহেগা'।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
এমতাবস্থায় বাংলাদেশে পাকিস্তান সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত বিএনপি (জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দল নয়) এবার ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে তাদের নির্বাচনী প্রচারে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসতেও পারে। বিশেষ করে এবারের ভারত সফরের পর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার হাবভাব দেখে সেরকমই মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী মিডিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষণেও এ রকম আশাব্যঞ্জক মন্তব্য করা হয়েছিল। খালেদা জিয়া তথা বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে বাংলাদেশজুড়ে। তাই ক্ষমতায় যেতে 'অধীর অস্থির' বিএনপি ভারত ও মার্কিনবিরোধিতা থেকে বহুলাংশে সরে আসবে। এই ছিল ভারত সফরের পর বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে দেশের প্রভাবশালী কয়েকটি মিডিয়া এবং কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর অভিমত।
ভারতবিরোধিতা এবং মার্কিনবিরোধিতা কি একই সূত্রে গ্রথিত? আমার বক্তব্য থেকে এ রকম প্রশ্ন উঠতেই পারে। এ প্রশ্নে অনেকের মতো আমারও পর্যবেক্ষণ :পাকিস্তানি রাজনীতি তো বটেই, বাংলাদেশেও পাকিস্তান সমর্থনপুষ্ট রাজনীতির রকম-সকম এক। ভারত শত্রুরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাই। শত্রুর বন্ধুকে তো শত্রুরূপেই গণ্য করতে হয়। নাকি?
ইদানীং অবশ্য পাকিস্তানি রাজনীতির মূলধারা আগের তীব্র ভারতবিরোধিতা থেকে কিছুটা সরে এসেছে, যা কায়েম হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে খণ্ডিত হওয়া দুই রাষ্ট্রের পত্তন হওয়ার পরপরই। পাকিস্তান এখন সেই মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে ভারতের সঙ্গে। ভারতও 'চিরবৈরী' পশ্চিম সীমান্তের দেশটিকে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ করতে আগ্রহী। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ভারতকে তিন তিনবার আক্রমণ করা দেশটি পারস্পরিক মৈত্রী স্থাপনে একটু বেশি দেরি করে ফেলেছে। মৈত্রী-মৈত্রী খেলা চলতে পারে দুই দেশের মূলধারার রাজনীতির মধ্যে। কিন্তু তালেবান ও জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া ঘোর ভারতবিরোধী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভেতর বিরোধিতার বিপক্ষে গিয়ে পাকিস্তানের রক্তহীন ফ্যাকাসে ও দুর্বল রাজনীতি কি তা ইচ্ছে করলেও পারবে? এই প্রশ্ন অতিশয় বাস্তব।
যা হোক, এবারের ভারত সফরের পর বিএনপি রাজনীতিতে ভারতবিরোধিতা সর্বাংশে না হলেও বহুলাংশে লোপ পাবে_ এ রকমটা আশা করা গিয়েছিল। কিছুদিন বিএনপি তথা খালেদা জিয়া তার কয়েকটি বৃহৎ জনসভায় ভারতবিরোধী কোনো বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরতও ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ভারতবিরোধী সেই ভূমিকা পরিত্যাগ করা বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। গত ১৯ ডিসেম্বর বিএনপি আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে তার বক্তৃতায় খালেদা জিয়া পরিষ্কার বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় না এলে বাংলাদেশের মানচিত্র বদলে যাবে। বলেছেন, সামনে আর একটা যুদ্ধ। সেটা হচ্ছে দেশ রক্ষার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শামিল হতে হবে 'দেশ বাঁচাতে' হলে।
২০০৫ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় বেগম খালেদা জিয়া (তথা বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী) বলতেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে ফেনী পর্যন্ত চলে যাবে ভারতের অধিকারে। বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়বে ভারতীয় সৈন্য। তারা বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্য বানিয়ে ছাড়বে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু ফেনী ভারত দ্বারা অধিকৃত হয়নি। ভারতীয় সেনাবাহিনীও ঘাঁটি গাড়েনি বাংলাদেশে! এবার খালেদা জিয়া বলছেন :২০১৪ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের মানচিত্রই বদলে যাবে। বঙ্গোপসাগর তো নয়, মিয়ানমারও নয়। তাহলে বাংলাদেশের মানচিত্র বদলে দেওয়ার শক্তি রাখে ভারত। অর্থাৎ 'ভাশুরের' নাম মুখে না নিয়েও খালেদা জিয়া বাংলাদেশের মানচিত্র বদলে যাওয়ার পেছনে যে ভারতকেই দায়ী করতে চাইছেন_ এই বক্তব্য অতি পরিষ্কার।
