বিশেষ সাক্ষাৎকার : জিয়াউদ্দিন বাবলু-রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দেশের মানুষ জিম্মি
কোন দিকে যাচ্ছে দেশ? সরকার ও বিরোধী দলের পরস্পরবিরোধী কর্মসূচি কি দেশকে সংঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে? সহিংসতা থেকে মুক্তির উপায় কী? গণতন্ত্রকে সুসংহত রাখতে আমাদের করণীয় কী? এসব বিষয় নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছিলেন সাবেক মন্ত্রী, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা জিয়াউদ্দিন বাবলু।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব
কালের কণ্ঠ : সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে শুরু করা যাক। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
জিয়াউদ্দিন বাবলু : শুরুতেই একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে চাই। আমার পরিচয় আমি রাজনীতি করি। দীর্ঘর্দিন ছাত্ররাজনীতি করেছি। আমি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটা বড় কথা নয়, দেশের একজন নাগরিক হিসেবেই চলমান রাজনীতি নিয়ে আমার নিজস্ব একটি মত আছে। রাজনীতির নামে এখন যা চলছে, তা কাঙ্ক্ষিত নয়। গণতন্ত্রের জন্য তা কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে সংঘাত আরো তীব্র হবে। আমি মনে করি, তাতে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, নির্বাচনের অধিকার বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার অধিকার পর্যন্ত ক্ষুণ্ন হওয়ার একটা আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
কালের কণ্ঠ : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হয়। বিশেষ করে সরকার ও বিরোধী দলকে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক চিত্র দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দল সঠিক ভূমিকা পালন করছে?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : হ্যাঁ, এটা মানতে হবে, সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় বিরোধী দল সরকারের একটি অচ্ছেদ্য অংশ। সরকারি দল ও বিরোধী দল নিয়েই সরকার। বিরোধী দলকে মনে করা হয় ছায়া সরকার। কিন্তু আমাদের এখানে আমরা সচরাচর যা দেখতে পাই, তা আশাপ্রদ নয়। এই সংসদের মেয়াদ চার বছর হতে চলল। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন এ প্রক্রিয়া চলে আসছে। মনে রাখা দরকার, বিরোধী দল কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসে, নির্বাচিত হয় জনগণের দ্বারা। জনগণের কথা সংসদে তুলে ধরা বিরোধী দলের দায়িত্ব। সব দেশেই এমনটি হয়ে থাকে। আমাদের দেশে গত ২২ বছর আমরা সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চর্চা করছি। কিন্তু গণতন্ত্রে বা সংসদীয় পদ্ধতির যেটা সারকথা, সংসদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করা, একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া- তা আমাদের এখানে হচ্ছে না। এর ফলটা কী হচ্ছে? মুখে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বললেও কার্যত সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তার প্রতিফলন কোথাও নেই। এটা দেশের জন্য দুঃখজনক, গণতন্ত্রের জন্য শুভকর নয়।
কালের কণ্ঠ : ডিসেম্বর মাসে বিরোধী দলগুলো যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করল, সেটাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরতালকে আপনি কতটা কার্যকর ও শক্তিশালী প্রায়োগিক অস্ত্র হিসেবে দেখছেন?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : এখন এটা মানতেই হবে যে আজকের বাস্তবতায় পৃথিবীর কোনো সভ্য-উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে আজকাল হরতাল বলতে কিছু নেই। হ্যাঁ, এটা ঠিক, হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। প্রতিবাদ জানানোর মাধ্যম। কিন্তু আজকের দিনে পৃথিবী যেখানে গেছে, আমরা যখন ঢাকায় বসে বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের খবর পেয়ে যাচ্ছি, এমন একটি সময়ে, যখন বিশ্বকে বলা হচ্ছে একটি গ্লোবাল ভিলেজ, তখন হরতাল সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর কোনো কার্যকর মাধ্যম নয় বলেই আমি মনে করি। এতে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব কিছুরই একটা স্থান-কাল-পাত্র আছে। অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় ঘোরা, কিংবা বোমা ফাটানো, এটা কার্যকর কোনো মাধ্যম নয়। যদি ১৯৭১-এর কথা বিবেচনা করা হয়, তাহলে কী দেখি আমরা? তখন সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার জন্য। তখন অস্ত্র ধরাটাই ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার। তখন দেশের মানুষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দেশকে মুক্ত করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। সেই সময় অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া, বোমা ফাটানো, যুদ্ধ করা বৈধ ছিল। সেটা ছিল নৈতিক একটি ব্যাপার। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া, বোমাবাজি করা কোনোভাবেই নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। সুতরাং স্থান-কাল-পাত্রভেদে নৈতিকতার দিকটিকে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। হ্যাঁ, অবশ্যই বলব, হরতাল আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে হরতাল কোনো কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়। এই রাজনৈতিক কর্মসূচিটি এখন অকার্যকর বলে আমি মনে করি। এটা এমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নয়, যার মাধ্যমে জনগণের প্রতিবাদের ভাষা প্রকাশ করা যায়। জনগণ এটা পছন্দ করে না। হ্যাঁ, হরতাল করার অধিকার সবারই আছে। আবার হরতাল সমর্থন না করার অধিকারও সবার আছে। একজন রিকশাচালকের রিকশা চালানোর অধিকারও কিন্তু তার গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকার ক্ষুণ্ন করার অধিকার কারো