নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা by এ এম এম শওকত আলী
গত ১৭ ডিসেম্বর একটি ইংরেজি দৈনিকে ঢাকা মহানগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার বিষয়ে কিছু বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হয়। যেসব তথ্যের বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তা কারো অজানা নয়। প্রকাশিত তথ্যাবলি বহুলাংশে সঠিক।
আশঙ্কা হলো, এ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে দুর্বলতা নিরসনে কোনো সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে না। এ আশঙ্কার ভিত্তি হলো, অতীতেও মিডিয়ায় নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সিটি করপোরেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। অতীতে বিশ্বব্যাংক নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতির জন্য অর্থ সাহায্য দিয়েছে। এর চিহ্ন এখনো নগরের কোনো রাস্তায় দৃশ্যমান বৃহৎ আকারের ইস্পাতের তৈরি আধার (কনটেইনার)। বৃহৎ আকারের এ ধরনের আধার কতটুকু ব্যবহারযোগ্য সে বিষয়টি হয়তো ভেবে দেখা হয়নি। তবে এর পেছনে যুক্তিও ছিল। বড় আকারের আধার সংখ্যায় বেশি হবে না। কয়েক হাজার বাড়ির বর্জ্য এসব আধারে ফেলা হলে করপোরেশনের জন্য ট্রাকের সাহায্যে এগুলো স্থানান্তর করা সহজ হবে। কিন্তু যেসব বাড়ি এগুলো থেকে দূরে, তারা কি কষ্ট করে এগুলো ব্যবহার করবে? বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য। এর সঙ্গে কোনো কোনো এলাকায় ছোট আকারের পাকা চৌবাচ্চার মতো বর্জ্য ফেলার বন্দোবস্তও করা আছে। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। ফলে পথচারীসহ অন্যদের দুর্গন্ধের শিকার হতে হয়। কয়েক বছর ধরে নগরের কোনো কোনো এলাকায় বাড়িভিত্তিক বর্জ্য অপসারণের জন্য অনেকটা বেসরকারীকরণের মাধ্যমে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। এর জন্য বাড়িপ্রতি ৩০০ এবং পরে ৪০০ টাকা ফি ধার্য করা হয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে রয়েছে এ ব্যবস্থা। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট এলাকায় নির্মিত পাকা চৌবাচ্চাও রয়েছে। সেখান থেকে বর্জ্য অপসারণ করা হয় না।
বেসরকারি ব্যবস্থাপনার আত্মপ্রকাশ একটি ভালো উদ্যোগ। এ বিষয়ে কিছু প্রশ্নও রয়েছে। মূল প্রশ্ন হলো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। এর জন্য নগরবাসী বাড়িপ্রতি হোল্ডিং ট্যাক্সও প্রতিবছর দিয়ে থাকে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত ৪০০ টাকা দেওয়ার বাধ্যবাধকতার ফলে দ্বৈত ট্যাক্স প্রথা প্রবর্তিত হয়। আদর্শিক বিচারে বিষয়টি অনৈতিক। বেসরকারি ব্যবস্থাপনার প্রদেয় ব্যয়ভার সিটি করপোরেশন বহন করলে ভালো হতো। বিকল্প হিসেবে হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য যে অর্থ দেওয়া হয়, তা হারাহারিভাবে হ্রাস করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরে বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে বিকল্প উৎপাদনশীলতার সুযোগ করে দেবে। বলা হয়, রান্নাবান্নার অবশিষ্টাংশ রিসাইক্লিং করা হলে এ থেকে জৈব সার উৎপাদন সম্ভব ছিল। যে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার সৃষ্টি করা হয়েছে, তার ফলে রান্নাঘরের বর্জ্যই অপসারণ করা হয়। বাড়িপ্রতি এর পরিমাণ খুব বেশি হবে না। তবু বলা যায়, এর ফলে নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কিছু অংশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে।
এ ধরনের আইনি বিধানের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জৈব সারের ব্যবহার অধিক মাত্রায় চালু করা। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৯ মিলিয়ন হেক্টর জমির মধ্যে ৩.৮৪ মিলিয়ন হেক্টরে জৈব উপাদান অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। জৈব সার ব্যবহারে এর অভাব দূর করা সম্ভব। তা করা হলে অধিক ফসল ফলানোও সম্ভব। এ ছাড়া অধিক হারে জৈব সার ব্যবহারের ফলে ব্যয়বহুল রাসায়নিক সারের ব্যবহারও হ্রাস করা যায়, যা কৃষকের উৎপাদন ব্যয়ও হ্রাস করবে। এ ছাড়া যেসব সারের বিনির্দেশ সরকার অনুমোদন করেছে, তার ব্যতিক্রম হলে সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধানও রয়েছে। এর জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাজার থেকে সারের নমুনা নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ সংগ্রহ করে বিনির্দিষ্ট পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে। অনুমোদিত মান না থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতকারক বা ক্ষেত্রমতো ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনা হয়। শাস্তিও দেওয়া হয় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে। কারখানা পরিদর্শনের নিয়মও রয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অন্যান্য দেশের অনুরূপ।
জৈব উৎসের বর্জ্য রিসাইক্লিং-সংক্রান্ত গবেষণা অতীতে হয়েছে। ওয়েস্ট কনসার্ন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে এ গবেষণা করেছিল। ফলে এ বিষয়ে একটি প্রকাশনাও পাওয়া যায়। এর নাম কমিউনিটি ভিত্তিক জৈব সার উৎপাদন। এ প্রকাশনায় বর্ণিত পদ্ধতি ব্যবহারে কেউ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম ওয়েস্ট কনসার্ন। তবে যত দূর জানা যায়, এ উদ্যোগও স্থায়িত্ব লাভ করেনি। কারণ কী তা অনুসন্ধানযোগ্য। সাম্প্রতিককালে জেলা ও উপজেলায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় জৈব সার উৎপাদনের বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। তবে এখানে আইনি নিয়ন্ত্রণের জন্য খুব বেশি উদ্যোক্তা আগ্রহী নয়। যেকোনো ধরনের সার উৎপাদন ও বিক্রির জন্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আইনের বলে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের আইন ২০০৬ সালে করা হয়েছে। আইন থাকা ভালো। আইনের অযৌক্তিক প্রয়োগ বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাহত করে। বাংলাদেশে ২০০৮ থেকে এর অযৌক্তিক ও অবৈধ প্রয়োগই দৃশ্যমান। এ আইনের বিধান অনুযায়ী যেসব সার বা সারজাতীয় দ্রব্যের বিনির্দেশ (স্পেসিফিকেশন) সরকার ঘোষণা করেছে, সেসব সার বা সারজাতীয় দ্রব্যের মাঠ পর্যায়ে ও গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হবে না। আইনের এ ধারা লঙ্ঘন করে ২০০৮ থেকে বিনির্দেশ জারি করার পরও দুটি বিষয়েই বাধ্যতামূলক প্রথা চালু আছে, যা অযৌক্তিক ও আইনসিদ্ধ নয়।
এ বিষয়ের জন্য ক্যাটালিস্ট নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা সম্পন্ন করে সরকারের তথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মন্ত্রণালয় এ সমীক্ষার ফলাফল একটি টেকনিক্যাল কমিটি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে। এ কমিটি সংশ্লিষ্ট সবার মতামত গ্রহণের পর এ অবৈধ প্রথা রদ করার পক্ষে সুপারিশ করেছে বলে জানা যায়। আশা করা যায়, অচিরেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জারি করা হবে। রান্নাঘরের বর্জ্য জৈব সার উৎপাদনকারীরা ব্যবহার করবে কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের বর্জ্য অপসারণ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি জৈব সার উৎপাদকরা যদি যোগসূত্র স্থাপন না করে, তাহলে এ কাজ সম্ভব হবে না। বিকল্প হিসেবে নগরের নির্দিষ্ট জায়গায় যেসব বর্জ্য রাখা হয়, যেখানে এর ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পরীক্ষা করা যায়। সরকার বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে পারে।
নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্য একটি দিক অধিকতর দুর্বল। হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বর্তমানে প্রকট হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। বাস্তবেও একই চিত্র। মূল কারণ সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের আত্মপ্রকাশ। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম কারো অজানা নয়। তবে এ ক্ষেত্রে রোগীদের সেবার বিষয়টিই অধিকতর আলোচিত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নয়। কয়েক বছর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কিছু বিধান প্রণয়ন করেছিল। এসব বিধান কাগজেই থেকে গেছে। বাস্তবে এটা অনুসরণ করা হয় না। এর কারণ একাধিক।
এক. স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত পরিদর্শন ও বিধান অনুসরণের বাধ্যবাধকতার অভাব। দুই. বিধান অনুযায়ী এ ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক আধার ব্যবহার করার কথা। বাস্তবে তা অনুসৃত হয় না। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অধিকর্তাদের মতে, বর্জ্য পৃথক আধারে দেওয়া হলেও তা বর্জ্য অপসারণের সময় অন্যান্য বর্জ্য থেকে পৃথক করা হয় না। বরং একই সঙ্গে ট্রাকে তোলা হয় এবং নির্দিষ্ট স্থানে অপসারণ করা হয় না। তিন. প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিধান সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র অনুসরণ করার চেষ্টা করে অনেকটা নিষ্ফলভাবে। চার. বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধিকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময়ও হয় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব সময়ই মনে করত, নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অর্থাৎ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার। হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরও দায়িত্ব রয়েছে- এমন কোনো ধারণা ছিল না। পাঁচ. সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় জমির অপ্রতুলতা। এটা সহজে দূর করা সম্ভব নয়। কারণ জমির দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছয়. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সম্পদের অভাব। সাত. এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাব।
নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী ও পরিবেশবান্ধব না করা গেলে জনস্বাস্থ্যেরই ক্ষতি হবে। রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আশার কথা, সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট একটি প্রকল্প দুই বা তিন বছর ধরে স্থানীয় সরকার বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে, যদি পুনরায় অনুরূপ প্রকল্প বাস্তবায়িত না হয়। অন্যদিকে সুব্যবস্থাপনা স্থায়ী করার জন্য নিরপেক্ষভাবে সার্বিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা চিহ্নিত করে তার সমাধানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব হবে না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
বেসরকারি ব্যবস্থাপনার আত্মপ্রকাশ একটি ভালো উদ্যোগ। এ বিষয়ে কিছু প্রশ্নও রয়েছে। মূল প্রশ্ন হলো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। এর জন্য নগরবাসী বাড়িপ্রতি হোল্ডিং ট্যাক্সও প্রতিবছর দিয়ে থাকে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত ৪০০ টাকা দেওয়ার বাধ্যবাধকতার ফলে দ্বৈত ট্যাক্স প্রথা প্রবর্তিত হয়। আদর্শিক বিচারে বিষয়টি অনৈতিক। বেসরকারি ব্যবস্থাপনার প্রদেয় ব্যয়ভার সিটি করপোরেশন বহন করলে ভালো হতো। বিকল্প হিসেবে হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য যে অর্থ দেওয়া হয়, তা হারাহারিভাবে হ্রাস করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরে বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে বিকল্প উৎপাদনশীলতার সুযোগ করে দেবে। বলা হয়, রান্নাবান্নার অবশিষ্টাংশ রিসাইক্লিং করা হলে এ থেকে জৈব সার উৎপাদন সম্ভব ছিল। যে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার সৃষ্টি করা হয়েছে, তার ফলে রান্নাঘরের বর্জ্যই অপসারণ করা হয়। বাড়িপ্রতি এর পরিমাণ খুব বেশি হবে না। তবু বলা যায়, এর ফলে নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কিছু অংশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে।
এ ধরনের আইনি বিধানের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জৈব সারের ব্যবহার অধিক মাত্রায় চালু করা। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৯ মিলিয়ন হেক্টর জমির মধ্যে ৩.৮৪ মিলিয়ন হেক্টরে জৈব উপাদান অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। জৈব সার ব্যবহারে এর অভাব দূর করা সম্ভব। তা করা হলে অধিক ফসল ফলানোও সম্ভব। এ ছাড়া অধিক হারে জৈব সার ব্যবহারের ফলে ব্যয়বহুল রাসায়নিক সারের ব্যবহারও হ্রাস করা যায়, যা কৃষকের উৎপাদন ব্যয়ও হ্রাস করবে। এ ছাড়া যেসব সারের বিনির্দেশ সরকার অনুমোদন করেছে, তার ব্যতিক্রম হলে সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধানও রয়েছে। এর জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাজার থেকে সারের নমুনা নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ সংগ্রহ করে বিনির্দিষ্ট পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে। অনুমোদিত মান না থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতকারক বা ক্ষেত্রমতো ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনা হয়। শাস্তিও দেওয়া হয় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে। কারখানা পরিদর্শনের নিয়মও রয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অন্যান্য দেশের অনুরূপ।
জৈব উৎসের বর্জ্য রিসাইক্লিং-সংক্রান্ত গবেষণা অতীতে হয়েছে। ওয়েস্ট কনসার্ন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে এ গবেষণা করেছিল। ফলে এ বিষয়ে একটি প্রকাশনাও পাওয়া যায়। এর নাম কমিউনিটি ভিত্তিক জৈব সার উৎপাদন। এ প্রকাশনায় বর্ণিত পদ্ধতি ব্যবহারে কেউ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম ওয়েস্ট কনসার্ন। তবে যত দূর জানা যায়, এ উদ্যোগও স্থায়িত্ব লাভ করেনি। কারণ কী তা অনুসন্ধানযোগ্য। সাম্প্রতিককালে জেলা ও উপজেলায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় জৈব সার উৎপাদনের বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। তবে এখানে আইনি নিয়ন্ত্রণের জন্য খুব বেশি উদ্যোক্তা আগ্রহী নয়। যেকোনো ধরনের সার উৎপাদন ও বিক্রির জন্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আইনের বলে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের আইন ২০০৬ সালে করা হয়েছে। আইন থাকা ভালো। আইনের অযৌক্তিক প্রয়োগ বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাহত করে। বাংলাদেশে ২০০৮ থেকে এর অযৌক্তিক ও অবৈধ প্রয়োগই দৃশ্যমান। এ আইনের বিধান অনুযায়ী যেসব সার বা সারজাতীয় দ্রব্যের বিনির্দেশ (স্পেসিফিকেশন) সরকার ঘোষণা করেছে, সেসব সার বা সারজাতীয় দ্রব্যের মাঠ পর্যায়ে ও গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হবে না। আইনের এ ধারা লঙ্ঘন করে ২০০৮ থেকে বিনির্দেশ জারি করার পরও দুটি বিষয়েই বাধ্যতামূলক প্রথা চালু আছে, যা অযৌক্তিক ও আইনসিদ্ধ নয়।
এ বিষয়ের জন্য ক্যাটালিস্ট নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা সম্পন্ন করে সরকারের তথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মন্ত্রণালয় এ সমীক্ষার ফলাফল একটি টেকনিক্যাল কমিটি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে। এ কমিটি সংশ্লিষ্ট সবার মতামত গ্রহণের পর এ অবৈধ প্রথা রদ করার পক্ষে সুপারিশ করেছে বলে জানা যায়। আশা করা যায়, অচিরেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জারি করা হবে। রান্নাঘরের বর্জ্য জৈব সার উৎপাদনকারীরা ব্যবহার করবে কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের বর্জ্য অপসারণ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি জৈব সার উৎপাদকরা যদি যোগসূত্র স্থাপন না করে, তাহলে এ কাজ সম্ভব হবে না। বিকল্প হিসেবে নগরের নির্দিষ্ট জায়গায় যেসব বর্জ্য রাখা হয়, যেখানে এর ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পরীক্ষা করা যায়। সরকার বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে পারে।
নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্য একটি দিক অধিকতর দুর্বল। হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বর্তমানে প্রকট হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। বাস্তবেও একই চিত্র। মূল কারণ সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের আত্মপ্রকাশ। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম কারো অজানা নয়। তবে এ ক্ষেত্রে রোগীদের সেবার বিষয়টিই অধিকতর আলোচিত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নয়। কয়েক বছর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কিছু বিধান প্রণয়ন করেছিল। এসব বিধান কাগজেই থেকে গেছে। বাস্তবে এটা অনুসরণ করা হয় না। এর কারণ একাধিক।
এক. স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিয়মিত পরিদর্শন ও বিধান অনুসরণের বাধ্যবাধকতার অভাব। দুই. বিধান অনুযায়ী এ ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক আধার ব্যবহার করার কথা। বাস্তবে তা অনুসৃত হয় না। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অধিকর্তাদের মতে, বর্জ্য পৃথক আধারে দেওয়া হলেও তা বর্জ্য অপসারণের সময় অন্যান্য বর্জ্য থেকে পৃথক করা হয় না। বরং একই সঙ্গে ট্রাকে তোলা হয় এবং নির্দিষ্ট স্থানে অপসারণ করা হয় না। তিন. প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিধান সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র অনুসরণ করার চেষ্টা করে অনেকটা নিষ্ফলভাবে। চার. বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধিকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময়ও হয় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সব সময়ই মনে করত, নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অর্থাৎ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার। হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরও দায়িত্ব রয়েছে- এমন কোনো ধারণা ছিল না। পাঁচ. সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় জমির অপ্রতুলতা। এটা সহজে দূর করা সম্ভব নয়। কারণ জমির দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছয়. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সম্পদের অভাব। সাত. এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাব।
নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী ও পরিবেশবান্ধব না করা গেলে জনস্বাস্থ্যেরই ক্ষতি হবে। রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আশার কথা, সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট একটি প্রকল্প দুই বা তিন বছর ধরে স্থানীয় সরকার বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে, যদি পুনরায় অনুরূপ প্রকল্প বাস্তবায়িত না হয়। অন্যদিকে সুব্যবস্থাপনা স্থায়ী করার জন্য নিরপেক্ষভাবে সার্বিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা চিহ্নিত করে তার সমাধানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব হবে না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments