বিশ্বজিৎ নয়, জাতির বিবেককে হত্যা by মেজর (অব.) সুধীর সাহা

হাজার হাজার মানুষ হত্যা নয়; শুধু একজন মানুষ হত্যা। বিশ্বজিৎ দাসকে ৯ ডিসেম্বর বিরোধী জোটের অবরোধ চলাকালে পুরান ঢাকায় রড দিয়ে পিটিয়ে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে এবং ছুরিকাঘাত করে একদল মানুষ নামের পশু হত্যা করেছে।
কখনো কখনো একটি হত্যাও হয়ে ওঠে সমাজের মোড় ঘুরে যাওয়ার নিয়ামক। বিশ্বজিৎ হত্যা এমনই একটি হত্যা। কামনা করছি, এ হত্যা দিয়েই শেষ হোক রাজনৈতিক বর্বরতা, জাগ্রত হোক বিবেক আর মনুষ্যত্বের রাজনীতি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের হত্যা ঘুরিয়ে দিয়েছিল স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের চাকা। ভাষা আন্দোলনে রফিক, শফিক, বরকতের হত্যাকাণ্ড এক সময় সজোরে আঘাত করেছিল স্বৈরাচারী পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীকে। আজ আবার সংঘটিত হয়েছে একটি মহা আলোড়ন সৃষ্টিকারী হত্যা। এবার হয়েছে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারের গলিতে ১২৩ নম্বর দোকান আমন্ত্রণ টেইলার্সের দরিদ্র মালিক বিশ্বজিৎ দাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড। ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে যান নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎ। আত্মরক্ষার জন্য দৌড়ে দ্বিতীয় তলায় টমাস ডেন্টাল ক্লিনিকে আশ্রয় নিলে ১৪-১৫ জনের একটি ঘাতক দল সেখানে গিয়ে বিশ্বজিৎ বোমা মেরেছে মনে করে তাঁকে মারধর শুরু করে। 'শালাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না'- এমন বক্তব্য দিয়ে শুরু করে বিশ্বজিৎকে হত্যার মহড়া। বাঁচার তাগিদে বিশ্বজিৎ এক পর্যায়ে বলে ওঠেন- 'ভাইয়া, আমি হিন্দু, বিএনপি বা কোনো রাজনীতির সঙ্গে আমি জড়িত নই।' 'আমি হিন্দু'- এটা বলে বিশ্বজিৎ আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার শেষ চেষ্টা করেছিলেন। বিশ্বজিৎ মরিয়া হয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন, আমি হিন্দু, তাই আমি ওদের দলে নই। কিন্তু রক্ষা পাননি বিশ্বজিৎ। ততক্ষণে কিলারদের হত্যার নেশায় পেয়ে বসেছিল। ছোরা, চাপাতি আর রড দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত হানছিল নিরীহ এক যুবকের ওপর। এক সময় আত্মরক্ষার জন্য বিশ্বজিৎ ক্লিনিকের ভেতর থেকে বারান্দায় চলে আসেন। সেখানে তাঁকে চাপাতি দিয়ে আরো এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এক পর্যায়ে সেখানে ক্লিনিকে প্রবেশকালে বিশ্বজিৎ মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। ঘাতকরা তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে বের হয়ে আসে। মর্মান্তিক বিশ্বজিৎ হত্যার সারসংক্ষেপ মোটামুটি এমনই। ইতিমধ্যে সারা দেশের মানুষই টিভি চ্যানেলের ফুটেজ থেকে এবং সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে জেনে গেছে, কারা হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছিল।
ঘটনার দুদিন পর অর্থাৎ মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১১ জন বা এর বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে বলে দাবি করলেও ডিএমপি দাবি করে, ওই ঘটনায় কাউকে তখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। ঘটনার এক দিন পর অর্থাৎ সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছিলেন আটজন গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো দাবি করেন, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছাত্রলীগ কোনোভাবেই