চারদিক- ফুলতলার গামছা by গাজী মুনছুর আজিজ
মাটির ভিটা। মাটির দেয়াল। ওপরে টিনের চালা। সব মিলিয়ে মাটির ঘর। ঘরের সামনে বারান্দা। সেই বারান্দার এক পাশে ছোট্ট তাঁত। মাঝ বয়সী এক নারী সেই তাঁতে বুননের কাজ করছেন। বারান্দার অন্য পাশে আরেকজন মাঝ বয়সী নারী চরকায় সুতা মোড়াচ্ছেন।
কেবল এই ঘরের বারান্দা নয়, এখানকার প্রায় প্রতিটি ঘরের বারান্দায় দেখা যাবে তাঁতে কাপড় বুননের এই দৃশ্য। মূলত তাঁরা গামছা বুনছেন। আর এই গামছা বুননের তাঁতিপাড়াটির অবস্থান খুলনার ফুলতলা উপজেলার আলকা-দামোদর গ্রাম। ‘কারিকরপাড়া’ হিসেবেই সবার কাছে বেশি পরিচিত গামছা বুননের এই তাঁতিপাড়াটি।
এখানকার আলকা গ্রামের তাঁতি শিরিন বেগম বলেন, ‘সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গামছা বোনার কাজ করি। দিনে এক থান বা চারটি গামছা বুনতে পারি। আবার সময় বেশি পেলে বেশি গামছাও বুনতে পারি। সাধারণত লম্বায় চার হাত ও চওড়ায় দুই হাত গামছা চারটি বিক্রি করা হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। এ ছাড়া লম্বায় সাড়ে তিন হাত ও চওড়ায় দেড় হাত গামছা চারটি বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। অনেক সময় রং, নকশা ও গুণগত মানের জন্য গামছার দাম কমবেশিও হয়ে থাকে। এক থান বা চারটি গামছা বিক্রি করলে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা লাভ হয়। তবে আগে আরও বেশি লাভ থাকত। এখন সুতার দাম বেশি হওয়ার কারণে লাভ আগের চেয়ে কম হয়।’
তাঁতি আলেয়া বেগম বলেন, ‘গামছার সুতা কিনতে পাওয়া যায় ফুলতলার বাজার ও খুলনার বাজারে। দেশি এসব সুতার দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই আমাদের গামছা বুননের কাজও দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে। কারণ, আগের তুলনায় সুতার দাম এখন অনেক বেশি। এ জন্য আমাদের অনেকে গামছা বুননের কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করছেন। ফলে এখানকার তাঁত ও তাঁতির সংখ্যাও দিন দিন কমছে।’
‘গামছা বুননের নকশা আমরা নিজেরাই করে থাকি। আমাদের এখানে বোনা গামছার নকশাগুলোর নাম ঝুড়ি, চেক, ঝালকাঠি, লেডিস ইত্যাদি। তবে গামছার জমিন আর পাড়ের রং ও নকশার মধ্যে কিছুটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। অর্থাৎ পাড় এবং জমিনের রং ও নকশা আলাদা রঙের ও নকশার হয়ে থাকে। তাই এখানকার প্রতিটি গামছারই তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি চওড়া পাড় দেখা যাবে। এ ছাড়া এখানকার বোনা গামছার রংগুলো সাধারণত উজ্জ্বল হয়ে থাকে। লাল, সাদা, নীল, হলুদ, খয়েরিসহ প্রায় সব কটি রঙের সুতার ব্যবহার দেখা যাবে এখানকার বোনা গামছায়।’ এ কথা তাঁতি পারভিন বেগমের।
তাঁতি রাশিদা বেগম বলেন, ‘আমরা গামছা বুনে হাটে বিক্রি করি। এখানকার ফুলতলার বাজারে গামছার হাট বসে প্রতি রবি ও বুধবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সারা দেশ থেকে আসা পাইকার বা মহাজনেরা এসব গামছা কিনে নিয়ে যান। আবার অনেক সময় গামছা বুনে বাড়িতেই রেখে দিই। পাইকারেরা বাড়িতে এসে গামছা কিনে নেন। অনেক পাইকার অগ্রিম ফরমাশ দিয়ে যান গামছা বোনানোর জন্য। অনেক খুচরা ক্রেতাও বাড়িতে আসেন গামছা কেনার জন্য।’
তাঁতি মতিয়ার বিশ্বাস বলেন, ‘গামছা বুননের পেশা আমাদের বাবা-দাদাদের সময় থেকে দেখে আসছি। বলা যায়, এটা আমাদের আদি পেশা। তাই এখানকার প্রায় প্রতিটি পরিবারের প্রায় প্রত্যেক সদস্যই এই গামছা বুননের সঙ্গে জড়িত।’
লাভ বেশি না হওয়ার কারণে অনেক তাঁতি গামছা বোনা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। অন্যদিকে মেশিনের তৈরি গামছার দাম কম হওয়ায় হাতে বোনা গামছার চাহিদাও কমেছে। তাই কয়েক বছর আগেও আলকা ও দামোদর গ্রামে পাঁচ শতাধিক তাঁত ছিল। এখন সেখান থেকে কমে দুই থেকে আড়াই শ তাঁত আছে।
এখানকার তাঁতগুলোতে একজন তাঁতি একটি তাঁতে বুননের কাজ করেন। তাঁর কোনো সহকারীর প্রয়োজন হয় না। হাতে টানা এই তাঁতগুলো মাটির ওপর বসানো। আর তাঁতি বসেন মাটিতে কিছুটা গর্ত করে সেই গর্তে। তাঁত বোনার সময় তাঁতির হাত ও পা একসঙ্গে কাজ করে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, এখানকার গামছা দেশের ঐতিহ্যবাহী বুননশিল্পের একটি। কিন্তু সুতার মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে এখানকার তাঁত ও তাঁতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী বুননশিল্পটি। তাই এখন এই শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা। তাদের সহযোগিতায় এই শিল্প আবার ফিরে পেতে পারে তার পুরোনো ঐতিহ্য এবং সেই সঙ্গে তাঁতিরাও আবার ফিরে আসতে পারেন তাঁদের পারিবারিক আদি পেশায়।
