অটিজম- অটিস্টিক শিশুদের জন্য সরকার কী করছে by সৈয়দা শাহনেওয়াজ লতিকা
অটিস্টিক শব্দটির সঙ্গে এখন কমবেশি সবাই পরিচিত। যে পরিবারগুলোতে অটিস্টিক সন্তান আছে, সেসব পরিবারের অভিভাবক, অর্থাৎ মা-বাবাদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমি রাষ্ট্রের ও সমাজের বিবেকবান মানুষকে কিছু বিষয়ের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আমি একজন অটিস্টিক সন্তানের মা। আমার সন্তানটি ছেলে। নাম অনিন্দ্য মোমেন অর্ক। বয়স ১৭ বছর। প্রিয়দর্শন। ও কথা বলতে পারে না। একজন মা হিসেবে আমি ১৭টি বছর একজন অটিস্টিক সন্তানের সঙ্গে থেকে তার আচার-আচরণ, বেড়ে ওঠা এবং বয়ঃসন্ধিকালে তার যে মানসিক টানাপোড়েন, এগুলো দেখেছি ও দেখছি। আমি কোনো বিশেষজ্ঞ নই। তবে সন্তান অটিস্টিক হওয়ার কারণে প্রযুক্তির সুবাদে ইন্টারনেট ঘেঁটে অটিজম সম্পর্কে নিজের অনেক জিজ্ঞাসা এবং অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমার নিজের মধ্যে কিছু হতাশাবোধও জন্ম নিয়েছে, নিজের সন্তানের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারার কারণে।
যাহোক, এবার আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব পরিস্থিতির দিকে একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশে আমাদের যাঁদের অটিস্টিক সন্তান আছে, সেই পরিবারগুলো ভীষণভাবে অসহায় ও একাকী। এ পরিবারগুলোর অটিস্টিক সন্তানসহ অন্য সদস্যরাও (মা, বাবা, ভাইবোন) যেকোনো ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান এবং আত্মীয়-পরিজনদের বাসায় বেড়ানো, এগুলো থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন। যাঁরা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাঁদের সব সময় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় কখন না জানি কী অভিযোগ আসে সন্তানটির অস্বাভাবিক আচরণের কারণে। রাস্তায় চলতে গেলে সব সময় তটস্থ থাকতে হয় কখন না জানি কী অস্বাভাবিক কাণ্ড বাধিয়ে বসে।
যে সময়টুকু সন্তানটি স্কুলে থাকে, সেই সময়টুকুতে কোনো কোনো মা হয়তো চাকরি বা অন্যান্য ব্যস্ততায় কাটান। উল্লেখ্য, মায়েরা যে কাজেই ব্যস্ত থাকুন না কেন, প্রতি মুহূর্তেই তাঁর নার্ভ কোনো না কোনোভাবে সজাগ থাকে সন্তানটির জন্য। অর্থাৎ মোটামুটি দিন-রাতের ২৪ ঘণ্টাই নার্ভের ওপর একটা চাপ থাকে। এই হচ্ছে পারিবারিক অবস্থা।
এবার আমি একটু আমাদের সমাজের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই। আমাদের সমাজ অটিস্টিক সন্তানদের জন্য কতটা সহায়ক? মা-বাবার অনুপস্থিতিতে এ সন্তানগুলো কাদের তত্ত্বাবধানে থাকবে? তাহলে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে ওরা কি রাস্তার সন্তান হয়ে যাবে? সমাজ ওদের পাগল হিসেবে বিবেচনা করবে? এ প্রশ্নগুলো আমি নিশ্চিত আমার মতো প্রতিটি অটিস্টিক সন্তানের মা-বাবারই। এ প্রশ্নটি আমার মনে আরও বদ্ধমূল হয়েছে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। নিচে সংক্ষেপে আমি ঘটনাটি উল্লেখ করছি।
আমরা ভাড়া বাসায় লালমাটিয়ায় থাকি। গত সেপ্টেম্বরে বাসা বদলে গিয়েছিলাম লালমাটিয়ারই আরেকটি বাসায়। নতুন বাসায় আমাদের অটিস্টিক সন্তানটির খাপ খাইয়ে নিতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। প্রথম থেকেই টুকটাক কিছু অভিযোগও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আসছিল। এ অবস্থায় আমাদের সবার (অর্থাৎ মা, বাবা ও একমাত্র বড় ভাইয়ের) মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় যাতে অটিস্টিক সন্তানটির আচরণের কারণে কোনো অভিযোগ না আসে, সেদিকে কড়া নজর রাখা। মোটামুটি এভাবে কড়া নজরদারিতেই চলছিল দিনগুলো। এর মধ্যে একদিন হরতাল হলো। স্বাভাবিকভাবেই ওর স্কুল এবং আমার বড় ছেলের ভার্সিটি বন্ধ ছিল। বড় ছেলের তত্ত্বাবধানে ওকে রেখে আমি আর আমার স্বামী অফিসে গিয়েছিলাম। দুপুরে বড় ছেলে ফোনে জানায়, ওর ছোট ভাইটি বারান্দা দিয়ে একটা আফটার শেভ লোশনের বোতল ফেলে দিয়েছে, যেটা রাস্তার ওপর পার্ক করা একটা গাড়ির ওপর পড়েছে এবং গাড়িটির পেছনের কাচ ভেঙে গিয়েছে। চালক ওপরে এসে বড় ছেলেকে জানিয়ে গেছেন।
খবরটি পাওয়ার পর আমি ভয়ে দ্রুত বাসার দিকে রওনা দিই এবং ওর বাবাকেও ফোনে জানিয়ে দিই তাড়াতাড়ি বাসায় আসার জন্য। বাসার নিচে গাড়িটি দেখলাম, চালক এগিয়ে এলে তাঁকে আশ্বস্ত করলাম কাচ লাগিয়ে দেওয়া হবে। আমার স্বামীও একইভাবে চালককে আশ্বস্ত করে বাসায় ফিরল। জানা গেল, গাড়িটি একই বিল্ডিংয়ের ঠিক পাশের অ্যাপার্টমেন্টে যিনি থাকেন, তাঁর। মোটামুটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবং খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, ছয় থেকে আট হাজার টাকার মধ্যে বাজারের ভালো মানের কাচই লাগিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু বিপত্তি ঘটল যখন সন্ধ্যায় গাড়ির মালিক চালককে দিয়ে খবর পাঠালেন নাভানা থেকে কাচ লাগিয়ে দিতে হবে। আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত চাকরিজীবী। খুবই সাধারণ মানের একটা গাড়ি আছে। ধারণা করতে পারছিলাম না, নাভানাতে যেতে চাচ্ছে কেন? যাহোক, পরদিন সকালে ভদ্রলোক আমার স্বামীকে অনেকটা জোর করেই সঙ্গে করে নাভানাতে নিয়ে গেলেন। তারপর বোঝা গেল উনি অরিজিনাল নতুন কাচ চাচ্ছেন; যার দাম ৫২ থেকে ৫৫ হাজার টাকার মধ্যে। হয়তো সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিলেন, নাভানা থেকে বলা হলো কাচের অর্ডার দিতে হবে এবং পেতে তিন মাস সময় লাগবে। ভদ্রলোক হয়তো তখন আর ঝুঁকি নিলেন না। বাজার থেকে একটি কাচ নিজে কিনে ১৮ হাজার টাকার ওপরে দাবি করলেন, যা শেষ পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকায় ফয়সালা করতে হয়।
এ ঘটনার পর আমরা বাসা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই এবং যে বিল্ডিংয়ে আগে ছিলাম, ওই বিল্ডিংয়ের আরেকটি অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসি। এ ঘটনাটি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। খুব অসহায় লাগে নিজেদের। বারবার শুধু মনে হতে থাকে, এ সন্তানদের জন্য সহায়ক কি কোনো আইন আমাদের দেশে নেই? কী হবে এ সন্তানটির, যখন আমরা থাকব না? আজ আমি এ প্রশ্নটি রাষ্ট্রের কাছে এবং সমাজের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাছে রাখতে চাই।