জড়িত নয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব বিশ্বজিৎ দাসের ওপর হামলাকারীরা কেউ ছাত্রলীগের কর্মী নয় বলে দাবি করেন। এরপর প্রেসসচিব অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পারিবারিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরেন। প্রেসসচিব মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ওবায়দুল কাদের, রফিকুল ইসলাম শাকিল, মীর মোহাম্মদ নুরে আলম, ইমদাদুল হক ও সাইফুল ইসলাম- এই ছয়জনের বাবা, ভাই, মামা, চাচা প্রমুখ আত্মীয়ের রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরেন। এই ছয়জনের নিকটতম আত্মীয়রা কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত নন- এমনটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন প্রেসসচিব। কিন্তু প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব যুবকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পরিচয় বলা হয়নি। যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বীকার করা হয়েছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় না দিয়ে বরং তাদের আত্মীয়স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয় প্রদান করা হয়েছে।
'ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না' প্রবাদটি সবার জানা। ক্ষমতায় গেলে মানুষের যে ভীমরতি হয় এবং সব কিছু গুলিয়ে যায়, এমন কারণেই সম্ভবত এই সোজা সত্য প্রবাদটিও সরকারের উচ্চ মহল ভুলে বসে আছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে তারা শুধু বিশ্বজিৎ দাসের পরিবারকে নয়; বরং পুরো জাতিকেই ভাঁওতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। হত্যাকারীদের একটি পরিচয়ই থাকে এবং তা হলো হত্যাকারী- এই সহজ সত্যটা সরকার ভুলে গেল কী করে? হত্যাকারীর বিচার বা শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে হত্যাকারীর রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আনার প্রয়োজন কী? হত্যা যে করেছে সে যেই হোক তার বিচার হবে- এই বক্তব্য সরকার দিলে তাতে সরকারের কী এমন ক্ষতি হতে পারত?
বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগ হত্যা করেনি- এমনটা প্রমাণ করার দায়িত্ব সরকারকে কে দিয়েছিল? যারা হত্যাকারী, তাদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে তাদের মা-বাবা, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা, পেশা, বয়স ইত্যাদি হয়তো বিবেচনায় আসতে পারে। শাস্তি কম বা বেশির ব্যাপারে রাজনৈতিক পরিচয় তো কোনো কাজে লাগবে না। তবে সরকার কেন এত ঢাকঢোল পিটিয়ে তারা যে ছাত্রলীগের কেউ নয় এমনটা প্রমাণে উৎসাহী হয়ে উঠেছে? হত্যাকারীদের রক্ষা করার এবং তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের সামনে পর্দা টেনে ধরার উদ্যোগ কি স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অফিসকেই নিতে হবে?
ইতিমধ্যে হাইকোর্টের নির্দেশ জারি হয়েছে টিভি চ্যানেলের ফুটেজে আসা চিহ্নিত জড়িতদের গ্রেপ্তারের পক্ষে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত পাঁচজনকে চিহ্নিত করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র বাংলা বিভাগের মাহফুজুর রহমান নাহিদ ও দর্শন বিভাগের ইমদাদুল হকের সনদ বাতিল করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্র ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের রফিকুল ইসলাম শাকিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নুরে আলম, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ওবায়দুল কাদেরকে স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে।
চারদিকে কালো পতাকা ও ব্যানার। শোকাহত মানুষের বুকে কালো ব্যাজ। ঘাতকদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করা হয়েছে গত বুধবার অনুষ্ঠিত শাঁখারীবাজার এলাকায় মানববন্ধনে। গত বৃহস্পতিবার পুনরায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ও সামাজিক সংগঠনের লোকজন মিছিল করে বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিশ্বজিতের বড় ভাইও যোগ দিয়েছিলেন এই মিছিলে।
বিশ্বজিৎ একবার বলেছিলেন, তিনি 'হিন্দু'। কিন্তু তা বলেও বাঁচতে পারেননি। এই বিশ্বজিৎরাই ১৯৭১ সালে আরেকবার বলেছিলেন, 'আমি মুমিন মুসলমান।' কলেমা পড়া শিখেছিলেন বিশ্বজিৎরা জীবন রক্ষার জন্য। সেদিন পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী এবং এ দেশের রাজাকার বাহিনী বিশ্বজিৎরা হিন্দু কি না তা প্রমাণ করার জন্য কলেমা পড়তে বলত এবং লুঙ্গি তুলে দেখতে চাইত। সেদিন বিশ্বজিৎরা মিথ্যা বলে বাঁচতে চেয়েছিলেন; কিন্তু বাঁচতে পারেননি। তাঁদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছিল, তাঁদের ঘরবাড়ি দখল করে নিয়েছিল, তাঁদের যুবতী কন্যাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। সেই বিশ্বজিৎ এবার সত্যি কথা বলেছিলেন- 'আমি হিন্দু'। কিন্তু না, এবারও হলো না। এবার সত্য বলেও প্রাণ রক্ষা হলো না। বিশ্বজিৎরা কি বারবার শুধু মার খাবেন? তাঁদের কি বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও থাকতে নেই? বিএনপি-আওয়ামী লীগ আর জামায়াতের রাজনৈতিক চক্রের মধ্যে পড়ে বিশ্বজিৎরা বারবার মার খেয়ে চলেছেন তাঁদের সাধের বাংলাদেশে। কিছু একটা হলে শুধু তাঁরাই মার খান। তাঁরা কক্সবাজারের রামুতে মার খান, পথে-ঘাটে চলতে মার খান, তাঁরা পালিয়ে গিয়ে ভারতেও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মার খান। আজও বিশ্বজিৎ জীবন দিয়ে সবাইকে জানিয়ে গেলেন- বিশ্বজিৎরা এখনো নিরাপদে নেই।
বিশ্বজিৎ হত্যার দৃশ্য গোপনে ঘটেনি। টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার, সংবাদপত্রের রিপোর্টার- সবার সামনেই ঘটেছে ঘটনাটি। সাধারণ মানুষও ঘটনাস্থলে থেকে দৃশ্যটি দেখার সুযোগ পেয়েছিল। সবাই দেখলেও শুধু ঘটনাটি দেখতে পায়নি এ দেশের পুলিশ। ওই এলাকায় ডিউটিরত পুলিশরা তখন কি নীরবে দেখেছে ঘটনাটি? না, ওরা ঘটনাটি ঘটাতে সাহায্য করেছে? প্রশ্ন আছে, উত্তরটি সরকারকেই জেনে নিতে হবে।
বিশ্বজিৎ, আপনি মরে গিয়ে আমাদের বিবেককে আরেকবার ধাক্কা দিয়ে গেলেন। আমাদের মানবতা কি এবার আমাদের ঘরে ফিরে আসবে? বিশ্বজিৎ, আপনি হারিয়ে গিয়ে কি আরো বিশ্বজিতের হারিয়ে যাওয়ার গুপ্ত পথটি বন্ধ করে দিতে সক্ষম হবেন? আপনার মৃত্যু, আপনার কান্না, আপনার কষ্ট- এ শুধু আপনার সম্পদ নয়, এ তো আমাদের গ্লানি আর ক্লেশের প্রতিচ্ছবি। বিশ্বজিতের এমন অকালমৃত্যুর বেদিতে দাঁড়িয়ে আমরা কি একবার মানবতার জয়গান গেয়ে উঠতে পারি না? আরো বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে বিবেকের হাতগুলো কি এবার আমরা একসঙ্গে অগ্রসর করে একের ওপর এক একত্র করে রাখতে পারি না? অপরাধের হিসাব কষতে আর রাজনৈতিক হিসাব টানবেন না- এমন অনুরোধ কি আমরা করতে পারি না? অপরাধীকে শুধুই অপরাধী ভাবুন- এমন অনুরোধ কি করতে পারি না? বিবেকের তাড়নায় মানুষকে মানুষ হিসেবে চিন্তা করতে এবং সেই মানুষের নিরাপত্তা প্রদানের রাজনীতিতে ফিরে যেতে কি আমরা অনুরোধ জানাতে পারি না?

লেখক : কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.