গাজী মুনছুর আজিজ
এখানকার আলকা গ্রামের তাঁতি শিরিন বেগম বলেন, ‘সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গামছা বোনার কাজ করি। দিনে এক থান বা চারটি গামছা বুনতে পারি। আবার সময় বেশি পেলে বেশি গামছাও বুনতে পারি। সাধারণত লম্বায় চার হাত ও চওড়ায় দুই হাত গামছা চারটি বিক্রি করা হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। এ ছাড়া লম্বায় সাড়ে তিন হাত ও চওড়ায় দেড় হাত গামছা চারটি বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। অনেক সময় রং, নকশা ও গুণগত মানের জন্য গামছার দাম কমবেশিও হয়ে থাকে। এক থান বা চারটি গামছা বিক্রি করলে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা লাভ হয়। তবে আগে আরও বেশি লাভ থাকত। এখন সুতার দাম বেশি হওয়ার কারণে লাভ আগের চেয়ে কম হয়।’
তাঁতি আলেয়া বেগম বলেন, ‘গামছার সুতা কিনতে পাওয়া যায় ফুলতলার বাজার ও খুলনার বাজারে। দেশি এসব সুতার দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই আমাদের গামছা বুননের কাজও দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে। কারণ, আগের তুলনায় সুতার দাম এখন অনেক বেশি। এ জন্য আমাদের অনেকে গামছা বুননের কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করছেন। ফলে এখানকার তাঁত ও তাঁতির সংখ্যাও দিন দিন কমছে।’
‘গামছা বুননের নকশা আমরা নিজেরাই করে থাকি। আমাদের এখানে বোনা গামছার নকশাগুলোর নাম ঝুড়ি, চেক, ঝালকাঠি, লেডিস ইত্যাদি। তবে গামছার জমিন আর পাড়ের রং ও নকশার মধ্যে কিছুটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। অর্থাৎ পাড় এবং জমিনের রং ও নকশা আলাদা রঙের ও নকশার হয়ে থাকে। তাই এখানকার প্রতিটি গামছারই তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি চওড়া পাড় দেখা যাবে। এ ছাড়া এখানকার বোনা গামছার রংগুলো সাধারণত উজ্জ্বল হয়ে থাকে। লাল, সাদা, নীল, হলুদ, খয়েরিসহ প্রায় সব কটি রঙের সুতার ব্যবহার দেখা যাবে এখানকার বোনা গামছায়।’ এ কথা তাঁতি পারভিন বেগমের।
তাঁতি রাশিদা বেগম বলেন, ‘আমরা গামছা বুনে হাটে বিক্রি করি। এখানকার ফুলতলার বাজারে গামছার হাট বসে প্রতি রবি ও বুধবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সারা দেশ থেকে আসা পাইকার বা মহাজনেরা এসব গামছা কিনে নিয়ে যান। আবার অনেক সময় গামছা বুনে বাড়িতেই রেখে দিই। পাইকারেরা বাড়িতে এসে গামছা কিনে নেন। অনেক পাইকার অগ্রিম ফরমাশ দিয়ে যান গামছা বোনানোর জন্য। অনেক খুচরা ক্রেতাও বাড়িতে আসেন গামছা কেনার জন্য।’
তাঁতি মতিয়ার বিশ্বাস বলেন, ‘গামছা বুননের পেশা আমাদের বাবা-দাদাদের সময় থেকে দেখে আসছি। বলা যায়, এটা আমাদের আদি পেশা। তাই এখানকার প্রায় প্রতিটি পরিবারের প্রায় প্রত্যেক সদস্যই এই গামছা বুননের সঙ্গে জড়িত।’
লাভ বেশি না হওয়ার কারণে অনেক তাঁতি গামছা বোনা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। অন্যদিকে মেশিনের তৈরি গামছার দাম কম হওয়ায় হাতে বোনা গামছার চাহিদাও কমেছে। তাই কয়েক বছর আগেও আলকা ও দামোদর গ্রামে পাঁচ শতাধিক তাঁত ছিল। এখন সেখান থেকে কমে দুই থেকে আড়াই শ তাঁত আছে।
এখানকার তাঁতগুলোতে একজন তাঁতি একটি তাঁতে বুননের কাজ করেন। তাঁর কোনো সহকারীর প্রয়োজন হয় না। হাতে টানা এই তাঁতগুলো মাটির ওপর বসানো। আর তাঁতি বসেন মাটিতে কিছুটা গর্ত করে সেই গর্তে। তাঁত বোনার সময় তাঁতির হাত ও পা একসঙ্গে কাজ করে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, এখানকার গামছা দেশের ঐতিহ্যবাহী বুননশিল্পের একটি। কিন্তু সুতার মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে এখানকার তাঁত ও তাঁতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী বুননশিল্পটি। তাই এখন এই শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা। তাদের সহযোগিতায় এই শিল্প আবার ফিরে পেতে পারে তার পুরোনো ঐতিহ্য এবং সেই সঙ্গে তাঁতিরাও আবার ফিরে আসতে পারেন তাঁদের পারিবারিক আদি পেশায়।
গাজী মুনছুর আজিজ
No comments