আর রাষ্ট্রের কাছে আমার জোর দাবি, অটিস্টিক সন্তানদের রাষ্ট্রের সন্তান হিসেবে ঘোষণা করা হোক এবং তাদের সহায়ক পর্যাপ্ত আইনের ব্যবস্থা করা হোক। সর্বোপরি অটিস্টিক সন্তানদের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে উন্নত বিশ্বের আদলে হোমের ব্যবস্থা করা হোক, যাতে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে এ সন্তানদের কোনো অসুবিধা না হয়।
সৈয়দা শাহনেওয়াজ লতিকা: ম্যানেজার রিসার্চ, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ।
syeda.lotika@yahoo.com
যাহোক, এবার আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব পরিস্থিতির দিকে একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশে আমাদের যাঁদের অটিস্টিক সন্তান আছে, সেই পরিবারগুলো ভীষণভাবে অসহায় ও একাকী। এ পরিবারগুলোর অটিস্টিক সন্তানসহ অন্য সদস্যরাও (মা, বাবা, ভাইবোন) যেকোনো ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান এবং আত্মীয়-পরিজনদের বাসায় বেড়ানো, এগুলো থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন। যাঁরা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাঁদের সব সময় ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় কখন না জানি কী অভিযোগ আসে সন্তানটির অস্বাভাবিক আচরণের কারণে। রাস্তায় চলতে গেলে সব সময় তটস্থ থাকতে হয় কখন না জানি কী অস্বাভাবিক কাণ্ড বাধিয়ে বসে।
যে সময়টুকু সন্তানটি স্কুলে থাকে, সেই সময়টুকুতে কোনো কোনো মা হয়তো চাকরি বা অন্যান্য ব্যস্ততায় কাটান। উল্লেখ্য, মায়েরা যে কাজেই ব্যস্ত থাকুন না কেন, প্রতি মুহূর্তেই তাঁর নার্ভ কোনো না কোনোভাবে সজাগ থাকে সন্তানটির জন্য। অর্থাৎ মোটামুটি দিন-রাতের ২৪ ঘণ্টাই নার্ভের ওপর একটা চাপ থাকে। এই হচ্ছে পারিবারিক অবস্থা।
এবার আমি একটু আমাদের সমাজের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই। আমাদের সমাজ অটিস্টিক সন্তানদের জন্য কতটা সহায়ক? মা-বাবার অনুপস্থিতিতে এ সন্তানগুলো কাদের তত্ত্বাবধানে থাকবে? তাহলে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে ওরা কি রাস্তার সন্তান হয়ে যাবে? সমাজ ওদের পাগল হিসেবে বিবেচনা করবে? এ প্রশ্নগুলো আমি নিশ্চিত আমার মতো প্রতিটি অটিস্টিক সন্তানের মা-বাবারই। এ প্রশ্নটি আমার মনে আরও বদ্ধমূল হয়েছে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। নিচে সংক্ষেপে আমি ঘটনাটি উল্লেখ করছি।
আমরা ভাড়া বাসায় লালমাটিয়ায় থাকি। গত সেপ্টেম্বরে বাসা বদলে গিয়েছিলাম লালমাটিয়ারই আরেকটি বাসায়। নতুন বাসায় আমাদের অটিস্টিক সন্তানটির খাপ খাইয়ে নিতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। প্রথম থেকেই টুকটাক কিছু অভিযোগও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আসছিল। এ অবস্থায় আমাদের সবার (অর্থাৎ মা, বাবা ও একমাত্র বড় ভাইয়ের) মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় যাতে অটিস্টিক সন্তানটির আচরণের কারণে কোনো অভিযোগ না আসে, সেদিকে কড়া নজর রাখা। মোটামুটি এভাবে কড়া নজরদারিতেই চলছিল দিনগুলো। এর মধ্যে একদিন হরতাল হলো। স্বাভাবিকভাবেই ওর স্কুল এবং আমার বড় ছেলের ভার্সিটি বন্ধ ছিল। বড় ছেলের তত্ত্বাবধানে ওকে রেখে আমি আর আমার স্বামী অফিসে গিয়েছিলাম। দুপুরে বড় ছেলে ফোনে জানায়, ওর ছোট ভাইটি বারান্দা দিয়ে একটা আফটার শেভ লোশনের বোতল ফেলে দিয়েছে, যেটা রাস্তার ওপর পার্ক করা একটা গাড়ির ওপর পড়েছে এবং গাড়িটির পেছনের কাচ ভেঙে গিয়েছে। চালক ওপরে এসে বড় ছেলেকে জানিয়ে গেছেন।
খবরটি পাওয়ার পর আমি ভয়ে দ্রুত বাসার দিকে রওনা দিই এবং ওর বাবাকেও ফোনে জানিয়ে দিই তাড়াতাড়ি বাসায় আসার জন্য। বাসার নিচে গাড়িটি দেখলাম, চালক এগিয়ে এলে তাঁকে আশ্বস্ত করলাম কাচ লাগিয়ে দেওয়া হবে। আমার স্বামীও একইভাবে চালককে আশ্বস্ত করে বাসায় ফিরল। জানা গেল, গাড়িটি একই বিল্ডিংয়ের ঠিক পাশের অ্যাপার্টমেন্টে যিনি থাকেন, তাঁর। মোটামুটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবং খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, ছয় থেকে আট হাজার টাকার মধ্যে বাজারের ভালো মানের কাচই লাগিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু বিপত্তি ঘটল যখন সন্ধ্যায় গাড়ির মালিক চালককে দিয়ে খবর পাঠালেন নাভানা থেকে কাচ লাগিয়ে দিতে হবে। আমরা নিম্নমধ্যবিত্ত চাকরিজীবী। খুবই সাধারণ মানের একটা গাড়ি আছে। ধারণা করতে পারছিলাম না, নাভানাতে যেতে চাচ্ছে কেন? যাহোক, পরদিন সকালে ভদ্রলোক আমার স্বামীকে অনেকটা জোর করেই সঙ্গে করে নাভানাতে নিয়ে গেলেন। তারপর বোঝা গেল উনি অরিজিনাল নতুন কাচ চাচ্ছেন; যার দাম ৫২ থেকে ৫৫ হাজার টাকার মধ্যে। হয়তো সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিলেন, নাভানা থেকে বলা হলো কাচের অর্ডার দিতে হবে এবং পেতে তিন মাস সময় লাগবে। ভদ্রলোক হয়তো তখন আর ঝুঁকি নিলেন না। বাজার থেকে একটি কাচ নিজে কিনে ১৮ হাজার টাকার ওপরে দাবি করলেন, যা শেষ পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকায় ফয়সালা করতে হয়।
এ ঘটনার পর আমরা বাসা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই এবং যে বিল্ডিংয়ে আগে ছিলাম, ওই বিল্ডিংয়ের আরেকটি অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসি। এ ঘটনাটি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। খুব অসহায় লাগে নিজেদের। বারবার শুধু মনে হতে থাকে, এ সন্তানদের জন্য সহায়ক কি কোনো আইন আমাদের দেশে নেই? কী হবে এ সন্তানটির, যখন আমরা থাকব না? আজ আমি এ প্রশ্নটি রাষ্ট্রের কাছে এবং সমাজের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাছে রাখতে চাই।
আর রাষ্ট্রের কাছে আমার জোর দাবি, অটিস্টিক সন্তানদের রাষ্ট্রের সন্তান হিসেবে ঘোষণা করা হোক এবং তাদের সহায়ক পর্যাপ্ত আইনের ব্যবস্থা করা হোক। সর্বোপরি অটিস্টিক সন্তানদের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে উন্নত বিশ্বের আদলে হোমের ব্যবস্থা করা হোক, যাতে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে এ সন্তানদের কোনো অসুবিধা না হয়।
সৈয়দা শাহনেওয়াজ লতিকা: ম্যানেজার রিসার্চ, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ।
syeda.lotika@yahoo.com
No comments