বিএনপি তার ভারতবিরোধী ভূমিকা কোনোদিন ত্যাগ করতে পারবে বলে মনে হয় না। অনেকের মতে, বিএনপির ভেতরে ভারতবিরোধী অংশটি উপেক্ষার বিষয় নয়। ভাসানী ন্যাপ, ইউপিপি, মুসলিম লীগ, হক-তোয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিনের দল থেকে কৌশলগত কারণে বিএনপিতে যোগ দেওয়া ভারতবিরোধী অংশটি কার্যত এখন খালেদা জিয়াকে সামনে রেখে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিএনপির পক্ষে তাই ভারতবিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে আসা বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাস্তবতায় অসম্ভব বলেই মনে হয়। দ্বিতীয় যে কারণটি এক্ষেত্রে বর্তায়, তাও উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বিএনপির পক্ষে হয়তো কোনোদিনই নয়। সেটা হচ্ছে, বিএনপির জামায়াত-সম্পৃক্ততা। এটা তো রাজনীতিতে ওপেন সিক্রেট যে, বিএনপি চলে জামায়াত এবং ভঙ্গুরপ্রায়, তবে জেদি-গোঁয়ার একটি বিদেশি রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে, তাদের পরামর্শে এবং নির্দেশে।
মূলত, এই দুটি কারণে বিএনপির ভারত-মার্কিনবিরোধী ভূমিকা নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। গতি নেই বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা নেওয়া ছাড়া। বিএনপি আড়ালে ও প্রকাশ্যে কার্যত সেই রাজনীতিই করে চলেছে। দেশ রক্ষার 'যুদ্ধের' নামে খালেদা জিয়া যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করতে চাইছেন_ এতে সন্দেহের কারণ নেই। একদা যারা চাপিয়ে দেওয়া গণহত্যা ও বাংলাদেশ ধ্বংসের বিপক্ষে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর বিপক্ষে বীরোচিত লড়াই চালিয়ে বাংলাদেশ মুক্ত ও স্বাধীন করেছিলেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে পাকিস্তানপন্থি, বাংলাদেশবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ডাকা সমাবেশে যোগ দেন_ সেটা ভেবে আশ্চর্য হই! খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা কখনও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সমর্থন দিতে পারেন না। অনেকে বলছেন, ১৯ ডিসেম্বর বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলনে যোগ দেওয়া ৯৯ পার্সেন্টই 'জামায়াতের মুক্তিযোদ্ধা'। জামায়াতের তো একটি 'মুক্তিযোদ্ধা' ফ্রন্ট আছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে তারা একাধিকবার মিটিংও করেছে। তবে জ্ঞানপাপী ছাড়া এ বিষয়ে সবাই নিশ্চিত হবেন যে, 'জামায়াতের মুক্তিযোদ্ধা'রা ১৯৭১ সালে বাঙালি ও বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিল 'পাকিস্তান রক্ষা'র জন্য। বিএনপির গত ১৯ ডিসেম্বরের 'মুক্তিযোদ্ধা' সম্মেলনে তাদের সংখ্যাই বেশি ছিল। তাদের নিয়েই বেগম জিয়া দেশপ্রেমিক বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশের বিপক্ষে 'দেশ রক্ষা'র যুদ্ধ করতে চাইছেন!
না, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বিএনপি-জামায়াত এখন রাজনীতিতে পরস্পরের আত্মার আত্মীয়। তাদের বর্তমান অবস্থাটা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রেম-সৌহার্দ্যের তুরীয় অবস্থা। 'যেন বা দুহু কোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।' তবে যতদিন স্বাধীন বাংলাদেশ-বিরোধিতা এবং 'ভারত-মার্কিন' বিরোধিতা কায়েম আছে এবং থাকবে, ততদিন বিএনপি-জামায়াতের বিচ্ছিন্ন হওয়ার হেতু নেই। প্রকাশ্যে না হলেও অন্তরে তাদের মধ্যে পাক ওয়াতানকা 'ঝাণ্ডা উঁচা রহেগা'।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments