শিবির ধরতে ডিবির নতুন কৌশল, পাল্টা কৌশলে শিবির by নুর মোহাম্মদ ও ইমরান আলী
শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতারে নতুন কৌশলে সফলতা পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত দুই দিনে নতুন কৌশল অবলম্বন করে শিবিরের কেন্দ্রীয় এক নেতা, মহানগরের বিভিন্ন থানার সভাপতিসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪১ নেতাকে গ্রেফতার করেছে তারা।
এই অভিযানে গোয়েন্দা পুলিশের একজন উপ-পুলিশ কমিশনার, দুই অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, একজন সোয়াটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনারসহ একদল চৌকস সদস্য অংশ নেন।এদিকে, ডিবি’র নতুন কৌশলে ৪১ নেতা আটক হওয়ার পর গ্রেফ্তার এড়াতে কৌশল পাল্টে নিয়েছে শিবিরও। দলটির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে তাদের নতুন কৌশলের কথা জানা গেছে।
এরই মধ্যে নতুন কৌশলের বার্তা পৌঁছে গেছে মাঝারি ও উচ্চ-পর্যায়ের সব নেতার কাছে। কৌশলের প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে ডাকলেই সাড়া না দেওয়া।
একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, শিবিরের বড় বা ছোট কোনো নেতার কাছ থেকে ফোন এলে সঙ্গে সঙ্গে তা রিসিভ না করা। কিংবা রিসিভ করলেও ওপার থেকে কেমন বার্তা আসে তার ভিত্তিতে রেসপন্স করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বের হওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছে নতুন সাংকেতিক কোড।
এ ক্ষেত্রে কেউ ডেকে পাঠালে যতক্ষণ না তার অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যাবে ততক্ষণে বের না হওয়ার কথা বলা হয়েছে নেতাদের।
নেতাদের ফোন থেকে কল করে ডেকে পাঠিয়েই শুক্রবার দিনভর ৪১ শিবির নেতাকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। আর সে কারণেই শিবিরের ভেতরে ফোন কলে সাড়া বিষয়ক এই নতুন কৌশল।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতাদের সাজা হলে সারাদেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাবে শিবির; এমন তথ্যের ভিত্তিতে শিবির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারে নতুন করে অভিযান শুরু হয়েছে।
ডিবির এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করতে নানা তৎপরতা চালালেও এতদিন বড় ধরনের সফলতা আসেনি। হার মানতে হয়েছে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের । এমন অবস্থায় নতুন করে কৌশল নিয়ে মাঠে নেমে শুক্রবার কিছুটা সফলতা পাওয়া গেছে।
ওই কর্মকর্তা জানান, অভিযানে একজন উপ-পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে যোগ হয় ডিবির দুইজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ও পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াটের একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার। এরা হলেন, মশিউর রহমান, শহিদুল্লাহ এবং আশিকুর রহমান। এই টিম কাজ শুরু করে ১৯ ডিসেম্বর থেকে। ২০ ডিসেম্বর রাজধানীসহ সারাদেশে ইসলামী ও সমমনা ১২ দলের হরতালের আগের দিন গেন্ডারিয়া থেকে তিনজনকে আটক করার পর তাদের তথ্যের ভিত্তিতে শিবিরের কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা বিষয়ক সম্পাদক শাহীনুর রহমান ও নারায়ণগঞ্জ জেলা শিবিরের সভাপতি ইলিয়াস মোল্লাকে আটক করা হয়। তাদের দিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতাদের ফোন করে আনার চেষ্টা করলেও শিবিরের অধিকাংশ নেতা বিষয়টি বুঝে যায়।
তাকে নিয়ে রাজধানী বিভিন্ন জায়াগায় তল্লাশি করে কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি ডিবি। তবে শাহীনুর রহমান গ্রেফতারের খবর জানতেন না মহানগর পশ্চিমের সভাপতি সাজ্জাদ হোসাইন। শাহীনুরের মোবাইল থেকে ফোন করে সাজ্জাদ হোসাইনের অবস্থান সনাক্ত করে ডিবি।
তার তথ্যের উপর ভিত্তি করে সন্ধ্যায় আটক করা হয় সাজ্জাদকে। এরপর ডিবি পুলিশ পুরো কৌশলের প্রয়োগ করতে থাকে। সাজ্জাদের মোবাইল থেকে ফোন করে আনা হয় সেক্রেটারি গোলাম কিবরিয়াকে। দুইজনকে একত্র করে এর পর এক একে ফোন করা হয় পশ্চিমের ১২ থানার সভাপতি ও সেক্রেটারিকে।
ডিবির ওই কর্মকর্তা জানান, সাজ্জাদ ও কিবরিয়া প্রথমে ফোন করতে চাননি পরবর্তীতে তাদের নানা কৌশলে বাধ্য করা হয়। “মিরপুর ১০ নম্বরে আগামীকালের কর্মসূচি নিয়ে জরুরি একটি বৈঠক আছে তাড়াতাড়ি আসো” এটাই ছিলো প্রধান বার্তা।
কর্মকর্ততাটি জানান, বিষয়টি টনিকের মতো কাজ করে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ১২ থানার সভাপতি ও সেক্রেটারিসহ ২৭ জন আটক করে পুলিশ। এই ২৭ জনকে নিয়ে আবার গভীর রাতে রাজধানীর বিভিন্ন মেসে তল্লাশি চালানো হয়। সবমিলিয়ে এই অভিযানে আটক করা হয় ৪১ জনকে।
ডিবি’র ওই কর্মকর্তা মনে করেন কৌশলী এই ভূমিকার কারণে এক সাথে শিবিরের এত নেতাকে আটক করা সম্ভব হয়েছে। তিনি মনে করেন, এই আটকের মধ্যে দিয়ে শিবিরের তৎপরতা কিছুটা কমবে।
শিবিরের একজন কেন্দ্রীয় নেতা এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, “গোয়েন্দা পুলিশের কৌশলে কয়েকজন নেতা ধরা পড়েছেন এ কথা সত্য। কিন্তু তাই বলে শিবিরের তৎপরতা কমে যাবে এমটা আমরা মনে করি না।”
তিনি জানান, রাতেই তাদের কাছে খবর আসে সাজ্জাদ গ্রেফতার হয়েছেন। আর বিষয়টি জানা জানি হওয়াতে কর্মীরা সতর্ক হয়ে যায়।
শিবিরের এই নেতা বলেন, পশ্চিমে শিবিরের কয়েক’শ মেস আছে যেখান থেকে গ্রেফতার হতে পারতো হাজার শিবির কর্মী কিন্তু সেটা হয়নি।
শিবিরের এই নেতাই বাংলানিউজকে বলেন, ডিবি পুলিশের এই কৌশল জানার পর নতুন কৌশল অবলম্বন করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এড়াতে নানারকম নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে শিবিরের একাধিক নেতা বাসা পাল্টানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারও কারও মোবাইল ফোন পরিবর্তন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি পরিচিত কারো নম্বর থেকে ফোন কল আসলে নিশ্চিত না হওয়ার পর্যন্ত তাদের কথায় কোথাও বের না হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বের হওয়ার জন্য বিশেষ একটি সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে।
ওই নেতা বলেন, “এছাড়াও সাংগঠনিক কাজে কিছু নতুনত্ব আনা হয়েছে। কৌশলের অংশ হিসেবে এগুলো বলা সম্ভব হচ্ছে না।”
সূত্র বলছে, শিবিরে দীর্ঘ দিন ধরে একই কৌশলে আন্দোলন করার কারনে গোয়েন্দা সংস্থা, ডিবি পুলিশ বিষয়টি জেনে গেছে। তাই আন্দোলনে নামার জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে।
এবিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত শিবির সহিংসতার পথ না ছাড়বে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের গ্রেফতার অভিযান চলবে।”
No comments