মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই-দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-চায়ের কেটলিতে আটকে গেছে পবনের জীবন by জাহাঙ্গীর হোসেন
"আমি যখন যুদ্ধে যাই, তখন আমার বয়স ছিল ১৮ বছর। মাত্র এক মাস আগে আমি বিয়ে করি। স্ত্রী ও মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা সময় লেগেছিল। মাকে বলেছিলাম, তোমার তো তিনটা ছেলে; তার মধ্যে একটিকে অন্তত দেশের জন্য উৎসর্গ করো।
মা বলেছিল, 'তা কী করে হয়। নারীকাটা ধনকে কি কেউ মৃত্যুর মুখে যেতে বলে! আমি তোকে যেতে দেব না। তুই যদি আর ফিরে না আসিস।' মাকে বললাম, দেখো মা, তোমার পবন দেশের পতাকা হাতে বাড়ি ফিরবে। আর স্ত্রীকে বলেছিলাম, বেঁচে থাকলে দেখা হবে, সংসার হবে, সন্তান হবে। বেঁচে না থাকলে আমার জন্য দুঃখ করো না।" এক দমে কথাগুলো বললেন ৭০ বছর পেরোনো মুক্তিযোদ্ধা পবন মণ্ডল।
রাজবাড়ী জেলা সদরের মিজানপুর ইউনিয়নের চরনারায়ণপুর গ্রামে পবন মণ্ডলের বাড়ি। দীর্ঘ ৪০ বছর কাটিয়েছেন দিনমজুরি করে আর রিকশা চালিয়ে। এক বছর ধরে তিনি রাজবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের পাশে খুপরিঘর তুলে চা বিক্রি করছেন।
মুক্তিযোদ্ধা পবন মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলার সময়ও একটার পর একটা চা বানাচ্ছিলেন আর ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। অনেক তরুণ ক্রেতা তখনো জানত না, যাঁর বানানো চা তারা পান করছে, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যখন জানতে পারল, তখন থেকে খুব সম্মানের সঙ্গেই কথা বলল তাঁর সঙ্গে। একজন তো বলেই ফেলল, 'এ কেমন দেশে আমরা বাস করি? একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সংসার চালাতে গিয়ে এই বৃদ্ধ বয়সেও চা বিক্রি করতে হচ্ছে!'
চা বিক্রির ফাঁকে মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলতেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পবন মণ্ডলের চোখ-মুখ। তিনি বলেন, 'যুদ্ধ শুরু হওয়ার দেড় মাস পর মায়ের কাছ থেকে হাত-পা ধরে অনুমতি নিয়ে ভারতের বেতাই ক্যাম্পে যাই। সেখান থেকে দুদিন পর কোড়ইখালী ক্যাম্পে ১৮ দিন প্রশিক্ষণ নিই। এরপর উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে বিহারের চাকুলিয়ায় রাজপুত রেজিমেন্টে পাঠানো হয়। সেখানে ৩০ দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর রাজবাড়ী জেলা সদরের সোনাকান্দর গ্রামের জলিল কমান্ডারের হাতে আমাকে তুলে দেওয়া হয়। জলিল কমান্ডারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে আমরা ১২ জন দেশের পথে রওনা হই। বয়ড়া বর্ডার দিয়ে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করি। সে সময় আমাদের দলসহ বেশ কয়েকটি দল দেশে প্রবেশের জন্য বয়ড়া বর্ডারে অবস্থান করছিল। তবে সব গ্রুপই পাকিস্তানি সেনাদের তোপের মুখে পড়ে। টানা পাঁচ দিন সব গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে আমিও যুদ্ধ করি পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের সময় অসংখ্য গুলি আমার গা ঘেঁষে চলে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বুলেট যদি সে সময় আমার শরীরে লাগত, তবে দেশের মাটিতে এসে আর যুদ্ধ করা হতো না।'
পবন জানান, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বিজয়ের দুই মাস আগে তাঁদের দল রাজবাড়ী জেলা সদরের কোলারহাট এলাকায় পৌঁছে। সে সময় রাজবাড়ীতে অবাঙালি বিহারিদের আধিপত্য চলছিল। তারা রাজবাড়ীর নিরীহ বাঙালিদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছিল। পবন বলেন, 'আমরা কৌশলে জেলা শহরের দিকে এগোচ্ছিলাম। একই সঙ্গে রাতের আঁধারে জেলা শহরে এসে বিহারিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফিরে যেতাম।'
পবন আরো বলেন, "রাজবাড়ী মুক্ত হওয়ার দুদিন পর বাড়ি ফিরে যাই। আমার মা আমাকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। প্রতিবেশীদের ডেকে তখন মা বলছিল, 'তোমরা দেখো, আমার পবন ফিরে এসেছে, দেশ স্বাধীন করে ফিরে এসেছে।' তবে কয়েক দিন না যেতেই বিজয়ের আনন্দ ম্লান হতে শুরু করে। পেটের তাগিদে দিনমজুরি ও রিকশা চালাতে শুরু করি।"
পবন মণ্ডলের তিন ছেলে। দুই ছেলে আলাদা হয়ে গেছেন। মেজো ছেলে থাকেন বাবার সঙ্গে। পবন বলেন, 'ছেলেরাও সবাই খুব দরিদ্র। তবে এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি- এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।' তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও চা দোকানের আয় দিয়ে চলছে তাঁর সংসার। তিনি বলেন, 'দেশ আমাকে কী দেবে, আমিই তো দেশকে দিয়েছি। সেই দেশের কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই।'
রাজবাড়ী জেলা সদরের মিজানপুর ইউনিয়নের চরনারায়ণপুর গ্রামে পবন মণ্ডলের বাড়ি। দীর্ঘ ৪০ বছর কাটিয়েছেন দিনমজুরি করে আর রিকশা চালিয়ে। এক বছর ধরে তিনি রাজবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের পাশে খুপরিঘর তুলে চা বিক্রি করছেন।
মুক্তিযোদ্ধা পবন মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলার সময়ও একটার পর একটা চা বানাচ্ছিলেন আর ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। অনেক তরুণ ক্রেতা তখনো জানত না, যাঁর বানানো চা তারা পান করছে, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যখন জানতে পারল, তখন থেকে খুব সম্মানের সঙ্গেই কথা বলল তাঁর সঙ্গে। একজন তো বলেই ফেলল, 'এ কেমন দেশে আমরা বাস করি? একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সংসার চালাতে গিয়ে এই বৃদ্ধ বয়সেও চা বিক্রি করতে হচ্ছে!'
চা বিক্রির ফাঁকে মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলতেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পবন মণ্ডলের চোখ-মুখ। তিনি বলেন, 'যুদ্ধ শুরু হওয়ার দেড় মাস পর মায়ের কাছ থেকে হাত-পা ধরে অনুমতি নিয়ে ভারতের বেতাই ক্যাম্পে যাই। সেখান থেকে দুদিন পর কোড়ইখালী ক্যাম্পে ১৮ দিন প্রশিক্ষণ নিই। এরপর উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে বিহারের চাকুলিয়ায় রাজপুত রেজিমেন্টে পাঠানো হয়। সেখানে ৩০ দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর রাজবাড়ী জেলা সদরের সোনাকান্দর গ্রামের জলিল কমান্ডারের হাতে আমাকে তুলে দেওয়া হয়। জলিল কমান্ডারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে আমরা ১২ জন দেশের পথে রওনা হই। বয়ড়া বর্ডার দিয়ে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করি। সে সময় আমাদের দলসহ বেশ কয়েকটি দল দেশে প্রবেশের জন্য বয়ড়া বর্ডারে অবস্থান করছিল। তবে সব গ্রুপই পাকিস্তানি সেনাদের তোপের মুখে পড়ে। টানা পাঁচ দিন সব গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে আমিও যুদ্ধ করি পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের সময় অসংখ্য গুলি আমার গা ঘেঁষে চলে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বুলেট যদি সে সময় আমার শরীরে লাগত, তবে দেশের মাটিতে এসে আর যুদ্ধ করা হতো না।'
পবন জানান, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বিজয়ের দুই মাস আগে তাঁদের দল রাজবাড়ী জেলা সদরের কোলারহাট এলাকায় পৌঁছে। সে সময় রাজবাড়ীতে অবাঙালি বিহারিদের আধিপত্য চলছিল। তারা রাজবাড়ীর নিরীহ বাঙালিদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছিল। পবন বলেন, 'আমরা কৌশলে জেলা শহরের দিকে এগোচ্ছিলাম। একই সঙ্গে রাতের আঁধারে জেলা শহরে এসে বিহারিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ফিরে যেতাম।'
পবন আরো বলেন, "রাজবাড়ী মুক্ত হওয়ার দুদিন পর বাড়ি ফিরে যাই। আমার মা আমাকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। প্রতিবেশীদের ডেকে তখন মা বলছিল, 'তোমরা দেখো, আমার পবন ফিরে এসেছে, দেশ স্বাধীন করে ফিরে এসেছে।' তবে কয়েক দিন না যেতেই বিজয়ের আনন্দ ম্লান হতে শুরু করে। পেটের তাগিদে দিনমজুরি ও রিকশা চালাতে শুরু করি।"
পবন মণ্ডলের তিন ছেলে। দুই ছেলে আলাদা হয়ে গেছেন। মেজো ছেলে থাকেন বাবার সঙ্গে। পবন বলেন, 'ছেলেরাও সবাই খুব দরিদ্র। তবে এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি- এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।' তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও চা দোকানের আয় দিয়ে চলছে তাঁর সংসার। তিনি বলেন, 'দেশ আমাকে কী দেবে, আমিই তো দেশকে দিয়েছি। সেই দেশের কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই।'
No comments