নেই। হরতাল এখন চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের কোনো চিহ্ন নেই। জোর করে মানুষকে ঘরে আটকে রাখা হচ্ছে। হরতাল আহ্বান করা হলে মানুষ চেষ্টা করে ঘর থেকে বের না হতে। এই ডিসেম্বরে হরতাল-অবরোধের নামে আমরা কী দেখলাম? সহিংসতা। রিকশা-গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। আবার হরতাল বা অবরোধ-প্রতিরোধের নামে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের মতো একটি দুঃখজনক ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। আমাদের মনে রাখতে হবে, 'সন্ত্রাস থেকে সন্ত্রাস জন্ম নেয়।' কেন এসব ঘটেছে? একটাই কারণ- গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিবাদ না করে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : অর্থাৎ রাজনৈতিক কর্মসূচি আজকাল চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক দৈন্য, নাকি সাধারণ নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : যদিও আমি একটি রাজনৈতিক দল করি, তার পরও মনে করি, সাধারণ নাগরিকরা আজ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জিম্মি। তাদের মতামতের কোনো মূল্য এখানে নেই। সাধারণ নাগরিকদের মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যও বটে। রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দৈন্য। ভলতেয়ারের একটি কথা আছে, 'আমি আপনার সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু আপনার ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি প্রাণ দেব।' এটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। আমাদের এখানে আমরা কী দেখছি? আমি একজন নাগরিক হিসেবে আপনার হরতালের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু আমার অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দেওয়া দূরের কথা, আপনি আমার জীবনের জন্য সংশয় হয়ে দেখা দিচ্ছেন। গণতন্ত্রের মূল যে স্পিরিট, 'এসেন্স অব ডেমোক্রেসি হচ্ছে, আই মে ডিফার উইথ ইউ বাট আই অ্যাম রেডি টু প্রটেক্ট ইয়োর রাইট'- আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা একেবারেই অনুপস্থিত। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এক কথায় বলা যায়, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা আমাদের দেশে নেই। কথাটা কঠিন শোনালেও বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
কালের কণ্ঠ : আবার একটু হরতাল প্রসঙ্গে আসা যাক। জামায়াত কিছুদিন আগে একটি হরতাল দিলে বিএনপি সেই হরতালে নৈতিক সমর্থন দেয়। বিএনপির এ সমর্থন আপনি কতটা নৈতিক মনে করেন?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : আমি মনে করি, আগেও বলেছি, যেকোনো দলেরই নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে হরতাল ডাকার অধিকার আছে। জামায়াতেরও আছে। তাদের নেতাদের মুক্তির দাবিতে তারা হরতাল-অবরোধ ডাকতেই পারে। এটা আমাদের সংবিধানেও স্বীকৃত। একজন সাধারণ ও নিরপেক্ষ নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, সেই দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা মানে সেই দাবিকে সমর্থন করা। বিএনপি একটা দলীয় ব্যাখ্যা দিয়েছিল। সেটা বোধ হয় এ রকম যে জামায়াত আগের দিন জনসভা করতে চেয়েছিল। জনসভা করতে দেয়নি বলে তারা হরতাল ডেকেছে। বিএনপি সেই ব্যাপারে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। এটা হচ্ছে বিএনপির এক ধরনের ব্যাখ্যা। কিন্তু আমরা যদি নির্মোহভাবে ব্যাখ্যা করি, তাহলে কী দাঁড়ায়? জামায়াত সেদিন যে সভা ডেকেছিল, সেটা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে। সরকারি বিধিনিষেধের কারণে সেই সভা হতে পারেনি। এর প্রতিবাদে তারা হরতাল দেয়। অর্থাৎ তাদের মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা। বিএনপি নৈতিক সমর্থন দিয়ে জামায়াতের ওই দাবির পক্ষেই তাদের অবস্থান সংহত করেছে।
কালের কণ্ঠ : রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে প্রধান দুই দলের মধ্যে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন বা প্রতিরোধ- অনেকে মতে, এর নেপথ্যের কারণ এটাই যে কেউ ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করতে চায়, কেউ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে চায়। দুই পক্ষের এই চাওয়ার মধ্যে জনগণের সম্পৃক্ততা কতটুকু?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েই যদি কথা বলি, তাহলে বলতে হবে হরতাল ও হরতালবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে। বিরোধী দল ও সরকারি দলের এই কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে কী প্রকাশ পায়? না, কোনোটির সঙ্গেই জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। যে দল ক্ষমতায় আছে, তারা ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে চায়। আরেক দল ক্ষমতায় যেতে চায়। আজকের দ্বন্দ্ব ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়েই। সেই দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের প্রাণ পর্যন্ত যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মধ্যে পড়ে না। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে এক ধরনের উলঙ্গ ও সহিংস প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, নির্বাচিত সরকার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকবে। হ্যাঁ, এই পাঁচ বছরের মধ্যে সরকারের ত্রুটি নিয়ে আপনি রাজপথে কথা বলতে পারেন। একই সঙ্গে আপনাকে সংসদেও কথা বলতে হবে। সংসদীয় পদ্ধতিতে, যেখানে সংসদই সব কর্মকাণ্ডের উৎস, সেখানে সংসদকে বাদ দিয়ে বিরোধী দল রাজপথকেই বেছে নিয়েছে। ফলে ব্যাপারটি খুব একপেশে হয়ে গেছে। সংসদের ভেতরে ও বাইরে, দুই জায়গাতেই আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। তবে সেই আন্দোলন অবশ্যই সহিংস হবে না, জনজীবনকে বিপর্যস্ত করবে না- এটা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের জানমাল-সম্পদহানির মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না, এটা নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে আমরা কী দেখছি? জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দিকে কারো দৃষ্টি নেই। বিরোধী দলের অনেক কথা বলার থাকতে পারে। তার জন্য জনমত গঠন করতে হবে, সংগঠিত করতে হবে জনগণকে। সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলো তুলে ধরে জনগণের কাছে যেতে হবে। জনমত গঠন করতে হবে। জনগণের রায় নিতে হবে। আমি মনে করি, জনগণই হচ্ছে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার মালিক। কাজেই জনগণের আস্থাভাজন হতে হবে। গণতন্ত্রকে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। সেই নির্বাচন কিভাবে হবে, সেটা নির্ধারিত হবে সংসদে, রাজপথে নয়। সমস্যার সমাধান রাজপথে হবে না। তাতে গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলো শক্তিশালী হবে না। গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাবে। রাজপথে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে গেলে তার ফল ভালো হবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনি জনমত গঠনের কথা বললেন। গণতন্ত্রে জনমত গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জনমত গঠনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ভূমিকা রাখছে?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে এটা মনে করা যেতে পারে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকেই নিয়ামক হিসেবে মনে করছে। এখানে জনগণের নামে হরতাল ডাকা হচ্ছে। জনগণের নামে এখানে হরতাল প্রতিহত করার কর্মসূচিও দেওয়া হচ্ছে। যে জনগণের নামে পালিত হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচি, সেই জনগণ কি এদের সঙ্গে আছে? না, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমার তো মনে হয়, বর্তমান সময়ে এসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কৃষকের কথাই ধরা যাক। আমাদের জিডিপিতে কৃষকের অবদান ৩০ শতাংশ। বাংলার কৃষক আমাদের জন্য কেবল খাদ্য উৎপাদনই করে না, দেশকে খাদ্যে উদ্বৃত্ত করেছে। তারা খাদ্য উৎপাদন না করলে আজ আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হতো। আমরা কি তাদের কাছে যাচ্ছি? দেশের বেশির ভাগ মানুষের বাস গ্রামে। আমরা কি তাদের কথা বলছি? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম শহরকেন্দ্রিক। আমি মনে করি, আমাদের রাজনীতিকে তৃণমূলে নিয়ে যাওয়া উচিত।
কালের কণ্ঠ : হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি এখন কতটা উপযোগী?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : এটা এখন আর কোনো কার্যকর রাজনৈতিক অস্ত্র নয়, সে কথা আমি আগেই বলেছি। বলেছি, একটা ঔপনিবেশিক দেশে বা পরাধীন দেশে এটা কার্যকর হতে পারে। স্বাধীন দেশে এটা গ্রহণযোগ্য কোনো প্রক্রিয়া নয়। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। হরতালে কী দেখছি আমরা? শহরের মানুষ গাড়ি বের করছে না। আমরা আমাদের সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠাচ্ছি না। কেন? ভয়ে। অভিভাবকরা কিন্তু হরতাল সমর্থন করে সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না, তা নয়। শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানো হচ্ছে না ভয়ে। মানুষ রাস্তায় কম বের হচ্ছে ভয়ে। জীবন বিপন্ন হোক- এটা কেউ চায় না। অর্থাৎ হরতালে যে গাড়ি বের হচ্ছে না, মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না, এতে এটা প্রমাণিত হয় না যে মানুষ হরতাল সমর্থন করছে। এর পেছনের কারণটি হচ্ছে ভয়। আবার সরকার যে পদ্ধতিতে হরতাল-অবরোধ প্রতিরোধ করতে চাইছে বা ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। আমি মনে করি, এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। আমি মনে করি, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সে জন্য রাজনীতিতে সৃজনশীলতার বিকাশ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে গণতন্ত্র নেই। কাউন্সিলগুলো চাপিয়ে দেওয়া হয়। দলে যদি গণতন্ত্র না থাকে তাহলে দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে কেমন করে? আগে দলে গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। মননের জগতে গণতান্ত্রিক স্পৃহা কার্যকর থাকলেই সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। নেতৃত্বের মস্তিষ্কে যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কাজ না করে, তাহলে গণতন্ত্র সংকটাপন্ন হবেই।
কালের কণ্ঠ : সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। অনেকেই বলছেন, সংলাপ হতে পারে সমাধান সূত্র। কিন্তু সংলাপের পরিবেশ কি আছে? সংলাপের পরিবেশ কেমন করে সৃষ্টি করা যায়?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : আমি মনে করি ও বিশ্বাস করি, সংলাপই হচ্ছে একমাত্র ও কার্যকর উপায়। এর কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব থাকবে, দ্বিমত থাকবে। ভিন্নমতের অবকাশ গণতন্ত্রে স্বীকৃত। কিন্তু অবস্থাটা যখন একেবারে আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন কী করতে হবে? আলোচনায় বসতে হবে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বৈরী পরিবেশ সহিংসতার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না। আর তেমনটি যদি করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলব, আমাদের কষ্টার্জিত গণতন্ত্র ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়বে। কাজেই সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে দুই দলকেই একমত হতে হবে। এজেন্ডা নির্দিষ্ট করে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। দুই দলকেই সমঝোতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। উভয় পক্ষকেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বসতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চায় না। অন্যদিকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এমন একটি বিপরীতমুখী অবস্থানে সমস্যার সমাধান কেমন করে সম্ভব? হ্যাঁ, মানতে হবে দুই দলই অনড়। তার পরও এর মধ্যেই একেবারে যে পথ খোলা নেই, তা নয়। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সমস্যা? উভয় দল যদি নির্বাচনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তাহলে একটি ফর্মুলা বের হয়ে আসবেই। উভয় পক্ষকেই নিজেদের জায়গা থেকে সরে আসতে হবে। অন্যথায় সংঘাত অনিবার্য। তাতে নির্বাচনের সম্ভাবনা নষ্ট হবে বলে আমি মনে করি। বিরোধী দল কী মানতে চায়, সেটা সরকারকে বিবেচনা করে দেখতে হবে। সমাধান তো একটা আসতেই হবে। সংবিধানের মধ্য থেকেই সমাধান বের করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে। যেসব দল সংসদে আছে, সেই দলগুলোকে নিয়ে একটি সরকার গঠন করা যেতে পারে নির্বাচনের সময়ের জন্য। এটাকে বলা যেতে পারে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। সরকার একটি রূপরেখা দিয়েছে অনেক আগে। বিএনপি সংসদে গিয়ে কিংবা সংসদের বাইরে একটা রূপরেখা তো দিতে পারে। সমঝোতা খুঁজতে হবে সংবিধানের মধ্যেই। সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। এ সমাধানের আলোচনা সংসদের ভেতরে-বাইরে- যেকোনো জায়গাতেই হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : রাজনৈতিক দলগুলোর কারণেই গণতন্ত্র সংকটে পড়ে বারবার- এমন কথা বলেন অনেকে। দেশে এখন একটি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : সমঝোতা, সমঝোতা এবং সমঝোতা। সমঝোতার বিকল্প নেই। সংলাপ ছাড়া সমঝোতাও হবে না। কথাগুলো বারবারই বলছি। সমঝোতা ছাড়া এই কঠিন, সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। আর এ সহিংস রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে হবে, আমাদের ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকেই ঘুরবে। আমাদের গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থাও তাতে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আর তেমনটি ঘটলে সেটা হবে জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। গণতন্ত্রের জন্য সেটা কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনিও ছাত্ররাজনীতি করেছেন। এখনকার ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : দলীয়ভাবে তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবেও আমি বিশ্বাস করি, ছাত্ররা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে সচেতন অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া কিন্তু সহজ নয়। কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে? দেশের সবচেয়ে মেধাবী তরুণরা। তারাই তো আমাদের সমাজের অগ্রসরমান অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো সব আন্দোলনের সূতিকাগার। ডাকসুকে বলা হয়ে থাকে সেকেন্ড পার্লামেন্ট। আজকে কেন ছাত্রদের এ অবস্থা? কারণ কোথাও ছাত্ররাজনীতি নেই। কোনো ছাত্র সংসদ কার্যকর নয়। গত ২২ বছর কোনো ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি। এভাবে গত ২২ বছরে আমরা ছাত্রদের, যারা আগামী দিনের রাজনীতিক, তাদের রাজনীতিশূন্য অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছি। আমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গণতন্ত্রচর্চার চেষ্টা করছি কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতন্ত্রহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আগামী নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ হচ্ছে না। আমরা ছাত্রদের এক অন্ধকার পথে ঠেলে দিচ্ছি। দেশে নির্বাচন না হলে একটা অরাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ছাত্ররাজনীতও তো এর বাইরে নয়।
কালের কণ্ঠ : সম্প্রতি টিআইবির দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি রিপোর্ট ঝড় তুলেছে। এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : এটা নিয়ে তো অনেক ঝড় বয়ে গেল। এটা নিয়ে অনেক টক শো দেখেছি। অনেক কথা শুনেছি। ওই রিপোর্ট কতটা বাস্তবসম্মত, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। তারা যেটা করেছে সেটা হচ্ছে করাপশন পাসসেপশন ইনডেঙ্। ডিটেইল কাজ করা হয়নি। কাজেই এর বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। প্রক্রিয়া সঠিক বলে মনে হয় না।
কালের কণ্ঠ : পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ফিরে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।
জিয়াউদ্দিন বাবলু : পদ্মা সেতু মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকার। এটা মানুষ চায়নি। মহাজোট অঙ্গীকার করায় মানুষের ভেতর একটা প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। এটা না হওয়া দুঃখজনক। যখন বিশ্বব্যাংক বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তোলে, তখনই সরকার ব্যবস্থা নিতে পারত। সংক্ষেপে বলা যায়, পানি এত ঘোলা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এতে সরকারের ভোটব্যাংকে টান পড়বে।
কালের কণ্ঠ : রেন্টাল বিদ্যুৎ নিয়েও অনেক কথা চালু আছে বাজারে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : অনেকেই রেন্টাল বিদ্যুতের বিপক্ষে কথা বলেন। আমি মনে করি, সহজে সমাধানের পথ খুঁজতে সরকারের কাছে এর বিকল্প কিছু ছিল না। সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিদ্যুতের যে সমস্যা ছিল, তা থেকে মুক্তি পেতে এটাই ছিল সহজ পথ।
কালের কণ্ঠ : সব দিক বিবেচনায় সরকারকে সফল না ব্যর্থ বলবেন আপনি?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : 'ভালো-মন্দ মিলায়ে সকলি।' কোনো সরকারই শতভাগ সফল হতে পারে না, কোনো সরকারই শতভাগ ব্যর্থ হয় না। ভালো-মন্দ মিলিয়েই একটি সরকার সামনের দিকে যায়। সেখানে সাফল্যের ভাগ বেশি হলে সেটা ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে যায়। আবার ব্যর্থতার ভাগ বেশি হলে তা সাফল্যকে ছাপিয়ে যায়। এ সরকারের অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু তার প্রকাশ নেই।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জিয়াউদ্দিন বাবলু : আপনাকেও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে শুরু করা যাক। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
জিয়াউদ্দিন বাবলু : শুরুতেই একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে চাই। আমার পরিচয় আমি রাজনীতি করি। দীর্ঘর্দিন ছাত্ররাজনীতি করেছি। আমি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেটা বড় কথা নয়, দেশের একজন নাগরিক হিসেবেই চলমান রাজনীতি নিয়ে আমার নিজস্ব একটি মত আছে। রাজনীতির নামে এখন যা চলছে, তা কাঙ্ক্ষিত নয়। গণতন্ত্রের জন্য তা কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে সংঘাত আরো তীব্র হবে। আমি মনে করি, তাতে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, নির্বাচনের অধিকার বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার অধিকার পর্যন্ত ক্ষুণ্ন হওয়ার একটা আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
কালের কণ্ঠ : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, সংসদীয় পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হয়। বিশেষ করে সরকার ও বিরোধী দলকে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক চিত্র দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দল সঠিক ভূমিকা পালন করছে?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : হ্যাঁ, এটা মানতে হবে, সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় বিরোধী দল সরকারের একটি অচ্ছেদ্য অংশ। সরকারি দল ও বিরোধী দল নিয়েই সরকার। বিরোধী দলকে মনে করা হয় ছায়া সরকার। কিন্তু আমাদের এখানে আমরা সচরাচর যা দেখতে পাই, তা আশাপ্রদ নয়। এই সংসদের মেয়াদ চার বছর হতে চলল। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন এ প্রক্রিয়া চলে আসছে। মনে রাখা দরকার, বিরোধী দল কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসে, নির্বাচিত হয় জনগণের দ্বারা। জনগণের কথা সংসদে তুলে ধরা বিরোধী দলের দায়িত্ব। সব দেশেই এমনটি হয়ে থাকে। আমাদের দেশে গত ২২ বছর আমরা সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চর্চা করছি। কিন্তু গণতন্ত্রে বা সংসদীয় পদ্ধতির যেটা সারকথা, সংসদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করা, একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া- তা আমাদের এখানে হচ্ছে না। এর ফলটা কী হচ্ছে? মুখে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বললেও কার্যত সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তার প্রতিফলন কোথাও নেই। এটা দেশের জন্য দুঃখজনক, গণতন্ত্রের জন্য শুভকর নয়।
কালের কণ্ঠ : ডিসেম্বর মাসে বিরোধী দলগুলো যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করল, সেটাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরতালকে আপনি কতটা কার্যকর ও শক্তিশালী প্রায়োগিক অস্ত্র হিসেবে দেখছেন?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : এখন এটা মানতেই হবে যে আজকের বাস্তবতায় পৃথিবীর কোনো সভ্য-উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে আজকাল হরতাল বলতে কিছু নেই। হ্যাঁ, এটা ঠিক, হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। প্রতিবাদ জানানোর মাধ্যম। কিন্তু আজকের দিনে পৃথিবী যেখানে গেছে, আমরা যখন ঢাকায় বসে বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের খবর পেয়ে যাচ্ছি, এমন একটি সময়ে, যখন বিশ্বকে বলা হচ্ছে একটি গ্লোবাল ভিলেজ, তখন হরতাল সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর কোনো কার্যকর মাধ্যম নয় বলেই আমি মনে করি। এতে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব কিছুরই একটা স্থান-কাল-পাত্র আছে। অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় ঘোরা, কিংবা বোমা ফাটানো, এটা কার্যকর কোনো মাধ্যম নয়। যদি ১৯৭১-এর কথা বিবেচনা করা হয়, তাহলে কী দেখি আমরা? তখন সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার জন্য। তখন অস্ত্র ধরাটাই ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার। তখন দেশের মানুষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দেশকে মুক্ত করার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। সেই সময় অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া, বোমা ফাটানো, যুদ্ধ করা বৈধ ছিল। সেটা ছিল নৈতিক একটি ব্যাপার। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া, বোমাবাজি করা কোনোভাবেই নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। সুতরাং স্থান-কাল-পাত্রভেদে নৈতিকতার দিকটিকে আমাদের বিবেচনা করতে হবে। হ্যাঁ, অবশ্যই বলব, হরতাল আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে হরতাল কোনো কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়। এই রাজনৈতিক কর্মসূচিটি এখন অকার্যকর বলে আমি মনে করি। এটা এমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নয়, যার মাধ্যমে জনগণের প্রতিবাদের ভাষা প্রকাশ করা যায়। জনগণ এটা পছন্দ করে না। হ্যাঁ, হরতাল করার অধিকার সবারই আছে। আবার হরতাল সমর্থন না করার অধিকারও সবার আছে। একজন রিকশাচালকের রিকশা চালানোর অধিকারও কিন্তু তার গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকার ক্ষুণ্ন করার অধিকার কারো নেই। হরতাল এখন চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের কোনো চিহ্ন নেই। জোর করে মানুষকে ঘরে আটকে রাখা হচ্ছে। হরতাল আহ্বান করা হলে মানুষ চেষ্টা করে ঘর থেকে বের না হতে। এই ডিসেম্বরে হরতাল-অবরোধের নামে আমরা কী দেখলাম? সহিংসতা। রিকশা-গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। আবার হরতাল বা অবরোধ-প্রতিরোধের নামে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের মতো একটি দুঃখজনক ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। আমাদের মনে রাখতে হবে, 'সন্ত্রাস থেকে সন্ত্রাস জন্ম নেয়।' কেন এসব ঘটেছে? একটাই কারণ- গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিবাদ না করে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : অর্থাৎ রাজনৈতিক কর্মসূচি আজকাল চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক দৈন্য, নাকি সাধারণ নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : যদিও আমি একটি রাজনৈতিক দল করি, তার পরও মনে করি, সাধারণ নাগরিকরা আজ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জিম্মি। তাদের মতামতের কোনো মূল্য এখানে নেই। সাধারণ নাগরিকদের মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যও বটে। রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দৈন্য। ভলতেয়ারের একটি কথা আছে, 'আমি আপনার সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু আপনার ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি প্রাণ দেব।' এটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। আমাদের এখানে আমরা কী দেখছি? আমি একজন নাগরিক হিসেবে আপনার হরতালের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু আমার অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দেওয়া দূরের কথা, আপনি আমার জীবনের জন্য সংশয় হয়ে দেখা দিচ্ছেন। গণতন্ত্রের মূল যে স্পিরিট, 'এসেন্স অব ডেমোক্রেসি হচ্ছে, আই মে ডিফার উইথ ইউ বাট আই অ্যাম রেডি টু প্রটেক্ট ইয়োর রাইট'- আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা একেবারেই অনুপস্থিত। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এক কথায় বলা যায়, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা আমাদের দেশে নেই। কথাটা কঠিন শোনালেও বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
কালের কণ্ঠ : আবার একটু হরতাল প্রসঙ্গে আসা যাক। জামায়াত কিছুদিন আগে একটি হরতাল দিলে বিএনপি সেই হরতালে নৈতিক সমর্থন দেয়। বিএনপির এ সমর্থন আপনি কতটা নৈতিক মনে করেন?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : আমি মনে করি, আগেও বলেছি, যেকোনো দলেরই নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে হরতাল ডাকার অধিকার আছে। জামায়াতেরও আছে। তাদের নেতাদের মুক্তির দাবিতে তারা হরতাল-অবরোধ ডাকতেই পারে। এটা আমাদের সংবিধানেও স্বীকৃত। একজন সাধারণ ও নিরপেক্ষ নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, সেই দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা মানে সেই দাবিকে সমর্থন করা। বিএনপি একটা দলীয় ব্যাখ্যা দিয়েছিল। সেটা বোধ হয় এ রকম যে জামায়াত আগের দিন জনসভা করতে চেয়েছিল। জনসভা করতে দেয়নি বলে তারা হরতাল ডেকেছে। বিএনপি সেই ব্যাপারে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। এটা হচ্ছে বিএনপির এক ধরনের ব্যাখ্যা। কিন্তু আমরা যদি নির্মোহভাবে ব্যাখ্যা করি, তাহলে কী দাঁড়ায়? জামায়াত সেদিন যে সভা ডেকেছিল, সেটা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে। সরকারি বিধিনিষেধের কারণে সেই সভা হতে পারেনি। এর প্রতিবাদে তারা হরতাল দেয়। অর্থাৎ তাদের মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা। বিএনপি নৈতিক সমর্থন দিয়ে জামায়াতের ওই দাবির পক্ষেই তাদের অবস্থান সংহত করেছে।
কালের কণ্ঠ : রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে প্রধান দুই দলের মধ্যে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন বা প্রতিরোধ- অনেকে মতে, এর নেপথ্যের কারণ এটাই যে কেউ ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করতে চায়, কেউ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে চায়। দুই পক্ষের এই চাওয়ার মধ্যে জনগণের সম্পৃক্ততা কতটুকু?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েই যদি কথা বলি, তাহলে বলতে হবে হরতাল ও হরতালবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে। বিরোধী দল ও সরকারি দলের এই কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে কী প্রকাশ পায়? না, কোনোটির সঙ্গেই জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। যে দল ক্ষমতায় আছে, তারা ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে চায়। আরেক দল ক্ষমতায় যেতে চায়। আজকের দ্বন্দ্ব ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়েই। সেই দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের প্রাণ পর্যন্ত যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মধ্যে পড়ে না। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হবে, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে এক ধরনের উলঙ্গ ও সহিংস প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, নির্বাচিত সরকার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকবে। হ্যাঁ, এই পাঁচ বছরের মধ্যে সরকারের ত্রুটি নিয়ে আপনি রাজপথে কথা বলতে পারেন। একই সঙ্গে আপনাকে সংসদেও কথা বলতে হবে। সংসদীয় পদ্ধতিতে, যেখানে সংসদই সব কর্মকাণ্ডের উৎস, সেখানে সংসদকে বাদ দিয়ে বিরোধী দল রাজপথকেই বেছে নিয়েছে। ফলে ব্যাপারটি খুব একপেশে হয়ে গেছে। সংসদের ভেতরে ও বাইরে, দুই জায়গাতেই আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। তবে সেই আন্দোলন অবশ্যই সহিংস হবে না, জনজীবনকে বিপর্যস্ত করবে না- এটা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের জানমাল-সম্পদহানির মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না, এটা নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এখানে আমরা কী দেখছি? জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দিকে কারো দৃষ্টি নেই। বিরোধী দলের অনেক কথা বলার থাকতে পারে। তার জন্য জনমত গঠন করতে হবে, সংগঠিত করতে হবে জনগণকে। সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলো তুলে ধরে জনগণের কাছে যেতে হবে। জনমত গঠন করতে হবে। জনগণের রায় নিতে হবে। আমি মনে করি, জনগণই হচ্ছে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার মালিক। কাজেই জনগণের আস্থাভাজন হতে হবে। গণতন্ত্রকে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। সেই নির্বাচন কিভাবে হবে, সেটা নির্ধারিত হবে সংসদে, রাজপথে নয়। সমস্যার সমাধান রাজপথে হবে না। তাতে গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলো শক্তিশালী হবে না। গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাবে। রাজপথে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে গেলে তার ফল ভালো হবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনি জনমত গঠনের কথা বললেন। গণতন্ত্রে জনমত গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জনমত গঠনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ভূমিকা রাখছে?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে এটা মনে করা যেতে পারে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকেই নিয়ামক হিসেবে মনে করছে। এখানে জনগণের নামে হরতাল ডাকা হচ্ছে। জনগণের নামে এখানে হরতাল প্রতিহত করার কর্মসূচিও দেওয়া হচ্ছে। যে জনগণের নামে পালিত হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচি, সেই জনগণ কি এদের সঙ্গে আছে? না, এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমার তো মনে হয়, বর্তমান সময়ে এসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কৃষকের কথাই ধরা যাক। আমাদের জিডিপিতে কৃষকের অবদান ৩০ শতাংশ। বাংলার কৃষক আমাদের জন্য কেবল খাদ্য উৎপাদনই করে না, দেশকে খাদ্যে উদ্বৃত্ত করেছে। তারা খাদ্য উৎপাদন না করলে আজ আমাদের খাদ্য আমদানি করতে হতো। আমরা কি তাদের কাছে যাচ্ছি? দেশের বেশির ভাগ মানুষের বাস গ্রামে। আমরা কি তাদের কথা বলছি? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম শহরকেন্দ্রিক। আমি মনে করি, আমাদের রাজনীতিকে তৃণমূলে নিয়ে যাওয়া উচিত।
কালের কণ্ঠ : হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি এখন কতটা উপযোগী?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : এটা এখন আর কোনো কার্যকর রাজনৈতিক অস্ত্র নয়, সে কথা আমি আগেই বলেছি। বলেছি, একটা ঔপনিবেশিক দেশে বা পরাধীন দেশে এটা কার্যকর হতে পারে। স্বাধীন দেশে এটা গ্রহণযোগ্য কোনো প্রক্রিয়া নয়। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। হরতালে কী দেখছি আমরা? শহরের মানুষ গাড়ি বের করছে না। আমরা আমাদের সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠাচ্ছি না। কেন? ভয়ে। অভিভাবকরা কিন্তু হরতাল সমর্থন করে সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না, তা নয়। শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠানো হচ্ছে না ভয়ে। মানুষ রাস্তায় কম বের হচ্ছে ভয়ে। জীবন বিপন্ন হোক- এটা কেউ চায় না। অর্থাৎ হরতালে যে গাড়ি বের হচ্ছে না, মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না, এতে এটা প্রমাণিত হয় না যে মানুষ হরতাল সমর্থন করছে। এর পেছনের কারণটি হচ্ছে ভয়। আবার সরকার যে পদ্ধতিতে হরতাল-অবরোধ প্রতিরোধ করতে চাইছে বা ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। আমি মনে করি, এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। আমি মনে করি, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সে জন্য রাজনীতিতে সৃজনশীলতার বিকাশ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে গণতন্ত্র নেই। কাউন্সিলগুলো চাপিয়ে দেওয়া হয়। দলে যদি গণতন্ত্র না থাকে তাহলে দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে কেমন করে? আগে দলে গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। মননের জগতে গণতান্ত্রিক স্পৃহা কার্যকর থাকলেই সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। নেতৃত্বের মস্তিষ্কে যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কাজ না করে, তাহলে গণতন্ত্র সংকটাপন্ন হবেই।
কালের কণ্ঠ : সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। অনেকেই বলছেন, সংলাপ হতে পারে সমাধান সূত্র। কিন্তু সংলাপের পরিবেশ কি আছে? সংলাপের পরিবেশ কেমন করে সৃষ্টি করা যায়?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : আমি মনে করি ও বিশ্বাস করি, সংলাপই হচ্ছে একমাত্র ও কার্যকর উপায়। এর কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব থাকবে, দ্বিমত থাকবে। ভিন্নমতের অবকাশ গণতন্ত্রে স্বীকৃত। কিন্তু অবস্থাটা যখন একেবারে আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন কী করতে হবে? আলোচনায় বসতে হবে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বৈরী পরিবেশ সহিংসতার মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না। আর তেমনটি যদি করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলব, আমাদের কষ্টার্জিত গণতন্ত্র ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়বে। কাজেই সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে দুই দলকেই একমত হতে হবে। এজেন্ডা নির্দিষ্ট করে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। দুই দলকেই সমঝোতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। উভয় পক্ষকেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বসতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চায় না। অন্যদিকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এমন একটি বিপরীতমুখী অবস্থানে সমস্যার সমাধান কেমন করে সম্ভব? হ্যাঁ, মানতে হবে দুই দলই অনড়। তার পরও এর মধ্যেই একেবারে যে পথ খোলা নেই, তা নয়। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সমস্যা? উভয় দল যদি নির্বাচনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তাহলে একটি ফর্মুলা বের হয়ে আসবেই। উভয় পক্ষকেই নিজেদের জায়গা থেকে সরে আসতে হবে। অন্যথায় সংঘাত অনিবার্য। তাতে নির্বাচনের সম্ভাবনা নষ্ট হবে বলে আমি মনে করি। বিরোধী দল কী মানতে চায়, সেটা সরকারকে বিবেচনা করে দেখতে হবে। সমাধান তো একটা আসতেই হবে। সংবিধানের মধ্য থেকেই সমাধান বের করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে। যেসব দল সংসদে আছে, সেই দলগুলোকে নিয়ে একটি সরকার গঠন করা যেতে পারে নির্বাচনের সময়ের জন্য। এটাকে বলা যেতে পারে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। সরকার একটি রূপরেখা দিয়েছে অনেক আগে। বিএনপি সংসদে গিয়ে কিংবা সংসদের বাইরে একটা রূপরেখা তো দিতে পারে। সমঝোতা খুঁজতে হবে সংবিধানের মধ্যেই। সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। এ সমাধানের আলোচনা সংসদের ভেতরে-বাইরে- যেকোনো জায়গাতেই হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : রাজনৈতিক দলগুলোর কারণেই গণতন্ত্র সংকটে পড়ে বারবার- এমন কথা বলেন অনেকে। দেশে এখন একটি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : সমঝোতা, সমঝোতা এবং সমঝোতা। সমঝোতার বিকল্প নেই। সংলাপ ছাড়া সমঝোতাও হবে না। কথাগুলো বারবারই বলছি। সমঝোতা ছাড়া এই কঠিন, সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। আর এ সহিংস রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে হবে, আমাদের ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকেই ঘুরবে। আমাদের গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থাও তাতে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আর তেমনটি ঘটলে সেটা হবে জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। গণতন্ত্রের জন্য সেটা কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনিও ছাত্ররাজনীতি করেছেন। এখনকার ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : দলীয়ভাবে তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবেও আমি বিশ্বাস করি, ছাত্ররা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে সচেতন অংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া কিন্তু সহজ নয়। কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে? দেশের সবচেয়ে মেধাবী তরুণরা। তারাই তো আমাদের সমাজের অগ্রসরমান অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো সব আন্দোলনের সূতিকাগার। ডাকসুকে বলা হয়ে থাকে সেকেন্ড পার্লামেন্ট। আজকে কেন ছাত্রদের এ অবস্থা? কারণ কোথাও ছাত্ররাজনীতি নেই। কোনো ছাত্র সংসদ কার্যকর নয়। গত ২২ বছর কোনো ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি। এভাবে গত ২২ বছরে আমরা ছাত্রদের, যারা আগামী দিনের রাজনীতিক, তাদের রাজনীতিশূন্য অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছি। আমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গণতন্ত্রচর্চার চেষ্টা করছি কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতন্ত্রহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আগামী নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ হচ্ছে না। আমরা ছাত্রদের এক অন্ধকার পথে ঠেলে দিচ্ছি। দেশে নির্বাচন না হলে একটা অরাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ছাত্ররাজনীতও তো এর বাইরে নয়।
কালের কণ্ঠ : সম্প্রতি টিআইবির দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি রিপোর্ট ঝড় তুলেছে। এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : এটা নিয়ে তো অনেক ঝড় বয়ে গেল। এটা নিয়ে অনেক টক শো দেখেছি। অনেক কথা শুনেছি। ওই রিপোর্ট কতটা বাস্তবসম্মত, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। তারা যেটা করেছে সেটা হচ্ছে করাপশন পাসসেপশন ইনডেঙ্। ডিটেইল কাজ করা হয়নি। কাজেই এর বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। প্রক্রিয়া সঠিক বলে মনে হয় না।
কালের কণ্ঠ : পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ফিরে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাই।
জিয়াউদ্দিন বাবলু : পদ্মা সেতু মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকার। এটা মানুষ চায়নি। মহাজোট অঙ্গীকার করায় মানুষের ভেতর একটা প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। এটা না হওয়া দুঃখজনক। যখন বিশ্বব্যাংক বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তোলে, তখনই সরকার ব্যবস্থা নিতে পারত। সংক্ষেপে বলা যায়, পানি এত ঘোলা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এতে সরকারের ভোটব্যাংকে টান পড়বে।
কালের কণ্ঠ : রেন্টাল বিদ্যুৎ নিয়েও অনেক কথা চালু আছে বাজারে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : অনেকেই রেন্টাল বিদ্যুতের বিপক্ষে কথা বলেন। আমি মনে করি, সহজে সমাধানের পথ খুঁজতে সরকারের কাছে এর বিকল্প কিছু ছিল না। সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিদ্যুতের যে সমস্যা ছিল, তা থেকে মুক্তি পেতে এটাই ছিল সহজ পথ।
কালের কণ্ঠ : সব দিক বিবেচনায় সরকারকে সফল না ব্যর্থ বলবেন আপনি?
জিয়াউদ্দিন বাবলু : 'ভালো-মন্দ মিলায়ে সকলি।' কোনো সরকারই শতভাগ সফল হতে পারে না, কোনো সরকারই শতভাগ ব্যর্থ হয় না। ভালো-মন্দ মিলিয়েই একটি সরকার সামনের দিকে যায়। সেখানে সাফল্যের ভাগ বেশি হলে সেটা ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে যায়। আবার ব্যর্থতার ভাগ বেশি হলে তা সাফল্যকে ছাপিয়ে যায়। এ সরকারের অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু তার প্রকাশ নেই।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জিয়াউদ্দিন বাবলু : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments